চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️ #পর্ব_১৫ #লেখনীতে_নন্দিনী_নীলা

0
444

#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_নন্দিনী_নীলা

বিকেলে স্পর্শ এলো মাংস নিয়ে। এপাশে থেকে আব্বু ও গেছিল দিতে তারপর আপুর বাসায় গেছে। স্পর্শের সাথে সীফা এসেছে। স্পর্শ শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছে।এটা আমরাই দিয়েছি। খুব মানিয়েছে। সীফা এসে আমাকে বলল শাড়ি পরতে। স্পর্শ নাকি তাই বলেছে। আমার গলা শুকিয়ে আসে শাড়ি পরার কথা শুনলেই। আজো তাই হলো। কিন্তু সীফা শাড়ি পড়াতে দক্ষ সেই হাতে শাশুড়ি মার পছন্দ করা মেরুন রঙের শাড়িটা পরিয়ে দিল। এখন আমায় ওদের সাথে ওই বাসায় যেতে হবে। স্পর্শ বাইরে বসে আছে আম্মু তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে আমার শাড়ি পড়া হতেই সীফা কেও ধাক্কিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। আম্মু দুজনে খাওয়াচ্ছে। আমি সাজগোজ করতে লাগলাম।

স্পর্শ কে দেখলাম খাবারের সামনে অসহায়ভাবে বসে আছে। তিনি আর খেতে পারছে না বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু আম্মু তো তা মানছে না জামাইকে পেয়েছে তো আর কি লাগে তিনি স্পর্শের প্লেট ভরে ফেলছে। আমি গিয়ে আম্মুকে থামালাম। স্পর্শ প্লেটের খাবার আর গিলতে পারলো না। আমি তাকে হাত ধুয়ে উঠতে বললাম। আর মাকে বললাম,

‘ তুমি তো দেখি খাইয়েই মেরে ফেলবে।’

মা লজ্জা পেল একটু। আমার কথায় না স্পর্শকে এমন নাকানিচোবানি খেতে দেখে।

লজ্জা আমতা আমতা করতে লাগলো স্পর্শের সামনে।

তিনজন এই বাসায় চলে এলাম। বিকেলের সময় টা এই বাসায় ই কাটলো। আরেকটা জিনিস ঠিক হলো দুইদিন পর একটা ফ্যামিলি ট্যুরে যাওয়া হবে। আমাদের বাড়ির সবাই স্পর্শ দের বাড়ির সবাই, আর আপুদের বাড়ির আপী ভাইয়া। এই ট্যুরের কথা শুনে আমার আনন্দের সীমা র‌ইল না। বেড়াতে যেতে কে না পছন্দ করে আমিও করি। আর তা যদি হয় আপন মানুষদের সাথে তাহলে তো কথাই নাই।

বাড়িতে এসে আব্বু এসেছে দেখলাম। তাদের কথাটা বললাম। তারা রাজী না বলল আমরাই যাব তারা যাবে না। আমি স্পর্শ কে ফোন করে জানিয়ে দিলাম সব। স্পর্শ বলল,

‘ ডোন্ট ওয়ারি। আমি সবাইকে রাজি করিয়ে নিয়েই যাব টেনশন করো না।’

‘ আচ্ছা।’

.
আপুরা তিন দিনের আগে ফ্রি হতে পারেনি।তাই আমাদের তিনদিন পরেই ট্যুরে যাওয়ার বন্দোবস্ত হলো। আমার আব্বু আম্মু কে রাজি করাতে স্পর্শের অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। অবশেষে সফল হয়েছে। তাই তো আজ তিনদিন পর আমরা সবাই হৈ হল্লা করতে করতে বেড়াতে যাচ্ছি। আমরা সবাই যাব স্পর্শের নানু বাড়ি সিলেট। এত দূরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমার নানা শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আমাকে আর আমার পরিবারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাগল করে দিচ্ছে। কারো সময় ও সুযোগের অভাবে আর যাওয়া হয়নি। এবার ট্যুরে যাওয়ার কথা শুনতে সেখানে যাওয়ার কথা বলছে। বেড়ানো ও হবে তাদের দাওয়াত রক্ষা করা হবে এজন্য সেখানেই যাচ্ছি সবাই।
আব্বু আম্মু আর আমার শশুর শাশুড়ি এক গাড়িতে। আপু ভাইয়া আর আমি স্পর্শ এক গাড়িতে। মোহিনী ভাবি ভাইয়া আর সীফা এক গাড়িতে।
স্পর্শ ড্রাইভ করছে আমি পাশে বসা। পেছনে আপু আর মাহিন ভাইয়া। আমরা চারজনেই টুকটাক কথা বলেছি। আপু তার শশুর বাড়ি, ননদ, নানা শশুরবাড়ি সবার গল্প করছে।

আমি তাই মনোযোগ সহকারে শুনছি। আপু আর আম্মু আমাকে এখানে আসার আগে প‌ইপ‌‌ই করে বলেছে আমি যেন খুব ভদ্র হয়ে থাকি‌। আর কথা যেন কম বলি। সবার সাথে ভদ্রতার সাথে কথা বলি আর বুঝে শুনে যেন বলি। আমিও মাথা নেড়েছি।

অর্ধেক রাস্তা আসতেই মাহিন ভাই আর আপু সামনে এলো জোর করে আমাদের পেছনে পাঠিয়ে। কারণ স্পর্শ একা সম্পুর্ণ রাস্তা ড্রাইভ করলে অনেক ক্লান্ত হয়ে যাবে। তাই ভাইয়া করছে এখন।
পেছনে আসতেই স্পর্শ খপ করে আমার হাত ধরে হাতের পিঠে একটা চুমু খেল আমি বিস্মিত নয়নে স্পর্শের দিকে তাকালাম। স্পর্শ হাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখেই চোখ বন্ধ করে আছে সিটে। আমি ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে করতে সামনে তাকালাম আপুরা আমাদের ধ্যানে নাই। আমি নিচু স্বরে স্পর্শ কে বললাম,

‘ হাত ছাড়ুন।’

স্পর্শ আমার কথার প্রতি উত্তর করল না। অন্য কথা বলল, ‘ আমার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখো। যেতে আমাদের আরো অনেক সময় লাগবে। একটু ঘুমাও তাহলে মনে হবে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।’

আমি বড় বড় চোখ করে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছি। এই লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কি সব বলছে। সামনে আপু আর ভাই আছে তাড়াতাড়ি কি ভুলে গেছে নাকি।

‘ আপুদের সামনে আপনি এসব কি বলছেন? তাদের সামনে আমি আপনার এত কাছাকাছি থাকবো। তারা কি ভাববে? আপনার লজ্জা লাগছে না।’

স্পর্শ বন্ধ চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল সরাসরি এবার‌। তারপর বলল,

‘ কি ভাববে? আমরা যে হাসবেন্ড ওয়াইফ সেটা কি ভুলে গেছো? কাছাকাছি থাকলেই কি? আমাদের সম্পর্কে বৈধতা আছে! আর আমি জাস্ট আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে বলেছি। চুমু খেতে বলিনি যে লজ্জা পাবো।’

স্পর্শের এমন লাগাম ছাড়া কথা শুনে আমি চুপ করে গেলাম। আপু আর ভাইয়া নিজেদের মত কথা বলছে আমাদের দিকে তাদের খেয়াল নাই। স্পর্শের কাছে হার মেনে আমাকে তার কাঁধে মাথা রাখতেই হলো।

অনেকক্ষণ জার্নিতে আমার চোখে ঘুম তাড়াতাড়ি নেমে এলো।
সবার আগে এই বাসায় আমরা পৌছালাম। আমার ঘুম ভেঙে গেছে এখানে আসার আধা ঘণ্টা আগেই। আমি ঘুম থেকে চোখ মেলে দেখেছি স্পর্শ জাগ্রত। তিনি আমার ঘুমন্ত মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ মেলে তার চোখের গভীরতা দেখে থতমত খেয়ে গেলাম।

স্পর্শ আমার চোখের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, ‘ ঘুম ভেঙেছে আপনার তাহলে। সম্পূর্ণ রাস্তা শেষ করেই আপনার ঘুম ভাঙলো।’

আমি স্পর্শের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে সরে বসলাম। জানলা দিয়ে বাইরের দৃষ্টি ফেলে বললাম ঘুমঘুম কন্ঠ,

‘আমরা কি চলে এসেছি আর কতদূর!’

‘তাকিয়ে থাকো আর পাঁচ মিনিট তাই পুরনো কালের দুতালা বাড়ি দেখতে পাবা। সেটাই তোমার মামা শ্বশুর বাড়ি!’

‘ সত্যি এত তাড়াতাড়ি চলে এলাম!’অবাক গলায় বললাম কারণ আমার মনে হচ্ছে আমি এইমাত্র ঘুমিয়েছি এত তাড়াতাড়ি চলে এলাম এমনটাই মনে হচ্ছে।

‘জি না ম্যাডাম। আপনি পাক্কা তিন ঘন্টা ঘুমিয়েছেন।’

আমি অবাক স্বরে বললাম, ‘ এত সময়! আমার তো মনে হচ্ছে এইমাত্র ঘুমালাম!’

‘ভালো। চলে এসেছে ওই দেখো!’

বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো না এটা আদিম কালের। মডেল আদিম কালের হলেও চকচকে একদম।পুরনো বাড়ি এটা দেখলে কেও বলবে না শুধু ডিজাইন টাই পুরোনো। এত সুন্দর করে যত্ন করে রেখেছে এটা যে পুরনো বাড়ি বুঝার উপায় নাই। চকচকে রঙ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাজাদের বাড়ি মনে হচ্ছে!

আমরা সবার আগেই পৌঁছেছি তাই সবার আগে ভেতরে গেলাম আমরাই। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। আদ বয়স্ক একটা লোক আমাদের দেখে স্পর্শ মনে হয় চিনতে পারল আমাদের তিনজনকে তো আর চিনবে না। চিনতে পেরে ভেতরে চলে গেল।একটু পরে একদল লোক বেরিয়ে এল চিৎকার-চেচামেচি করতে করতে সেখানে একজন বয়স্ক মহিলা স্পর্শ কে জাপ্টে ধরলো স্পর্শ তাকে নানু বলেছে। এটাই স্পর্শ এর নানু আমি তাকে চিনি তার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে। আরো অনেক ছেলেমেয়ে ছোট বাচ্চা অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। মোটামুটি সবাইকে আমি চিনি। স্পর্শের মামা দুই জন, মামি দুই জন আর তাদের ছেলে মেয়ে পাঁচজন‌‌।সবার সাথে আমার আগেই সাক্ষাৎ হয়েছে শুধু এই বাসায় আসা হয় নাই। আমি মামা মামী দের কে সালাম দিয়ে তাদের সাথে দুই একটা কথা বললাম। নানু স্পর্শকের ছেড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সালাম দেয়ার সুযোগ পেলাম না তিনি খুবই মিশুক। স্পর্শের মামাতো পাঁচ বোন। এক মামার দুই মেয়ে এক মামার তিন মেয়ে। তাদের দুজনের একজনেরও ছেলে নাই।

স্পর্শের চার মামাতো বোন‌ই খুব ভালো শুধু একজন বাদে‌।সেও ভালো কিন্তু সে নাকি আগেই স্পর্শ কে পছন্দ করত মনে মনে নাকি স্পর্শের বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। তাই আমার সাথে স্পর্শের বিয়ে হয়েছে। আমাকে ভালোবেসে! এসব জানার পর থেকে নাকি তার মন ভেঙেছে! তাই সে এই একটা কারনে আমাকে সহ্য করতে পারে না! কিন্তু আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করে নি। কিন্তু সে একটা কারণেই আমার সাথে মিশতে পারে না দূরে থাকে। আমি জারার দিকে অসহায় মুখ করে তাকালাম। জারা এক দৃষ্টিতে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পর্শে তার ছোট মামাতো বোন ফারজানা ও মাইশার সাথে কথা বলছে ওদের চকলেটের দুইটা বক্স দিল।

সবার সাথে আমরা ভিতরে গিয়ে বসলাম তখনই বাবা-মা মোহিনী ভাবীরা সবাই চলে এলো। সবাই ক্লান্ত তাই ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে যে যার জন্য ঠিক করে রাখা রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সারারাস্তা আমি ঘুমিয়ে এসেছি তাই আমার চোখে ঘুম নাই। আমাকে আর স্পর্শকে এক রুমে থাকতে দেওয়া হলো।স্পর্শ রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝলাম না। তিনি আমার সাথে ঘুমিয়েছেন তাহলে তিনি আবার এখন ঘুমাচ্ছে কেন? অদ্ভুত আমি একাই জেগে থাকবো। এই বাসার সবার সাথে আগে কথা হলেও একটু ইতস্ত বোধ করি সবার সাথে কথা বলতে। যতই হোক মামা শ্বশুর বাড়ি। শ্বশুরবাড়ি নামটা আসলে কেমন যেন নিজে গুটিয়ে যায়। চঞ্চল ফিলিংসটা ভেতর থেকে ঘুমিয়ে যায়।আবার এটা আমার বাড়ি আমার নানু বাড়ি থাকতো তাহলে আমি কিছুতেই আমার শান্ত স্বভাবের হয়ে থাকতে পারতাম না। লাফালাফি চঞ্চলতা তো আমার রক্তে রক্তে মিশে আছে। কিন্তু নিজের শ্বশুরবাড়ি গেলে আর এখানে এসে আমি একদম শান্ত স্বভাবের ভদ্র হয়ে যায়। গালে হাত দিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি কোন দিকে যাবো বুঝতে পারছি না।সেই মুহূর্তে যারা এসে আমার হাত ধরে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেল । আমি বিস্মিত হয়ে জারার দিকে তাকিয়ে আছি। জারা আমার থেকে এ ক্লাস নিচে পড়ে এজন্য আমি নাম ধরে সম্মোধন করি। জারা আমার ছোট থাকলেও আমাকে নাম ধরে ডাকে ভাবি বলে না। ওকে যেদিন আমি প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি আমাকে ভাবি বলোনা কেন? আমি যে তোমার ভাবি হই আর তুমি তো আমার বয়সে বড় না তাহলে আমাকে এভাবে বলতে সমস্যা কি? সেদিন অকপটে বলে দিয়েছিল,

‘তুমি সম্পর্কে আমার ভাবি হলেও আমি তোমাকে ভাবি কোনদিন বলব না!আর তোমাকে যে আমি ভাবি বলি না সেটা কেউ জানবেও না! কারণ আমি কখনো কারো সামনে তোমার কথাতে কথাই বলব না। তোমাকে চিনি না এমন করেই থাকবো।’

‘অদ্ভুত মেয়ে!’

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here