চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️ #পর্ব_২৪

0
350

#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#পর্ব_২৪
#লেখনীতে_নন্দিনী_নীলা

স্পর্স আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। বাসার কাছাকাছি আসতেই স্পর্শ উঠে বসল আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ সরি খুব ক্লান্ত লাগছিল তাই ঘুমিয়ে পড়েছি।’

‘ সমস্যা নাই। আপনার কি হয়েছে বলুন না প্লিজ!’

‘ আমার কিছুই হয়নি।আমি একদম ঠিক আছি। তুমি আমাকে নিয়ে প্যানিক হইও না। শুধু আমার উপর ভরসা রেখো আর তোমার বিশ্বাসটা বজায় রেখো।’

‘এসব কেন বলছেন? আমি আপনাকে খুব বিশ্বাস করি। নিজের থেকেও বেশি। আর ভরসা? আমার ভরসার এক মাত্র স্থান তো আপনি। বাবা মার পর আমি আপনাকেই ভরসা করি ভালোবাসি।’

‘ জানিনা। কেন বললাম! কিন্তু আমার উপর তোমার বিশ্বাসটা অটুট রেখো।’

‘ হুম। আপনি এতো উদাসীন কেন? একবার আমার দিকে ভালো করে তাকালেন না।’

আমার কথা শুনে স্পর্শ আমার দিকে এগিয়ে আসলো। দু হাত আমার দু গালে রাখল অতঃপর আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

‘কান্না করতে করতে তো দেখি চোখ গুলো ফুলিয়ে ফেলেছো। একটু ভালো লাগছে না।তোমার পুরো মুখ সাদা কালো হয়ে আছে। চোখের কাজল লেপ্টে কি বিশ্রী অবস্থা হয়েছে। দু’ঘণ্টা এই অবস্থা আমি যদি আর কোনদিন ফিরে না আসতাম তখন কি করতে তুমি? তখন তো মনে হয় পাগল হয়ে যেতে!’

আমি অবাক নয়নে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছি কেমন কৌতুক সুরে কথাগুলো বলছে। আমি কপাট রাগ দেখিয়ে বললাম,

‘ এসব কি কথাবার্তা? আপনি আর কোনদিন ফিরে কেন আসবেন না কেন? আপনি আমায় ছেড়ে কোথায় যাবেন?আমায় ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন আপনি?’

স্পর্শ আমার কথা শুনে আমার কপালে ভালবাসার পরশ দিল। তারপর বলল,

‘ তোমাকে আমি খুব বেশি ভালোবাসি। কখনো আমাকে ভুল বুঝনা!’

স্পর্শর কথা শুনে আমার বুক কেঁপে উঠল। ভালোবাসি বলেছে তাও যেন একটা ভয় তার মধ্যে। সেই ভয়টা দেখে আমার বুকটা কাপছে। শ্বশুর বাড়িতে আসতেই হইচই বেড়ে গেল। স্পর্শ আমার হাত ধরে বাইরে বের হতে যাবে তখনই তার ফোন বেজে উঠল। আমি স্পর্শের ফোনের দিকে আড়চোখে তাকাতে যাব স্পর্শ কেমন লুকিয়ে ফোনটা দেখে কেটে দিলো।
আমি সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছি। কিন্তু সাথে সাথেই সন্দেহ ধুর করে‌ ফেললাম। আমি আর আগের মতো অভিমান করবো না স্পর্শের উপর তিনি আমাকে খুবই ভালোবাসে আমি জানি।
শুধু শুধু আজাইরা চিন্তা করে নিজেও কষ্ট পাই ওকেও কষ্ট দেয়।

স্পর্শ ফোন অফ করে আমাকে ধরে গাড়িতে থেকে নামলো। শাশুড়ি মা আমাকে একটা গলায় হার পরিয়ে দিল। হালকা নিয়ম-কানুন শেষ করে আমাকে ভেতরে আনা হলো। স্পর্শের কোলে চড়েই আমি ভেতরে আসলাম। মুহুর্তটা আমার লজ্জায় কেটেছে।

ভেতরে আসার পর আমাকে অনেকটা সময় বাইরে সবার বসে কাটাতে হলো। স্পর্শের আর দেখা পাওয়া গেল না। অবশেষে আমাকে স্পর্শের রুমে আনা হলো‌। দারুন একটা পরিবেশ তৈরি করেছে রুমটায়। রুমটায় ঢুকেই মনটা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো‌। এটা বুঝি আমার বাসর ঘর। আমি লজ্জা মুখ ঢেকে ব্লাশিং হচ্ছি ।
সেই মুহূর্তে স্পর্শের ভাবি এসে রুমে ঢুকলো। আমি তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে দাড়ালাম।

‘একি তুমি এখনো এইখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো ভেতরে চলো‌।’ বলে আমার হাত ধরে রুমে ভিতর নিয়ে গেল। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

রুমটা ভালো করে দেখে বলল, ‘ পছন্দ হয়েছে?’

আমি লজ্জা মিশ্রিত মুখে মাথা নাড়লাম।
ভাবি তা দেখে হাসলো আর বলল,
‘ এবার বসে থাকো তোমার বরের জন্য। সেতো বাসাতেই নাই কোথায় চলে গেছে কে জানে ফোন ও তুলছে না। আজ এমন কেন যে করছে স্পর্শ কে জানে। যে মেয়েকে বিয়ে করার জন্য এতো পাগল এই যে রুমটাও নিজের হাতে সাজিয়েছে কিন্তু হঠাৎ করেই কি হলো। হুটহাট উধাও হয়ে যায়। আর খালি কি যেন ভাবে কাউকেই বলছে না। তুমি দেখ তো কিছু জানতে পারো কিনা।’

আমি হাঁ করে ভাবির দিকে তাকিয়ে কথা শুনলাম।
স্পর্শের কিছু একটা হয়েছে আমি এই বাসর ঘর দেখতে দেখতে সব ভুলে গেছি। এখন আবার ভাবি বলায় সব মনে পড়ল। আমি আনন্দ ভুলে চিন্তায় ডুবে গেলাম। ভাবি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

‘আরে কি বললাম তুমি স্পর্শের থেকে বেশি কাতর হয়ে গেলে! স্পর্শ হয়তো কিছু নিয়ে চিন্তিত আছেন। তুমি ওকে স্বাভাবিক করো। তুমি তো ওর বউ আর ও তোমাকে যে ভালোবাসে তুমি চাইলেই ওকে ঠিক করতে পারবে। সেই জন্যই তোমাকে বলেছি। এখন তুমি আবার দুশ্চিন্তা করা শুরু করো না।’

‘আচ্ছা ভাবি।’

ভাবি আমাকে স্পর্শের জন্য অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল। স্পর্শ আসলে কি করব সব বলে গেল।
আমি স্পর্শ আসলে কিভাবে কি করব ভাবতে ভাবতে সময় পার করতে লাগলাম। এই বুঝিস স্পর্শ আসলো সেই চিন্তায় দরজার দিকে তাকাচ্ছি তো চোখ নিচের দিকে নামাচ্ছি। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে একাই। সারাদিনের ক্লান্তি তার ওপর এভাবে বারোটা অব্দি বসে থাকে আমি আরো ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। আর ক্লান্ত হয়ে আমার চোখে সারা রাজ্যের ঘুম এসে ভিড় করলো। কিন্তু এই স্পর্শের কোন খবর নাই। এর আগে আমার শাশুড়ি মা আমার ননদ এসে বসে থেকে গেছে এইমাত্র সীফা বাইরে গেল মা মা করতে করতে।

তার দুই মিনিট পরে স্পর্শের আগমন ঘটল রুমে। স্পর্শকের দেখে আমার চোখের ঘুম উধাও। আমি তড়িৎগতিতে বিছানা থেকে উঠে স্পর্শের সামনে এসে দাঁড়ালাম। লজ্জা টজ্জা কোথায় পালিয়ে গেছে কে জানে? আমার চোখে এখন শুধু রাগ ঝরছে কোথায় ছিলেন উনি এতো লেটে কেন করলেন?

স্পর্শ দরজা আটকে আমায় এমন রাগের চোখে তার দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।

‘আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?’

‘ একটা কাজে গেছিলাম।’

‘ কি কাজে গেছিলেন? আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি সেটা কি ভুলে গেছেন?’

‘নিজেকে ভুলে যেতে পারি। কিন্তু তোমাকে এক সেকেন্ডের জন্য ও ভুলতে পারবোনা।’

আমি বললাম, ‘ তাই তাহলে আমাকে এতো অপেক্ষা করালেন কেন?’

স্পর্শ বলল, ‘আমি যেখানে ছিলাম কিন্তু আমার মনটা তোমার কাছে পড়ে ছিল। তুমি জানো গাড়ি আমি কত হাই স্পিডে চালিয়ে এসেছি। এক্সিডেন্ট করলে আর বাঁচতাম না সেটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু সেইসবের চিন্তা আমার ছিল না আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল তোমার কাছে দ্রুত আশা।’

‘ আপনি খুব বেশি খারাপ। আপনি নিজের ক্ষতি হবে এমন কিছু করছিলেন। অথচ আমার কথা ভাবেননি। আজ যদি আপনার কিছু হয়ে যেত তাহলে আমার কি হতো আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসো না, একটুও না। আজ এতদিন পর আমাদের এক হ‌ওয়ার দিন। আজ কতো প্রতীক্ষা পর আমরা এক হচ্ছি। আপনার জন্য সেজেগুজে আমি বসেছিলাম। আপনি সময়মতো আসেননি
আর যখন এসেছেন বিষণ্ন মুখ নিয়ে এসেছেন। আমার সাথে একটা ভালো করে কথা বলেননি। আমার দিকে একটু ভালো করে তাকাননি। সব ভুলেও আমি এখানে আসার পর ঠিক হয়ে ছিলাম। কিন্তু আবার সেই অপেক্ষা! আগে আমি আপনাকে সহ্য করতে পারতাম না! অপেক্ষা করিয়েছি? কষ্ট দিয়েছি! সেই প্রতিশোধ কি এখন আপনি নিচ্ছেন আমার উপর?’

‘আমি তোমাকে একটা কথা অনেক আগেই বলেছ আমাকে কখনো ভুল বুঝবে না! আর অবিশ্বাস করবে না! যাকে ভালোবাসি তার উপর প্রতিশোধ নেওয়া যায়? আর তখন তুমি তোমার মন ছেলেমানুষী ছিলো।আর তুমি যে আমার মতনই আমাকে পাগলের মত ভালবাসে সেটা আমি জানি বুঝি।’

আমি স্পর্শের কথা শুনে ও শান্ত হতে পারলাম না। কাঁদতে লাগলাম। স্পর্শ আমার হাত ধরতে যাবে সেই মুহূর্তে মনে পরলো ভাবি আমাকে বলেছিল স্পর্শের যখন রুমে আসবে সাথে সাথে আমার তাকে সালাম করতে।
আমি নিজের কান্না আটকানোর কান্নার চেষ্টা করতে করতে কান্না মিশ্রিত গলায় থেমে থেমে সালাম দিলাম‌। পায়ে হাত দিয়ে সালাম কে আমি সমর্থন করি না। আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নত করতে নেয়। আমি মুখে সালাম দিলাম শুধু। সালাম দিতে দেখে স্পর্শের মুখে হাসি ফুটল আমার হাত ধরে জোর করে কাছাকাছি এনে সালামের উত্তর নিল।

‘ আজ কে অন্তত আমার উপর অভিমান করোনা। আজকের রাতটা আমি আমার এই মায়ারানীর সাথে সুন্দর ভাবে কাটাতে চাই‌। প্রতিটা সেকেন্ড প্রতিটা মুহূর্ত ভালোবাসা ময় করতে চাই। দুজন দুজনের চোখ চোখে রেখে অনন্ত সময় কাটাতে চাই। আর বারবার ভালোবাসি ভালোবাসি বলতে চাই। বারবার আমার সেই স্বপ্নে দেখা সেই সময়গুলো কাটাতে চাই! প্রত্যেকটা মুহূর্ত অনুভব করতে চাই।’

স্পর্শ বললেও আমি ভুলতে পারছি না স্পর্শের সেই বিষন্ন মুখটা। যিনি আমাকে পাওয়ার জন্য এত ব্যাকুল হয়ে ছিল। বিয়ের এই দুদিন কতটা আনন্দ তার মধ্যে আমি দেখেছি সব কিছু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করেছে। কিন্তু আজ বিকাল থেকেই তার মনটা উদাস উদাস ভাবটা দেখছি। এটা আমি একটু ও ভুলতে পারছিনা আমার মনের মধ্যে বিঁধে আছে যেন।
আমার অন্য মনস্ক মলিন মুখ দেখে স্পর্শ আমার গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল খুব নরম সুরে,

‘ কী হয়েছে আমার চড়ুইপাখির? আজকে আমি তোমার মুখে শুধু সেই মিষ্টি হাসিটা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি তোমার মুখের সেই হাসি ছিটেফোঁটা পাচ্ছিনা। তোমার ভেতরে আমি কষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সেটা কি আমার জন্যে ? এই কষ্টের জন্য হয়তো আমি দায়ী।’

‘ আজকে কি হয়েছে সত্যি করে বলুন। আপনি কোথায় ছিলেন? আমাদের বাড়িতে যাইতে এত সময় কেন নিলেন? আবার এখনি বা কোথায় চলে গিয়েছিলেন? এসব না জানা পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না। আমি আপনার সাথে থাকতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার সাথে অভিনয় করছেন এটা মানতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে এখন আপনি যেটা দেখাচ্ছেন এসব জোর করে দেখাচ্ছেন। আপনি এখন বিষন্ন! আপনার মনটা খারাপ! কিছু নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত! কিন্তু আমাকে বুঝাতে চাচ্ছেন না। নিজেকে লুকিয়ে আড়ালে করে রেখেছেন।আমার সাথে অভিনয় করে সবাই চালাচ্ছেন!

স্পর্স আমার কথা শোনে। এক হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আর একহাতে আমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে মৃদু কন্ঠে বলে,

‘তুমি খুব চালাক হয়ে গেছো মায়া রানী! অবশ্য আমার ছোঁয়াই হয়েছে। আমার সাথে থাকতে থাকতে অনেকটা আমার মতো হয়ে যাচ্ছে। আই লাইক ইট।’

#চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here