#ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০১
#আসেফা_ফেরদৌস
মল্লি, মন খারাপ, এখনো রেগে আছ? আশ্চর্য! আর কতক্ষন এভাবে রেগে থাকবে, এই রাগটা পড়বে কখন হুম?
আচ্ছা, তুমি ববং এক কাজ করো, রাগ পড়ে গেলে একটা মেসেজ দিয়ে দিও। আমি ফোন করব।
বারবার কল করছি তুমি তো ধরছ না, অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে কাজেও মন বসাতে পারছি না! তারচেয়ে তুমিই বরং আমাকে ফোন করে বোলো, কখন তোমার মেজাজ ঠান্ডা হবে প্রিয় কন্ঠটা তখনই শুনব নাহয়!
একদৃষ্টিতে ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে মল্লিকা। ইচ্ছে ছিল না মেসেজগুলো পড়ার, নোটিফিকেশন আগে বাজলেও সে পাত্তা দেয়নি। তবে কৌতুহলের কাছে হেরে গিয়ে ওগুলোতে চোখ বুলিয়েছে খানিকক্ষণ। এবং এ মুহূর্তে মন চাইছে মোবাইলটা ভেঙে ফেলতে। মানুষের খামখেয়ালিপনার একটা সীমা থাকা উচিত! অবশ্য ফয়সালের বেলায় এসব বলে লাভ নেই। সে অন্যরকম, সবসময় নিজেস্ব জগতে মেতে থাকে।
মল্লিকার সঙ্গে ফয়সালের বিয়ে হয়েছে আজ দশ বছর, এই দশ বছরে মেয়েটা তাকে একইরকম দেখছে। একদম ছেলেমানুষ! বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেই ফয়সাল হাসি ঠাট্টায় উড়িয়ে দিতে পছন্দ করে এবং গাম্ভীর্য জিনিসটা যায় না ওর সঙ্গে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফয়সালের মধ্যে কোনো ভারিক্কি আসেনি, বরং দিনকে দিন মানুষটার অপরিপক্কতা বাড়ছে বোধহয়!
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে মল্লিকা, কিন্তু মাথাটা ঠান্ডা হচ্ছে না। এমন তো বেশিকিছু আবদার করেনি, কেবল দু তিনটে দিন নিজের বোনের সঙ্গে কাটাতে চেয়েছিল।
মৌনী আপু আর দুলাভাই ছেলেমেয়েদের নিয়ে কুয়াকাটা বেড়াতে যাচ্ছেন। ফসসাল, মুকুল এবং মল্লিকাকেও সঙ্গে যাবার জন্য খুব করে ধরেছিলেন দুজন, তবে শেষ পর্যন্ত হলো না!
এ বাড়িতে সারাদিন সংসারের ব্যস্ততায় একরকম চলে যায়, একঘেয়েমি লাগে। এ অবস্থায় একটু পরিবর্তনে স্বস্তি খুঁজতে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু না, তাতেও বাধ সাধল ফয়সাল। মানুষটা সবসময়ই এমন নিজের আনন্দ খুশির সে ষোলোআনা বোঝে, অথচ অন্যের বেলায় একেবারে অবুঝ শিশু!
মল্লিকা উঠে বসল। অনেক বেলা হয়ে গেছে। মুকুল স্কুল থেকে ফিরবে এখনই। এসেই ছেলেটা ভালো কিছু খেতে চাইবে। সকালবেলা স্কুলে যাবার সময় ওকে নাশতা করাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। টিফিনেও তেমন কিছু খায় না সে, বাড়ি ফিরলে তাই ওর খাবারদাবারে দিকে মল্লিকা এবং মুকুলের দাদী বেশ মনোযোগ দিয়ে থাকেন।
জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল মেয়েটা, এখান থেকে পরিস্কার রাস্তা দেখা যায়। পাশের বাড়ির লীনা ভাবির গাড়িটা কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে এসে থামবে হয়ত, লীনা ভাবির ছেলে রনি মুকুলের সঙ্গেই পড়ে। দুজনের স্কুল যাওয়া আসাও একসঙ্গেই।
সে যাইহোক, এখন আর বসে থেকে লাভ নেই দুদিন ধরে ছেলেটা ডিমচপ খেতে চাইছে। এখন বানিয়ে রাখলে গরম গরম খেতে পারবে। দুরকমের মিষ্টিও আছে এ বেলার নাশতাটা নিয়ে অন্তত চিন্তা নেই।
তাছাড়া, সকাল থেকে ওরও কিছু খাওয়া হয়নি শাশুড়ি মা দুবার এসে নাশতার জন্য ডেকে গিয়েছেন, ঘরে নাশতা পাঠাতে বলেছেন, বারণ করেছে মল্লিকা। বলেছে, ইচ্ছে হলে সে নিজে নিয়ে খাবে এখন কিছুক্ষণ ঘুমাতে চায়।
মেয়েটা রান্নাঘরে পা রাখতেই স্যান্ডেলের শব্দে ফিরে তাকালেন মল্লিকার শাশুড়ি মিসেস রেবা। খানিকটা ঝাঁজের সঙ্গেই বললেন, বৌমা এলে? খাবার ঘরে নাশতা ঢেকে রেখেছি খেয়ে নাও।
না মা, এখন আর খিদে নেই! একটু চা খাব ভাবছি। মল্লিকা দেখতে পাচ্ছে, চুলায় আলু সেদ্ধ হতে দেয়া হয়েছে।
-তো আমাকে ফোন করে বললে না কেন, মনির মা বেরিয়ে গেল একটু আগে যাবার আগে তোমার চা টা করে দিয়ে যেত নাহয়!
-অসুবিধা নেই, আমি নিজে করে খেতে পারব। মা,আলু দিয়ে কি কিছু রান্না হবে?
আরে দুদিন থেকে দাদুভাই ডিমচপের জন্য মাথা খারাপ করে ফেলেছে। তাই ভাবলাম, এ বেলা করে দেই।
জি। মল্লিকা হাসছে।
শাশুড়ি মা বললেন, তা তোমার কী শরীর টরীর খারাপ নাকি, এতবেলা পর্যন্ত শুয়ে আছ!
না, এমনি, ভালো লাগছিল না মা! চেহারা দেখে বোঝা যায় মেয়েটা ভালো কান্নাকাটি করেছে।
তাকিয়ে আছেন মিসেস রেবা। খানিকক্ষণ একথা ও কথার পর বললেন, মল্লিকা, দেখতে দেখতে তোমাদের বিয়ের বয়স তো কম হলো না, মুকুলও বড়ো হচ্ছে, এবার তো মেজাজটার উপর একটু নিয়ন্ত্রণ আনো। তুমি ফয়সালের সঙ্গে এত চিৎকার চেঁচামেচি করলে ছেলেটা কী শিখবে? তাছাড়া, মনোমালিন্য সব স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই হয়ে থাকে ব্যাপারটা নিয়ে চেঁচিয়ে বাড়িঘর মাথায় তোলার তো কিছু নেই। তারচেয়েও বড়ো কথা, তোমার আর ফয়সালের মধ্যে ঝগড়া হলে তার গলা তো কিছু শোনা যায় না, শোনা যায় শুধু তোমার গলা!
বাড়িতে আমি আছি, তোমার শ্বশুর আছেন, আশেপাশের লোকজন প্রায়ই আসে, ব্যাপারটা একটু খেয়াল রাখো। আর ঝগড়া হলে কাল হয়েছে, বিষয়টাকে আজ আবার টেনে আনলে কেন?
তুমি তো আজ নাশতার টেবিলেই এলে না! ফয়সাল মন খারাপ করে অফিসে গেল। বুঝতেই তো পারো, সকাল বেলা অফিসে যাবার আগে ছেলেটা চায় তুমি কাছাকাছি থাকো, অথচ মেজাজ খারাপ হলে মুকুল কিংবা ফয়সাল কারো দিকেই তুমি নজর দিতে চাও না!
আরে বাবা, ঝগড়া তো তোমার শ্বশুর আর আমার মধ্যেও হয়েছে। আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল যৌথ পরিবার, শ্বশুর, শাশুড়ি,দেবর ননদ মিলে কত মানুষ! তবে কখনো কোনো কাকপক্ষীও আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারেনি। অথচ তোমাদেরকে নিয়ে রীতিমতো আলোচনা হচ্ছে! ব্যাপারটা কেমন হলো বলো তো?
মেজাজটা চড়ে যাচ্ছে মল্লিকার।কাল সবমিলিয়ে মা বড়োজোর এক দেড় মিনিটের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে থাকতে পারেন, যা থেকে কথাকাটাকাটির মূল বিষয়বস্তুর মর্ম উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তারপরও তিনি এতগুলো কথা শোনালেন!
সব দোষ ফয়সালের! সকালবেলা নিশ্চয় সে মুখ কালো করে মা বাবার সামনে এসেছে, তা দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন সবাই। আশ্চর্য এক মানুষ, যার চেহারায় মনের সব কথা লেখা থাকে! আসুক ফয়সাল বাসায়, আজ সন্ধ্যায় সম্ভবত আরেকটা ঝগড়া হবে!
মেয়েটা চোখ নামিয়ে রেখেছে।
শাশুড়ি মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, অনেক বেলা হয়ে গেল বৌমা, এবার নাশতাটা খেয়ে গোসল সেরে নাও। ছেলের জন্য বসে থাকতে হবে না তোমাকে, মুকুল ফিরলে আমি দেখব। আর ঝগড়াঝাঁটি যাই হয়েছে, হয়েছে। বিষয়টাকে আর লম্বা টেনো না। জানোই তো, দুদিনের মধ্যেই ফাইজা, জামাই আর মিনিকে নিয়ে আসছে, মাহফুজ আসবে। বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ, এরমধ্যে তুমি যদি মুখভার করে রাখো ফয়সালটা মন খারাপ করে এদিক সেদিক ঘুরবে। জামাইয়ের সামনে এসব কি ভালো দেখাবে বলো?
চুপ করে আছে মল্লিকা।
মা বললেন, এক কাজ করো ফয়সালের সঙ্গে আজ তুমি নাহয় কাছাকাছি কোথাও থেকে ঘুরে এসো বা শপিঙে যাও। দুজনেরই ভালো লাগবে।
মেয়েটা মনে মনে বলল, আগামী দশদিনেও এমন কিছু করার ইচ্ছে আমার নেই মা! আপনি কেবল পরিবার এবং ফয়সালকে নিয়েই বেশি ভাবছেন। তারচেয়ে বরং আমার মনের দিকে তাকিয়ে আপনার ছেলেকে দুটো কথা শোনালে ভালো লাগত!
মল্লিকা চোখ তুলে তাকাতেই হানিফ সাহেব উঁকি দিলেন দরজায়, বললেন, এককাপ চা পাওয়া যাবে?
এই যে! তুমি এসেছ আবার চায়ের কথা বলতে, একটু আগেই না এক কাপ দিলাম! আরে দুপুরের রান্না চড়াব এখন! ধমকে উঠলেন মিসেস রেবা।
শব্দ করে হেসে ফেলল মল্লিকা। ভীষণ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো,মা, আপনি কি কথাটা এখন আস্তে বলেছেন? কিন্তু মেয়েটা চেপে গিয়েছে।
ও হানিফ সাহেবকে বলল, বাবা, ড্রইং রুমে গিয়ে বসুন চা আমি নিয়ে আসছি। নিজেও এক কাপ খাব তো, আপনার জন্যও বানিয়ে দিচ্ছি।
হ্যাঁ বৌমা তাহলে তো বেশ হয়। জলদি এসো! আমিও সকালে তেমন একটা নাশতা করিনি দুজনে একসঙ্গে খাব। তুমি টেবিলে না থাকলে নাশতা করে মজা পাওয়া যায় না আসলে, তখন কেবল একজনের খবরদারিই চলে! হানিফ সাহেবের ইঙ্গিতটা মিসেস রেবার দিকে স্পষ্ট।
জি বাবা আসছি। মেয়েটার চেহারায় মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে হালকা বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন মিসেস রেবা। আশ্চর্য! ছেলের বৌয়ের সামনে এভাবে বলতে হবে? মাঝেমধ্যেই মল্লিকার সামনে তাকে হালকা খোঁচা দিয়ে কথা বলেন হানিফ সাহেব, এতে মেয়েটা বেশ মজা পায়। আসলে ফয়সাল এবং তার বাবার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই।
ঘড়িতে সময় রাত আটটা। এমন সময় এক কাপ চা এবং হালকা নাশতা খাওয়ার অভ্যাস ফয়সালের। ও অফিস থেকে ফিরেছেও বেশ কিছুক্ষণ, হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বসে আছে, কিন্তু চা নাশতার দেখা নেই।
যার প্রধানত দুটো কারণ হতে পারে এক, কাল বিকেলে ছোট মামা আসছেন তাছাড়া, দু একদিনের মধ্যে ফাইজা আসবে সবমিলিয়ে বাড়িতে বেশ তোরজোর চলছে। রান্নাবান্না, ঘরদোর গোছানো, এরমধ্যে হয়ত আলাদা করে সন্ধ্যার নাশতা তৈরি হয়নি। তবে চাটা আসতে সমস্যা কোথায়! সেটা আসছে না দ্বিতীয় কারণে, কেন না, মল্লিকা রেগে আছে।
বাইরে গিয়ে একটু হাঁকডাক দেয়ারও উপায় নেই। একে তো টুটুলের টিচার এসেছে বাসায়, ছেলেটা পড়ছে। বাবা ড্রইংরুমে বসে খবর দেখছেন, তার উপর পাশের বাসার খালাম্মা এসে মায়ের সঙ্গে আড্ডা জুড়েছেন।
আর মল্লিকা, সে এ মুহূর্তে কোথায় আছে জানা নেই! হয়ত আশেপাশের কোনো রুমে বসে মৌনী আপুর সাথে ফোনে গল্প করছে।
ইশ! কেন যে মেয়েটা এত কষ্ট পেল, ওভাবে দুলাভাইকে না করাটা আসলেই উচিত হয়নি। বেড়াতে যাবার কথা উঠতেই অবস্থাটা মল্লিকাকে বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল! ভুলই হয়ে গেছে।
আজ সারাদিনে একটা ফোন করেনি মল্লিকা, ফয়সাল কী করে বলবে বিয়ের এতবছর পরও মেয়েটা এভাবে রাগ করলে ওর কাছে কতটা অসহায় লাগে!
দু এক মিনিট উশখুশ করে সে বিছানা ছাড়তে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময় ট্রে সাজিয়ে মল্লিকা ঘরে ঢুকল।
চলবে
কেউ লেখা কপি করবেন না।