দিন_বদলের_হাওয়ায় [১০] #তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)

0
443

#দিন_বদলের_হাওয়ায় [১০]
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)

মামারা চলে গেলেন রাত এগারোটা নাগাদ। গল্প করতে করতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। মামারা যাওয়ার পর ঘর ঝাড়ু দিয়ে বাসনপত্র ধুয়ে ঘরে আসলাম ঘুমানোর জন্য। রেদোয়ান শুয়ে পড়েছে। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে। আমি শুয়ে পড়লাম। কিন্তু চোখ লেগে আসতেই কলিং বেলের শব্দে উঠে বসলাম। এতো রাতে কে আসবে? শোয়া থেকে উঠে বসে রেদোয়ানকে ডাক দিলাম। দুই তিন বার ডাকার পর ও উঠলো। দরজা খুলতে গেলো ও। দেখলাম রুশা আপা এসেছে। রুশা আপাকে দেখে ভীষণ আশ্চর্য হলাম। এতো রাতে তিনি কেন এসেছেন? নিহাল, নিশি ওরা কোথায়?ওদের তো নিয়ে আসে নি। রুশা আপা দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার শাশুড়ির রুমে চলে গেলেন। আমিও পিছন পিছন গেলাম। যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে আপা? আপনি এতো রাতে? কোন সমস্যা হয়েছে কি?

রুশা আপা আমার কথায় বিরক্তি নিয়ে বললেন, সেটা তোমার না জানলেও চলবে।

রুশা আপা আমার শাশুড়ির ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। রেদোয়ান আমাকে বললো, চলো ঘরে চলো। শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

আমি আর রেদোয়ান ঘরে চলে আসলাম। দুজনেই এসে শুয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় শাশুড়ির ঘর থেকে রুশা আপা আর আমার শাশুড়ির বিড়বিড় শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আমি রান্নাঘরে গেলাম‌। চাল, ডাল ধুয়ে চুলায় চড়াতেই কলিং বেলের শব্দ পেলাম। দরজা খুলে দেখলাম নিশি আর নিহাল দাঁড়িয়ে আছে। নিশি আমাকে দেখে বললো, মামি মা আম্মু কি এখানে এসেছে? রাত্রে বাবার সাথে ঝগড়া করে কোথায় যেন চলে গেছে আম্মু।

এবার বুঝলাম রুশা আপার এখানে আসার কারণ। বাচ্চা দুটোর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। নিহালের চেহারা ফুলে উঠেছে। কান্না করেছে হয়তো। করবে না কেন পাঁচ বছরের ছেলে কি মা ছাড়া থাকতে পারে? আমি দু’জনকেই ঘরে নিয়ে আসলাম। এরপর রুশা আপাকে ডাক দিলাম। আমার ডাক শুনে রুশা আপা আর আমার শাশুড়ি দুজনেই আমার কাছে এলেন। রুশা আপাকে দেখে নিহাল তার কাছে গিয়ে মা বলেই হাউ মাউ করে কান্না করে দিলো। রুশা আপা ওকে কোলে তুলে নিলেন। এরপর নিশিকে বললেন, এখানে কেনো এসেছিস? তোর বাপ তোদের এখানে কেন পাঠিয়েছে? যে দু পয়সা কামাই করে তাতে সবার পেটে ভাত যায় না। তার উপর আমার গায়ে হাত তুলে।

রুশা আপার কথায় বললাম, ওকে এভাবে বলছো কেন আপা? ও তো ছোট মানুষ। ভাইয়ার জেদ ওর উপর উঠাচ্ছো কেন?

আমার শাশুড়ি তৎক্ষণাৎ আমাকে বললেন, তুমি চুপ থাকো। ওর মাইয়ারে ওয় কয়। তোমার কি? পারলে নিজে একটা জন্ম দিয়া মাথায় তুইলা নাচো। এত বছর বিয়া হইলো একটা নাতি নাতনির মুখ দেখাইতে পারলা না আবার কথা কও।

শাশুড়ির কথায় মাথা নিচু করে নিলাম। সেখান থেকে সরে আসলাম। শাশুড়ির কথাটা মনে খুব দাগ কেটেছে। চুপচাপ রান্নাঘরে গিয়ে নিজের কাজে মন দিলাম। কিছুক্ষণ পর রুশা আপা রান্নাঘরে এলেন। আমাকে বললেন, ঘরে কিছু আছে খাওয়ার মতো কিছু কি দিবে? সকাল থেকে না খেয়ে আছি সেদিকে খেয়াল আছে?

দিচ্ছি আপা। রান্না হয়ে এসেছে। আপনি খান সাথে আপনার বাচ্চা দুটোকেও খাওয়ান। নিশি বললো ওরা রাত থেকে না খেয়ে আছে। নিজের সন্তান নেই তো আপা ওদের এমন অবস্থায় দেখলে খুব খারাপ লাগে। কিছু মনে করবেন না।

রুশা আপা চুপ করে রইলেন। আমি আমার কাজে মন দিলাম। হঠাৎই রুশা আপা বললেন, রেদোয়ান এখন কি করে আয়রা?

টিউশনি করে দুটো।

এতে সংসার চলে?

ওই তো যতটুকু চলে আরকি। খাই তো অন্যেরটা।

রুশা আপা আর কিছু বললেন না। আমি রান্না শেষে সবাইকে খাবার দিলাম। খাওয়া শেষ করে রুশা আপা আর আমার শাশুড়ি কোথায় যেন গেলো। সাথে নিহাল আর নিশিকেও নিলেন। আমি আর কিছু বললাম না।

দিনটা কোনরকমে কাটলো। আমার দুই জা তাদের রুমেই একা একা দিন পার করে। কারো সাথে কারো কোন মিল নেই। সন্ধ্যায় রুশা আপা আর শাশুড়ি ফিরে এলেন। শাশুড়ির মুখে বিরক্তির ছাপ রুশা আপার মুখটা মলিন। নিহাল নিশি কে আনে নি। তাদের দেখে মনে হচ্ছে কি যেন লুকাচ্ছেন। আমি আর কিছু জিজ্ঞাস করলাম না।

রেদোয়ান পড়ানো শেষ করে বাড়ি ফিরলো সাড়ে সাতটায়। রেদোয়ান বাড়িতে এসেই রুশা আপাকে ডাকা শুরু করলেন। রুশা আপা ওর ডাক শুনে ওর কাছে গেলো। রেদোয়ান ওনাকে বললো, তোর কি হয়েছে রে আপা? জহির ভাই ফোন করে কি বললো এগুলো?

রুশা আপা নিচু কন্ঠে বললেন, কি বলেছে?

তোদের মধ্যে কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে? যখন বিয়ে করেছিলি তখন দেখে বিয়ে করিস নি? তার সামান্য বেতন সংসারটা একটু কোনমতে চালিয়ে নে না। সে তো বললো প্রমোশন পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আসলে কাল রাগের মাথায়……

রুশা আপার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার শাশুড়ি দ্রুত গতিতে সেখানে এসে বললেন, কি ঠিক হইবো? দুই পয়সা খাওয়াইতে পারে না। আমার মাইয়ার গায়ে হাত দেয়!

রেদোয়ান শান্ত ভাবেই বললো, মা গায়ে হাত কেন তুলেছে তা তুমি জানো? তোমার মেয়ে তাকে কি বলেছে জিজ্ঞেস করো তো।

আমার মাইয়া ঠিকই করছে। তুই চুপ থাক।

আমার বোনের সংসার ভেঙে যাচ্ছে আমি চুপ থাকবো মা? তুমি ভাইয়াকে কি বলেছো?

যা ইচ্ছা কইছি। তোর কি? তোর কি বইনে দুই পয়সা দেওয়ার মুরোদ আছে? দিতে তো পারবি না কিছুই এতো বড় বড় কথা কছ কেন?

রেদোয়ান আর কিছু বললো না। শাশুড়ি গদগদ করে রুশা আপার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন শুনলাম। দেখেই গেলাম কিছু বলতে পারলাম না। বাচ্চা দুটোর জন্য খুব আফসোস হতে লাগলো। রুশা আপার সংসারটা টিকবে তো? বাচ্চা দুটোর কি হবে?

রাতে সব কাজ সেরে খাওয়া দাওয়ার পর সব গুছিয়ে ঘুমোতে গেলাম। রেদোয়ান বিছানায় শুয়ে আছে। সকালে বলা মায়ের কথাটা মনে পড়ে গেলো। আমি রেদোয়ানের পাশে বসে বললাম, তোমার সাথে কথা ছিলো কিছু।

রেদোয়ান আমার কথায় ভাবনার জগত থেকে বের হলো। বললো, হ্যাঁ বলো।

আজকে মা আমাকে সন্তানের কথা বলেছে। বলেছে বিয়ের এতো গুলো বছর হলো কিন্তু তাকে নাতি নাতনির মুখ দেখাতে পারছি না।

রেদোয়ান নড়েচড়ে বসল। বললো, তুমিও কি তা চাও?

প্রত্যেক মেয়েই মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করতে চায় রেদোয়ান।

তা তো ঠিক। কি বাচ্চা হলে তাকে খাওয়াবে কি?

কেন আমরা যা খাচ্ছি তাই খাবে ও।

রেদোয়ান হাসলো। বললো, রুশা আপাও কিন্তু এমন ছিলো আয়রা। ভালোবেসে জহির ভাইকে বিয়ে করেছে। তা সাথে ভাঙা ঘরে থাকতে পারবে বলেও ওয়াদা করেছিলো। কিন্তু এখন দেখো কি হচ্ছে। একটু কষ্টে থাকার কারণে ভাইয়াকে ছেড়ে চলে এসেছে। একবারও দুটো বাচ্চার কথা ভাবলো না। আমি চাই না তুমিও এমন হও।

তুমি আমাকে এতো দিনে এটুকু চিনলে রেদোয়ান?

তোমাকে সবটাই চিনি আমি আয়রা। কিন্তু মানুষ বদলাতে সময় লাগে না। দেখছো না তোমার চারপাশের মানুষগুলোকে? সময়ের সাথে সাথে তুমিও বদলে যেতে পারো। আর আমি তোমাকে বদলাতে দেখতে পারবো না আয়রা। তোমাকে হারাতে আমার ভীষণ কষ্ট হবে।

কিছু বললাম না ওর কথায়। চুপচাপ ঘুমিয়ে গেলাম।

সকাল বেলা শাশুড়ি থেকে শুনলাম রুশা আপা এখন থেকে এখানে থাকবে।রুশা আপা জহির ভাইয়ার কাছে আর যাবে না। গতকালই নিহাল আর নিশি কে জহির ভাইয়ের কাছে দিয়ে আসা হয়েছে। আমি অবাক হলাম। কিন্তু কিছু বললাম না। খালি দেখতে থাকলাম রুশা আপার মলিন মুখখানি। জানি না আপার মনে কি আছে। শুধু ভাবছি বাচ্চা দুটোর কি হবে? মাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে তারা? নিহাল তো এখনো অনেক ছোট!

দেখতে দেখতে কেটে গেলো পনেরো দিন। রুশা আপা আমাদের এখানেই আছেন। কিন্তু তিনি আর আগের মতো কথা বলেন না। সবার থেকে দূরে দূরে থাকেন। কয়েকদিনে হয়তো স্বামীর গুরুত্ব বুঝে গেছেন। আমার দুই জা তার সামনে কিছু না বললেও পেছনে কম কথা শুনায় না। আমার শাশুড়িও যে এতো তেজ করে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন তিনিও এখন বিরক্ত। ভীষণ আশ্চর্য লাগে তাদের দেখলে। কিন্তু আমি কিছু বলি না। চুপচাপ নিজের কাজ করে যাই। দরকার আছে আমার এসবে কথা বলে? এভাবে অন্যের ব্যাপারে কথা বলে নিজেকে অপদস্থ করার কোন মানেই হয় না। তাই সবসময় চুপ থাকি।

আজ রেদোয়ান হঠাৎ করেই বাসায় আসার পর রুশা আপা তার কাছে গিয়ে বললেন, রেদোয়ান আমি বাড়ি ফিরে যাবো রে। এখানে আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমার সংসারে আমি ফিরে যাবো।

রুশা আপার কথায় মিশে আছে সংকোচ মিশে আছে লজ্জা। রেদোয়ান শান্ত ভাবে বললো, ভাইয়া কি তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে? নাকি চলে যেতে বলেছে?

এমন কিছুই তো বলে নি।

তাহলে চলে যা। মানা করেছে কে? তুই ভাইয়াকে যা মনে করিস তেমন কিন্তু ভাইয়া না রে। গতকালও ভাইয়া ফোন করে তোকে দিয়ে আসতে বলেছে। তোর ছেলেটা প্রতিদিন তোর জন্য কান্না করে। আর ওত ছোট মেয়ে কি তোর সংসার বোঝে রে আপা? সেই পিচ্চি মেয়েটাই এখন সব সমালাচ্ছে। আর তুই মায়ের কথায় নেচে নেচে সব ছাড়লি।

রুশা আপা মাথা নিচু করে নিলেন। বললেন, আমি বাড়ি ফিরবো রে।

আপার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। রেদোয়ান আর কথা বাড়ালো না। বললো, কখন যাবি?

এক্ষুনি।

রেদোয়ান না করলো না। রুশা আপাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লো। আমার শাশুড়িও ততটা নাক গলালেন না। বুঝলাম না শাশুড়ির এমন পরিবর্তনের কারণ। তবে ভালো লাগছে রুশা আপার সংসারটা ঠিক হলো তো।

রেদোয়ান চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হলো। এরপর কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলে দেখলাম স্বর্ণা ভাবি দাঁড়িয়ে আছে। বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। তাকে এমন উত্তেজিত দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে ভাবি? এমন..

আমার শেষ হওয়ার আগেই তিনি বললেন, জলদি টিভি অন করেন ভাবি। জলদি যান।

ভাবির কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তার কথায় যেয়ে টিভিটা অন করলাম। ভাবি আমার সাথেই ঘরে আসলেন। বললেন, ভাবি নিউজ চ্যানেল দেন জলদি।

আমি নিউজ চ্যানেলে দিলাম। সন্ধ্যা আটটার খবর দিচ্ছে। খবর দেখে আমি ভীষণ আশ্চর্য হলাম। আমার চোখ দুটো দিয়ে আপনাআপনিই অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকলো…….

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমা করবেন। কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি কার্টেসীসহ কপি করাও নিষিদ্ধ।যারা পূর্বে কপি করেছেন তারা গল্পটি ডিলিট করে দিবেন। বার বার সতর্ক করা হচ্ছে।)

Join

https://facebook.com/groups/272194598259955/
All part https://www.facebook.com/groups/272194598259955/permalink/475640541248692/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here