ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০৯ #আসেফা_ফেরদৌস

0
306

#ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০৯
#আসেফা_ফেরদৌস

মল্লিকা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল এতক্ষণ, এবার চমকে উঠল। ফয়সাল তাহলে ওকে আরফানের সঙ্গে কথা বলতে দেখে ফেলেছে! এজন্যই কি ওর এভাবে বদলে যাওয়া?
একটু ঘাবড়ে গিয়ে মেয়েটা বলল, ফয়সাল শোনো!
আমার কথা এখনো শেষ হয়নি মল্লিকা, প্লিজ শেষ করতে দাও। ফয়সালের কন্ঠটা একদম স্বাভাবিক।
খানিক্ষণের নীরবতা, এরপর ছেলেটা আবার বলতে শুরু করল, তো, সেদিন, সেদিনই আমি জানলাম যে, তুমি আসলে সুখী হতে পারোনি, যদিও এখানে তুমি খুব একটা খারাপ নেই! এখনো তোমার অনেক আক্ষেপ, অনেক বেদনা এমন রয়ে গেছে যা হয়ত আমাকে বলা যায় না! আশ্চর্য! কেন বলা যায় না মল্লি? আমার আচরণে যদি তুমি এতটাই আঘাত পেয়ে থাকো যে নিজেকে তোমার অবহেলিতই মনে হয়, বা আমাকে তোমার এবং তোমার পরিবারের প্রতি উদাসীন, তবে কথাটা সরাসরি আমাকে বলাই কি শ্রেয় নয়?
ওহ্ সরি! তুমি তো অনেকবারই তর্কের ছলে বলেছ, অনেকভাবে বলেছ, অথচ আমিই বোকা, কথাগুলোকে তোমার রাগের মাথায় বলা কথার কথা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছি! সরি হ্যাঁ!
মল্লিকা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো ভিজে আসছে বারবার। এতক্ষণ ওভাবে খেয়াল করেনি ফয়সাল, হঠাৎ চোখে পড়তেই ধাক্কা খেলো একটু, বলল, ছি,ছি, মল্লিকা! তুমি কাঁদছ কেন? তোমাকে তো কখনোই খুব একটা কান্নাকাটি করতে দেখিনি, তাই আজ এভাবে কাঁদলে আমার খারাপ লাগবে। তুমি আরফানের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেছ, তাতে সমস্যাটাই বা কী! আরফান তোমার অতীত, সেটাও আমার জন্য তেমন কোনো সমস্যা না আসলে, এমন অতীত তো অনেকেরই থাকে, আমারও থাকতে পারত। তাছাড়া, আমি জানি, অতীত তোমার জন্য অতীতই! তাকে তুমি কখনোই বর্তমানে টেনে আনতে চাও না। আরফানকেও তো তুমি তাই বললে। আরফানের ব্যাপারে আমাকে তুমি আগে থেকে বলতে পারোনি সেটাও নাহয় মেনে নিলাম। বুঝতে পারছি, বিয়ের আগে তোমার সাহসে কুলায়নি আর বিয়ের পর এসব আলোচনা টেনে আনতে তুমি সাচ্ছন্দ্য বোধ করোনি! যদিও আমি কিন্তু বেশ কবারই জানতে চেয়েছিলাম, কখনো সরাসরি, কখনো বা ঠাট্টার ছলে। কিন্তু যতবারই আমি জানতে চেয়েছি, তুমি কথাটা ঘুরিয়ে ফেলেছ!
আচ্ছা, তুমি তো আমাকে খুব ভালো করে চেনো, আমাদের মধ্যে ভয়, অস্বস্তি, বোঝাপড়ায় সমস্যা, কোনোটাই নেই, তারপরও কেন বলতে পারলে না বলো তো?
দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে মল্লিকা, কিন্তু চোখের পানি থামেনি। হয়ত এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া ওর জন্য এ মুহূর্তে কঠিন।
ফয়সাল বলল, আমি বলি কেন? কারণ, তুমি তোমার অতীতের ভালোলাগা, মন্দলাগা, কিংবা আনন্দ বেদনায় আমাকে সামিলই করতে চাওনি!
না ফয়সাল! এটা সত্য না!
মল্লিকা বেশ জোর দিয়ে বলেছে কথাটা। কিন্তু সম্ভবত ফয়সালের কাছে এই আশ্বাস আজ গ্ৰহণযোগ্য নয়।
একটু ঠাট্টার ছলে ও বলল, না? আচ্ছা, বাদ দাও! অতীত নিয়ে মন খারাপ করে আমাদের বর্তমানে কষ্ট পাবার কিছু নেই, যা হবার হয়ে গেছে!
তাহলে তুমি কেন এত কষ্ট পাচ্ছ, অন্তরকে এমন কী বলেছি আমি যে তোমাকে এভাবে কষ্ট পেতে হবে? মল্লিকার ছটফটানি বুঝতে কষ্ট হয় না।
ফয়সালের হাসছে চুপচাপ। বলল, হ্যাঁ আমার কষ্ট পাবার মতো এমন কীইবা বলেছ তুমি! কিছুই তো বলোনি, আরে আরফানকে কী বলবে, আমাকেই তো বলোনি! আমি জানতাম না তোমার অনেকগুলো স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে, জানতাম না তোমার ভেতরে এ নিয়ে প্রতিদিন আক্ষেপ গুমরে কাঁদে, জানতাম না, প্রকৃতির সাথে তুমি অতীতের কথা বলো! কী বলবে, আমি জানতে চাইনি? অবহেলা করেছি তোমাকে, তা তো নয়! আমি তো বারবার জানতে চেয়েছি! তোমার স্বপ্ন নিয়ে, জীবনের লক্ষ্য নিয়ে, অথচ তুমি বলতেই চাওনি! এসব তো ছাড়ো, আমি তো এটাও জানতাম না যে, তোমার আরেকটা নাম আছে, মিতু!
মিতু আমার নাম নয়!
হ্যাঁ নাম নয়, কিন্তু এই নামটা যে তোমার হতেও পারত, কিংবা এর পেছনে যে গল্পটা, সেটাও তো তুমি আমাকে কোনোদিন বলোনি!
মল্লিকা কী বলবে জানা নেই! চোখ নামিয়ে ও কাঁদছে চুপচাপ।
ফয়সাল বলল, আমি ফাইজা শামীমের ঘরে দাবা খেলছিলাম, হঠাৎ দেখলাম, তুমি পাশে নেই। খুঁজতে খুঁজতে গেস্ট রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ তোমার কন্ঠ শুনে থমকে দাঁড়াতে হলো! সেই আমিই‌ কিনা একপর্যায়ে শুনলাম, তোমাকে মনে করার মতো অবসর আমার হবে না!
অবসর হবে না? সত্যি? তুমি বুঝি এমনটাই বিশ্বাস করো?
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মেয়েটা, কিন্তু হাত তুলে থামতে বলল ফয়সাল। বলল, আচ্ছা, তোমার পেছনে ঘুরঘুর করে যেই আমাকে রোজ হাসির পাত্র হতে হয়, তাকেই কেন এমনটা শুনতে হলো? তাছাড়া, এখানেই তো শেষ নয়! শুনলাম, এখানে তুমি খুব একটা খারাপ নেই!
খারাপ নেই বললে সমস্যাটাই বা কি? মল্লিকা বলতে গেলে অস্থির!
শব্দ করে হাসল ফয়সাল, একটু থেমে বলল, সমস্যাটা যে কী, তা তুমি ঠিকই বুঝতে পারতে যদি এমন কিছু আমি আমার অতীতের প্রেমিকাকে বলতাম, প্রেমিকা বাদ দাও, আমি যদি ঠাট্টার ছলেও এমন একটা কথা আমার বন্ধুবান্ধবদের কাউকে বলতাম, তবে তুমি চেঁচিয়ে, বাড়িঘর মাথায় তুলে, একপর্যায়ে কথা বলা বন্ধ করে দিতে! আর তুমি তো কথাটা সিরিয়াসলি বলেছ!
তাকিয়ে আছে মল্লিকা। জানে, সহজ সরল মানুষের মনে ছোট্ট একটা কথাও অনেক সময় মারাত্মক আঘাত হানতে পারে। ছেলেটার বেলায় এমনই হয়েছে। তাছাড়া, ফয়সাল জানতই না মল্লিকার কোনো অতীত আছে! তাই হয়ত আঘাতটা লেগেছে বেশি!
ফয়সাল বলল, মল্লিকা, খারাপ নেই আর ভালো আছির মধ্যে একটা সুক্ষ্ম কিন্তু গভীর পার্থক্য পার্থক্য আছে। একটার অর্থ মানিয়ে নেয়া, অন্যটার অর্থ সুখে থাকা! সেটা তুমি জানো নিশ্চয়।
বুঝলাম, বহুবছর পর নিজের পুরোনো ভালোবাসাকে সামনে দেখতে পেয়ে তুমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছ, নিজের কষ্ট‌গুলো জলজ্যান্ত হয়ে চোখের পর্দায় ভেসেছে হয়ত, আরফানের উদ্ভ্রান্ত জীবন কিংবা তার কৌতূহলের সামনে নিজের বেদনা লুকাতে পারোনি তুমি, জীবনের আক্ষেপ করে বসেছ, স্মৃতিচারণ করেছ, ঠিক আছে! কিন্তু যখন আমার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলো, তখন কি তোমার বলার মতো কিছুই ছিল না? একটা বাক্যও না! তোমার সংসারের মায়ায় আমার জন্য কোনো অনুভূতি নেই কি?
মল্লিকা উত্তর গুছিয়ে নেবার আগেই ফয়সাল বলল, কেন? আমি তো তোমাকে মন থেকে ভালোবেসেছি, আগলে রেখেছি, জীবনের সুখ দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি তোমার সঙ্গে, সাধ্যমতো তোমার সব আবদার মেটানোর চেষ্টা করেছি, তারপরও উদাসীনতা আমার বৈশিষ্ট্য হলো কেন? আমাদের মাঝে একটা জীবন, জীবনের গল্প, ভালোলাগা, ভালোবাসা, হাসি, কান্না, মান, অভিমান, অনুনয়, আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি, মুকুল, এতকিছু! এবং আনন্দ বেদনায় দুজন দুজনার হয়ে দশটা বছর পার করার পরও সেদিন তোমার ঐ নির্লিপ্ততার কী মানে! তবে কি আমার মল্লিকার দৃষ্টিতে আমি শুধুমাত্র একটা খামখেয়ালির মানুষ! তোমার রাগ জেদ, বিরক্তি, কুঁচকে যাওয়া কপাল শুধুই কি আমার জন্য?
ফয়সাল, রেস্ট করো প্লিজ,পরে তোমার শরীরটা একটু ভালো হলে আমরা কথা বলব! মল্লিকার কন্ঠে স্পষ্ট অনুনয়।
তাকিয়ে আছে ফয়সাল একটু দম নিয়ে বলল, মল্লিকা, আমার দুলাভাইয়ের মতো ভালো চাকরি নেই, ভাইয়ার মতো ভালো রেজাল্ট কিংবা বড়ো ডিগ্ৰী নেই, দেখতে আমি শামীমের মতো সুন্দরও না, আমি সব পরিবেশে হেসে খেলে মানিয়ে নিতে পারি না, একদম সাধারণ একটা মানুষ আমি। কিন্তু এই সাধারণ মানুষটার সত্যিকারের ভালোবাসার কি কোনো মূল্যে নেই? আমার ইমোশন কি তোমার চোখে অমূল্য হতে পারে না?
কেন পারবে না, অবশ্যই অমূল্য ফয়সাল!
হ্যাঁ অমূল্য! এখন তো বলাটা সহজ! বিয়ের আগে আমি প্রেমটেম করিনি মল্লি, আর প্রেমে ব্যর্থ হওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার! তাই বলতে পারব না হঠাৎ করে ব্যর্থ অতীত সামনে এসে দাঁড়ালে মানুষ ক্ষনিকের জন্য হলেও বর্তমানের সুখ বেমালুম ভুলে যেতে বসে কিনা! নাকি আমাদের মধ্যে বলার মতো তেমন হৃদয়ের টান সৃষ্টিই হয়নি! আচ্ছা, তুমি কি আজও আমায় ততটা ভালোবাসতে পারোনি, যতটা ভালোবাসলে তোমার ভীষণ প্রিয় হওয়া যেত, এমনই প্রিয়, যার কথা না চাইলেও মুখে চলে আসে! উত্তর দিয়ো না, আমি নিতে পারব না!
ফয়সাল, একদম উল্টো পাল্টা ভাববে না প্লিজ!
ফয়সাল হাসছে। মল্লিকাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমার কাছে আমার এ অভিযোগ অহেতুক বা অবান্তর মনে হচ্ছে বোধহয়, হয়ত ভেতরে ভেতরে রেগেও যাচ্ছ, কিন্তু আমি নিরুপায়, মনটা একটু হালকা করতে কথাগুলো যে তোমাকে বলতেই হবে!
না, না, আমি মোটেও রেগে যাইনি ফয়সাল বিশ্বাস করো, কথাগুলো বলে তুমি বরং ভালোই করেছ, নয়ত ভুলবোঝাবুঝি বাড়ত শুধু শুধু! আমার পুরো ব্যাপারটা পরিস্কার করতে একটু সময় লাগবে এই যা!
আমি তোমাকে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি করিনি মল্লি, জবাবও চাইছি না যে ব্যাখ্যা দিতে হবে। মনের ভাবনাগুলো তোমার কাছে ব্যক্ত করছি কেবল! এর বেশি কিছু না, অযথা টেনশন নিয়ো না। তাছাড়া, উত্তর জেনেই বা কী হবে, কিছু কিছু কষ্ট পেরিয়ে যাওয়া সময়ের সাথেই যায়! দশটা বছর চাপা একটা কষ্ট তো আমি ভোগ করেছি, আমার কেমন লাগছে আশা করি বুঝতে পারছ!
হঠাৎ ফয়সাল হাসল একটু, এরপর প্রসঙ্গ ঘুরে গেল একদম ভিন্ন দিকে। খানিক চুপ থেকে ও বলল, আমাকে তুমি সবসময়ই বেশ ধুমধাম করে জন্মদিন উদযাপন করতে দেখেছ, অথচ আগে ব্যাপারটা এমন ছিল না কিন্তু! নিজের জন্মদিন আমি একদম সাদামাটভাবে শুধুমাত্র কাছের বন্ধুদের নিয়েই উদযাপন করতাম, বাসায় হয়ত একটা কেক আসত ব্যাস এটুকুই!
কিন্তু হঠাৎ করে হিসাব নিকাশটা পাল্টে গিয়েছিল, আমার এক জন্মদিনে বন্ধুরা ধরে বেঁধে নিয়ে গেল মার্কেটে, উদ্দেশ্য কিছু কিনে ‌দেবে, সেখানেই তোমাকে প্রথম দেখি, তুমি তোমার বান্ধবী কলির সঙ্গে ছিলে, না তখনো পারিবারিকভাবে আমাদের দেখা হয়নি। শুধু বায়োডাটার সঙ্গে থাকা ঐ ছবিটা দেখেছিলাম, আমি অবশ্য দেখতেই চিনলাম, বারবার তাকাচ্ছিলাম তোমার দিকে, তুমি যদিও লক্ষ্য করোনি। কিছু না কিনেই বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন, আসলে তোমাকে দেখার পর থেকেই পেছন পেছন ঘুরছিলাম, তাই তোমরা বেরিয়ে যাবার পর আর থাকতে ইচ্ছে হয়নি। তোমার সঙ্গে অনাগত আগামীর স্বপ্ন দেখেছিলাম বারবার। ভাগ্যক্রমে এর কিছুদিন পরই আমাদের বিয়ে হয়! এরপর থেকেই আমি জন্মদিনটা বেশ ধুমধাম করে পালন করি, আফটার অল জন্মদিনের পাশাপাশি আমাদের প্রথম দেখা বলে কথা!
তবে আজ কয়েক বছর ধরে দেখছি আমার এই উদযাপন নিয়ে বাড়াবাড়ি পরিবারের সবার বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছে! মা এবং তুমি তো বিরক্ত হওই, এমনকি মুকুল পর্যন্ত মুখ লুকিয়ে হাসে! তাছাড়া, নিজের আনন্দের জন্য কারও কাছে আবদার বা জেদ করে যে সুখী হওয়া যায় না, এই সত্যটা আমি এতদিনে বুঝেছি! সেজন্যই এবারের জন্মদিনটা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আমি আগের মতোই উদযাপন করতে চাই! আমাদের প্রথম দেখার উদযাপনটাও এবার আমি একান্ত নিজের করে রাখতে চাই। সবসময় তো মুখের উপর স্বার্থপরই ডাকো, এবার নাহয় সত্যি সত্যি একটু স্বার্থপর হয়েই দেখি! আর সত্যি বলতে সেদিন আমাকে তো তুমি ‌লক্ষ্য করোনি, কেবল আমিই তোমাকে দেখেছিলাম! কথাটা তোমাকে কোনদিন বলব এমন ইচ্ছেও ছিল না, কেন জানি না আজ বলে বসলাম।

চলবে
কেউ লেখা কপি করবেন না

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1515115962336759/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here