রোদেলা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ৫০

0
1096

#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৫০

এমন সময় কলিং বেল বাজে…
একবার…
দুইবার……
গেইটের বাইরে থাকা ব্যাক্তি কলিং বেলের শব্দের মধ্যে দিয়ে নিজের ভেতরকার অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে, বিরক্ত মুখে এ্যামী দরজা খুলতে যায়…

দড়জা খুলে অবাক হয়ে যায় এ্যামী….
এত রাতে গেইটের বাইরে যাকে দেখলো তাকে দেখে হতবাক এ্যামী, দ্রুত ঘড়িতে তাকায় ও, দেখে এগারেটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট….
দড়জায় দাড়িয়ে থাকা মেয়েটি বললো-
: কেমন আছেন আপু…?
: ভালো, তুমি…?! এত রাতে….
: হ্যা জোভান বললো কাল নাকি আপনি চলে যাবেন, তাই আপনি থাকতে থাকতেই চলে এলাম…
: আমি চলে যাবো তো …! আমি না থাকলে তোমার কি আসা নিষেধ…?
: না, তা নয়, আচ্ছা আপু ভেতরে এসে কথা বলি….?
গেইট ছেড়ে দাঁড়ায় এ্যামী… ও রুমে ঢুকে সোফায় বসে….
: আপু পানি…
: দাঁড়াও আনছি….
পানিটা এক নিশ্বাসে শেষ করে মেয়েটা বললো-
: আপু জোভান আর শিমুল বললো আপনি শোভনের বিয়ের জন্য ওদেরকে মেয়ে খুঁজতে বলেছেন…
: হ্যা, ওর যা অবস্থা…. তুমিও তো এসে দেখে গিয়েছিলে একবার…..
: হ্যা, আপু আমি আমার বাবা মা কে বলে চলে এসেছি…. তারাও আসছে, আপনারা বড়রা কথা বলে সব ঠিকঠাক করে নিন… আপনাদের আপত্তি না থাকলে- আমি শোভনকে বিয়ে করতে চাই….

এ্যামী যেন একটা শক খেলো ওর কথা শুনে….
এই মেয়ে এক নিশ্বাসে এত কথা বলতে পারে দেখে এ্যামী বিস্মিত….!
মুহূর্তেই তাকালো মেয়েটার মুখে, গোলগাল চেহারার এই মিষ্টি মেয়েটি শোভনের ক্লাসমেট। ওদের স্কুল কলেজ একই ছিলো, এমনকি ওরা একসাথে কোচিং ও করতো। পাশ করার পর সারা প্রাইভেট মেডিকেলে ডাক্তারি পড়তে গেলো, আর শোভন ভর্তি হয়েছিল সিএসই তে…
এ এলাকাতেই ওদের বাড়ি। ওর বাবা মা দু’জনই সরকারি চাকুরীজীবি,

ওদের ঐ সময়কার বন্ধুরা একেকজন একেক জায়গায় গেলেও ওদের বন্ধুত্ব কিন্তু তখনো ছিলো।
ওদের বড় একটা সার্কেল ছিলো, অনেকেই হারিয়ে গেছে অবশ্য তবে সারা, জোভান, লিরা, শিমুল, রাহি, শোভন এরা এখনো খুব ভালো বন্ধু। সারা এমন একটা মেয়ে যার মতো একজনকে জীবণে পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার… শিক্ষিত, সুন্দরী, ভদ্র, বিনয়ী, বুদ্ধিমতী
কিন্তু….

এ্যামী শান্ত গলায় বলে-
: সারা…! তুমি কি বলছো তা জানো তো….
মাথা নিচু রেখে সারা বললো-
: হ্যা আপু আমি জানি…
আমাকে আপনাদের অপছন্দ করার কোন কারন নেই, আমাদের ব্যাপারে তো সবই জানেন আপনারা। নতুন করে কি বলবো…

আঙ্কেল আর বাবা দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিলেন । এখন যদিও তারা মনমালিন্যে আর অভিমানে কথা বলে না কেও কারো সাথে, তবুও আমার ধারনা
তারা এ বিয়েতে অমত করবে না। তাছাড়া আমি একজন ডাক্তার, আমি ওর ভালো টেককেয়ার করতে পারবো…
বেশ কিছুক্ষণ মৌন থেকে সারা বললো-
আপু আপনি তো জানেনই ওকে আমি আগে থেকেই…….
: সব ঠিক আছে সারা, কিন্তু শোভন তো তোমাকে….
: আপু আমি সব ঠিক করে দিবো, মেয়েরা পারে না এমন কিছু আছে…, আল্লাহ সহায় হলে আমি সব সামলে নিতে পারবো….
: তা ঠিক, তবুও শোভনের যে…
: আপু আমি সব জানি, আমি না-হয় ওর জন্য রোদেলা হয়ে যাবো…
আহত চোখে তাকায় এ্যামী…
একটা কথা আপু আমার বাবা মা কেও যেন এসব না জানে, ও অসুস্থ এটা আমি তাদের বলেছি, এর বেশী কিছু জানলে তারা কষ্ট পাবে….

এমন সময় শোভনের মা বসার ঘরে এসে ওকে দেখে হতবাক হয়ে বলে-
: আরে সারা…!
এত রাতে…..!?
এ্যামী ইশারায় ওর মাকে কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করে, যদিও তিনি কিছুই বুঝেন না।

এমন সময় আবার কলিং বেল বাজে…
সারা এ্যামীর হাত ধরে ভিতরের দিকে চলে যায়, এ বাড়িতে অনেক আসা যাওয়ার কারনে ওর পুরো বাড়ি নখদর্পনে। চলতে চলতে ফিসফিস করে বলে-
আপু বাবা মা নিশ্চয়ই….

ঠিক ওর বাবা ঘরে ঢুকে শোভনের বাবার নাম ধরে ডাকতে থাকে….
এই নাসির…..! কই ব্যাটা তুই….!?
শোভনের বাবা হকচকিয়ে পাঞ্জাবি পরতে পরতে বসার ঘরে আসে….
এ আওয়াজ তার অনেক চেনা, অনেক কাছের…

: ভাবি সারা আমাদের একমাত্র মেয়ে, ও যে কত আদরের তা তো আপনারা জানেনই, কত বছর সাধনা করে আমরা ওকে পাইছি, আল্লাহ দয়াবান মুখ তুলে চেয়েছিলেন…
সারাজীবনে কখনোই ও মুখ ফুটে কিছু চায় নাই আমার কাছে, যে যা দিয়েছে খুশি মনে গ্রহণ করেছে। আমার সেই মেয়ে আর সন্ধ্যায় আমাকে ডেকে বলে-
ও নাকি শোভনকে বিয়ে করতে চায়…..
ভাবা যায় ব্যাপারটা……

যেই মেয়ে নিজের জন্য কখনো কোন ছোটখাটো জিনিসও চায় নি, সে দুম করে নিজের বিয়ের কথা বলবে….

এমন সময় শোভনের বাবা তার পাশে এসে দাঁড়ায়, দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং একই এলাকায় থাকা সত্ত্বেও প্রায় বছর সাতেক পর দেখা দুজনে…
তিনি শোভনের বাবাকে দেখে বলে-
আরে ব্যাটা কই ছিলি তুই, আয় এদিকে…
ভাবী মিষ্টি নিয়ে আসছি আমি, আমাদের মিষ্টি দিন। সারার মা তুমি দাঁড়িয়ে কেন, বসো…..

আসলে হইছে কি ভাবী আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। যে কোন সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি জিনিসটা ভীষণ খারাপ। আমরা অন্যের কথা শুনে নিজেদের মধ্যে ভুলবোঝাবুঝির সৃষ্টি করি। আমাদের সম্পর্কের যে দূরত্বের সৃষ্টি হইছে তার জন্য আমিই দায়ী ছিলাম। ইগো সমস্যার কারনে এতদিন মন পুড়লেও সামনে আসতে পারি নাই….
এজন্য আমি লজ্জিত, আপনজনের কাছে লজ্জা প্রকাশে দোষের কিছু নাই।

আজ আমার মেয়ের জীবণের এত বড় ইস্যু, ক্ষমা চাওয়ার এ সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে পারি….?
বন্ধু আমাকে তুই….

কথাটা সম্পন্ন করতে দেন না শোভনের বাবা…
বন্ধুকে আলিঙ্গন করে নেন…
সে আলিঙ্গনরত অবস্থায়ই বলে –
: বন্ধু আমার ঘরের জান্নাতকে আমি তোর ছেলের হাতে তুলে দিতে চাই…,
: এটা আমার সৌভাগ্য বন্ধু….
: বন্ধু কিরে ব্যাটা বেয়াই বল…
হেসে দেয় তারা…
ঘরে থাকা সবাই সে হাসিতে যোগ দেয়…

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত কথা হয় সকলের ,বড়রা অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় শোভনের সাথে কথা বলে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে….
ওর মনের যা অবস্থা তাতে এ ব্যপার কিভাবে নিবে তা বলা মুশকিল। এ্যামী দূর থেকে ইশারা করে ওর বাবাকে, এ ব্যাপারে বেশী কিছু না বলতে…

রহস্যজনক ভাবে সারার মা এসব ব্যাপারে নির্লিপ্ত। তার নির্লিপ্ততা কেও টের না পেলেও শোভনের মা ঠিক খেয়াল করেছেন। এটা অসম্ভব নয় যে তিনি শোভনের ব্যাপারে সব জানেন। তা কি তার এই নির্লিপ্ততার কারন…

কোন মা-ই চাইবে না তার একমাত্র মেয়ে এমন কোন জীবণ বেছে নিক যেখনে রয়েছে অন্য কারো অস্তিত্ব… সেখানে তার মেয়ের কোন স্থান নেই, সেই স্থানও আবার খেটেখুটে তৈরী করে নিতে হবে। খাটাখাটুনি কোন প্রশ্ন না, প্রশ্ন হচ্ছে সারার এত ত্যাগের পরও যদি শোভন ওকে মন থেকে গ্রহণ না করে…
এই তার মনের চিন্তা হয়তো….

সারা সেরাতে এ্যামির সাথেই ছিলো। ওর বাবা মা ফিরে গেছে তাদের বাড়ি।

পরদিন সকালে এ্যামী চলে যাবে, তাই ঘুমিয়ে পরলো সারাকেও বললো ঘুমাতে। পরদিন সকালে উঠে এ্যামী দেখে ওর বিছানা ফাঁকা। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে সাতটা… হুড়মুড় করে উঠে বারান্দায় খুঁজে সারাকে। সেখানে না পেয়ে দৌড়ে যায় রান্না ঘরে। মাকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন-
দেখ গিয়ে শোভনের ঘরে রয়েছে….

দ্রুত এ্যামী শোভনের ঘরে গিয়ে দেখে ওরা দুজন নাশতা খাচ্ছে আর গল্প করছে…
শোভনকে গল্প শুনতে দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে দু একটা কথার উত্তর ও দিচ্ছে ও…
শোভন ইদানীং নিজেতে এত ডুবে থাকে যে কেও কোন কথা বললে কোন উত্তর ও দেয় না। সেদিক থেকে এটা একটা ভালো দিক।

রান্না ঘরে গিয়ে এ্যামী বলে কখন উঠেছে শোভন…
সাড়ে ছয়টায় এসে সারা আমাকে জিজ্ঞেস করে ওর ঘুম ভাঙতে গিয়েছে। যদিও আমি বলেছি এত সকালে উঠে না ও….
সকালের হাঁটাহাঁটি নাকি ওর শরীরের জন্য ভালো হবে। ওকে ঘুম থেকে উঠিয়ে হাত মুখ ধুইয়ে ছাদে নিয়ে গেছে। সেখানে আধঘন্টা হেঁটে নাশতা নিয়ে গেলো ওকে খাওয়াতে….

একটা কথা আছে জানিস তো মর্নিং শো দা ডে….
এ্যামী আমি আশার আলো দেখতে পারছি….
তুইও কি পাচ্ছিস দেখতে……

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here