(১)
“আমি আর ও বাড়ি ফিরে যাবো না আম্মা৷” মেঘের কথা শুনে রুমে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ যে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল মেঘের দিকে৷
বিয়ের তিন দিনের মাথায় মেয়ে জামাইকে বাড়িতে নিয়ে আসে মেঘের পাঁচ ভাই আর দুই বোন৷ প্রত্যেকে ভিষণ হাসি খুশি ছিলো কিন্তু এই হাসি খুশির মূহূর্তটা যে বেশিক্ষণ স্থায়ী নয় সেটা ঘূনাক্ষরেও কেউ জানতে পারেনি৷ মেঘের মা তার মেয়ের মুখের কথা শুনে পাথর হয়ে বসে রইলেন৷ একটা শব্দও মুখ থেকে বের করলেন না৷ হয়তো মাত্রারিক্ত শক থেকে তিনি চুপ হয়ে রইলেন৷
মেঘ দৃঢ় গলায় কথাটা বলে তার ছোট্ট রুমটার দিকে যেতে নিলে মেঘের সেজভাই আবদুল্লাহ বলে উঠলেন,” দাড়া মেঘ৷ ও বাড়িতে ফিরে যাবি না মানে? কী বলতে চাস পরিষ্কার করে বল৷ আর যদি কোন সমস্যা থেকে থাকে সেটাও বল৷ জামাই যেহেতু বাড়িতেই আছে আমরা কথা বলে দেখি সমস্যার সমাধান হয় কী না?” আবদুল্লাহ কথা শেষ হতে মেঘ বলে উঠলো,” সেজভাই আমি আমার কথা জানিয়ে দিয়েছি৷ আমি আর ও বাড়িতে ফিরবো না৷ যে বাড়িতে নতুন বউয়ের সাথে শাশুড়ি ননদ দেবর জা শত্রুর মত আচরণ করে৷ কাপড়ে এসিড ঢেলে দেয়৷ পদে পদে নিজের জীবন নিয়ে ভয়ে থাকতে হয় এমন সংসারে আমি ফিরবো না৷ তাই ভালো হয় আমাকে ওই সংসারে ফিরতে না বলা৷ ও আর একটা কথা তোমাদের আদরের জামাই কে বলে দিও যদি তার মা বোন ভাই তার স্ত্রীর কথা মত চলতে যেমন টা গত তিনদিন ধরে চলে আসছে৷ আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তালাক নামা পাঠিয়ে দিতে৷” মেঘের কথা শেষ হতে না হতে স্বজোড়ে এক থাপ্পর পড়লো মেঘে বা গালে, থাপ্পর টা আর কেউ নয় মেঘের মা শেফালী বেগম মেরেছেন৷ মেঘ অশ্রুশিক্ত চোখে তার জন্মদাত্রী মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল৷ শেফালী বেগম রক্ত চক্ষু নিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,” বেয়াদপ মেয়ে কী বলছিস তার কোন বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তোর? বিয়ের তিন দিন পেরুতে না পেরুতে তালাকের কথা বলছিস? ”
মেঘ কোন রকম কান্নাটা আটকে বলতে লাগলো,” তাহলে কী চাও আম্মা? আমি ওই নরকে ফিরে যাই? যেখানে তোমার মেয়ের বিন্দু মাত্র দাম নেই৷ যেখানে ছোট থেকে বড় সদস্য আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে৷ বাড়ির চাকরের থেকে বেশি অত্যাচার করে সেখানে ফিরে যেতে বলছো?”
মেঘের কথা শুনে তার পাঁচ ভাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে৷ বড় ভাই নাজমুল তৎক্ষনাৎ বলে,” মেঘ তোর সাথে এত কিছু হয়ে গেছে আমাদের আগে কেন বলিস নি?”
” বলবো কি করে দাদা? ও বাড়ি ফোনে নেটওয়ার্ক থাকে না ৷ কাউকে কল করতে হলে বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দুরে গিয়ে কল করতে হয়৷ আর আমাকে তো বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি তাহলে কল কী করে করবো?” মেঘের মেজভাই তাজুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,” মেঘ এখন শান্ত হ৷ বিয়েটা কোন ছেলেখেলা না৷ তাই যা করার তা খুব সাবধানে করতে হবে৷ আর বড় আপা দুলাভাইরা তো কাল মনে হয় চলে যাবে৷ আর বাকি আত্মিয় স্বজন ও তাই বাড়ি ফাঁকা হওয়া অব্দি শান্ত থাক৷ তারপর না হয় জামাই আর তার পরিবারের সাথে কথা বলবো৷ মেঘ আর কথা বাড়ালো না৷ নিজের রুমে চলে গেল৷ এদিকে বাড়ির সবাই মেঘ কে নিয়ে দুঃচিন্তা করছে৷ কিভাবে সবটা ঠিক করা যায় সে চিন্তায় প্রত্যেকে মশগুল৷
২.
শশুড় বাড়ি এসে নতুন জামাই সোহেল বাজারে চলে গেল মেঘের বড় বোনের স্বামীকে নিয়ে৷ ব্যাগ ভর্তি বাজার করে শশুড় বাড়িতে আসে সোহেল৷ সোহেল অল্প বয়সে বিদেশ পাড়ি জমায় কাজের জন্য সেখানে বিশ বছর কাটিয়ে দেওয়ার পর দেশে ফিরতে তার বিয়ের তোরজোড় শুরু হয়ে যায়৷ পড়াশুনা তেমন জানা না থাকলেও সাধারণ জ্ঞান টুকু সোহেলের ছিলো৷ অজপাড়া গায়ের ছেলে সোহেল৷ বিদেশে থাকা কালিন দেশে অনেক জমিজমা কিনেছে৷ বাড়ি বানিয়েছে৷ গরু,ছাগল, হাস,মুরগির খামার সবটাই গড়েছে তার টাকায়৷ দেশে এসে মা বোনের জোরাজুরিতে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়৷ এমন না সোহেল দেখতে বেশ সুদর্শন যুবক৷ মাথা ভর্তি বড় একটা টাক , খানিকটা পেট উচু ৷ মেঘের শুরু থেকে সোহেলকে পছন্দ ছিলো না কিন্তু ভাইদের মুখের উপর কোন কথা বলতে পারেনি মেঘ৷ একে তো বাবা নেই ভাইদের টাকার উপর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা কোন ভাবে দিয়েছে বছর সাতেক হলো৷ বয়স ও প্রায় আঠাশ ছুঁই ছুঁই এমন না মেঘ দেখতে কুৎচিত শ্যাম বর্নের মেয়ে মেঘ৷ মাথা ভর্তি কৃষ্ণ কালো চুল৷ মায়াবী চোখ আর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা একচিলতে হাসি ব্যাস এতটুকুই৷ মেঘ চাইনি তার ভাইদের ঘাড়ে বসে খেতে৷ কারণ তাদের ভাইয়েরা বিবাহিত আলাদা সংসার আছে৷ নিজেদের খরচ চালিয়ে মা বোনদের খরচ চালিয়ে ভাইয়েরা হিমশিম খায় সেখানে নিজেকে রাজকন্যা ভেবে রাজপুত্র কল্পনা করা নেহাতি বোকামি ছাড়া আর কিছুই না৷ আর তাই তো আর মেঘের এই অবস্তা৷
সোহেল হাতমুখ ধুয়ে রুমে এসে মেঘের মুখ ভার দেখে সোহেল মেঘের গা ঘেষে বসে বলে,” কি হলো মেঘ তোমার মুখ ভার কেন?”
সোহেলের কথা শুনে মেঘ খানিকটা বিরক্তি নিয়ে সোহেলের থেকে একটু দুরে সরে বসে বললো,” আপনি আজ আপনার বাড়িতে একা ফিরে যাবেন সোহেল৷ ”
” মানে!”
” মানেটা খুব সহজ সোহেল আমি আপনার সাথে ও বাড়িতে ফিরছি না৷ যেখানে ছোট থেকে বড় সদস্য আমাকে নিচু করে অপমান করে আর সদ্য বিয়ে হওয়া স্বামী তা দেখেও না দেখার ভান করে৷ সে সংসারে অন্তত এই মেঘ ফিরে যাবে না৷
মেঘের কথা শুনে সোহেলের চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে৷ দাঁতে দাঁত চেপে খুব আস্তে করে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,” খবরদার মেঘ ভুলেও আমার পরিবারের কোন সদস্যদের উপর আঙ্গুল তুলবে না৷ তোমার কপাল ভালো আমি তোমাকে বিয়ে করেছি৷ নাহলে তো আমার মনে হয় না তোমার কোথাও বিয়ে হত৷ মুখ ভর্তি পক্সের দাঁগ, বয়সও তো কম হয়নি৷ বুড়ি হয়ে গেছো৷আয়নায় নিজেকে দেখেছো কখনো? দেখলে হয় তো আর এই কথা বলতে না৷” রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললো সোহেল৷
সোহেলের কথা শুনে মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠলো৷ যেটা দেখে সোহেল কিঞ্চিৎ বিস্ময় চোখে তাকিয়ে রইল মেঘের দিকে৷
মেঘ সোহেলের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে বললো,” রাত হবার আগে এবাড়ি থেকে বিদেয় হবেন৷ আপনার মুখটাও যেন আমি আর এই জন্মে না দেখি৷”
সোহেল এবার রাগ সামলাতে না পেরে মেঘের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে,” খুব চো’পা হয়েছে না তোর? ভুলে যাস না তোর বিয়ে হয়ে গেছে আর তুই আমার বউ৷” এত শক্ত করে হাত চেপে ধরেছে যে ব্যাথায় মেঘের আখিদ্বয় জোড়া ভরে উঠলো৷ তখনি হুট করে মেঘের বড় বোনের মেয়ে আলিয়া রুমে এসে হাজির হয়৷ আলিয়াকে দেখে সোহেল মেঘের হাত ছেড়ে দিয়ে হাসি মুখে আলিয়াকে বলে,” আম্মু তুমি এখানে?”
” হ্যাঁ খালু আপনাকে আর আন্টিকে বড়মামা ডাকছে৷ বারান্দায় আসেন৷”
” আচ্ছা আম্মু আমরা আসছি৷” আলিয়া তার আন্টির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত তারপর রুম থেকে বেড়িয়ে গেল৷ সোহেল মেঘের দিকে আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল৷ আর তার পেছন পেছন মেঘও বের হলো৷
৩.
মাথা নিচু করে বসে আছে সোহেল৷ মেঘের পাঁচ ভাই সোহেলকে ঘিরে বসে আছে৷ একেক ভাই একেক টা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে সোহেলের দিকে আর সোহেল চুপ করে বসে আছে৷ বাড়ির বাকি সব সদস্যগণ পিঠা বানাতে মশগুল৷ এদিকে কারোর কোন খবর নেই৷ নাজমুল প্রথমে ভেবে ছিলো মেঘের বিষয় নিয়ে আগামীকাল কথা বলবে কিন্তু ঢাকা থেকে কল এসেছে তাকে আগামীকাল সকালে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিতে হবে তাই বাকি ভাইদের সাথে পরামর্শ করে আজই সোহেলের সাথে কথা বলবে বলে সিধার্ন্ত নেওয়া হবে৷
” সোহেল আমি আমার বোনের কাছ থেকে সবটা শুনেছি৷ এখন তোমার কী কিছু বলার আছে?”
সোহেল এবার মাথা তুলে মেঘের দিকে একনজর তাকিয়ে বলে উঠলো ………..
.
.
.
.
#সূচনা_পর্ব
#মেঘের_বাড়ি☁️
#লেখনীতে_ফারহানা_আক্তার_ছবি
[বিঃদ্রঃঅনেকদিন পর লিখলাম৷ ভুল ত্রুটি সুন্দর ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন৷]