রহস্যময় সারপ্রাইজ আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা পর্ব-২

0
277

রহস্যময় সারপ্রাইজ
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
পর্ব-২

হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙুলের মাঝে কলম আটকে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কলম ঘুরাচ্ছে অধরা। কপালে চিন্তার ভাজ। কোন কিছু নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করছে সে। তার চিন্তার গভীরতায় আছে প্রতিভার মামলা। খানিক আগেই প্রতিভার ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে পেয়েছে সে। যাতে বলা হয়েছে, প্রতিভা অন্তঃসত্ত্বা ছিল। তেরো থেকে পনেরো সপ্তাহ হবে। অধরা ধারণা করছে প্রতিভার গর্ভধারণের কথা পরিবারের কেউ জানে না। হয়তো তুরাগ ও জানে না। বিষয়টা জানা থাকলে প্রতিভার মৃত্যুতে সবার মনোভঙ্গি ভিন্ন হতো। সাধারণত প্রথম সন্তান নিয়ে মা বাবার আশা, আকাঙ্খা, আনন্দ, উল্লাস বেশি থাকে। যেহেতু প্রতিভা তুরাগের পরিণয়টা ছিল প্রেমের এবং দুজনের মাঝে ভালোবাসা বেশ তবে সন্তান নিয়ে আনন্দটাও বেশি থাকার কথা। সেই সাথে যত্ন ও বেশি থাকার কথা।

অনাগত সন্তানের কথা জানলে তুরাগ এত রাতে প্রতিভাকে এক ছাড়ার কথা না। নিজেদের গাড়ি থাকা সত্ত্বেও অধরাকে লোকাল গাড়িতে করে আসা যাওয়া করতে দিতো না। সবসময় নিজস্ব গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটা হঠাৎ লোকাল গাড়ির আশ্র‍য় নিলো। তাও এত রাতে! কেনো! এই প্রশ্নও রহস্যজনক। প্রেগন্যান্সি এবং প্রতিভার লোকাল গাড়ি চড়ার রহস্যটা তুরাগের জবানবন্দি থেকে উদঘাটন হবে।

স্ত্রীর মৃত্যুর পর গত কয়েক ঘন্টায় ছ’বার জ্ঞান হারিয়েছে তুরাগ। হুশ ফিরে প্রতিভা প্রতিভা বলে আবার জ্ঞান হারায়। যার কারণে তার জবানবন্দি নেয়া সম্ভব হয় নি। তুরাগের জবানবন্দি নিলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসতো,এত ধোঁয়াশা থাকতো না।

অধরার মনে নতুন নতুন প্রশ্ন হানা দিচ্ছে। আচ্ছা, প্রতিভার মৃত্যুর পিছনে প্রেগন্যান্সিই দায়ী নয় তো ? কোথাও এই বাচ্চা অবৈধ নয় তো! প্রতিভা কি পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলো? এবং বাচ্চাটা তার প্রেমিকের। যার কারণে তুরাগ জানার আগে প্রতিভা কারো সাথে পরিকল্পনা করে নিজের মৃত্যু নিজে ডেকেছে? কিংবা সেই প্রেমিকের সাথে কোন কারণে বিরোধ লেগে প্রেমিকই প্রতিভাকে খুন করেছে! এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। হতে পারে। আজকাল পরকীয়া, খুন এসব অহরহ দেখা যায়। কিন্তু সবার ভাষ্যমতে প্রতিভা-তুরাগের বন্ধনটা বেশ দৃঢ় ছিলো। সম্পর্কটা ভালোবাসায় ভরপুর ছিলো। তুরাগকে প্রতিভা প্রচন্ড ভালোবাসতো। যদি ভালো না বাসতো কিংবা পরকীয়া করতো তবে তুরাগ অসুস্থ হওয়ার পর দিনরাত তুরাগের সেবা না করে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যেতো। সে তো তা না করে অসুস্থ স্বামীর সেবায় দিন রাত এক করে দিয়েছে। তবে স্বামীর প্রতি এত ভালোবাসা থাকলে অনাগত সন্তানের কথা স্বামীকে জানালো না কেনো! যদি জানায় তবে তারা আমাদের কাছে বিষয়টা লুকালো কেনো!এখানে ও রহস্য আছে। পুরো কেসটাই ধোঁয়াশা, রহস্যঘেরা। এ যেন কুহেলিকা ধূম্রজালের আবৃত কোন শীতাতপ রাতের প্রকৃতির রূপ।

আরেক ধোয়াঁশা হলো মৃত্যুর ধরণ। প্রতিভার মৃত্যুটা শ্বাসরোধ এর কারণে হয়েছে। যা গলায় দড়ির মাধ্যমে হয়েছে। রিপোর্ট বলছে গত কাল রাত তিনটা নাগাদ প্রতিভার মৃত্যু হয়েছে। ফরেনসিক রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে অধরা ভাবছে, প্রতিভার মৃত্যু যদি গলায় দড়ির প্যাচে শ্বাসরোধের কারণে হয় তবে গলায় দড়ির চিহ্ন তো থাকবে, কিন্তু আমি যখন লাশ দেখলাম তখন তো গলায় বিন্দুমাত্র চিহ্ন ও ছিলো না। গলায় ফাঁস লাগালো অথচ গলায় কোন দাগ হলো না, এটা কিভাবে সম্ভব!

প্রতিভা বাবার বাসা থেকে বের হয়েছে রাত এগারোটায়, রাত বারোটায় প্রতিভা শিলাকে ম্যাসেজ করেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় রাত বারোটা অবধি ও প্রতিভা সুস্থ সবল এবং স্বজ্ঞানে ছিলো। প্রতিভার ফোন লোকেশন বলছে সে রাত বারোটায় ধানমন্ডি লেকে ছিলো। ম্যাসেজ দেয়ার পর থেকে এখন অবধি ফোনটার লোকেশন ধানমন্ডি লেকই দেখাচ্ছে। যারঅর্থ ফোনটা এখনো ওখানেই আছে। কিন্তু প্রতিভা বাবার বাসা থেকে মিরপুর স্বামীর বাসায় না গিয়ে এতে রাতে লেকের পাড়ে কেনো গেলো! কে ডেকেছে তাকে? তার প্রেমিক? নাকি অন্যকেউ!
প্রতিভা যখন লেকে গেলো তখন তার বাবা মা ধানমন্ডি নিজেদের বাড়িতে ছিলো। স্বরূপা প্রতিভার বাবার বাসায় ছিলো। তুরাগ ও মিরপুর নিজের বাসায় ছিলো। তবে বাসায় যাবার নাম করে প্রতিভা লেকে কেনো গেলো! কে ডাকলো?আর তার মৃত্যু কেনো হলো! এটা রহস্য সংখ্যা ২।

রহস্য সংখ্যা ৩ হচ্ছে, প্রতিভার মৃত্যু হয়েছে রাত তিনটায়। তুরাগদের বিল্ডিংয়ের দারোয়ান গেট খুলে ভোর পাঁচটায়। বিল্ডিংয়ের অনেকে ফজর নামাজ পড়তে যায়, মুসল্লিদের জন্যই গেট খোলা হয়। ভোর থেকেই মানুষের চলাচলা শুরু হয়ে যায়। ভোর পাঁচটার পর লাশ আনা সম্ভব নয়।

অধরা থানায় আসার আগে বিল্ডিংয়ের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছে। ভোর পাঁচটার পর বাইরের কাউকে বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করতে কিংবা বের হতে দেখা যায় নি। যার অর্থ ভোর পাঁচটার আগেই লাশ তুরাগের বাসার সামনে পৌঁছে গেছে। কিন্তু দারোয়ানের ভাষ্যমতে কাল রাত বারোটা থেকে ভোর পাঁচটার অবধি, না কেউ বিল্ডিং থেকে বেরিয়েছে, আর না কেউ বাইরে থেকে এসেছে। সিসিটিভি ফুটেজ ও এমনটাই বলছে। ভুঁইয়া ভিলার গ্রাউন্ডে কোণায় কোণায় লাইট জ্বালানো থাকে সারারাত। লাইটের উজ্জ্বল আলোতে প্রতি সেকেন্ড সিসিটিভিতে রেকর্ড হয়। কেউ যদি লাশ নিয়ে আসে তবে সিসিটিভিতে রেকর্ড হওয়ার কথা। কিন্তু তেমন তো রেকর্ড হয় নি। কেউ যদি না আসে তবে লাশ তুরাগের ফ্ল্যাটের সামনে আসলো কিভাবে? রহস্য এখানেই।

রহস্যজালে মস্তিষ্কে ঢেকে গিয়েছে অধরার। মাথা চেপে খানিক ভেবে সিদ্ধান্ত নিল সবকিছু আবার খুব ভালো করে খুতিয়ে দেখবে। এখনি ভুঁইয়্যা ভিলায় গিয়ে সব কিছু আরেকবার পরখ করে আসবে । অধরা আন্দাজ করছে সে কোন সূত্র ফেলে এসেছে। সেই সূত্রের সন্ধানেই যাবে। সিসিটিভি ফুটেজ আরেকবার চেক করবে। কিন্তু তার আগে একবার ফরেনসিক রিপোর্ট এর ব্যাপারটা সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। মৃত্যুটা কিভাবে হয়েছে জানাটা জুরুরি৷ এতেই হয়তো কোন জোট থাকতে পারে।

ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তার লিপিকা মন্ডলকে ফোন দিলো অধরা। তার সাথে ব্যাক্তিগতভাবে পরিচিত সে। তাই খাতিরটা একটু বেশিই। প্রথমবার রিং হওয়ার পরই রিসিভ হলো। কুশল বিনিময় শেষে অধরা জিজ্ঞেস করল,
” ডক্টর প্রতিভার মৃত্যুটা কিভাবে হয়েছে?”
“শ্বাসরোধের কারণে মৃত্যু হয়েছে। গলায় দড়ির দাগ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ গলায় ফাঁস দেয়ার ফলে শ্বাসবন্ধ হয়ে মারা গেছে।”

লিপিকার স্বরটা স্বাভাবিক। তার স্বাভাবিক স্বরে অস্বাভাবিক হয়ে গেলে অধরার স্বর। বিস্ময়ে কন্ঠরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম। বিস্ময় ঠেলে জিজ্ঞেস করল,
” আমি যখন লাশ দেখলাম তখন তো গলায় কোন দাগ ছিলো না। তবে এখন কিভাবে দেখা গেলো! ”

” তুমি দেখোনি কারণ দড়ির দাগটা ভারি মেকাপের সাহায্যে ঢেকে দেয়া হয়েছে। তারউপর গলায় থাকা ভারি নেকলেসটা দেয়ার ফলে গলার দাগটা কারো নজরে পড়েনি। যা আমাদের পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। ”

ডক্টর লিপিকার কথায় অধরার বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল। কিন্তু সেটা লিপিকার কাছে প্রকাশ না করে বললো,
“শরীরে আর কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে?”
“না, শরীরে আর কোথাও একটা পিপড়ার কামড় সমান জখম ও নেই। গলায় ফাঁস দেয়ার ফলেই মৃত্যু হয়েছে।”
“মৃত্যুর আগে প্রতিভা কি নেশা করেছিল?”
“না। একদম স্বাভাবিক ছিলো। ”
“সেক্সুয়াল কিছু?”
“নাহ। ”
“লাশের শরীরে কারো আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে? ”
“নাহ। ”
“আপনার কি মনে হয় এটা কি কোন ভাবে আত্মহত্যা হতে পারে?”
“মৃত্যুর আলামত দেখে তো স্পষ্ট বলা যায় এটা হত্যা। আত্মহত্যা কোনভাবেই হতে পারে না। আত্মহত্যা হলে তার চোখে মুখে বিস্ময়ভাব থাকতো না। যা লাশের চেহারায় দেখা যাচ্ছে। ”
“আত্মহত্যা হলে মৃত্যুর পর নিজের গলার দাগ কিভাবে মুছা সম্ভব? আর যদি হত্যা মামলা হয় তবে প্রতিভার মুখে আতঙ্ক থাকতো। যা মৃত্যুর পর প্রতিভার মুখে ছিলো না। এখানেই রহস্য। ”
কপালে চিন্তার ভাজ গাঢ়তর করে বলল অধরা।
“এই রহস্য উদঘাটন করতে হবে তোমাকে। ”
হেসে বলল লিপিকা।

অধরা তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না। ভাবুক হয়ে কিছু একটা ভাবল। ভাবনা থেকে বেরিয়ে চঞ্চল গলায় জিজ্ঞেস করল,
” আপনি প্রতিভার ভিতরে বেড়ে উঠা ভ্রুণের ডি এন এ টেস্ট করুন। আর যত দ্রুত পারেন আমাকে রিপোর্ট জানান। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আপনাকে পরে ফোন দিচ্ছি।”
বলে লিপিকার উত্তরের আশা না করে ফোন কেটে দিলো অধরা। তারপর কনস্টেবল আদাবরকে ডাক দিলো।

অধরার তলবে মিনিটখানের মাঝেই কেবিনের দরজায় এসে দাঁড়ালো চল্লিশোর্ধ্ব এক শ্যামবর্ণের লোক। পরনে পুলিশী পোশাক। দরজায় নক করে বলল,
“আসবো ম্যাডাম?”
” আসুন।”

আদাবর ভিতরে এসে অধরার ডেস্কের সামনে নত ভঙ্গিতে দাঁড়ালো। অধরা বললো,
” আদাবর সাহেব আপনাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা পালন করেছেন?”
“জ্বি ম্যাডাম ।”
“রিপোর্ট করুন।”

অধরার আদেশের আদাবর বলা শুরু করল,
” লাশের উপর থাকা চিরকুট, নেম কার্ড,র‍্যাপিং পেপার, ট্রলি সব কিছু পরীক্ষা করেছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিভাগ। তাদের দেয়া রিপোর্ট মুতাবেক চিরকুট এবং নেমকার্ড ছাড়া কোথাও কারো আঙুলের ছাপ নেই। চিরকুট এবং নেমকার্ডে আঙুলের চাপ পাওয়া গেছে। যা লাশের আঙুলের ছাপের সাথে মিল পাওয়া যায়। ”
“রিপোর্ট মোতাবেক, চিরকুট আর নেমকার্ড প্রতিভা’ই লিখেছে।”
আনমনে বললো অধরা। আদবর বললো,
“জ্বি, ম্যাডাম। তবে একটা কথা বলতে হয়, এটা পূর্ব পরিকল্পিত হত্যা। খুনী সবকিছু ঠান্ডা মাথায় নিখুঁত ভাবে করেছে। কোথাও একটা সূত্র রেখে যায় নি। ”

চিন্তিত ভঙিতে অধরা সায় জানিয়ে বলল,
“তা যা বলেছেন। তবে প্রমাণ ছাড়া আমরা মামলাকে আত্মহত্যা কিংবা হত্যা কোনটাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছিনা। শুধুমাত্র ধারণা করতে পারি। আত্মহত্যা হোক কিংবা হত্যা সবটাই পূর্ব পরিকল্পিত। মামলা এখনো ধোঁয়াশাময়। আমার মনে হয়ে আমাদের আবার ভুঁইয়া ভিলায় যাওয়া উচিত। সবকিছু আরেকবার খুঁতিয়ে দেখা দরকার। কোথাও কোন সূত্র রেখে আসলাম কি না। ”
“জ্বি ম্যাডাম।”

এরিমাঝে দরজায় নক হলো। দরজায় পুলিশ পোশাকে এক যুবক দাঁড়ানো। অধরা ভিতরে আসতে বললো। অনুমতি পেয়ে পুলিশ কনস্টেবল জিহাদ অধরার কেবিনে প্রবেশ করলো। একটা ফাইল অধরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“ম্যাডাম সবার কললিস্ট ডিটেইলস এবং লোকেশন ।”

প্রতিভা জিহদের হাত থেকে ফাইলটা হাতে নিয়ে খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লো। তারপর বললো,
“ফোন লোকেশন অনুযায়ী কাল রাত বারোটা থেকে সকাল দশটা অবধি প্রভাত মির্জা,তিহানা, এবং স্বরূপা ধানমন্ডি প্রভাত মির্জার নিজে বাড়ি অর্থ্যাৎ মির্জা হাউজে ছিলো। তুরাগ আর শিলা মিরপুরে তুরাগের ফ্ল্যাটে ছিলো। প্রতিভা ছিলো ধানমন্ডি লেকে। এখনো প্রতিভার ফোন লেকেই এক্টিভ। ”
“জ্বি ম্যাম।”
“গাড়ি বের করতে বলো, তুরাগের বাসায় যেতে হবে।” গম্ভীরমুখে আদেশ করল অধরা। আদেশ মাফিক জিহাদ ছুটল বাইরের দিকে।

**

এই মুহুর্তে অধরা বসে আছে মিরপুরের পূর্ব কাজীপাড়ার সাত তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং ভুঁইয়া ভিলার কন্ট্রোল রুমে। উদ্দেশ্য, দ্বিতীয়বারের মতো সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা।

গত দুদিনের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করার পর হতাশার আভা ফুটে উঠল অধরার চেহারায়। সন্দেহজনক কিছুই ফেলো না। তৃতীয়বার চেক করার সময় একটা ব্যাপার চোখে পড়ল। মিনিট দশেকের সিসিটিভি ফুটেজ উধাও! কাল ভোররাত চারটা থেকে চারটা দশ এর মধ্যকার ফুটেজ নেই। রাতে তিনটা উনষাট এর পর চারটা এগারোর ফুটেজ দেখাচ্ছে। মধ্যখানের দশ মিনিট কেটে আগে পরের সময়টাকে এডিট করে জোড়া দিয়ে দিয়েছে। এমন ভাবে এডিট করেছে সময়ের দিকে নজর না দিলে বুঝাই যাবে না যে মাঝের দশমিনিট নেই। অতি নিখুঁত ভাবে করার কারণে সকালে চেক করার সময় অধরার চোখে পড়েনি।
যা সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখায় এখন চোখে পড়ছে। তারমানে এই দশমিনিটের মাঝেই প্রতিভার লাশ তুরাগের ফ্ল্যাটের সামনে রেখে গেছে কেউ। প্রতিভার মৃত্যু হয়েছে রাত তিনটায়,লাশ পৌঁছেছে চারটায়। ধানমন্ডি থেকে মিরপুরের দূরত্বটাও ঘন্টাখানেক। লাশ আনার মাঝেই ঘন্টা পেরিয়ে যাবে, এক ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু,সাজানো, প্যাকিং, এবং গন্তব্যে প্রেরণ সব হয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব!
তবে একটা কথা স্পষ্ট যে এসব মোটেও একজনের কাজ নয়। এতে কয়েকজন কিংবা একটা দলের সম্পৃক্ততা আছে। নাহলে দশমিনিটের মাঝে লাশ জায়গামতো পৌছানো, সিসিটিভি ফুটেজ ডিলিট করা এবং পালায়ন একজনের ধারা সম্ভব নয়। আর এটা পূর্ব পরিকল্পিত হত্যা, আত্মহত্যা নয়। কোন ভাবেই সুইসাইড হতে পারেনা। হত্যার জন্য পরিকল্পনার দরকার হয়, আত্মহত্যার জন্য নয়।

সেকেন্ড দশেক ভেবে অধরা ভূঁইয়া ভিলার মালিক সমিতির সভাপতিকে তলব করল। সাতজনের অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে কাজী পাড়ার ভুঁইয়া ভিলা। এর একটা মালিক সমিতি আছে। যার সভাপতি দেলোয়ার ভুঁইয়া। বয়স পঞ্চাশের ঘরে গিয়ে আটকেছে। ময়লা গায়ের রঙ, মোটা ঠোঁটের উপর মোটা ঘন কালো গোঁফ। চ্যাপটা চিবুক। দানবের মতো শরীর। চেহারায় হিংস্রতার আভাস। মূলত তিনি নেতা গোছের লোক, রাজনীতি করেন। বেশ প্রভাবশালী। এলাকায় অনেক দাপট তার। তার এই দাপটের জন্যই দশজনের মালিকানা সত্ত্বেও বিল্ডিংটা তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।

অধরার তলব পেয়ে খানিক পরেই দেলোয়ার সাহেব মালিক সমিতির সবাইকে নিয়ে বীরবেশে হাজির হলেন কন্ট্রোল রুমে। ভাবটা এমন যেন তিনি কোন মঞ্চে বক্তব্য রাখতে যাচ্ছেন। অধরা সবার দিকে এক নজর দিয়ে বললো,
“মালিক সমিতির সভাপতি কে?”
“আমি।”

কন্ট্রোল রুমের এক কোণায় থাকা একটা চেয়ার টেনে পায়ের উপর পা রেখে বসে বললেন দেলোয়ার ভুঁইয়া । অধরা দেলোয়ার ভুঁইয়ার দিকে সন্দেহের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। অধরার মনে হচ্ছে এই লোকটা খুন করতে পারে। চেহারায় খুনি খুনি ভাব আছে। তা ছাড়া নেতা মানুষ। তাদের জন্য এসব বাঁ হাতের খেলা। তবে প্রমাণ ছাড়া তো আর যাকে তাকে খুনির পদবী দেয়া যায় না। মনের সন্দেহকে মনে চেপে রেখে অধরা বললো,
” কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব কার উপর ন্যাস্ত?”
“ফরিদের উপর। ”
গম্ভীরমুখে বললেন দেলোয়ার সাহেব। অধরা আদেশের স্বরে বললো,
“কোথায় সে? ডাকুন তাকে।”
“সে তো এখানে নেই। গ্রামে গেছে অসুস্থ মাকে দেখতে। ”
কন্ঠের গম্ভীর্যতা বজায় রেখে বললেন দেলোয়ার সাহেব। তার উপর সন্দেহের দৃষ্টি ফেলে অধরা বললো,
“কবে গেছে?”
“দু’দিন আগে।”
“এই দুইদিন কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব কার উপর ন্যস্ত ছিল?”
“কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব একজনের ছিলো সে হচ্ছে ফরিদ। সেই কন্ট্রোল রুম কন্ট্রোল করে। ফরিদের অনুপস্থিতিতে কন্ট্রোল রুম খালিই থাকে। সিসিটিভিতে সব রেকর্ড হয়। ফরিদ আসলে চেক করে কোন সমস্যা দেখলে আমাদের জানায়,আমরা সমাধান করি।”
” ফরিদের অনুপস্থিতিতে মালিক সমিতির কেউ একজন দিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করাতে পারতেন। তাহলে আজ কেউ এভাবে লাশ রেখে পালিয়ে যেতে পারতো না। আপনাদের একটু অসচেতনতার জন্য মানুষের জীবন যায়।”

কন্ঠে বিরক্তির আভা মিশিয়ে বললো অধরা। অধরার কথায় দেলোয়ার সাহেবের চোয়ালে কাঠিন্যতা দেখা দিলো।
কন্ঠে কঠোরতা মিশিয়ে কালো চেহারাটাকে আরো কালো করে বললেন,
“আপনি তদন্ত করতে এসেছেন সেটাই করুন। আমাদের কাজ শিখাতে আসবেন না। কন্ট্রোল রুমে কাকে রাখবো না রাখবো আমরা বুঝবো। আপনাকে বলতে হবে না। এই সিকিউরিটিতেও ভুঁইয়া ভিলায় কখনো চুরি ও হয় নি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এখন খুন হয়েছে। এতে আমাদের তো দোষ নেই। খুনী খুন করেছে। আমরাতো করিনি। আর সবসময় তো আর খুন হয় না যে আমরা সতর্ক থাকব। আজ হয়েছে আর কখনো হবে না। আমাদের সিকিউরিটি এমনই থাকবে। তাই আপনি আমাদের নীতি না শিখিয়ে খুনিকেই ধরুন। ”

অধরার চোয়াল গম্ভীর হলো এ পর্যায়ে। স্বরে ঢাকল দৃঢ়তায়,
“আমি আমার কাজই করছি। আপনাদের জবাবদিহি করার অধিকার এবং ক্ষমতা দুটোই আছে আমার। খুন যেহেতু ভুঁইয়া ভিলায় হয়েছে আর আমাকে মামলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাই মামলা সমাধান করার জন্য আমাকে যা করতে হয় আমি তা করবো। এর পিছনে যত বড় নেতা বা রাঘব বোয়ালই থাকুক না কেনো আমি খুনীকে আইনের আওতায় এনে শান্তি দিবোই। ”

দেলোয়ার সাহেব মুখ ভর্তি পানের রস পিক করে পাশে ফেলে হেসে বললেন,
” আপনার যা করার করুন। আমরাও দেখব কেমন পারেন আপনি। পারলে খুনীকে বের করুন ”
থেমে দৃঢ় গলায় বললেন,
“আর হ্যাঁ, আমরা নির্দোষ মানুষ আমাদের এসবে জড়াবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মামলা রফাদফা করুন। বিল্ডিংয়ে পুলিশের যাতায়াত আমার পছন্দ নয়। এমনিতেই পুলিশদের আমার ভীষন অপছন্দ। আপনাদের তদন্তের চাপে পুরো বিল্ডিংয়ের সব মানুষের ডিস্টার্ব হচ্ছে। খুনীকে বের করতে এসেছেন খুনীকে বের করে দলবল নিয়ে বিদায় হন। আমাদের জ্ঞান দিতে কিংবা জেরা করতে আসবেন না। অন্যথায় ফলাফল ভালো হবে না।”

অধরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দেলোয়ার ভুঁইয়া তার দলবল নিয়ে চলে গেলেন। তারা যেতেই কনস্টেবল জিহাদ বলে উঠল,
“চোরের মায়ের বড় গলা। এই লোকের নামে চাঁদাবাজি,খুন,অপহরণের মামলা আছে। ক্ষমতার দাপটে আইন তাকে শাস্তি দিতে পারে না। এই লোকেরে আমার সন্দেহ হয়। দেখতেই খুনী লাগে। এই লোক কোথাও কোনভাবেই এই খুনের সাথে জড়িত নয় তো, ম্যাডাম?”

রাগের শিখা তখন অধরার চোখে। দেলোয়ার সাহেবের হুমকিতে তার দেহের রক্ত চলকে যেন মাথায় উঠে গিয়েছে। রাশভারী গলায় বলল,
” অসম্ভব নয়। ক্ষমতার দাপটে মানুষ সব করতে পারে। এখন আমাদের সূত্র খুঁজে বের করতে হবে। কে কোন এঙ্গেলে চাল চালছে সেটাই আমাদের বের করতে হবে। একবার সূত্র খুঁজে পেলে আমরাও আমাদের ক্ষমতা দেখাতে পারব। আচ্ছা শুনো, মালিক সমিতির সবার উপর নজর রাখো। ”
“ঠিক আছে, ম্যাডাম।”
“এখন দারোয়ানকে ডাকো।। ”

ভুঁইয়া ভিলার মধ্যবয়সী দারোয়ান বোরহান উদ্দিন অধরার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন নত ভঙ্গিতে। ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে ও দরদর করে ঘামছেন। বাদামী চামড়ার হাতজোড়া কাঁপছে থরথর করে, ত্রিকোণ চোয়াল ভয়ে ঘেরা, কপালে চিন্তার ভাজ। ভয়ে কাচুমাচু করছেন। চোখ এদিক ওদিক করছে,যেন পালানোর পথ খুঁজছে। ভাবটা এমন যেন বড় সড় কোন অপরাধ করে ধরা খেয়েছেন। অধরা বোরহানের বেগতিক অবস্থা দেখে মৃদু হাসলো। বোরহানের ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” এমনটা কেনো করলেন?”
“কক্কি কক্করেছি?”
তোতলিয়ে বললো বোরহান। অধরা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” প্রতিভার সাথে আপনার কিসের শত্রুতা ছিলো যে এভাবে খুন করলেন? আমি জানি সব, আমার কাছে লুকিয়ে লাভ নেই। সত্যটা বলুন।”

দারোয়ান অধরার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here