স্বপ্নতরী (পর্ব-3)

0
456

#স্বপ্নতরী (পর্ব-3)

♡আরশিয়া জান্নাত

কনকনে শীতের দিনে সকাল আটটায় ক্লাস করা যে কতোটা যন্ত্রণার তা কেবল ঘুমকাতুরে মানুষরাই জানে। ছেলেরা তো দুই মিনিটে রেডি হয়ে বের হতে পারে সেখানে মেয়েদের ঘুম থেকে উঠতে হয় নিম্নে আধঘন্টা আগে। নীরার একদম ইচ্ছে করছেনা কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে এই শীতের সকালে ঠান্ডা পানি ধরতে। ফার্স্ট ক্লাস মিস দিবে সেই সাহস ও নেই, হারুন স্যার ক্লাসের সবকয়টার নাম রোল মুখস্থ রেখেছেন। কেউ মিস দিলে এখনো ছোট বাচ্চার মতো দাঁড় করিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করেন। এমনিতেই ক্লাসের সবাই ভাবে শীতকালে নীরা ভাল্লুক হয়ে যায়। অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। “আল্লাহ শীতকালে ক্লাস হয় কিজন্য! ধুররর”

“রাতের বেলা কানে তার দিয়া ঘুমাস বইলাই ফজরের আজান শুনোস না। ফজরের নামাজ না পইড়া যে ঘুমাই থাকে শয়তান তার কানে পেশাব কইরা দিয়া যায়। তোর কানে তো ডেইলি করে।”

“দাদী খেতে বসে কিসব বলো তুমি!”

“তো বলমুনা? মরলে বুঝবি তখন হায় হায় কইরাও কাম হইতোনা। ফেরেশতা যখন ডান্ডা লইয়া বাইড়ানি দিবো কানতে কানতে কইবি আমারে দুনিয়াতে ফেরত পাঠান আমি নামাজ পড়মু ভালা মানুষ হমু। হায়রে তহন আর কাম হইতোনা। আমার এতো নাইনাতকোর কেউই বুঝি আমার কবরের বাত্তি হইতোনা!”
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাহানারা বেগম। তিনি রোজ সকালে সবাইকে নামায পড়তে তাড়া দেন। কিন্তু কেউই বিশেষ পাত্তা দেয়না। তবুও তিনি বলেই যান, আল্লাহকে অন্তত বলতে পারবেন আমি চেষ্টা করেছিলাম,,,,

ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে বসে গরম গরম চা আর শিঙারা নিয়ে বসেছে রিমি, পুজা আর নীরা। নীরা হাই তুলতে তুলতে বললো, শীতকালটা খুব যন্ত্রণাদায়ক ঋতু। সারাদিন ঘুম আসে ভাল্লাগেনা,,

রিমি ভেংচি কেটে বললো, তোর কোন ঋতু ভাল্লাগে! একটু বৃষ্টি হলেই বলোস বর্ষাকাল ভাল্লাগেনা। গরমকালও ভাল্লাগেনা। তোর ভাল্লাগেটা কি??

“আমার তোরে ভাল্লাগে। আয় চুম্মা দেই!”

“তোর চুম্মা তোর কাছে রাখ। চল না কোথাও ঘুরতে যাই? মানুষ শীতকালে কতখানে ঘুরে! সাজেক যাবি কিংবা নীলগিরি?”

পুজা– “বিয়ার পর জামাই লইয়া যাইস” আমার মায়ের ডায়লগ। উনি আমারে কোনোখানে যাইতে দিবেনা।

রিমি– পাইছি দুইটা বান্ধবী। একটা কম্বল ছাইড়া উঠবোনা আরেকটার মা দিবোনা! তোদের চেয়ে সীমারা ভালো। ওদের সাথে ফ্রেন্ডশীপ করলে কতখানে যে ঘুরতে পারতাম।

নীরা– সারাজীবন এক খোঁটা দিস না। যা যা এখন যাইয়া ফ্রেন্ডশীপ কর। মনে নাই সোনারগাঁও এ ওদের লগে নাচতে নাচতে গেছ এরপর কি ঘটছে?

পুজা– ঐসব মনে থাকবেনা তো! আমাদের মতো পিওর সিঙ্গেল ভদ্র মাইয়ার বান্ধবী হওয়া তোর সাত কপালের ভাগ্য। দেখি দেখি কপালের মাপ দেখি পাঁচ আঙুলের কপাল নাকি?
রিমি কপাল থেকে হাত সরিয়ে বললো,ফাজলামি করিস না। চল না যাই, তোরা তো জানোস আমি কোথাও যাইতে পারিনা। তোদের তো গ্রামের বাড়ি আছে আমার তাও নাই। জীবনটাই তেজপাতা,,,

নীরা– আচ্ছা দেখি কোথাও যাওয়া যায় কি না।

রিয়া সেই কখন থেকে আলিফের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আলিফের খবর নাই। সে ভেবেছিল আজ পড়া বুঝে নেওয়ার বাহানাতে আলিফের সঙ্গে সময় কাটাবে, এইজন্য ইচ্ছে করে দুটো ক্লাস মিস করেছে। কিন্তু আলিফের খোঁজই পাওয়া যাচ্ছেনা। তবুও অপেক্ষা করতে একটুও বিরক্ত লাগছেনা বরং বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে। একটু পর পর ফোনের স্ক্রিনে নিজেকে দেখে নিচ্ছে সব ঠিকঠাক আছে কিনা। পুজা দূর থেকে ওর এসব দেখে বললো, এই দেখ দেখ রিয়া কেমন করতেছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে বফের সঙ্গে দেখা করবে হেহেহে।
রিমি– এই আঁতেলনীরও বফ আছে? হায় আল্লাহ এই পৃথিবীতে খালি আমারেই সিঙ্গেল রাখলা!!

নীরা– সারাক্ষণ এতো হা হুতাশ না করে বফ জোগাড় করলেই পারিস। একটা মানুষ বফ নাই বলে এতো ডিপ্রেশন দেখাতে পারে উফফ!

পুজা–তোরা ছাড় তো এসব। আমারে দেখতে দে কার জন্য এতো অপেক্ষা।

নীরা– তুই এতো ছুঁচা! অন্যের জীবন নিয়ে এতো ইন্টারেস্ট কেন তোর?

রিমি– মেয়েদের বৈশিষ্ট্য এটা। এতো রিয়েক্ট করিস না তো। অন্যের গসিপ না করলে কিসের জিন্দেগী?

পুজা– সেটা নীরা বুঝবেনা।

নীরা– সব তোরাই বুঝোস। দেখতে থাক অন্যের প্রেম কাহিনী আমি যাই।

রিমি– কই যাস?

নীরা– ঘুম আসতেছে বাসায় যাই।

রিমি আর পুজা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো, তোর থেকে এটাই আশা করা যায়!
🍁🍁🍁🍁🍁

আলিফের বড় ভাই তাশফিক কিছুদিন আগে কানাডা থেকে ফিরেছে। এবার ছেলেকে বিয়ে করিয়েই দম ফেলবেন মিসেস আলেয়া। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কত মেয়ের খোঁজ নিয়েছেন বলা মুশকিল। তারমধ্যে চারটা মেয়েকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। এরমধ্যে তাশফিকের যাকে পছন্দ হবে তার সঙ্গে মিটিং ফিক্সড করবেন। তাশফিককে অবশ্য বারবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছে পছন্দের কেউ আছে কি না। সে তেমন কিছু বলেনি। আলিফ জানতো তাশফিকের পছন্দের একজন ছিল। কিন্তু ভাই কেন সে বিষয়ে কিছু বললোনা তাঁর বুঝে আসেনি। সেই কথা বলতেই ভাইকে জোর করে তার ফেভারিট রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে।

“ভাই সত্যি করে বলতো তোর গফ কই? আমি যতদূর জানি কেউ ছিল! মা কে কিছু বললি না যে?”

“আরেহ না তেমন কিছু না থাকলে তো বলতামই”

“মিথ্যে বলিস না”
তাশফিক চুপ থেকে বলল, আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি আলিফ। ভেবেছিলাম বিয়ে ওর সঙ্গেই জীবন কাটাবো। কিন্তু ও আমায় কিছু না বলেই বিয়ে করে ফেলেছে!আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই,,,”

“মানে কি! সে কি তোর সঙ্গে রিলেশনে ছিল না?”

“হ্যাঁ! কেন বলেনি সেটা জিজ্ঞাসা করার স্কোপ পর্যন্ত দেয়নি। সবকিছু থেকে ব্লক করে রেখেছে। আমি ওর বিয়ের ছবি পেয়েছি অন্যভাবে।”

“এখন কি করবি?”

“মা-বাবা যেখানে বলবে সেখানেই করবো। আমার আর কি করার আছে!”

“মেয়েরা খুব অদ্ভুত তাই না ভাই!”

“অদ্ভুতের চেয়ে অদ্ভুত। এদের রহস্য বোঝা খুব কঠিন!!”

“তোর খবর বল। রিলেশনে গেছিস নাকি? কোন এমপির মেয়ের সঙ্গে যেন ভেজাল হয়েছিল মিটমাট হয়েছে?”

” আরেহ না! রিলেশনে যাবো তেমন মেয়ে চোখেই পড়েনা। আর ক্যাম্পাসে এমন কত কি ঘটে! মা অল্পতেই প্যানিক হয়ে যায় জানো তো।”

“এটার বেলা বেশি হয়েছিল। আমাকে পর্যন্ত ফোন করে বলেছে তোকে বুঝাতে! বুঝিস তো পলিটিক্যাল মানুষের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া ঠিক না।”

“টেনশন নিওনা। এখন বিয়েতে কনসেনট্রেট করো। তুমি করলেই তো আমার লাইন ক্লিয়ার!’

তাশফিক সামনের টেবিলে তাকাতেই থমকে যায়। একটা মেয়ে কি সাবলীলভাবে খেতে খেতে দুনিয়ার কথা বলে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে অনেক বাঁচাল প্রকৃতির। সে চারপাশের তোয়াক্কা না করে বকবক করেই যাচ্ছে। তাশফিক হাসিমুখে অপলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। আলিফ ভাইয়ের চেহারা দেখে পিছু ফিরে দেখে এক মেয়ের দিকে তার ভাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।

“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না দোস্ত আমরা নীলগিরি যাবো। আল্লাহ আমার যে কি আনন্দ লাগছে! এই শোন তোর দাদার ক্যামেরাটা মাস্ট আনবি। আমি কিন্তু অনেক ছবি তুলবো।”
খুশিতে গদগদ হয়ে এক নাগাড়ে কত কি বলে যাচ্ছে রিমি। পুজা ওর এসব দেখে হাসতে হাসতে বললো, দোস্ত রিল্যাক্স। খাওয়াটা তো শেষ কর। তুই তো খুশিতে পাগল হয়ে গেছিস।

“আমি তোরে বুঝাতে পারবোনা। যাবো ভাবতেই নাচতে ইচ্ছে করতেছে। এটা পাবলিক প্লেস না হলে আমি নির্ঘাত লুঙ্গি ডান্স দিতাম”

আলিফ তুড়ি বাজিয়ে বললো, ভাই এই দুনিয়াতে আছিস নাকি চলে গেছিস?

তাশফিক চমকে উঠে বললো, না মানে ঐ আর কি!
আলিফ ভাইয়ের এমন অপ্রস্তুত চেহারা দেখে হাসতে লাগলো। তার বুঝতে বাকি রইলোনা তার ভাই এই রেস্টুরেন্টে ক্রাশ নামক অখাদ্য খেয়ে ফেলেছে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here