#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#পর্ব_১৮
#লেখনীতে_নন্দিনী_নীলা
বিছানাকান্দি ( Bisnakandi / Bichnakandi) ভারত এবং বাংলাদেশের বর্ডার এলাকায় অবস্থিত। বিছনাকান্দি থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে থাকা লাল পতাকাগুলোর সারি জানান দেয় যে ওপাশেই ভারত। এখান থেকে সহজেই ভারতীয় জলপ্রপাত গুলো দেখা যায় যা থেকে পানি বয়ে আসে বিছানাকান্দি পর্যন্ত।
মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ছোট বড় পাথরের উপর দিয়ে ছুটে আসা স্বচ্ছ পানির স্রোতধারা সৃষ্টি করেছে এক মনোরম পরিবেশ। যা হতে পারে ভ্রমণ পিপাসীদের জন্য এক আকর্ষনীয় স্থান। একটি কাঠের ব্রিজ বাংলাদেশের বর্ডারের মধ্যে পড়েছে যা পানি প্রবাহের বিপরীত দিকে অবস্থিত উচ্চভুমি আর সমতল ভূমির মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজ করে। এর ফলে আদিবাসীদের গবাদীপশু চারনের বিশেষসুবিধা হয়েছে।
পাথর, পানি, পাহাড় আর আকাশ নিয়েই যেন বিছানাকান্দি। এখানে আসার পর যে কথাটি সর্বপ্রথম মনে হয় তা হল প্রশান্তি। এই প্রশান্তিটুকু নিমিষেই ভুলিয়ে দেয় প্রতিদিনকার শত গ্লানি। প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে যেন হার মানতেই হয় নাগরীক সভ্যতাকে।
স্পর্শ ফটোগ্রাফারকে কোথা থেকে ধরে নিয়ে এলো আর আমার সাথে ফটাফট কয়টা পিকচার তুলে নিলো। আপু আর মাহিন ভাইয়া নিজের ফোনেই সেলফি নিতে ব্যস্ত। আমি আর স্পর্শ পোজ দিতে। বড়রা নিজের মতো আছে।
বিকেলের দিকে আমরা মালনীছড়া চা বাগানের দিকে অগ্রসর হলাম।
চারপাশে সবুজের সমারোহ। নীল আকাশের নিচে যেন সবুজ গালিচা পেতে আছে সজীব প্রকৃতি। উঁচু-নিচু টিলা এবং টিলাঘেরা সমতলে সবুজের চাষাবাদ। শুধু সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে টিলা বেষ্টিত ছোট ছোট জনপদ। পাহাড়ের কিনার ঘেষে ছুটে গেছে আকাবাঁকা মেঠোপথ। কোন যান্ত্রিক দূষণ নেই। কোথাও আবার ধাবমান পথে ছুটে চলছে রূপালী ঝর্ণাধারা। প্রকৃতির সকল সৌন্দর্যের সম্মিলন যেন এখানে। এমন অন্তহীন সৌন্দর্যে একাকার হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান।
বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ হলেও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অন্য এক ভালোলাগার ধারক হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান। তাই ছুটির অবসরে কিংবা বৈকালিক বিনোদনের তৃষ্ণা মেটাতে ছুটে যান চা বাগানের সবুজ অরণ্যে। সারাটা বিকাল চলে সবুজের ভেতর লুকোচুরি, হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে অবগাহন।
আব্বু আম্মু বাসায় এসে ই শুয়ে পরেছে। এতো জার্নি তারা নিতে পারেনি। কাল আমরা চলে যাব তিনদিন শেষ। রাতে আজ সবাই আড্ডা বসলো। স্পর্শের ফোন আমার হাতে। আমি আজকে বেড়ানোর ছবিগুলো দেখছি। আমাদের পাশে ভাইয়া আপু আর স্পর্শের 5 মামাতো বোন আছে।
আমি ছবি দেখতে দেখতে আজকের তোলা ছবি পেরিয়ে গেলাম।
গ্যালারি ফাংশন থেকে বেরিয়ে ফোন ঘাটাঘাটি করতে লাগলাম। স্পর্শ আবার কোন মেয়ের সাথে কথা বলে নাকি চেক করছি। হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং দেখছি।
‘ আমার বউ কি করছে?’
হঠাৎ করেই স্পর্শের ফিসফিসিয়ে কানের কাছে বলা কথা শুনে ছিটকে উঠলাম। ঠাস করে ফোন আমার কোলের উপর পরে গেছে। খুব ভয় পেয়েছি।
আমি ভয়ার্ত চোখে স্পর্শের দিকে তাকালাম। তার মুখে হাসি। আমি আমতা আমতা গলায় বললাম,
‘ কিছু না তো। ছবি দেখছি আপনি খুব ভালো ছবি তুলেছেন আমার একা।’
স্পর্শ আমার পাশে খুব আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বলল, ‘ তাই।’
আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘ হুম।’
স্পর্শ আমার কোলের উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনের হাসিটা আরো জড়ালো করলো।আমি শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিচ্ছি বারবার।
‘ হোয়াটসঅ্যাপ এ তুমি কার ছবি দেখছি বউওওও?’ স্পর্শ শেষের কথাটা টেনে বললো।
আমি তরিৎ গতিতে নিচের দিকে তাকিয়ে হাত মুচড়াতে লাগলাম। আর আড়চোখে স্পর্শের দিকে তাকালাম। স্পর্শ ফোন আমার সামনে ধরে একটা একটা করে কয়েকটা মেয়ের আইডি ও মেসেজ দেখালো।
‘ এই মেয়েদের সাথে তোমার হাজব্যান্ড এর কোন রিলেশন আছে নাকি দেখছিলে তাই না ?’
আমি মুখে কুলুপ এঁটে দাঁতে দাঁত চেপে শক্তভাবে বসে আছি। স্পর্শ আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
‘ এরা আমার কলেজ, ভার্সিটি লাইফের বান্ধবী। যাদের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক প্রতিদিনই একবার করে হলেও কথা হয়। তোমার সাথে ওরা
মিট করতে চাচ্ছে অনেকদিন। এখানে থেকে গিয়ে একদিন ওদের সাথে মিট করিয়ে দেব।’
আমি লজ্জা পেলাম খুব। আমি এই মেয়েদেরকে সত্যি সন্দেহ করে মেসেজ গুলো পরতেছিলাম কিন্তু স্পর্শের কাছে ধরা খেয়ে লজ্জায় নাকানিচুবানি খেলাম ভালোই।
স্পর্শের ছোট মামার মেয়ে তনু এসে আমাকে জোর করে স্পর্শের সামনে থেকে নিয়ে গেল। স্পর্শ আসতেই দিবে না তনু জোর করে নিয়ে বাসার ভেতরে নিয়ে এলো।
আমি ও তনু জিজ্ঞেস করছি কেন টেনে নিয়ে এলো। বলছে না শুধু বলে আসো আমার সাথে ভাবি। আর কি করার ওর সাথে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ভেতরে এসে দেখলাম এখানে আরেকজন আছে। মিলি জারার ছোট বোন। দুজনে এখানে কি জন্য আমাকে আনলো কে জানে? আমাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে এরা গুজুর ফুজুর করতে লাগলো। আমি কান খাড়া করে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু একটা বাক্য আমার কানে এসেও পৌঁছালো না।
2 মিনিট পরই দুজনের মতলব বুঝতে পারলাম।
‘ তোমরা আমাকে এই শাড়ি পড়ানোর জন্য নিয়ে এসেছে?’ তনুর দিকে প্রশ্ন ছুড়লাম।
তনু বলল,’ভাবি কালকে তো আপনারা চলে যাবেন!তাই আজকে আমাদের তরফ থেকে ভাইয়ার জন্য একটা গিফট ছোট্ট। আপনাদের জন্য তেমন তো কিছু করতে পারলাম না। তাই ভাবছে আপনাকে ভাইয়ার মনের মত করে সাজিয়ে ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দেবো।’
আমি ওদের বললাম, ‘এসবের কোন দরকার নাই! আমি শাড়ি পড়ে ইজি ফিল করিনা। এটা আমাকে পড়িও না।’
‘ আমরা অনেক সুন্দর করে পরিয়ে দিব তুমি প্লিজ না করো না।’
ওদের মুখের উপর আর আমি কিছু বলতে পারলাম না। ওদের আনন্দটা মাটি করতে চাইলাম না। ওদের কথা মত শাড়ি পড়লাম।
দুজন আমাকে ইচ্ছা মতো সাজালো। তারপর দুই পাশের দুই হাত ধরে দুজনে আমাকে সবার কাছে নিয়ে চেয়ে নিয়ে এলো। স্পর্শর পাশে নিয়েই বসিয়ে দিল। লাল রঙা শাড়ি পরেছি নতুন বউদের মত আমার ঘুমটা টেনেছি। এজন্য অটোমেটিকলি নতুন বউদের মতন এক রাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরেছে আমাকে।
স্পর্শ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এটা দেখে আমার লজ্জার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তবু ও জড়োসরো হয়ে স্পর্শের পাশে বসে পরলাম।
এখানকার সবাই মিলে আমার প্রশংসা করছে। তনু আর মিলি কেও করছে ওরা খুব সুন্দর সাজিয়েছে আমাকে তাই। সেই মুহূর্তে জারা এসে ওর বোন মিলিকে টেনে বাসার ভেতরে নিয়ে গেল। আর আমার দিকে রাগী চোখে তাকাল। সবাই যার যার বউকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। স্পর্শ আমার হাত মুঠোয় নিয়ে বসে আছে।
পাঁচ মিনিট পর মিলি এলো মুখটা কালো করে। গালে থাপ্পড় এর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে আমার সাথে মেশার ফল এটা বুঝতে বাকি রইলো না।
মিলির জন্য মন খারাপ হলো আমার। জারা যতটাই খারাপ মিলি ততটাই ভালো।
‘ কি হয়েছে মুখ কালো করেছো কেন?’
স্পর্শ আমাকে মলিন মুখে দেখে জিজ্ঞেস করলো।আমি মিলির থেকে চোখ সরিয়ে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ আমাকে কেমন লাগছে?’
স্পর্শ বলল, ‘ কথা ঘুরানো শিখে গেছো দেখছি’
‘ কথা ঘুরালাম কোথায়?’
‘ মন খারাপ কেন তাহলে?’
‘ আমার জন্য একজন কষ্ট পাচ্ছে তাই।’
স্পর্শ কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল, ‘ তাই? কে?’
‘ আছে একজন। আচ্ছা বললেন না তো আমাকে কেমন লাগছে!’
‘ কেমন লাগছে! বলতে হবে কেন আমার তাকানো দেখে বুঝতে পারছো না?’
‘না আমি এতো চোখের ভাষা বুঝতে পারি না।’
‘ এটা ভালোবাসা।’
‘ আমি তো বুঝি না তাহলে কি আমার মধ্যে ভালোবাসা নাই?’
স্পর্শ চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ নানা আছে। সবার ভালোবাসা কি আর এক রকম নাকি!’
‘ হুম।’
আমি মিটিমিটি হাসছি মুখ ঘুরিয়ে। স্পর্শ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
শাড়ি পড়ে হাঁটতে এখন আমার ঝামেলা না হলেও বাধা সৃষ্টি করতে জারা আছে। মুটামুটি আড্ডাটা শেষ হতেই আমরা সবাই বাসার ভেতরে যেতে লাগলাম তখন জারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চাইলো। আমি ভয় পেয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি পড়ার আগেই স্পর্শ পাশ থেকে আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। আর বাঁচিয়ে নিয়েছে। এটা বোধহয় স্পর্শের চোখে পরেছে। স্পর্শ আমাকে সাবধানে ধার করিয়ে জারাকে বলল,
‘ জারা তুই মারিয়াকে ধাক্কা দিলি কেন?’
জারা ভয়ে কাঁপছে। ও যে এইভাবে ধরা খাবে ভাবতেই পারেনি। ভয়ে কান্না করে দিয়েছে। স্পর্শ রাগে চিৎকার করে ফেলেছিল কিন্তু জারার কান্না দেখে শান্ত হয়। আমি ও দ্রুত এসে স্পর্শের এক হাত জরিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
‘ কি হলো কথা বলছিস না কেন? ধাক্কা কেন দিলি সমস্যা কি তোর?’
‘ আমি ইচ্ছে করে দেয়নি ভাইয়া। অসাবধানতাবশত লেগে গেছে বিশ্বাস করো।’ জারা কান্না মিশ্রিত গলায় বলল।
স্পর্শ তাও বিশ্বাস করছে না। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে স্পর্শের অনেক কষ্টে থামিয়ে বললাম,
‘ ইচ্ছে করে দেয়নি মনে হয়। চলুন তো ঘুম পাচ্ছে আমার।’
‘ আমি স্পষ্ট দেখেছি জারা প্রতিহিংসা চরিত তোমাকে ধাক্কা দিয়েছে। এতো রাগ কিসের ওর তোমার উপর?’
‘ জানি না। কাল তো চলেই যাব আজ আর ঝামেলা চাইনা প্লিজ।’
#চলবে…..