চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️ #পর্ব_২৯

0
341

#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#পর্ব_২৯
#লেখনীতে_নন্দিনী_নীলা

পাকা গিন্নির মত সংসারের কাজে লেগে পরেছি। পড়েছি বলতে আজকেই পড়লাম। শাশুড়িকে বলে কয়ে আজ রান্নাঘরের দায়িত্ব নিয়েছি। এই কতদিন শুধু তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে রান্না দেখেছি আর শিখেছি জানিনা কতটুকু আয়ত্ত করতে পেরেছি। কিন্তু আজকে খুব উৎসাহের সাথে রান্নাঘরে একা দাঁড়িয়ে আছি সবাইকে বলেছি। আজকে আমি রান্না করে খাওয়াবো। সবাই কে রান্না ঘরে থেকে বিদায় করে আমি একা রান্নাঘরে রাজত্ব করছি। পেঁয়াজ বের করে প্রথমে পেঁয়াজ কুচি কুচি করে কাটছি। পেঁয়াজের ধকে আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। নাক টানছি আর কাটছি তখন দেখলাম রান্নাঘরের দরজা দিয়ে কে যেন উঁকি মারছে। আমি ঝাপসা চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি কে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে?

দরজার কাছের লোকটা আমি তাকাতেই দৌড়ে এলো আমার কাছে আর ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন?’

আমি কন্ঠ শুনেই স্পর্শের চিনে গেছি।

‘ আমি কাঁদবো কেনো? আমিতো পেঁয়াজ কাটছি।’

স্পর্শ বলল,’ তুমি তো কাঁদছো! এই যে চোখের জল! তাকাতেও পারছ না কি হয়েছে তোমার চোখে? আমাকে সত্যি করে বলো। রান্নাবান্না কিছু করতে হবে না চলো আমার সাথে।’

বলেই স্পর্শ আমার হাত ধরে উঠাতে চাইল,

আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘আরে আমার কিছু হয়নি। পেঁয়াজের ধক আমার চোখে লাগছে আর পেঁয়াজ কাটা শেষ আমি এখন রান্না করবো। আপনি এখান থেকে যান।’

‘তোমার রান্না করতে হবে না তুমি আকাম করে ফেলবে। ‘

‘ খুব সুস্বাদু রান্না করবো দেইখেন। আমার হাতের রান্না খেতে গিয়ে না আবার প্লেট খেয়ে ফেলেন সেই চিন্তা করছি।’

‘ বাজে কথা না বলে চল আমার সাথে।’

‘আরে দেখছেনা কত কষ্ট করে আমি রান্নার জোগাড় করলাম। এখন আমি চলে যাব সম্ভব।’

‘তোমাকে এইসব আজাইরা কাজ করার ভূত টা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে কে বলতো?’

‘এইসব আজাইরা কাজ কে বলল আপনাকে? এই সব বউদের কাজ। আমি তো তাই করছি।’

‘তোমাকে ব‌উদের কাজ করে বউ হতে হবে না তুমি এমনিতে আমার বউ ওকে।’

‘ করতে হবে আমি করব।’

‘ উফফফ। আচ্ছা করো। আমিও থাকব তোমার সাথে। তোমাকে হেল্প করব।’

‘আপনি কি জীবনে রান্না ঘরে ঢুকেছেন? জীবনে কাজ করেছেন? আপনি কি না করবেন আমাকে হেল্প?’

‘জীবনে না ঢুকলেও আমি তোমার থেকে সবকিছুতে এক্সপার্ট। দেখবে তোমাকে আমি কি সুন্দর হেল্প করি! ‘

‘ওকে আপনি তাহলে আলু কেটে দেন আমাকে।’

স্পর্শ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ওয়েট আমি কেটে দিচ্ছি।’

স্পর্শ আলু এনে ছুলতে লাগলো আলো ছুলতে গিয়ে স্পর্শ অর্ধেক আলো ফেলে দিল। কিন্তু স্পর্শের কাটার স্টাইল দেখে আমি নিজের আলু কাটা কথা ভাবতে লাগলাম আমিও হাজার বার আলো কাটতে দেখেছি আর কেটেছি আমাকে মাঝে মাঝে আম্মু আলো কাটতে বসা তো। এতবার করে ও‌ আমি স্পর্শর থেকে উন্নতি করতে পারি নাই। আমিও আলু কাটতেই গেলে অর্ধেক আলো ফেলে দেয়।
হাজার বার করে ওই ভুলটা আমি শুধরাতে পারিনি।

‘আমি এখানে থাকলে আসলে তুমি কাজে মন দিতে পারবেনা যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ! এজন্য আমাকে সরানোর জন্য বলছিলা আমি কাজ পারবো না তাই না!’

‘মোটেই না। আমি দেখছিলাম আপনি কাজ ঠিকমতো করছেন কিন। আবার গন্ডগোল করলে তো আমারই সমস্যা। আপনাকে আমি মোটেও দেখছিলাম না।’

‘যেভাবে তাকিয়ে ছিলে যে কেউ জানি তুমি আলো নয় আমাকে দেখছিলে।’

‘সব সময় ঘাড়তেরামি করবেন না আমি আপনাকে দেখছিলাম না আমি আলু কাটা দেখছিলাম!’

‘ আচ্ছা ঠিক আছে ম্যাম। যুগ যুগ ধরেই বউরা কিছু করলে সে অন্যায় স্বামীরাই গ্রহণ করে। ‘

‘ আমি এখানে কি অন্যায় করলাম আপনার দিকে তাকিয়ে থাকলেও আমি আমার স্বামী দিকে তাকিয়েছি তাতে অন্যায়ের কি হলো?’

আমার কথা শুনে স্পর্শ হা হা করে হেসে দিল। আর হেসেই আর্তনাদ করে উঠলো। আমি চমকিত চোখে স্পর্শের হাতের দিকে তাকালাম। স্পর্শের হাতে চাকু ছিল সেই ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল আর হাসছিল। তখনই অঘটন ঘটেছে হাতের মধ্যে চাকু দিয়ে লেগেছে। আর কেটে যাওয়া স্থান থেকে গল গল করে রক্ত পড়ছে। আমি ছুটে গিয়ে স্পর্শের হাত চেপে ধরলাম। আর বারবার করে সরি বলতে লাগলাম।

‘ইস কতো খানি কেটে গেল। আমার জন্য। আমি যদি আপনার সাথে মজা না করতাম তাহলে আপনার হাত কাটতো না। আমি সত্যি খুব পচা বউ।’

স্পর্শ আমার কান্না মিশ্রিত কন্ঠ শুনে আমাকে শান্ত করতে লাগল নিজের ব্যথা ভুলে। আমি খুব অপরাধবোধে ভুগতে লাগলাম। কেন যে সবসময় মজা করি নিজের মজার জন্য নিজের প্রিয় মানুষটা এখন কষ্ট পাচ্ছে।

স্পর্শর কাটা স্থান টা দেখলেই আমার বুকের ভেতর টা কেমন করে ওঠে।

স্পর্শকে ধাক্কিয়ে কিচেন থেকে বের করে দরজা আটকে দিলাম এবার আমি একাই রান্না করবো। উনি থাকলে শুধু আকাম হবে আর খালি মজা করতে ইচ্ছা হবে। এবার আর কোন মজা আমার মাথায় আসলো না। লেখিকা নন্দিনী নীলা মন খারাপ করে রান্না করতে লাগলাম। আর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম আজকে রান্না যেন ভাল হয় এত বড় মুখ করে শ্বশুরবাড়ি সবাইকে বলেছি। রান্না করে খাওয়াবো। যদি খাবার ভালো না হয়। তাহলে আর মান সম্মান কিছুই থাকবে না।

দীর্ঘ সময় ধরে আস্তে আস্তে রান্না শেষ করে বেরোলাম। সবাই হাসিমুখে বসে ছিল আমাকে দেখে শাশুড়ি মা বলল,

‘যাও গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসো। আমাদের তো খিদেয় পেট চো চো করছে। ব‌উমার হাতে রান্না খাবো বলে কথা।’

মাথানিচু করে বললাম, সরি মা আমার জন্য আপনাদের কষ্ট করতে হলো।’

‘আরে মেয়ে সরি বলছো কেন? মেয়ে কষ্ট করে রান্না করেছে। বাবা-মা সেটাতো উপভোগ করে।’

আশেপাশে স্পর্শ আছে কিনা খুঁজতে খুঁজতে রুমে এলাম। না পেয়ে গোসল করতে চলে গেলাম প্রচণ্ড গরম লেগেছে। এখন ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করলে ভালো লাগবে।

কিন্তু এই গোসল করতে আসার তাড়ায় তো জামা কাপড় ছাড়াই চলে এসেছি। গোসল করে এখন জামাকাপড় আনি নাই দেখলাম। এখন কি পড়বো আর এই ভেজা পোশাক কতক্ষণ পরে থাকবো কি এক যন্ত্রণা। রুমে উঁকি মারতেই দেখলাম স্পর্শ পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে আমি তাকে দেখেই আবার দরজা আটকে দিলাম।

স্পর্শ সেই শব্দ পেয়ে দরজার কাছে এসে দরজা ধাক্কা মেরে বলল,

‘কি হয়েছে বের না হয়ে আবার ভেতরে ঢুকে পড়লে কেন? চলো সবাই ডাইনিং টেবিলে ওয়েট করছে ।’

‘আপনি যান আমি একটু পর আসছি‌। আমার একটু লেট হবে।’

‘ওকে আমি ওয়েট করছি একসাথে যাব!’

‘ আরে বলছি না আপনি যান। আমি একটু পর আসছি। আপনার আমার জন্য ওয়েট করতে হবে না।’

‘ তুমি কি সেই কারনে আমার উপর রেগে আছো? দেখো তখনকার ব্যবহারে কিন্তু আমি তোমার উপর রাগ করেছি। উল্টা তুমি এখন আমাকে রাগ দেখাচ্ছো কেন?’

নিজের মাথায় নিজে বাড়ি মারছি।আমি রাগ দেখালাম কোথায়? কোন কথাই বলা যায় না। খালি ভাবে আমি রাগ করেছি কপাল আমার।

স্পর্শ জোরে জোরে ধাক্কাসে ভাবছে আমি রাগ করেছি তাই আওয়াজ করছি না।

আমিও তাও দরজা খুললাম না। স্পর্শের কাছে পোশাক চাইতে লজ্জা করছে আর আমি এখন যে অবস্থা সেই অবস্থাই স্পর্শের সামনের দরজা খুলে উঁকি মারতে পারবো না। তাই আমি তাকে চলে যেতে বললাম। এবার চলে গেল স্পর্শ কিন্তু কঠিন রাগ করেছ আমার উপর। তা আমি নিচে এসে দেখতে পারলাম। মহাশয় রাগের চোটে আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত আমি খাবার টেবিলে বসে সরি বললাম। স্পর্শ তাকালো না পর্যন্ত। সবাইকে খাবার তুলে দিয়ে আবার বসে পড়লাম। স্পর্শ চুপচাপ খাচ্ছে আমি তার দিকে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম খাবার কেমন হয়েছে? তিনি কোনো কথাই বলল না। আমি ঢোক গিলে র‌ইলাম।
এই রাগটা আমি ভুলে গেলাম ভাবলাম হয়ত রাগ কমে যাব। স্পর্শ খাবার খেয়ে কোথায় যেন চলে গেছে আগেভাগে খাবার থেকে উঠে গেছিল। বাসার সবাই খেয়ে অনেক অনেক প্রশংসা করল। অতটাও ভালো হয়নি কিন্তু অতটাও আখ্যাত হয়নি খাওয়া যাবে ভালো না হলেও। সবার প্রশংসা শুনেও খুশি হতে পারলাম না স্পর্শ কিছুই বলল না উল্টো রাগ করলো। কিন্তু আমি জানি তিনি আমার উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবে না। রাগ তো করি আমি। সে কখনো আমার উপর রাগ করে না।

কিন্তু এবার আমাকে ভুল প্রমাণ করল স্পর্শ। কঠিন রাগ করেছে বাসায় ফিরল রাত করে এসে আমার সাথে কথা বললো না। আমি কথা বললেও আমার সাথে কথা বলে না। কেমন যেন ইগনোর করে। আমার কেন যেন কান্না কান্না পেল। আমি কান্না করলাম। স্পর্শ দেখেও তার মন গললো না। কেমন যেন পাষানের মত কান্না দেখেও না দেখার ভান করল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম স্পর্শের কান্ড দেখে সামান্য কারণে এতটা রাগ।

সকালে শাশুড়ি মার কাছে বসে বসে বলছি আর কাদছি। তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here