‘লোডশেডিং’
পর্ব ২.
তাবিনা মাহনূর
__________
বিকেলে পড়তে এলো সাদিয়া। সাদিক আসেনি। এর অর্থ, জেবিন এ সম্পর্কে কিছু জানেন না। সাদিয়াকে চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো চৈতি, ‘সাদিক কোথায়? ও পড়বে না?’
সাদিয়া বই খাতা রেখে নির্বিকার চিত্তে উত্তর জানালো, ‘ওকেও বলেছিলাম। বললো ওর হোমওয়ার্ক বুঝে বুঝে করে ফেলেছে।’
– একবার আমাকে দেখিয়ে নিতো। সবটা ঠিক আছে কিনা বুঝিয়ে দিতাম।
– ও তো এমনই।
– মামণি জানেন না তুই যে আমার কাছে পড়তে এসেছিস?
সাদিয়া দুই পাশে মাথা নেড়ে জানালো, জেবিন জানেন না। চৈতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সাদিয়ার হাত ধরে বললো, ‘তুই আগে মামণির অনুমতি নিয়ে আয়। তারপর পড়তে বসবো।’
সাদিয়া এ ব্যাপারে বড়ই অলস। মায়ের সাথে কথা বলতে তার জড়তা তৈরি হয়। মনে শান্তি খুঁজে পায় না। তাই বোনের কাছে বেশিক্ষণ থাকতে তার ভালো লাগে। মায়ের কোলে থেকে মাতৃত্বের যেই ঘ্রাণ রয়েছে তা সে খুঁজে পায় না। অথচ বোনটা হাত ধরে পাশে বসিয়ে রাখলে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠে। হয়তো সে বুঝতে পারে ভালো মনের মানুষের শরীরের ঘ্রাণ কতখানি মধুর।
এবারও সে তার আলসে ভাব প্রকাশ করে বললো, ‘ধুর আপি, বাদ দাও তো।’
চৈতি মানতে নারাজ। বাসায় অশান্তি তার ভালো লাগে না। সে সাদিয়ার হাত ধরে টেনে বাবার কাছে গেল। জেবিন এখন তিনতলার ঘরে আছেন। সেখানে বড় চাচী দিলারার সাথে বিকেলের আড্ডা জমিয়েছেন তিনি। বাবাকে একা পেয়ে নিজ সত্ত্বা ফিরে পেলো চৈতি।
– বাবা, সাদিয়াকে পড়তে পাঠিয়েছো কিন্তু মামণি জানেন না। এটা কেমন কথা?
সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘শবনম’ উপন্যাসের বইটা হাত থেকে নামিয়ে চোখ তুলে তাকালেন সারাফ সাহেব। সচরাচর মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না তিনি। কুহুর চোখ যেন বসিয়ে দেয়া হয়েছে চৈতির মুখে। চৈতির শিশুসুলভ রাগী কণ্ঠ শুনে এবং গাল ফুলে ওঠা দেখে হেসে উঠলেন তিনি, ‘কেমন কথা মা?’
চৈতি ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘আমিই তো প্রশ্ন করছি।’
সারাফ সাদিয়ার দিকে তাকালেন, ‘সাদিয়া মা, তুমি ঘরে যাও তো।’
চৈতি তার বাবার মাথা ম্যাসাজ করে দিচ্ছে আর গল্প করছে। সারাফ সাহেব পুরোনো দিনে হারিয়ে গেলেন। মেয়ের কলেজের গল্প শুনতে শুনতে নিজের কলেজের গল্পও বললেন। তখনও কুহু নামের অধ্যায় শুরু হয়নি। তিনি তখন বেশ ভালো ছাত্র ছিলেন। কুহুর সাথে পরিচয়ের পর সিনেমার নায়কের মতো দিওয়ানা হয়ে পড়ালেখাও নিলামে উঠেছিল। এসব স্মৃতিচারণের মাঝে হারিয়ে গেল চৈতি। কল্পনায় সে স্বাধীনকে নিয়ে ভাবলো, এমন দিন কি তার আসবে না?
– চৈতালি, তোর চোখটা কেমন দেখতে, তুই জানিস?
– মায়ের মতো, তাই না?
দরজায় টোকা দিয়ে কেউ তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। চৈতি এক পলক দেখে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সারাফ উঠে বসে বললেন, ‘সৌরভ বাবা, ভেতরে এসো।’
সারাফের সামনে সৌরভ ভদ্র ছেলে। চৈতির যত্ন যেন তার জীবনের অংশ, এমন একটা ভাব নিয়ে নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশ করে সে। ধমক দিয়ে নিচু মানসিকতার পরিচয় দেয়ার সাহস সারাফের সামনে নেই।
সারাফের সামনে বসে সৌরভ কেমন তেলতেলে হাসি হেসে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম ছোট কাকা। আপনারা বাবা মেয়ে সময় কাটাচ্ছেন দেখে আসছিলাম না।’
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তোমাকে ইদানিং খুব ব্যস্ত দেখি। কি হয়েছে? অনার্স এখনো শেষ হয়নি তো তোমার।
– জি, এবার শেষ বর্ষে। ওই আরকি, প্রেজেন্টেশন নিয়ে অল্প ব্যস্ত আছি।
– আর তোমার বাবা কেমন আছে? চার তলায় আসতে বুঝি কষ্ট হয় তোমাদের? আমাকে একটু দেখে যেতে পারো না তোমরা? আমিই যাই শুধু।
নানান আলোচনা চললো তাদের মাঝে। এই আলাপে চৈতির অংশগ্রহণ করা সাজে না। উঠে যেতেও পারছে না সে। এক পর্যায়ে তার অংশীদারিত্ব চলে এলো সারাফের কথায়।
– আমার মেয়েটা উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে। এই বছর পার হলেই ইন্টার পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। তুমি ওকে মাঝে মাঝে পড়াতে এসো বাবা। ওকে নিয়ে আমার স্বপ্ন অনেক বড়।
আকাশের চাঁদ হাতে পেলেও মানুষ এতোটা খুশি হতো কিনা জানা নেই যতটা সৌরভ হয়েছে আজ। কণ্ঠে খুশি ধরে রেখে উৎসাহ প্রকাশ করলো সে। এদিকে চৈতির মাথায় বাজ পড়েছে। এরকম একটা মানুষ নামের কলঙ্কের কাছে জ্ঞান অর্জন করার স্বাদ তার বিন্দুমাত্র নেই। তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো সে, ‘আমি তো একাই পড়তে পারি বাবা। তার চেয়ে সাদিককে পড়ালে ভালো হয়। সাদিয়া আমার কাছে পড়লেও, সাদিক পড়ে না।’
সৌরভ ভেতরে রেগে গেলেও বাইরে তা প্রকাশ করলো না। মুচকি হেসে বললো, ‘আমার কাছে পড়তে আপত্তি থাকলে বলে দে। এতো বিব্রত হওয়ার প্রয়োজন নেই।’
এই একটি কথার পেছনে বড় অর্থ জুড়ে আছে যেটা উহ্য রেখেছে সৌরভ। কথাটি হবে, ‘আমার কাছে পড়তে আপত্তি থাকলে বলে দেখ, তোর পড়াশোনা বন্ধ করার ব্যবস্থা করে ফেলবো।’ সেটা চৈতি বুঝতে পারলেও সারাফ বুঝলেন না। তবে তিনি মেয়ের মতামতকে গ্রহণ করলেন।
– চৈতালি, তোর যদি একা পড়তে অসুবিধা না হয় তবে আমি জোর করবো না। কিন্তু তুই টাকার কথা চিন্তা করিস না।
সৌরভ চমকে উঠলো, ‘টাকা মানে?’
– তোমাকে বাকিতে রাখবো নাকি? তুমি সময় বের করে পড়াবে, অথচ আমি টাকা দিব না সেটা কীভাবে হয়?
সৌরভ খুব লজ্জা পেলো। তার প্রেয়সীকে পড়ানোর জন্য সে টাকা কীভাবে নিবে? মুখটা নত করে সে বলে উঠলো, ‘এই কথাটা বলে আপনি আমাকে কষ্ট দিলেন ছোট কাকা। আমি কেন টাকা নিব চৈতিকে পড়াতে? ও কি আমার আপন কেউ নয়? চৈতি কি সাদিয়াকে পড়াতে টাকা নেয়? তাহলে আমি কেন নিব?’
হেসে উঠলেন সারাফ। সৌরভের অভিমানী কণ্ঠে বলা কথা শুনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো চৈতি। একটা মানুষ কীভাবে দুই রূপ ধারণ করতে পারে তা সৌরভকে না দেখলে অজানা রয়ে যেত।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জেবিন বললেন, ‘বাইরে থেকেই শুনছি সৌরভ নাকি কুহুর মেয়েকে পড়াবে? ভালোই তো হলো। মেয়েটার টিউটর নেই। আপন মানুষের কাছে পড়াও ভালো হবে।’
সারাফের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। জেবিন পারতপক্ষে চৈতি বলে ডাকেন না। সবসময় কুহুর মেয়ে, নাহলে আপনার মেয়ে।
কাকীর আওয়াজ শুনে সৌরভ প্রশ্ন তুললো, ‘ছোট কাকী, তুমিই বলো, আমি কেন চৈতিকে পড়ানোর জন্য টাকা নিব?’
– ওমা! টাকা নিবি না কেন?
– তুমিও এমনটা বলছো? তুমি জানো না চৈতি আমার জন্য কি?
– তা জানি। তাই বলে টাকা হাতছাড়া করবি কেন? আজকাল টাকাই সব।
– আহা ছোট কাকী, টাকার বিষয়টা আমি ছেড়ে দিই না কখনো। কিন্তু এটা এমন একটা বিষয় যেখানে টাকার কথা চিন্তাই করা যায় না।
চৈতি বুঝতে পারলো, টাকা দেয়া হোক বা না হোক, তাকে এই ক্রোধান্বিত হায়নার কাছে পড়তেই হবে। জেবিনের আগমন বিষয়টাকে আরো সহজ করে দিয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠে মলিন মুখে বাবার দিকে তাকালো সে। এই আলাপে বাবা নেই। তিনি উপন্যাসের বইটা হাতে নিয়ে বসে আছেন। পড়তে পারছেন না কিন্তু ব্যস্ত হওয়ার অভিনয় করছেন। বাবাকে ধীর স্বরে ডেকে বললো, ‘আমি আসছি বাবা।’
যাওয়ার আগে একবার জেবিনকে বলে গেল সে, ‘মামণি, সাদিয়া আর সাদিক কি আমার কাছে পড়বে? আজ সাদিয়াকে পাঠাতে চেয়েছিলেন বাবা।’
সাদিয়া তার কাছে বিনা অনুমতিতে গিয়েছিল, এটা সে গোপন রাখলো। জেবিন কখনোই সরাসরি তাকান না চৈতির দিকে। এবারও এমন ভাবে কথা বললেন যেন চৈতির উপস্থিতি বেশ অসহনীয়।
– ওদেরকে পড়ানোর কোনো দরকার নেই। ওরা শিমুলের কাছে পড়তে যাবে।
চলে এলো চৈতি। ছাদে কাপড় আছে, সেগুলো নিয়ে আসতে হবে। আরো একটি কারণ, মনের মণিকোঠায় থাকা মানুষটিকে এক ঝলক দেখা।
আস্তে আস্তে কাপড় তুলছে চৈতি, সময়কে থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা। সামনের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি আনমনে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। পকেট থেকে হারমোনিকা বের করে বাজানো শুরু করলো। চৈতির ইচ্ছে করছে এক লাফে ছাদ পেরিয়ে মানুষটির কাছে গিয়ে সুরের ছন্দে হারিয়ে যেতে। দুঃখের বিষয়, মুক্ত পাখিটা উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। সুন্দর চেহারা দেখার উপায় নেই।
চৈতির মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে গেল। ছাদের দরজার কাছে গিয়ে সজোরে লাগিয়ে দিল দরজাটি। অমনি চমকে তাকালো স্বাধীন। কিন্তু তা ক্ষনিকের জন্য। স্বল্প সময়ে চৈতি দেখা পেলো বিস্ময় ভরা চাহনি যেখানে কৌতুহল ও আকর্ষণ ছড়িয়ে আছে। হয়তো বুকে ধক করে উঠেছিল এমন মোহনীয় মুহূর্তে বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে। এবার নিজের প্রতি রাগ উঠে গেল চৈতির। অযথা ভয় দেখানো একদম ঠিক হয়নি।
বাজনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, চৈতির মন খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে দোষারোপ করতে করতে সব কাপড় উঠিয়ে কাঁধে নেয়ার পর মনে হলো, একবার নিজের অনুশোচনা প্রকাশ করবে কি? দরজায় দুম দুম শব্দে কেঁপে উঠলো সে। নিশ্চয়ই সৌরভ।
দরজা খুলে ছাদে এলো সৌরভ। নীচে চৈতিকে না পেয়ে ছাদে চলে এসেছে। এসেই হাসতে হাসতে চৈতির বাম কাঁধে নিজের হাত রেখে বললো, ‘আমার সুচিত্রা, পড়তে চাও না কেন উত্তম কুমারের কাছে?’
নিজেকে উত্তম কুমারের মতো সুদর্শন ভাবে সৌরভ। সে নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী এবং চেহারার প্রেমে পড়ে অনেক মেয়ে রোজই তার মোবাইলে প্রেম বার্তার স্তুপ জমা করে। সেখানে সৌরভ মজে আছে চৈতির আদুরে চেহারার মাঝে। এখন তার মন খুব ভালো। শান্তি লাগছে এই ভেবে, তার প্রেয়সীকে সে প্রতিদিন বিনা সংকোচে একান্তে পাবে।
চৈতির অস্বস্তি হচ্ছে স্বাধীনের সামনে এভাবে জড়িয়ে ধরায়। না পারছে সরে যেতে, না পারছে কিছু বলতে। মুখটা একটু উঁচু করে সাহস সঞ্চার করে বললো, ‘কি করছেন ভাইয়া? কেউ দেখলে পঁচা বলবে।’
– তুই আমার বউ হবি, কার বাপের সাহস আছে যে কিছু বলবে? আর এখানে কেউ নেই। স্বাধীনকে দেখে লজ্জা পাচ্ছিস? ও আমাদের সবকিছু জানে।
এটা চৈতিও জানে। আর একারণেই মাঝে মাঝে তার খুব কষ্ট হয়, যখন সে অধিকার নিয়ে স্বাধীনের কাছে যেতে চাইবে তখন কি তার মনপুরুষ তাকে ফিরিয়ে দিবে বন্ধুর কথা ভেবে? এমনও হতে পারে, স্বাধীনের মনে তার প্রতি কোনো অনুভূতি জন্ম নেয়নি সৌরভের কারণে! এমনটা ভাবতেই ‘ধ্যাৎ!’ বলে কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে দিল চৈতি। সৌরভ সেটাকে লজ্জাবতী কন্যার লজ্জার বহিঃপ্রকাশ ভেবে হেসে উড়িয়ে দিলো। চৈতিকে ছেড়ে সে সামনের দিকে অগ্রসর হলো বন্ধুর সঙ্গ পেতে।
_____
রাতের অন্ধকার পুরো শহরকে নিস্তব্ধতায় ছেয়ে রাখে। মধ্য রাতে চৈতি বাড়ির দরজা খুলে সকলের অগোচরে ছাদে গেল। এই সময়ে মাঝে মাঝে হারমোনিকার মাতাল করা সুর ভেসে আসে যা চৈতির মনপুরুষ কোমল ঠোঁটের স্পর্শে বাজিয়ে তোলে। আজও সেই সুর শোনা যাচ্ছে। তাই সুরের মোহনায় মোহিত হয়ে চৈতি ছাদে চলে গেল।
ওপাশের ছাদে থাকা দোলনায় বসে কোনো এক গানের সুর তুলছে স্বাধীন। কি গান তা জানা নেই চৈতির। তবে এখন যেই ইচ্ছেটা জেগেছে তা সত্যিই ভয়ানক। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছে, মাত্র অল্প কিছু দূরত্বের বাঁধাটুকু ঘুচিয়ে দিলে কেমন হয়? বড় একটা লাফ দিয়ে ওপাশের ছাদে গিয়ে একবার সামনাসামনি দেখতে চায় সে স্বাধীনকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে হেঁটে চললো ছাদের কোণায়। রেলিংয়ে হাত রেখে তাকিয়ে থাকলো সে দোলনার দিকে। মনের এতগুলো ইচ্ছের কোনোটাই পূর্ণতা পাবে না। চোখের তৃষ্ণা কোনো রকম নিবারণ করা গেলেই হলো।
স্বাধীন উঠে দাঁড়িয়েছে। চোখ বুজে আপন মনে সুর তুলছে আর হেঁটে চলছে চিলেকোঠার ঘরের দিকে। হঠাৎ থেমে গিয়ে পেছনে তাকালো সে। চৈতি তখন মাদকতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এমনভাবে ধরা পড়ে যাবে কল্পনাও করেনি সে। এর আগেও তিন চারবার রাতের বেলা ছাদে এসে দেখেছে স্বাধীনকে। এবার পুরোপুরি ধরা পড়ে গেল। স্বাধীন ভ্রু কুঁচকে কিছুটা এগিয়ে এসেছে। চৈতির একবার মনে হলো, স্বাধীনকে ভুতের ভয় দেখিয়ে পালিয়ে যাবে। তার অবুঝ মনে এটাই চিন্তা যে, কোনো ক্রমে যেন সৌরভের কানে এই বিষয়টা না পৌঁছায়। স্বাধীন কিছুটা কাছাকাছি আসতেই বলে উঠলো, ‘তুমি এখানে কেন এতো রাতে?’
চৈতি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এতটুকু নড়চড় নেই। যেন কোনো মূর্তিকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ তার মনে চলছে উথাল পাথাল ঝড়। বারবার মনকে বলছে, ‘আর কখনো রাতে ছাদে আসবি না। জানি কথা শুনবি না কিন্তু এখন কোনোভাবেই বুঝতে দিবি না। একটু নড়েছিস তো কাল তোর জীবন নরকের শেষ স্তরে পৌঁছাবে।’
স্বাধীন আরেকটু কাছে এসে বললো, ‘কি ব্যাপার? নড়ছো না, চোখের পলক পড়ছে না, কি হয়েছে?’
চৈতির কোনো উত্তর নেই। স্বাধীন কিছুটা ভয় পেয়ে বললো, ‘চৈতি, এটা তুমিই তো?’
এবারও নিশ্চুপ চৈতি। স্বাধীন ঢোক গিলে বললো, ‘চৈতি? এইযে শুনছো?’
চৈতি ধপ করে মাথা ঝুলিয়ে দিলো নিচের দিকে। আঁতকে উঠলো স্বাধীন। তবু সেই জায়গা ছেড়ে নড়লো না। বলে উঠলো সে, ‘দেখো, তুমি চৈতি হলে চলে যাও। রাত বিরাতে এমন করে ঘুরে বেড়াতে হয় না। আর যদি চৈতি না হও…’
চৈতি মাথা ঝুলিয়ে রেখেছে তখনও। চুল গুলো সত্যিই শাকচুন্নির মতো লাগছে। কিন্তু স্বাধীনের কথায় বুকের হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিলো কিছুক্ষণের জন্য।
– আর যদি চৈতি না হও, তাহলে তো তোমার পিছে থাকা ভুতটাকে নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। ও নিজেও তোমার সঙ্গী।
‘আল্লাহ গো!’ বলে এক দৌড়ে চৈতি নেমে পড়লো ছাদ থেকে। স্বাধীন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে ছাদের মেঝের উপর। সে থাকে চিলেকোঠায় অথচ তাকে কিনা ভুতের ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ভাবতেই হাসি যেন থামার নাম নিচ্ছে না। তবে মেয়েটার অভিনয় দেখে সে খুব অবাক হয়েছে। এতো ভালো অভিনয় জানে এই মেয়ে!
ঘরের দরজার কাছে এসে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকলো চৈতি। বিছানায় বসে অনেকবার প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়ার পর তার মনে হলো, ছাদে স্বাধীনকে একা ফেলে এভাবে চলে আসাটা কাপুরুষের মতো দেখিয়েছে। যদি স্বাধীনের কোনো ক্ষতি হয়! উঠে দাঁড়ালো সে। কিন্তু উপরে যাওয়ার সাহস নেই তার। স্বাধীন তো অন্য ছাদে আছে। তাই ভয়টা আরো বেশি। হঠাৎ মনে হলো, স্বাধীনের শেষ কথার মাঝে ভয়ের ছাপ ছিল না একদমই। এমনকি খুব স্বাভাবিকভাবে বলেছিল সে তথাকথিত ভুতের কথা।
এখন পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল চৈতির কাছে। স্বাধীন যে এমন একটা দুষ্টুমি করবে তা চৈতির কল্পনার বাইরে ছিল। আগে যখন কথা কিংবা দেখা হতো, মাঝে মাঝেই তাকে রাগিয়ে দিত নানান ভাবে। মজা করে ডাকতো, রাগকন্যা। সৌরভ সকলকে তার সম্পর্কে হুমকি ধামকি দেওয়ার পর থেকে কোনো ছেলেই তার সান্নিধ্যে আসতে পারেনি। তেমনি, স্বাধীনও আর কখনো মজা করেনি, রাগকন্যা বলে ডাকেনি। আজ অনেকদিন পর এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়ে চৈতি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। স্বাধীন একটুও পরিবর্তন হয়নি।
কিন্তু চিন্তার বিষয়, কাল যদি স্বাধীন প্রানপ্রিয় বন্ধু সৌরভের কাছে সবকিছু বলে দেয় তাহলে হয়তো জীবনটা একেবারেই শেষ হয়ে যাবে। কালকের অপেক্ষায় রইলো চৈতি। সারারাত তার ঘুম হলো না। ফজরের সালাত পড়ে আরো এক ঘন্টা পর তার চোখে ঘুম নেমে এলো।
পরেরদিনের ঘটনাগুলো চৈতির জন্য অনেকটাই নতুন। সেই সাথে বেদনার এক স্পর্শ পেলো সে।
_____
চলবে ইন শা আল্লাহ…..