ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০৩ #আসেফা_ফেরদৌস

0
334

#ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০৩
#আসেফা_ফেরদৌস

তিনদিন পর।
বাড়ির সামনের রাস্তায় সিএনজি টা এসে থেমেছে, একগাদা প্যাকেট হাতে নিয়ে নামল মল্লিকা। ফাইজাকে সঙ্গে নিয়ে ও‌ বেরিয়েছিল, ফাইজা কিছু শপিং করবে বলল, ভাবি তুমিও সঙ্গে এসো! কোথাও বেরুবার ব্যাপারে মল্লিকার আগ্ৰহ সবসময়ই তুঙ্গে তাই সে সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু এখন চিন্তাটা অন্য‌ জায়গায় ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছে বেশ, বাড়িতে বাবা, ছোটো মামা, ফয়সাল, শামীম, মিলিয়ে চারজন আড্ডাবাজ মানুষ, সঙ্গে মুকুল, মিনি তো আছেই, মুকুল বড়ো হলেও মিনি তো একদম শিশু তার উপর আজ ছুটির দিনে মনির মাও ছুটি নিয়ে বসে আছে! সব মিলিয়ে মিসেস রেবার উপর চাপ পড়ে যাবে সন্দেহ নেই। এরমধ্যে মল্লিকা এবং ফাইজা এতক্ষণ বাইরে মা নিশ্চয় বকবেন!
সে যাইহোক, মল্লিকা ব্যাগে হাত দিতেই ফাইজা চিৎকার করে উঠল। বলল, না, না, ভাবি, যাবার সময় ভাড়া তুমি দিয়েছ,এখন আমি দেবো!
আ্যই চুপ! একদম বাজে বকবি না! ভাবির সঙ্গে বেরিয়েছিস যখন ভাড়া নিয়ে ভাবতে হবে না তোকে! ভাড়া আমিই দেবো, তুই বরং মাকে কীভাবে সামলাবি সেই বুদ্ধি বের কর, আজ ধমক খেতে হবে!
সেই বুদ্ধি আমাকে বের করতে হবে কেন, এসবের জন্য তোমার বরই তো যথেষ্ট! ছোটো ভাইয়ার সামনে তোমাকে কেউ কিছু বলেই দেখুক না, সঙ্গে সঙ্গে, সাফাই গাওয়া শুরু হয়ে যাবে! ভাইয়া তো বাড়িতেই, তোমার আর চিন্তা কী! ফাইজার কন্ঠে ঠাট্টা।
মল্লিকা হাসছে। ভাড়া মিটিয়ে তাড়া দিয়ে বলল, চল, চল, আর দেরি করে লাভ নেই! এমনিতেই যথেষ্ট আড্ডা হয়ে গিয়েছে!
হ্যাঁ চলো!
সিঁড়ি টপক বাড়ির দরজায় এসে বেল বাজিয়েছে মেয়েরা। খানিক পর মিসেস রেবা দরজা খুললেন। রাগে মায়ের পুরো চেহারা লাল হয়ে আছে। মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, বাসায় ফেরার আর দরকারটা কী ছিল? বাইরেই থাকতে নাহয়!
সরি মা! মেয়ে দুটো একসঙ্গে বলল। ওরা মুখ নামিয়ে ঘরে ঢুকছে। আসলেই দেরি হয়ে গিয়েছে অনেক!
মিসেস রেবা বলে চলেছেন, আমাকে এমন চাপের মধ্যে ফেলে তোমরা দুজন বাইরে বাইরে হাওয়া বাতাস খেয়ে বেড়াচ্ছ, এটা একটা কথা! আ্যই ফাইজা,আজ মার্কেট না গেলে কী এমন সমস্যা হয়ে যেত?
প্রয়োজন ছিল মা, তাছাড়া, আমার জন্য তো না, মিনির জন্য কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম!
হ্যাঁ এখন এটাই তো বলবি! নিজের জন্য কি কম কিছু কিনে ফিরেছিস? আমি কি জানি না, মার্কেটে গেলে তোর হুশ জ্ঞান কেমন থাকে! বাচ্চার মা হয়ে গিয়েছিস, এখনো বাচ্চামো গেল না!
আর বৌমা, সঙ্গে যে গেলে, তোমারও কি মাথা কাজ করেনি? বাসায় মেহমান,বাহারি রান্নাবান্না চলছে, কতরকমের কাজ, মনির মা আসেনি, মুকুল, মিনি,তার উপর তোমরাও বাসায় নেই! আচ্ছা আমি একা মানুষ, কতদিক সামলাব! এরমধ্যে ফাওয়াজ, লতা ভিডিও কল দিয়ে একঘন্টা আড্ডা জুড়ল! তাছাড়া, মাহফুজ আর তোমার বাবা, একটু পর পর খালি চায়ের আবদার করে, বাসায় শামীম আছে খালি চা কি পাঠানো যায় বলো!
শামীম? সেও কি একটু পর পর চা খাচ্ছে নাকি, আশ্চর্য তো! বাসায় কয় কাপ খায়? দাঁড়াও মা, আমি এক্ষুনি গিয়ে ওকে একটা ধমক লাগাচ্ছি! ফাইজা চটে গিয়েছে।
আ্যই থাম! তোকে আর পাকামো করতে হবে না! ভাইবোন দুটো হয়েছে একরকম, একেবারে আক্বেল বুদ্ধি নেই! তুমি যে বৌমা মাঝে মাঝে ফয়সালের ক্লাস নাও ঠিকই করো আসলে!
মল্লিকা চুপচাপ শুনছিল এতক্ষণ, এবার হেসে ফেলল। বলল, কী হয়েছে মা?
কী আর হবে, এমনিতেই আমি চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি,তার উপর ফয়সাল তার খালা খালুকেও দাওয়াত করে এসেছে। সোমাকে সে বলেছে, ছোটো মামা, ফাইজা এসেছে, খালামনি তুমিও খালুকে নিয়ে চলে এসো! ওরা আজ‌ বিকেলে আসবে!
আহারে ছোটো ভাইয়া! বাড়িটাকে কলকাকলি মুখর করতে চায় আরকি! ফাইজা হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছে! জোর করে হাসি ঠেকিয়ে রেখেছে মল্লিকা।
আরে ঘটনার কী এখানেই শেষ নাকি, ছেলেটা কোত্থেকে বারো চৌদ্দ বছরের পুরনো এক বন্ধুকে ধরে নিয়ে এসেছে তার সঙ্গে শুরু হয়েছে আড্ডা! আড্ডা তো শুধু আড্ডা না, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেবল বউয়ের প্রশংসা! মা বাবা, মামা, ছোটো বোনজামাই সবাই যে সামনে বসা সে ব্যাপারে ফয়সালের কোনো খেয়ালই নেই!
মল্লিকা বলতে গেলে বিস্মিত, কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলল, হায় আল্লাহ!
উচ্ছল হাসিতে ফেটে পড়েছে ফাইজা। বলল, ভাবি ভাইয়ার মাথায় তোমার চিন্তাটা যে খুব বেশি ঘোরে বোঝা গেল। একসঙ্গে দশটা বছর পার করার পরও এমন গদগদ প্রেম! আহা! ভাগ্য বটে তোমার!
আরে ঠাট্টা তামাশা রাখ এখন, একটু আমার সঙ্গে এসে হাত লাগা! তুইইবা ফয়সালের চেয়ে কম কীসে!
জি মা, আমরা হাতমুখটা ধুয়ে আসছি! মল্লিকা তাড়াহুড়ো করে বলল।
ওরা ঘুরতেই ফয়সাল পড়ল সামনে, ফাইজাকে দেখতে পেয়ে হালকা চটে গিয়েছে সে। বলল, আ্যই মিনিকে যে বাসায় রেখে গিয়েছিস খেয়াল নেই? এতক্ষণ কীসের বাইরে থাকা, তাছাড়া, বড়ো ভাইয়া, ভাবি আমাদের সবার সঙ্গে কথা বলতে ফোন করল, কিন্তু তুই আর মল্লিকা তো বাড়িতেই ছিলি না!
অসুবিধা নেই, বড়ো ভাইয়া, ভাবিকে আমি কল ব্যাক করব, এটা এমন কী সমস্যা! আর মিনির বাহানা না দিয়ে সোজাসুজি বলো না, ভাবিকে নিয়ে এতক্ষণে বাইরে যে ছিলাম এটাই ভালো লাগেনি তোমার!
আশ্চর্য! কীসের কথা নিয়ে কীসে লাগাচ্ছিস, আমি তো মিনির কথা ভেবে বললাম। মেয়েটা তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে শেষ! মা, আমি আর শামীম পালাক্রমে কোলে রেখেছি! তাই বললাম, আফটার অল মিনির ছোটো মামা হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না!
আহারে মিনির ছোটো মামা! তা আমাকে একটা ফোন করলেই পারতে!
ওহো! তোমরা ননদ, ভাবি ওভার এক্সাইটমেন্টে ফোনটা যে বাসায় ফেলে গিয়েছ মনে নেই?
জিভ কাটল ফাইজা।
আ‌্যাই তুমি হাত মুখটা ধুয়ে জলদি এসো তো! সেই কখন থেকে আরফানকে বসিয়ে রেখেছি! আমার এক সময়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড।
ফয়সাল কথাটা বলতেই কটমট করে তাকালেন মিসেস রেবা, একপর্যায়ে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে‌ গেলেন।
ব্যাপারটা মাথায় ঢোকেনি ছেলেটার, একটু অবাক হয়ে ও বলল, মা এমন করল কেন?
ফাইজা হাসি থামাতে পারছে না, মল্লিকা একটু রেগে গিয়ে বলল, তোমার আক্কেল বুদ্ধি হবে কখন হ্যাঁ?
কেন আমি আবার কী করলাম?
না, না, ছোটো ভাইয়া তোমার কোনো দোষ নেই, অযথাই সবাই এমন করে! আ্যই ভাবি, তুমি হাতমুখটা ধুয়ে ভাইয়ার সঙ্গে ড্রইং রুমে যাও, মায়ের কাছে আমি যাচ্ছি! ঘুরে হাঁটতে শুরু করেছে ফাইজা, বোঝাই যায় সে হাসছে।
কী হলো ব্যাপারটা! ফয়সাল কিছুই বুঝতে পারছে‌ না!
কিছু না। তুমি ড্রইং রুমে যাও। আমি হাতমুখ ধুয়ে, কাপড়টা বদলে আসছি!
প্রায় পনেরো বিশ মিনিট পর ড্রইং রুমে এসে ঢুকল মল্লিকা। ফয়সাল ওর মুখোমুখি সোফায় বসা, সঙ্গে শামীমও আছে। আর বন্ধু ভদ্রলোক উল্টোদিকের সোফায়, যার চেহারা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না!
মল্লিকা ঢুকতেই ফয়সাল বেশ বিগলিত হয়ে বলল, এসো, এসো, তোমার সঙ্গে দেখা করতে আরফান অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে।
হাসিমুখে এগিয়ে গেল মেয়েটা, কিন্তু সামনে যাকে চোখে পড়ল তাকে এ বাড়িতে, ফয়সালেরই বন্ধু হিসেবে দেখার জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
ফয়সাল বলে চলেছে, তো পরিচয় করিয়ে দেই, আরফান, এই হচ্ছে তোমার ভাবি মল্লিকা, এতক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যার গল্পই করলাম। আর মল্লিকা, ও আরফান, আমার বন্ধু ঠিক না, ছোটো ভাইয়ের মতো বলতে পারো, এক সময় এ এলাকায় ওর প্রায়ই আসা যাওয়া ছিল, আরফানের মেজ ফুপু থাকতেন এখানে, ও এলে মিন্টু ভাইয়ের চায়ের দোকানে প্রায়ই আড্ডা বসত আমাদের। তবে সেও আরও বারো তেরো বছর আগের কথা, রুনা খালাম্মা বাসা বদলের পর অবশ্য আর দেখা হয়নি। আজ হঠাৎ দেখলাম, তাও আমি একদেখায় চিনতে পারিনি। ও চিনেছে আমাকে। সে কিছুতেই আসবে না, রীতিমতো ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছি।
আরফান আর মল্লিকা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে, কখনো তো ভাবেনি জীবনে এভাবে আবার দেখা হবে, একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে ভিন্ন পরিচয়ে!
আরফানের চোখে ভীষণ মিষ্টি লাগছে মল্লিকাকে, চেহারায় বয়সের বিন্দুমাত্র ছাপ পড়েনি। চুলগুলো সামন্য ধুসর হয়েছে আগের মতো অতটা কুচকুচে কালো নেই, ছেলেটা ভাবছে, এই মেয়েটা ফয়সাল ভাইয়ের স্ত্রী, তার সন্তানের মা, ভাগ্যে বটে! তবে জীবনের ফেলে আসা বাঁকে মল্লিকার সঙ্গে তারও যে একটা গল্প রয়ে গেছে।
মল্লিকার চোখের বিন্দু বিন্দু জল, ভেতরে কান্না যেন গুমরে উঠছে। ভাবছে, ছেলেটার ওজন বেড়েছে ভালোই, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কিছুটা উদ্ভ্রান্ত লাগছে দেখতে, কিন্তু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায় ও দেখতে এখনো আগের মতই সুদর্শন! আরফান নামটা তো মল্লিকা ভুলেই গিয়েছিল, আসলে ওকে এ নামে ডাকা হয়নি কখনো। ওরা পরস্পরকে ভিন্ন নামে ডাকত!
ফয়সাল গড়গড় করে বলে যাচ্ছে কিছু, কিন্তু কথাগুলো আরফান কিংবা মল্লিকার খুব একটা কানে ঢুকছে না। অতীত স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়েছে ওরা!
ঘড়িতে সময় বিকেল তিনটে পঁচিশ। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ, গেস্ট রুমে থাকতে দেয়া হয়েছে আরফানকে, বিকেলে চা নাশতা করে যাবার কথা। ও থাকতে চাইছিল না, কিন্তু ফয়সাল ছাড়লে তবে তো! একপর্যায়ে মেনে নিতে হয়েছে। টেবিলে মল্লিকাকে খাবার দাবার এগিয়ে দিতে দেখে, ফয়সালের পাশে বসতে দেখে, ওর হাসি ঠাট্টায় সায় দিতে দেখে, এই পরিবারেরর সবার সঙ্গে একদম মিলেমিশে যেতে দেখে মনটা কেমন অনুভূতি শূন্য হয়েছে তা বলে বোঝানো মুশকিল! ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে এটাই কি দেখার বাকি ছিল? সবই ভাগ্য!

চলবে
কেউ লেখা কপি করবেন না।

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1505355926646096/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here