রোদেলা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ৫১

0
737

#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৫১

নোভেল ওর বাবার কাছে চলে গেছে দুই মাস হতে চললো তবুও একটা ফোন এখন অব্দি করে নি কাওকে। না নাসিমাকে, না ওর বড় চাচীকে। ও যাওয়ার সময় কিন্তু ঠিকই দেখেছে এ পরিবারটা কোন হালতে ছিলো। নোভেল যাওয়ার পর নাসিমা যেন একেবার পুকুরের পানির মতো শান্ত হয়ে গেছে। এই ধাক্কা হয়তো তার মেয়ে হারানোর শোককেও ছাপিয়ে গিয়েছে। তার স্বভাববিরুদ্ধ তিনি হয়তো সবসময় ব্যাস্ত হিসেব কষতে কাদের আঁকড়ে ধরে ছিলেন তিনি এতদিন। যা ছিলো ভেবেছিলেন তা আসলে কখনোই ছিলো না… মিথ্যা মরিচীকার পিছনে ছুটেছেন সারাটা জীবণ….
এ হুঁশ তার ঠিক হয়েছে এ কয়দিনে…

প্রথম জীবণে সত্যিকারের ভালোবাসা পায়ে ঠেলে জড়িয়ে ছিলেন ছলনায়, ভুল ছিলো সেটা….
অন্যদের কাছে সন্তানদের ছোট করে, সন্তানদেরকে দূরে রেখে আপন করেছিলেন যাদের, ঋণ শোধ কিংবা পাপ মোচনের আশায় ভুল সেটাও ছিলো…

আরো অনেক অনেক ভুল ভরা জীবণের প্রতিটি বাঁক…

এখন না আছে সেই সন্তান যাকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছেন, যার সাথে সবচেয়ে বেশী অন্যায় করেছেন দিনের পর দিন, অন্যদিকে না আছে তারা। অথচ দুনিয়ার কাছে তিনি দোষী মা, নিষ্ঠুর বোন কিংবা ফুফু…..
খোদ ইশ্বরই হয়তো ক্ষমা করবেন না তাকে….

প্রায় রাতেই রোদেলার মাথার বালিশ বুকে নিয়ে কাঁদেন নাসিমা। জামাকাপড় আলমারি থেকে নামিয়ে ভাজ করেন ব্যাস্ত ভঙ্গিতে। যেন মেয়ে এসেই গোসলে যাবে সে কাপড় নিয়ে। একটা সময় যখন সব খেয়াল হয়, কান্নায় ভেঙে পরেন সেই ভাজ করা কাপড় নিয়ে। নোভেল চলে যাবার পর তার এই দৃশ্য বেশী চোখে পরে প্রিসিলার…
কিন্তু মূল্যহীন এ কান্নার কোন দাম নেই এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে।

সুফিয়ানের তদারকিতে আদায় করা পূর্বাচলের জমির টাকায় বর্তমানে চিকিৎসা চলছে বড় মামার, সাথে এতগুলো মানুষের খাওয়াদাওয়া। সবাই যার যার মতো পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একদিকে সমস্যা থাকলে সেটা সবাই মিলে সমাধান করা যায়, কিন্তু নানান দিকের নানান সমস্যা কে কোনটা সামাল দিবে। বর্তামানে যা পরিস্থিতি নিজে চলতেই হিমশিম। তার উপর তারা কেওই অর্থনৈতিক ভাবে তেমন স্বচ্ছল না যে তাদেরকে আগলে রাখবে। তবুও সাধ্য মতো করছে সবাই…. এটা অস্বীকার করা যাবে না…

প্রিসিলার ম্যাচুরিটির বয়স জীবণের এ ধাক্কায় যেন অনেক বছর বেড়ে গেছে। নিজ থেকে খোঁজ নিয়ে বোনের টিউশনি গুলো করানো শুরু করেছে গত মাস থেকে, নাসিমা ওকে কিছুই বলে নি। সত্যি বলতে তার মেয়ে যে এত বড় হয়ে গেছে যে টিউশনি করাতে পারে তা তার খেয়ালই ছিলো না। খেয়াল হবে কিভাবে এতদিন তো তার চোখে নোভেল নামের এক মোহরে আবৃত ছিলো। টিউশন থেকে কিছু রোজগার হচ্ছে। যদিও তা নুন আনতে পানতা ফুরানোর অবস্থার মতো। তবুও তাই বা কম কি ছন্নছাড়া এ সংসারে…..

এদিকে কলেজে ভর্তির সময় এসে গেছে। কিন্তু মুখ ফুটে ওর বলার সাহস নেই, যে পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে ওরা যাচ্ছে তার উপর আবার কলেজ ভর্তির টাকা আসবে কোত্থেকে।

নাতাশা বলেছিলো তুই কোনটাতে ভর্তি হতে চাস বল….
আমি ভর্তি করায়ে দিবো….
এখন ও নিজেই অসুস্থ এর মধ্যে এ কথা কিভাবে বলা যায়…
মানুষ তো কত কথাই বলে সাহস দিতে…

একদিন হঠাৎ নাতাশা এসে হাজির, সেদিন রাতে ওদের ঘরে এসে প্রিসিলাকে বললো-
: তোর না কলেজ ভর্তি হওয়ার কথা, কিরে…!
: ……….
: কিরে কথা বলিস না কেন…?
: আপা বাদ দাও…
এসব নিয়ে কথা বলতে ভাল্লাগছে না…
: শোন রোদেলার চিন্তা ছিলো তোকে ভালো কোথাও ভর্তি করানো…
আমি কি তোর বোন না…
: আপা, এভাবে বলো না….
চোখ ভিজে যায় দুজনেরই….

চোখ মুছে প্রিসিলা বলে-
: যে পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে সবাই…
আমার সাহস হচ্ছে না এ বিষয়ে কথা বলতে…
নাতাশা ওর গাল টেনে বলে-
: পাঁকা বুড়ি একটা…
তাদের বলার কি দরকার, আমাকে না বলতে বলছি…
কি ধকল গেলো আমার, এত কিছু খেয়াল থাকে,
আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম…
আচ্ছা বাদ দে, কাল কাগজপত্র তৈরী করে রাখ, কোথায় ভর্তি হবি চিন্তা ভাবনা কর, তোর ভাইয়া তোর ভর্তির জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছে। ফুফুর সাথে আলাপ করে দেখ, তিনি কি বলেন…
নাতাশার কথায় যেন একটু যেন আশার আলো দেখে ও…

ওর মাকে রাতে বলে কথাটা…

তখন তিনি কোন উত্তরই দিলেন না, কি দিবে উত্তর, তার কোন উপায় নেই এই মুহুর্তে একটা টাকা বের করে মেয়ের ভর্তির জন্য।

নাসিমা সারা রাত অনেক ভেবে দেখলেন, প্রাইভেট কলেজে পড়াশোনায় অনেক খরচ, নাতাশা হয়তো ভর্তি করে দিবে কিন্তু সারা বছরের খরচের জোগান কোত্থেকে আসবে, তাছাড়া না চাইতে যারা দেয় তাদের কাছে বারবার চাওয়া যায় না। তাই সব ভেবে তিনি সরকারী কোন কলেজে ভর্তি হতে বললেন।

শেষমেশ কাছাকাছি একটা সরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন নাসিমার এক চাচাতো ভাই প্রিসিলাকে কলেজে ভর্তি করে দিয়ে আসে, তিনিও ঐ কলেজে পড়াশোনা করেন। নাতাশা বেশ কিছু টাকা এনেছিলো ভেবেছে অনেক টাকা হয়তো লাগবে। কারন ওর কলেজ ভর্তির সময় বেশ খরচ হয়েছিলো ওর বাবার, সেই হিসেব করে। সরকারি কলেজে নামমাত্র বেতন, ভর্তিও কম। তাই সব কাজ করেও সিংহ ভাগ টাকা অবশিষ্ট রয়ে গেলো। টাকাটা নাতাশাকে ফিরত দেয় প্রিসিলা।

নাতাশা টাকাটা ওর ফোনে একটা মোবাইল ব্যাংকিং এর একাউন্ট খুলে সেখানে জমা করে…
যাতে এই দুই বছরে পড়াশোনায় যখন যা দরকার হয় এখান থেকে নিয়ে নিতে পারে। নাতাশা এও বলে বাড়িতে এ টাকার কথাটা না বলতে, কারন অভাবের সংসার, এ টাকার খোঁজ পেলে এটাও কোন না কোন কাজে লেগে যাবে।

প্রিসিলা কেঁদে নাতাশাকে জড়িয়ে ধরে বলে –
আপা তুই যা করলি আজ, আমার বাবাও তা আমার জন্য করে নি জীবণে…

নাতাশা বলে-
আমি চেষ্টা করবো তোর পড়াশোনাটা চালিয়ে রাখতে, জানি না কতটুকু পারবো। তবুও নিঃসংকোচে তুই যখন যা প্রয়োজন আমাকে জানাবি, তোর ভাইয়া বলেছে তোর পড়াশোনার দায়িত্ব তার……

এই ভালোবাসা দায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দেয়, ভালো ভাবে পড়াশোনা করার, ভালোভাবে চলার, ভালো থাকার….
যাতে তাদের ভালোবাসার মান থাকে….

রোদেলার চলে যাবার পর ধীরে ধীরে প্রিসিলা যেন ওর আসনে বসলো। তবুও অনভিজ্ঞ প্রিসিলা নতুন জীবনে যেন খেই হারায় প্রতিদিন। ওর মা কাঁদে….
কেন কাঁদেন তিনি তা কাওকে বলেন না..
এ কান্না, চোখের নোনা জল তার মতোই রহস্যময়……
এ কান্না রোদেলার জন্য নাকি নোভেলের… তা বোঝে না প্রিসিলা…. তবুও মায়ের সব দোষ ভুল ভুলে মাকে আঁকড়ে ধরতে চায়, নতুন করে বাঁচতে চায়।

কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকে প্রিসিলা একটু ভোগান্তিতে পরে ক্লাস আর টিউশনির শিডিউল নিয়ে। কিন্তু কি আর করা বেঁচে থাকতে হলে এডজাস্ট করে নেয়া ছাড়া ভিন্ন কোন উপায় নেই…,

ওর প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যেতো বাড়ি ফিরতে, যদিও রোদেলা বিকেলের দিকে ফিরতো, কিন্তু টাইম ম্যানেজম্যান্টে প্রিসিলা ততোটা দক্ষ না এখন অবধি… তাই দেখা যায় কোন কোন স্টুডেন্ট দেড়-দুই ঘন্টাও পড়িয়ে ফেলছে। আসতে যেতেও সময় লাগে। মোদ্দা কথা পড়ানো ব্যাপারটাকে ও প্রোফেশনালি নিতে পারে নি তখনো। তাই এই তালগোল পাকানো অবস্থা।

এর মধ্যে একটা উকিল নোটিশ আসে –
ছোট মামার পক্ষ থেকে। পাওনা টাকা ফেরত চেয়ে….
বড় মামীর মাথায় আকাশ ভেঙে পরে যেন…

তার অবস্থা এই কৃষ্ণচূড়া নিবাসের সবচেয়ে করুণ। কারন তার স্বামী অসুস্থ, জমি বিক্রির টাকা দিয়ে সাধ্য মতো সব চিকিৎসা করছেন, যদিও তিনি জানেন তার স্বামীর হাতে সময় বড্ড কম….

একদিকে টাকা শেষ হচ্ছে, অন্যদিকে ফুরিয়ে আসছে সময়…
তারউপর ছোট ভাইয়ের পাওনা পরিশোধের তাগাদা….
তার চূড়ান্ত রূপ এই উকিল নোটিশ। ফোন দিয়ে একটা বারও জানতে চায় নি কি অবস্থা ভাইয়ের, কেমন আছেন তিনি , তার উপর পাওনা আদায়ের চাপ….

বড় মামী বলেন-
আসলে ও লজ্জায় ফোন করে নি, কি আর বলতো আমাদের যা অবস্থা। বাধ্য হয়ে বেচারা উকিল নোটিশ দিয়েছে। এতে দোষের কি আছে, ও যে টাকাটা পায় তা তো আর মিথ্যা না…., তোমার ভাইয়ের যদি কিছু হয়েও যায় সেটা শোধ করা আমার দায়িত্ব …..

জানো আমি হাল ছেড়ে দিছি নাসিমা তোমার ভাইয়ের চলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি এখন…..
তিনি চলে যাবেন একদিকে আর আমিও এ বাড়ি ওকে বুঝিয়ে দিবো আরেক দিকে….

প্রিসিলা হতবাক হয়ে শুনলো তার কথা, উনি হয়তো নিজেই জানেন না কি বলছেন উনি, কিংবা জানেন হয়তো….
এত বোঝা যার মাথায় তিনি এত শান্ত কি করে হন…..!?
এটা যে কত বড় গুন, নাসিমা এখন তা জানে…

একটার পর একটা শোক তাকে পাথরে বদলে দিয়েছে। তারচে বড় কথা তিনি তার পরাজয় মেনে নিয়েছেন। অনেক তো করলেন চেষ্টা… আল্লার সাথে কি পাল্লা চলে…..!?

একথা শোনার পর নাসিমার কপালে চিন্তার ভাঁজ, এমন কিছু যদি সত্যি ঘটে তাহলে তিনি কোথায় যাবেন এই মেয়েকে নিয়ে….!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here