লোডশেডিং’ পর্ব ২১.

0
285

‘লোডশেডিং’
পর্ব ২১.

তাবিনা মাহনূর

_________________

রাতে ঘুমানোর আগে চৈতি শিমুলের অপেক্ষায় থাকলো নিজের অজান্তেই। কিন্তু শিমুল এলো না। চৈতির শিমুলকে ছাড়া ঘুমানোর ইচ্ছে নেই। তবু অভ্যাস করতে হবে যেহেতু শিমুল সারাজীবন থাকবে না। তাই সে ফোন করলো না শিমুলকে।

বালিশ ঠিক করে পেছনে তাকাতেই চৈতি বলে উঠলো, ‘দাদি!’

জয়নাব হাসতে হাসতে চৈতির পাশে বসলেন। পেছন থেকে শিমুল বললো, ‘আজকে দাদি তোর কাছে ঘুমাবে। তুই কালকে আসতে বলেছিলি জানার পর আর অপেক্ষা করলো না।’

জয়নাব মুখ বেঁকিয়ে চৈতির কাছে শিমুলের নামে বিচার দিলেন, ‘কি হইছে জানিস দিদু? হ্যারে কইলাম আমার বাতের বেদনা উঠছে। হ্যায় বিশ্বাসই করতেছিল না। আমারে জোর কইরা হাঁটাইছে ওই দূর মাঠে। হ্যারপর আমি আর উডতে পারি না। তোর এইহানে আসমু কেমনে?’

শিমুল হাসতে হাসতে বললো, ‘হয়েছে হয়েছে। আমার নামে আর নালিশ করতে হবে না। আমি তোমার ভালোর জন্যই হাঁটতে নিয়ে গিয়েছিলাম। সবসময় বাতের ব্যথার অজুহাত করে হাঁটা বন্ধ করো। এতে ডায়াবেটিস বেড়ে যায় না? এজন্যই তো বিশ্বাস করছিলাম না।’

চৈতি দাদির পক্ষ নিয়ে বললো, ‘উহু। শিমুপু এটা মোটেও ঠিক করেনি।’

শিমুল বুঝতে পারলো চৈতি দাদির শিশুসুলভ আচরণকে উপভোগ করছে। সে মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বললো, ‘থাক তুই দাদির কাছে। কত জ্বালাবে বুঝবি।’

জয়নাব অনেক গল্প করলেন চৈতির সাথে। চৈতি দাদির গা ঘেঁষে শুয়ে আছে। দাদার সাহসী গল্প, গ্রামে ঘটে যাওয়া কিছু ভুতের কাহিনী আর ছোট বেলার গল্প বলছেন তিনি। চৈতি মাঝখানে প্রশ্ন করলো, ‘দাদি, একটা প্রশ্ন করি?’

– কর বুড়ি।
– বাবা যখন মাকে বিয়ে করে আনলেন, তখন তুমি রাগ করেছিলে?
– তা একটু করছিলাম রে। তোর মা হইলো ছোট বংশের মাইয়া। কিন্তু যত দিন গেল, তত দিন বুঝবার পারলাম যে কুহু হইলো অমায়িক বউ। কুহুর মতো মাইয়া পাওয়া সহজ কথা না রে দিদু।
– আমার মা অনেক ভালো। আমি আম্মুকে অনেক ভালোবাসি।
– সব সন্তানই মা-রে ভালা পায়।

চৈতি দাদির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দাদি, আমি একটা গল্প বললে তুমি শুনবে?’

– তুই গল্প বলবি? বল বুড়ি।
– একটা মেয়েকে একটা ছেলে পছন্দ করে। কিন্তু মেয়েটা করে না। তবে তাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। মেয়েটা…
– বিয়া কেমনে ঠিক অয়? মাইয়া রাজি না থাকলে কইয়া দিলেই পারে!
– দাদি, তুমি পুরোটা শুনো। মেয়েটা বলতে পারে না কারণ ছেলেটা অনেক ক্ষমতাশালী। বললে মেয়েটার ক্ষতি হয়ে যাবে।
– আইচ্ছা, হ্যারপর?
– মেয়েটা মনে মনে ঠিক করে, সে আরেকটু বড় হলে এই বিয়ে ভেঙে দিবে। কারণ তার মনে অন্য আরেকজন আছে। এই কথা ছেলেটা বুঝে যায়। তারপর..
– কি রে?
– মেয়েটাকে জোর করে ধর্ষণ করে।

জয়নাব আঁতকে উঠলেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ! কি চ্যাংড়া ছ্যাড়া!’

– এখন সবাই মিলে সেই মেয়েটাকে বিয়ে দিতে চায় ওই ছেলের সাথে। মেয়েটা সময় চেয়েছে। তোমার কি মনে হয়? মেয়েটা বিয়ে করবে?
– মাইয়া যদি চায় তাইলে করবার পারে। তয় হ্যায় আরেকজন রে ভালো পায় না?
– জি দাদি।
– ওই পোলা কি কয়?
– ওই ছেলে ভালোবাসে না।
– তাইলে বিয়া কইরা নিক ওই বেদ্দবের লগে। কিন্তু এইহানেও একখান কতা আছে।
– কি কথা?
– মাইয়া যদি না চায় তাইলে এই বিয়া দেওনের কুনো মানে নাই। বরং ওই ছ্যাড়ারে ধইরা ইচ্ছামতো মারবো সবাই। বেদ্দপ পোলা!
– মেয়েটা তো চায় না দাদি। ও অনেক ঘৃণা করে।
– তাইলে পুশ্নই আহে না। মাইয়ার বিয়া হইবো কিনা এইসব চিন্তা পরে। আগে হ্যার শান্তিডা দেখতে অইবো।

চৈতির মন ভরে গেল দাদির কথা শুনে। সে তাকে জড়িয়ে বললো, ‘দাদি, তুমি পুরোনো যুগের মানুষ হয়েও এতো সুন্দর কথা কীভাবে বলতে পারলে?’

জয়নাব হেসে চৈতিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি পুরানা হইলেও তুই যার কতা কইতেছস হ্যায় তো পুরানা না। নাকি?’

– জি দাদি। সে এই যুগের মেয়ে।
– হেইডাই কতা। হ্যার আইজকাল সাহায্যের অভাব হইবো না। আর আমাগো যুগে কেউ কাউরে সাহায্য কইরতো নারে। উল্টা মাইয়ার ঘাড়ে জেনার দোষ চাপাইয়া দিতো। কিন্তু অহন যুগ বদলাইছে। দুআ করি, মাইয়া ভালো থাউক।

চৈতি মুগ্ধ হলো, জয়নাব বেগমের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দেখে। তিনি এ যুগের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আবার একবার জিজ্ঞেসও করলেন না মেয়েটা কে? চৈতি বুঝতে পারলো, গ্রামীন স্বভাব বৈশিষ্ট্য পাওয়া এই নারীর গর্ভে সব শিক্ষিত সন্তান গড়ে উঠার একমাত্র কারণ ন্যায়পরায়ণ দৃষ্টিভঙ্গি। যা তার বড় চাচীর মাঝে নেই যতই তিনি শহরের শিক্ষিত কন্যা হন না কেন!

__________

– শিমুপু, তোমার কাছে এক্সট্রা বোরখা আছে?

বিছানা গুছানো বাদ দিয়ে শিমুল চৈতির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কেন?’

– আমি পরবো।

মুচকি হাসলো শিমুল, ‘আজকে বোরখা পরতে ইচ্ছে করছে কেন?’

– কাল অস্বস্তি লাগছিলো। তাই বোরখা পরবো।

শিমুল তার ড্রয়ার থেকে একটা নতুন জিলবাব এনে বললো, ‘এটা আমি তোর নিয়ত করে কিনে রেখে দিয়েছিলাম। আজ কাজে আসলো।’

– সুরমা রঙের! এই রংটা আমার পছন্দ। অনেক ধন্যবাদ আপু।
– তা আমি জানি। এজন্যই তো কিনেছি। তুই অপেক্ষা কর। আমিও তৈরি হয়ে নিই।
– আজকে আমি কোচিংয়ে যাচ্ছি না আপু।
– ওমা! তাহলে কোথায় যাবি?
– আজকে আমার এক বান্ধবীর বাসায় যাবো। ওর মা আমাদের কলেজের টিচার। উনি অনেক ভালো, আমাকে আদর করেন। উনার কাছ থেকে বিভিন্ন পরামর্শ নিব।
– কিসের পরামর্শ?
– পড়াশোনার। আপু, তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার বান্ধবী এসে আমাকে নিয়ে যাবে।

চৈতির তাড়াহুড়ো দেখে শিমুল বুঝতে পারলো, চৈতি কোনো কিছু লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে। এতে শিমুলের মনটা একটু খারাপ লাগলো তবে পরক্ষণেই ভুলে গেল চৈতির অবস্থান চিন্তা করে।

দুপুরে চৈতি ফিরে আসলে জেবিন তাকে দেখে বললেন, ‘খেয়ে নাও চৈতি। আড়াইটা বেজে গিয়েছে। ভাত খেয়ে এরপর গোসল করতে যাও।’

চৈতি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ‘আমি খেয়ে এসেছি।’

জেবিন মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তিনি জানেন চৈতি ইলিশ মাছ ভাজা, আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত পছন্দ করে। তিনি আজ তাই করেছিলেন। ইদানিং তার মনে চৈতির জন্য অদ্ভুত সহানুভূতি জাগ্রত হয়। তিনি চৈতিকে মেয়ে ভাবেন কিনা জানা নেই, তবে পরিবারের সদস্য হিসেবে মূল্যায়ন করতে শুরু করেছেন। কিন্তু চৈতির দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো সাড়া না পাওয়ায় মাঝে মাঝে নিজের উপরই রাগ উঠে যায় তার। এই যেমন এখন, চৈতির পছন্দের খাবার রান্না করার কোনো কারণ ছিল না। তবু কি মনে করে করলেন, এখন অপমান পেতে হলো।

ঘরে ঢুকে জিলবাব খুলে বড় শ্বাস নিলো চৈতি। একটু কষ্ট হয়েছে এটা পরে থাকতে কিন্তু খুব শান্তি পেয়েছে। কেউ চিনতে পারেনি তাকে। কেউ জ্বালাতন করেনি, কোনো ছেলে কটূক্তি করেনি। দুই একজন খালাম্মা বলে ডাকাডাকি করলেও তার খারাপ লাগেনি। বরং নিজের বয়স লুকাতে পেরে প্রশান্তি অনুভব করেছে। বান্ধবী তামান্নার মা কিছুতেই না খেয়ে আসতে দিলেন না। তাই পেটে খাওয়ার মতো জায়গা নেই। জেবিনের মলিন মুখ সে দেখেছে। দেখলেও তার কিছু করার নেই। এখন থেকে নিজের সুখ খুঁজবে সে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় ঘটেছে একটা। রিকশাওয়ালা মামা গলির মুখে রিকশা থামিয়ে দিলে তাকে বাকি পথ হেঁটে আসতে হয়েছে। সেসময় দেখা মিলেছে মনচোরার। স্বাধীন বরাবরের মতোই দৃষ্টি নীচে নামিয়ে হাঁটছিলো। আর চৈতি একবার দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। কাছাকাছি আসতেই সে শুনতে পায় স্বাধীন কারো সাথে ফোনে ঝগড়া করছে। ঝগড়া ঠিক নয়, বোঝাপড়া করছে। স্বাধীনের কন্ঠ মৃদু, ওপাশের মানুষের কন্ঠও খুব জোরে নয়। এসবকিছু চৈতি খেয়াল করতো না, যদি না বিষয়টা তাকে নিয়ে হতো।

কথাগুলো শুনে চৈতি বুঝতে পারে, স্বাধীন তার কোনো এক বন্ধুকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে সৌরভকে সহানুভূতি দেখিয়ে আহ্লাদ দেখানোর কোনো অর্থ হয় না। সৌরভ একটা বাজে কাজ করেছে, এটার জন্য সে অনুতপ্ত হলে ভুক্তভোগীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে। সে এখন পর্যন্ত সেটা করেনি, উল্টো ভুক্তভোগীর দোষ দেয়া হচ্ছে জানা সত্ত্বেও চুপ করে আছে। কথা বলার এক পর্যায়ে চৈতি স্বাধীনের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে, ‘একটু থামুন।’

স্বাধীন চমকে থেমে গেলে চৈতি বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম। আমি চৈতি। আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।’

স্বাধীন তখনো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চৈতি বলেছে, ‘আমাকে নিয়ে কারো সাথে তর্ক করার দরকার নেই। আমি নিরপরাধ সেটা আল্লাহ জানলেই হলো। আরও একটা কথা, আজকের পর থেকে আপনি আমাকে নিয়ে কোনো কথা বলবেন, কারো সাথেই না। যেহেতু অনেকেই জেনে গিয়েছে আমি আপনাকে পছন্দ করতাম তাই আপনি আমার পক্ষ নিলে ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে যাবে। দয়া করে এক বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করবেন না।’

এই কথাগুলো বলে চৈতি অনেক শান্তি পেয়েছে। এগুলো তার মনের কথা। সে এখন থেকে নিজের ইচ্ছেমতো চলতে চায়, কেউ তার জীবন নিয়ে ভাবলে তার কিছুই যায় আসে না। তবু ওই একটা মানুষ তাকে নিয়ে ভাবুক, এটা সে একদমই মানতে পারবে না।

গোসল শেষে বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখলো, সাদিয়া বিছানায় বসে আছে। চৈতি অনেকদিন পর তার বোনকে দেখে খুশি হলেও সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। খুশির বহিঃপ্রকাশের অনুভূতি সে হারিয়ে ফেলেছে। নির্বিকার ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করলো সে, ‘সাদিয়া? কেমন আছিস তুই?’

সাদিয়া গাল ফুলিয়ে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ আপু। কিন্তু তোমার সাথে রাগ করছি।’

– কেন?
– এতদিন হয়ে গেল, একটুও মনে পড়েনি আমাদের?

কেঁদে ফেললো সাদিয়া। তাকে জেবিন আসতে দিতেন না। আজ হঠাৎ তিনিই গিয়ে বললেন, চৈতির সাথে দেখা করতে। এই কথা শোনামাত্র সাদিয়া দৌড়ে বোনের কাছে চলে এসেছে। চৈতি তাকে কাঁদতে দেখে পাশে বসে তার চোখ মুছে দিয়ে বললো, ‘মনে পড়েছে। কিন্তু আমার মন ভালো নেই যে।’

– জানি। আম্মু বলেছে তোমার সাথে ওই নিয়ে কথা না বলতে।
– এটা মামণি ঠিক বলেছেন। ওই ঘটনা নিয়ে কথা বললে আমার মন আরো খারাপ হয়। তার চেয়ে অন্য কথা বল। সাদিকের কি খবর?
– ও ভালো আছে। মাঝে মাঝেই রেগে উঠে সৌরভ ভাইয়াকে মারতে চায়।

মাথার মাঝে ঝংকার দিয়ে উঠলো চৈতির। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে বললো, ‘সাদিয়া! তুই ঘর থেকে একটু বের হ তো!’

সাদিয়া ভয় পেয়ে দৌড়ে জেবিনের কাছে গেল। জেবিন ঘরে বসে চৈতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সাদিয়াকে দৌড়ে আসতে দেখে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কি হয়েছে মা?’

– আম্মু! আপু কেমন যেন করছে!

সারাফ আর শিমুল দুজনেই দ্রুত চৈতির কাছে গেল। মূলত তারা চৈতিকে নিয়ে আলোচনায় বসতে চেয়েছিল। কিন্তু চৈতির ঘরে এসে তাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে সারাফ কাছে গিয়ে বললেন, ‘কি হয়েছে চৈতালি? মা আমার?’

নিম্ন কণ্ঠস্বরে চৈতি বলে উঠলো, ‘সাদিয়া জাহান্নামের নাম নিয়েছে!’

সারাফ তাকে এক হাতে জড়িয়ে বললেন, ‘আমার ঘরে চল মা। মাথা ঠান্ডা কর।’

চৈতি সে ঘরে গেল না। সবাই তার ঘরেই আলোচনায় বসলো। চৈতির পাশে শিমুল বসে আছে। আর ঠিক সামনে জেবিন আর সারাফ বসে আছেন। কথা শুরু করলেন সারাফ সাহেব।

– বাজে ঘটনার পর অনেকদিন চলে গেল। আগামীকাল কামিনীর বৌভাত। বুঝতেই পারছিস, কালকে আবারো জটলা তৈরি হবে বাসায়।

চৈতি কিছুই বললো না। সারাফ আবারো বললেন, ‘একটা শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো দরকার চৈতালি।’

– কি সিদ্ধান্ত?
– তুমি যথেষ্ট স্বাভাবিক আচরণ করছো আবার অস্বাভাবিকও বলা যায়। তোমার মত কষ্ট পাওয়া মেয়েগুলো অনেকটাই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু তুমি আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ধৈর্য ধারণ করতে পেরেছো। নিশ্চয়ই তুমি পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছো? সেগুলো আমাদের কাছে বলো।
– আমি ঠিক করেছি আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিব।
– খুবই ভালো কথা। তুমি ভালো ছাত্রী। পরীক্ষাও ভালো হবে ইন শা আল্লাহ। আর ভালো না হলেও ক্ষতি নেই। পরীক্ষা দিলেই হবে। এরপর কি পরিকল্পনা আছে?
– ভর্তি পরীক্ষা দিব। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা দিব, কলেজগুলোতে এপ্লাই করবো।
– বাহ! তারমানে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে তোমার। আলহামদুলিল্লাহ। এটা তো পড়াশোনার বিষয় গেল। বাকি বিষয়?
– বাকি কোন বিষয়?

সারাফ সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন, ‘মা, পড়াশোনা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু পড়াশোনার বাইরেও কিছু কাজ আছে। আমাদের জীবন শুধু পড়ার জন্য তৈরি হয়নি।’

– আমি ঠিক করেছি এখন থেকে কঠোর পর্দা করবো। ইবাদতে মনোযোগ দিব।
– এটা তো আরও খুশির কথা! শিমুল মা, দেখেছিস কি সুন্দর চিন্তা করেছে আমার চৈতালি?

শিমুল একটু হেসে চৈতির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ও তো আজকেও বোরখা পরে বাইরে গিয়েছে। ইন শা আল্লাহ, ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ পর্দা করবে চৈতি।’

– ইন শা আল্লাহ। ইবাদত সর্বপ্রথম, এরপর দুনিয়ার চিন্তা। আমার এখন সরাসরি কথা বলতে হবে দেখছি। তুই শুধু সাইডে চলে যাচ্ছিস। সরাসরি বলছি, বিয়ে নিয়ে পরিকল্পনা কি তোর?

চৈতির ভ্রু কুঁচকে এলো, ‘বিয়ে?’

– হ্যাঁ। সারাজীবন একা কাটিয়ে দিবি?
– যদি বলি তাই করবো?
– সেটাতেও আমার আপত্তি নেই। তোর যা ইচ্ছা করবি। কিন্তু আমি, জেবিন আর শিমুল একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– কি সিদ্ধান্ত?
– তুই চাইলে স্বাধীনের সাথে কথা বলতে পারি।

চৈতি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার বাবা এমন কথা কি করে বলতে পারে সে বুঝতে পারছে না।

– বাবা! তুমি এমন একটা কথা কীভাবে ভাবলে?

ঘরে উপস্থিত সকলেই ঘাবড়ে গেল। সারাফ সাহেব বললেন, ‘কি এমন কথা বলেছি মা?’

– খুবই সস্তা একটা কথা বলেছো। আমার দুর্বলতা দেখিয়ে একজন সৎ মানুষের ভালো গুণের সুযোগ নিতে চাইছো?
– ছি ছি! সুযোগ কেন নিতে চাইবো? স্বাধীন খুব ভালো ছেলে।
– ভালো ছেলে বলেই এই সুযোগটা নিতে পারছো। আমি ধর্ষিতা। ধর্ষণের আগে তিনি রাজি ছিলেন না, আর এখন রাজি হয়ে যাবেন? কেন?
– তুই বুঝতে পারছিস না। স্বাধীন এখন ধর্মপ্রেমী ছেলে।কোনটা অন্যায় কোনটা ন্যায় এসব জ্ঞান ওর অনেক। ও নিশ্চয়ই তোকে ফিরিয়ে দিবে না। তাছাড়া…

চৈতি গমগমে কণ্ঠে বললো, ‘এটাই। তোমরা সবাই এখন একজন ভালো মানুষের ভালো ব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছ। কি আশ্চর্য! স্বাধীন ভাই কেন আমাকে বিয়ে করবেন? সহানুভূতি দেখিয়ে?’

– তোর দোষ নেই। এখানে তুই নিজেকে এতোটা ছোট করে দেখছিস কেন?
– তাহলে স্বাধীন ভাইয়ের উপরেই কেন চাপিয়ে দিতে চাইছো? অন্য কেউ নেই? নেই এমন কোনো লোক যে একটা ধর্ষিতাকে বিয়ে করার সাহস রাখে?

সবাই কিছুক্ষণের জন্য চুপ। শিমুল বলে উঠলো, ‘অন্য কেউ খুঁজলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু স্বাধীনকে আমরা ছোট থেকে দেখে আসছি। সবাই জানি ছেলেটা কত ভালো।’

– ছোট থেকে আরেকজনকেও দেখে এসেছো। শেষে সে কি করলো সেটাও তোমাদের জানা।

সারাফ কিছুটা রেগে গেলেন, ‘কি বলতে চাইছিস? স্বাধীন বাজে ছেলে?’

– না বাবা। উনি ভালো মানুষ। কিন্তু উনি ভালো বলেই আমি উনাকে বিয়ে করবো না। তোমাদের সমস্যা আমার বিয়ে নিয়ে। আমাকে বিয়ে করার কেউ নেই বলেই ধারণা। কিন্তু অনেক ছেলে পাবে যারা ডিভোর্সড কিংবা বউ মারা গিয়েছে। এদের সাথে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই।
– এ ধরণের ছেলের সাথে কেন বিয়ে দিব তোকে?
– কেন দিবে না?
– আমি আর কত বলবো যে তোর এই ঘটনায় কোনো দোষ ছিল না। তুই কেন সুখী জীবন পাবি না?
– স্বাধীন ভাইয়ের দোষ কোথায়? তিনি কেন সুন্দরী একজন সতী বউ পাবেন না?
– তোকে কিছুই বলবো না আর।

চৈতি শান্ত হয়ে বললো, ‘দুঃখিত বাবা। আমি বুঝতে পেরেছি আমাকে নিয়ে তোমাদের চিন্তা হয়। কিন্তু আমিও কিছু কথা বলতে চাই। আমি এখনই বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। আমি আগে পড়াশোনার একটা গতি করতে চাই। এরপর এগুলো ভাববো। ততদিন আমাকে বিয়ে নিয়ে কোনো জোর করবে না।’

– তোকে কেউ জোর করেনি। তোর মতামত নিতে চেয়েছিলাম। হঠাৎ এরকম প্রতিক্রিয়া দেয়ার কোনো দরকার ছিল না।
– দুঃখিত বাবা। ক্ষমা করে দিও। একটু বেশি রাগ দেখিয়ে ফেলেছি।
– ক্ষমার কথা আসছে কেন? শোন মা, আমরা তোর অভিভাবক। সবসময় ভালোটাই চেয়ে আসছি। এজন্য ওই প্রসঙ্গ তুলেছিলাম।
– তা জানি বাবা। তোমরা ছাড়া আর কেই বা আছে।

ঘরে তখনো অস্বস্তি বিরাজমান। চৈতি বুঝতে পারলো সারাফ সাহেবের কথা এখনো শেষ হয়নি। কি নিয়ে বলবেন সেটাও চৈতি অনুমান করতে পারলো।

– যা বলতে চায় বলো বাবা। শুধু নাম না নিলেই হবে।
– আজ তোর বড় চাচার সাথে দেখা হয়েছিল।

__________

চলবে ইন শা আল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here