#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:২৪
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
নির্জন কক্ষে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে অধরা। জুবায়ের ল্যাপটপ নিয়ে কিছু একটা করছে। সকাল সকাল জুবায়ের ওকে বেকুব মহিলা বলে তিরস্কার করেছে যার দরুন অধরা অপমানবোধ অনুভব করেছে। কারার কথা,কারণ আজ অবধি যত ঝামেলা হয়েছে সবটা অধরা নিজ বুদ্ধিতে সামলে নিয়েছে। জুবায়েরের মতো রাগচটা দানবাকৃতির মানবকে বশে এনেছে। এমন মহান নারীকে কি আর বেকুব মহিলা খেতাবে মানায়? বিষয়টা খুব দৃষ্টিকটু। এত বড় একটা কথা বলেও জুবায়েরের মধ্যে কোনো আফসোস নেই। থাকবেই বা কেনো। মেয়েটা হুট করে একটা বাইরের ছেলেকে নিজের বিবাহিত মেয়ের কক্ষে নিয়ে এসেছে। বিষয়টা একদম ঠিক হয়নি। সেই থেকে দুজনের কথা বলা বন্ধ। কহিনুরের জ্বর কমেছে কিন্তু শরীর দুর্বল এই যা। তাই ওরা নিজের কক্ষে ফিরে এসেছে। জুবায়ের ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে অধরাকে দেখে নিলো। কিছু একটা ভেবে বলল,
> রাত হয়েছে না ঘুমিয়ে বসে আছো কেনো? বাচ্চাদের মতো আচরণ করছো। ভুলভাল কাজকর্ম করছো হয়েছেটা কি তোমার? আমাকে ছাড়া ঘুম আসছে না বললেই হয়। কাছে এসো।
জুবায়ের ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো কিন্তু অধরা তাঁকালো পযর্ন্ত না। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে না করে পিছনে ফিরে বসলো। জুবায়েরের মুখ কালো হয়ে গেলো। বউয়ের রাগ হয়েছে ভালো করে বুঝেছে কিন্তু সেই সময় রাগের মাথায় দুমকরে মুখ দিয়ে কথা বেরিয়ে গেছে। কথা হচ্ছে বন্দুকের গুলির মতো একবার বেরিয়ে গেলে কি আর ফিরিয়ে আনা যায়? ল্যাপটপ সামনে রেখে ও অধরার সামনে গিয়ে বসলো। ওর মুখটা জোরকরে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> আচ্ছা বলোতো কহিনুর কে তুমি এতদিন লুকিয়ে কেনো রেখেছিলে? নিজের রিসোর্টে পযর্ন্ত তুমি বোরখা পরে চলাফেরা করেছো। কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন কোথাও যাওনি সবটাই তো মেয়েটার জন্য তাই না?
জুবায়েরের বলা কথাগুলো ও মন দিয়ে শুনলো। সবটা শুনে ও মাথা নাড়িয়ে সরল মনে বলল,
> ওকে লুকিয়ে রাখতাম সুলতান পরিবার আর শত্রুদের থেকে বাঁচাতে।
জুবায়েরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। বলল
> তবুও তো সেই ধরা পড়তে হলো। শত্রুর কি অভাব আছে চারদিকে? তাছাড়া মেয়েটা এখন আর ছোট নেই বড় হচ্ছে বিয়ে হয়েছে। সে এখন আমাদের কাছে আমানত বৈকি কিছুই না। সকালে আসা ছেলেটার চোখমুখের অবস্থা দেখেছিলে? মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। যদি মোহে পড়ে মেয়েটার ক্ষতি করতে আসে তখন? একটু ভালো করে চিন্তা করে তারপর রাগ দেখাবা বুঝলে?
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরা সবটা বুঝতে পেরেছে কিন্তু সেই মূহুর্তে ওর কিছু একটা হয়েছিল। ছেলেটার চোখের দিকে তাঁকিয়ে আর না বলতে পারেনি। অধরা জুবায়ের চোখের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> ওর চোখের দিকে তাঁকিয়ে আমি না বলতে পারিনি। ওর চোখে কিছু একটা তো ছিল। ছেলেটা স্বাভাবিক না। আমি ওকে সন্দেহ করে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু ও কৌশলে সেটা এড়িয়ে গেছে। তারপর কি হলো জানিনা আমার। ওর কথা মেনে নিলাম। বিশ্বাস করুন আমি আমার মধ্যে ছিলাম না।
জুবায়ের ভ্রু কুচকে ফেলল অধরার কথা শুনে। ছেলেটার উদ্দেশ্য কি হতে পারে মাথায় আসছে না। তবুও অধরাকে শান্ত করতে বলল,
> চিন্তা করো না আমি সামলে নিবো। বাইরের কেউ আসলে ডাইনিং রুমে আর যাবে না। সর্বদা মেয়েটার সঙ্গে থাকার চেষ্টা করবে। কিছু একটা হচ্ছে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে। আসো ঘুমাবে। দুরাত ঘুম হয়নি। শরীর খারাপ করবে।
কথাটা শুনে অধরা জুবায়েরকে ছাড়িয়ে দিয়ে মুখ ভার করে বলল,
> আপনার সঙ্গে আমি ঘুমাবো না। বেকুব মহিলা বলেছেন আমার মনে আছে।
অধরা কথাটা বলে বালিস হাতে সোফায় গিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লো। জুবায়ের সেদিকে তাঁকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ভাবলো, “এতো এতো বুঝিয়ে শেষমেশ লাভ টা কি হলো? সেই তো তাল গাছটা আমার। স্ত্রী বুদ্ধি ভয়ংকর। পারা যায় না।”
********
গভীর রাত,নির্জন কক্ষে কহিনু ঘুমিয়ে বুদ হয়ে আছে। মুখের উপরে বাদামি সিল্কি চুল গুলো এলোমেলোভাবে লুটোপুটি খাচ্ছে। কক্ষে আবছা আলো বিদ্যামান। নির্জনতা কাটিয়ে হঠাৎ ওর কানে কন্দনরত একটা কন্ঠ এসে আছড়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ওর শরীরে বিদ্যুৎ খেঁলে গেলো। একজন মহিলা খুব কাতর কণ্ঠে কাঁদছে আর বলছে,
> নূর আমাকে বাঁচাও প্লিজ। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নিয়ে যাও আমাকে। পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহণ করে মৃ*ত্যুর সুযোগ দাও প্লিজ। সাহায্য করো।
বারবার শব্দ গুলো উচ্চারণ হচ্ছে কহিনুরের কানে। মেয়েটা চোখ মেলে থাকালো। প্রথমে ঘাবড়ে গেলো কিন্তু তারপর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দ্রুত বিছানা থেকে নেমে শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে গেলো। রাতের আধারের সঙ্গে সঙ্গে বিশাল সুলতান ভিলাটাকে মনে হচ্ছে কোনো ঘুমন্ত রাক্ষস পুরী।চারদিকে পিনপতন নীরবতা। ডাইনিং রুমে লাল সবুজের আবছা আলো জ্বলছে। কহিনুর সাবধানে পা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলো। কার্পেট বিছানো ফ্লোরে পা ফেলার জন্য হাটা চলার আওয়াজ হচ্ছে না। তাছাড়া হয়তো রাতের এই সময়টাতে সুলতান ভিলা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। রাত অনুমানিক তিনটা বা তাঁর সামান্য কম। কহিনুর ডাইনিং রুমের দরজা খুঁলে বেরিয়ে পড়লো। আকাশে পূর্ণ চাঁদের আলো। বাগান হতে শিউলি নয়তো বেলী ফুলের মন মাতানো ঘ্রাণ ভেসে আসছে বাসাতে। গেটের কাছে দারোয়ান চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। গার্ডগুলো গান হাতে পাইচারী করছে আপনমনে, আশেপাশে লক্ষ্য নেই। নেহায়েত দায়বদ্ধতার জন্য এই রাতের বেলা স্ত্রী সন্তান ছেড়ে পরের ঘর পাহারা দিতে হচ্ছে। কহিনুর সেদিকে আর তাঁকালো না। শব্দটা ক্রমশ বৃদ্ধি হচ্ছে। কেউ অধীর আগ্রহ নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে তার কাছে যাওয়াটা এখন বেশি জরুরী। মানুষটাকে মুক্ত করতে হবে। কথাটা ভাবতে ভাবতে ও বাগানের দিকে চলে আসলো। গোলাপ গাছের পাশে ছোট্ট একটা সুড়ঙ্গ তার ভেতর থেকে আলোর রশ্মি বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। কহিনুর কিছু না ভেবেই সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লো। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো। কি যেনো এক অদম্য টানে ওকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই পাতালের নিচে ।
সিঁড়ির শেষভাগে গিয়ে ওর মনে হলো কেউ গভীর দৃষ্টি দিয়ে ওকে দেখছে যেটা ঠিক হচ্ছে না। ও ঝটপট আশেপাশে তাঁকালো কিন্তু দৃষ্টি আছড়ে পড়লো দেয়ালে কেউ নেই। কহিনুর পা ফেলে দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। সামনে তিনটা দরজা। ও পরপর দুটো দরজা পেরিয়ে তৃতীয় দরজার সামনে গিয়ে অলগোছে হাতটা দরজায় গিয়ে রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে শব্দ করে দরজা খুঁলে গেল। ভেতরে প্রবেশ করে ও চমকে গেলো। কক্ষের দেয়ালে র*ক্ত দিয়ে হাজারটা শব্দ আর লাইন অগোছালোভাবে লেখা আছে। শুধু তাই নয় ফ্লোরে সাদা শাড়ি পরিহিত কেউ একজন পড়ে আছে উপুড় হয়ে। কহিনুর কক্ষে ডান পা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ভদ্রমহিলা উঠে বসলো। কহিনুরের দিকে তাঁকিয়ে অমায়িক হেসে ছলছল চোখে উচ্চারণ করলো,
> অবশেষে এই কক্ষে তোমার পায়ের ধুলা পড়লো তাহলে? কতদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তুমি আসলে। তবুও আমি খুশি ভীষণ খুশী
কহিনুর মহিলাটার পা হতে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করলো। ধুলাবালিতে পরিপূর্ণ মলিন সাদা শাড়ি। বহুকাল এভাবে আটকে আছেন যেটা উনার মলিন চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বয়স বোঝার উপাই নেই। শুকনো শরীর আর দীর্ঘ কেশ পল্লবে মেয়েটাকে সত্যিই শুভ্র মনে হবে।। কহিনুর এবার উত্তর না দিয়ে আচমকা গিয়ে মেয়েটার হাত ধরে দাঁড় করালো। সঙ্গে সঙ্গে পাশের কক্ষ থেকে চিৎকারে চেচামেচি শুরু হয়ে গেলো সেই সঙ্গে দরজা ভাঙার চেষ্টা। মেয়েটা ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছে কিন্তু কহিনুরের মুখের ভাব ভঙ্গি খুব স্বাভাবিক। ও মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। এরপর প্রতিটা দরজায় গিয়ে নিজের হাতের আতো ছোঁয়া দিয়ে যখন সিঁড়িতে পা রাখলো ঠিক তখনই পেছন থেকে কয়েকজন মেয়ে এক সঙ্গে কহিনুর বলে ডেকে উঠলো। কহিনুর পেছনে তাঁকালো না। যদি তাঁকাতো তবে দেখতে পেতো ভয়ংকর এক দৃশ্য। কারণ পেছনে যারা আছে তারা কেউ স্বাভাবিক নেই। ভয়ংকর চেহারার মেয়েগুলোর শরীর র*ক্তে ভেসে যাচ্ছে। কারো গ*লা কা*টা কারো হাত পা জঘন্য ভাবে কা*টা অবস্থায় আছে তবে অদ্ভুত আর রহস্যজনক ভাবে সকলের মুখে হাসির ফোয়ারা। কহিনুর সিঁড়ির উপরে থমকে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র হাত উচু করে সবাইকে থামতে বলে আবারও এগিয়ে চলল। সঙ্গের মেয়েটা কহিনুরের কাজকর্ম অবাক হয়ে দেখছে। এই বাচ্চা মেয়েটার মধ্যে এতো সাহস কিভাবে আসছে উনার জানা নেই তবে বন্দী অবস্থায় কে যেনো স্বপ্নে এসে বলে যেতো অপেক্ষা করো কহিনুর আসবে তোমাকে নিয়ে যেতে। ইনশাআল্লাহ তোমার কষ্টের দিন শেষ হবে। সেই আশাতে এতটা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। যখন বন্দি হয়েছিলেন তখন বয়স কতটা ছিল? উনিশ বিশ বা তারও কম। জীবন থেকে কতটা বছর পেরিয়ে গেছে কে জানে। খুব আফসোস হয় নিজের জীবনের জন্য। কিন্তু নিয়তিকে কিভাবে খণ্ডন করবেন। ভাবতে ভাবতে উনি সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসলেন। কতকাল পরে বাইরের মুক্ত হাওয়া বাতাস শরীরে লাগলো। ফুলের সুবাসে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। উনি কিছুক্ষণ থমকে গেলেন কিন্তু কহিনুর দাঁড়িয়ে থাকলো না। উনার হাত টানতে টানতে সুলতান ভিলাতে প্রবেশ করলো। ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করেই কহিনুর ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালো আর সেটা দেখে ভদ্রমহিলা চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো। অধরা সোফায় থাকার দরুন ও জেগে ছিল। বাইরের শব্দটা শুনেই ও দ্রুত উঠে গেলো। শব্দ করে দরজা খুঁলে বেরিয়ে আসলো। কহিনুর একা আছে ওর জন্য চিন্তা হচ্ছে। জুবায়ের ওর পিছু নিলো। ওদিকে জামসেদ আর দাদুও উঠে গেছে। অধরা লাইট অন করে অচেনা কোনো মহিলার কোলে নিজের মেয়েকে দেখে চমকে উঠলো। ও দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
> কি করেছেন ওর সঙ্গে? আমার মেয়ের কিছু হলে আমি কিন্তু ছাড়বো না কাউকে। বলুন কি করেছেন?
অধরা কেঁদে ফেলল কথাটা বলে। বাড়ির বাকীরা ততক্ষনে এসে গেছে। জামসেদ কক্ষে পায়চারী করছিল সকালের ঘটনাটা নিয়ে। রুবিনা নামের মেয়েটাকে আধার ছেলেটা শিখিয়ে পড়িয়ে এই বাড়িতে এনেছিলো যাতে এখানে ওর ইমেজটা ভালো হয় আর সকলের বিশ্বাস অর্জন করতে পারে। ঘটনা শুনে ও লোক লাগিয়েছিল ছেলেটার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য। যা যা শুনেছে তাঁতে সামনে প্রচণ্ড ঝামেলা হতে চলেছে। কিভাবে সবটা সামলাবে ভাবতে পারছে না। রাতনা হলে দাদুর সঙ্গে পরামর্শ করতো। সেই সময় বাইরে থেকে শব্দ ভেসে আসলো তাই অপেক্ষা না করে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসলো। যা হচ্ছে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। জামসেদ সিঁড়ির মাঝামাঝিতে থমকে গেলো। ফ্লোরে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখে ওর হাত পা কাপাকাপি করছে। এমন অনুভূতির সঙ্গে ওর পরিচয় নেই। বহুকাল আগে এমনটা হয়েছিল তারপর সব বন্ধ। জুবায়ের আর দাদুর মুখের ভাবভঙ্গিও অস্বাভাবিক। অধরা ওদের দিকে তাঁকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলল। জুবায়ের নিজেকে সামলে নিয়ে টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস নিয়ে মেয়ের পাশে গিয়ে বসলো। অধরা বিড়বিড় করছে। মেয়েটাকে কিছু জিঞ্জাসা করতে চাইলো কিন্তু হলো না। বাতাসের গতিতে জামসেদ এসে মেয়েটাকে হাটু গেড়ে বসে নিজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। যেটা দেখে অধরার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। জামসেদ ফারুকী এই মলিন পোশাকে আবৃত মেয়েটাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে বিষয়টা সহজে হজম হচ্ছে না। জামসেদ মেয়েটার কপালে চুমু দিয়ে কেঁদে ফেলল। ফুপিয়ে উঠলো দুজনে। জুবায়ের মেয়ের জ্ঞান ফেরানো নিয়ে ব্যস্ত। মনে হলো যা হচ্ছে সবটা স্বাভাবিক। এমনটা হবে ওর জানা আছে। অধরার কৌতূহলের শেষ নেই হাজারো প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। জুবায়ের ওর দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> জ্বর আবারও ফিরেছে তুমি জানতে না? ওষুধ খাওয়াতে হবে রুমে চলো।
উত্তরের আশা না করে জুবায়ের মেয়েকে কোলে তুলে হাটা ধরলো। কিছুটা এগিয়ে পিছনে ফিরে জামসেদকে বলল,
> ওকে কক্ষে নিয়ে যাও। সকালে শুনবো বিস্তারিত। মেয়েটাকে গোসল করিয়ে কিছু খেতে দাও। ওর বিশ্রামের দরকার।
জামসেদ যেনো সবটা ভূলে গিয়েছিল। জুবায়ের মনে করিয়ে দেওয়াতে ও কৃতজ্ঞ হলো। দ্রুত মেয়েটাকে নিয়ে কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলো। জুবায়েরের দাদু ধপ করে সোফায় গিয়ে বসে পড়লেন। আরমান ফারুকী আজ বাড়িতে নেই। আছে কোনো এক কাজে। সেই সুযোগ বাড়িতে বিরাট এক রহস্য সামনে চলে আসলো।
******************
কহিনুর ঘুমিয়ে আছে। জুবায়ের আর অধরা ওকে ঘিরে বসে আছে। নীরবতা ভেঙে অধরা বলে উঠলো,
> মেয়েটা কে ছিল? ওর পরিচয় কি বলুন তো? কেমন জানি ভূতুড়ে ভূতুড়ে লাগছে।
জুবায়ের উত্তর না দিয়ে অধরাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো। অধরা বাঁধা দিলো কিন্তু জুবায়ের শুনলো না। বরং বিরক্ত হয়ে বলল,
> চুপচাপ থাকতে পারোনা? সব সময় ছটফট করো কেনো! কাছে থাকতে পারো না?
অধরার সহ্য হলো না। এই ভয়ংকর সমস্যার মধ্যে লোকটা কি সুন্দর ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল আছে। পুরো জুবায়ের ফারুকীটাই হয়তো রোমান্টিক ড্রামে চুবানো একজন মানুষ। সব পরিবেশে ঠান্ডা মাথায় বউয়ের কপালে চুমু বসিয়ে দিতে পারে। এতো ভালোর তো দরকার ছিল না। মেয়েটার সম্পর্কে জানা অতি জরুরী নয়তো অধরার শান্তি লাগছে না। জুবায়ের বেশ মজা পাচ্ছে ওকে বিব্রত করতে। তাই আরও কিছুটা রাগিয়ে দিতে অধরার হাতটা নিজের বুকের উপরে রেখে বলল,
> তুমি কাছে এলেই বুক কেমন ধুকপুক করে। আমি নিজেকে ভূলে যায়। ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। খুব ভালোবাসি তোমাকে।
অধরা হাত টেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> ফাজলামির একটা লিমিট থাকে। মেয়ের কক্ষে বসে আপনার এসব ভূত মাথায় চেপেছে? সবটা বলুন নয়তো আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি। তখনকার বেকুব মহিলার ঘটনাটা এখনো মনে আছে। রাগ এখনো আছে।
জুবায়ের ওকে পাত্তা না দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
> আরে বাবা রাগ করছো কেনো? মেয়েটা হচ্ছে জামসেদ ফারুকীর হবু বউ। শুনেছিলাম গোপনে বিয়েও নাকি করেছে। সে বহু আগের কথা যখন তোমার সঙ্গে আমার বিয়েও হয়নি। মেয়েটা হঠাৎ করে নিখোঁজ হলো। শুনেছিলাম বেঁচে নেই। বা পালিয়ে গেছে এমন। সেই ঘটনা থেকে জামসেদ পুরোপুরি উন্মাদ। কাউকে পরোয়া করে না। আমার কি মনে হয় জানো? ড্যাড নয়তো দাদু ওকে কন্ট্রোল করে। তোমাকে নিয়ে যেটা করলো সেটা ওদের প্ররোচনাতে। বলতে পারো বিভ্রান্ত করতে। যৌবনের প্রথমেই ও খারাপ ছিল না। মেয়েটাকে খুব ভালোবাসতো। যখন নিজের ভালোবাসকে হারিয়ে ফেলল তখন কালো যাদুর সঙ্গে একদম জড়িয়ে গেলো। মম বলেছে আমাদের মাকে পযর্ন্ত ও খু*ন করেছে।
অধরা ভ্রু কুচকে বলল,
> ওর না পাঁচিশ বছরের আগে বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিল? তাছাড়া ও রাতের বেলা বের হতো দিনে তো না? মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় কিভাবে? এতদিন ও কোথায় কিভাবে ছিল আর আজ কিভাবে আসলো। মাথা আউলে গেছে। উত্তর দিন।
জুবায়ের হাসলো অধরার কৌতূহল দেখে। রহস্য মেয়টাকে টানে এটা ওর জানা আছে। তাই চোখ বন্ধ করে বলল,
> জার্মানির মতো শহরে রাত আর দিনের পার্থক্য কি? দিনের চাইতে মানুষ রাতে বেশি বের হয়। তাছাড়া মেয়েটা আমার চাচি আম্মার মেয়ে। দাদুর একটা ভাই ছিল জমজ। তাঁর উত্তরসূরি। মেয়েটার পরিবার পরিজন বলতে আমরা ছিলাম। একটা দুর্ঘটনাতে ওর পরিবারের লোকজন মারা যায় সেই থেকে মেয়েটার দায়িত্ব আসে দাদুর উপরে। এখানেই থাকতো। তারপর জামসেদের সঙ্গে প্রণয়। বিয়েও হতো সমস্যা ঠিক হলে কিন্তু হঠাৎ কি হলো কে জানে। তারপর কহিনুরের জন্ম তোমার বিয়ে এসে জুটলো। তোমাকে নিয়ে একটার পর একটা ঝামেলা। তুমি গোয়েন্দার মতো দাপট দেখিয়ে আমার বারোটা বাজালে।
জুবায়ের শেষের কথাগুলো একটু মজা করেই বলল। কিন্তু অধরা তেতে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> এতদিন আমাকে বলেননি কেনো? বললে কি হতো? আমি তো ভেবেছিলাম আপনার ভাই এমনি এমনি বিয়ে করে না। বাইরে বাইরে মেয়েদের সঙ্গে ডেটিং করে অভ্যাস। এতোই যখন ভালোবাসা তখন বাইরের মেয়েদের সঙ্গে ওরকম করতে রুচিতে বাঁধেনি?
> তুমি হয়তো ভূলে যাচ্ছো জামসেদ হচ্ছে কোলো শক্তির আধার। ওকে পরিচালনা করে কালো যাদুর পেছনে থাকা শয়তান। আর তুমি তো জানো শয়তানের কাজ হচ্ছে এসব আজেবাজে কাজকর্ম করা।
> মেয়েটাকে কে আটকে রেখেছিল আপনি তো কিছুই জিঞ্জাসা করলেন না। কি সুন্দর করে ভাইকে উপদেশ দিয়ে আসলেন ঘরে নিয়ে সেবাযত্ন করতে। এদিকে বউয়ের যে পেট ফেঁটে যাচ্ছে কথা শোনার জন্য। চলুন না গিয়ে জেনে আসি। অনেক প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়।
জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
> চুপচাপ ঘুমাবে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলে তোমাকে আমি কক্ষে দরজা বন্ধ করে রেখে আসবো। সকালে সব শুনবো। এখন ঘুমাও
অধরা নিরাশ হয়ে মেয়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ভাবলো লোকটার সঙ্গে আর কথা নেই। নিজেই শুনবে সবটা। সুলতান পরিবারের মধ্যে আরো কত কত ঝামেলা পাকিয়ে আছে কে জানে।
চলবে