স্বপ্নতরী (পর্ব-4) ♡আরশিয়া জান্নাত

0
365

#স্বপ্নতরী (পর্ব-4)

♡আরশিয়া জান্নাত

বহু জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে নীলগিরি যাওয়ার দিন চলে এলো। নীরার মেজ ভাই-ভাবী(ফয়েজ,তুবা),রিমির ছোট বোন মুন্নি,পুজার বড়দা তাপস আর নীরা,রিমি,পুজাসহ সবাই দলবেঁধে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে প্রস্তুত। রিমি ইতিমধ্যেই গুগলে সব দেখে নিয়ে দারুণ এক্সাইটেড। কতদিনের শখ পূরণ হতে যাচ্ছে তার! ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস অন সীজন বলে রেজোর্ট বুক করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ফয়েজকে। আগে থেকে প্ল্যান থাকলে এই সমস্যাটা হতোনা। শেষে ভেবেছিল বান্দরবানের কোনো হোটেলে উঠবে, কিন্তু নীরার একটাই জিদ সে এক রাত নীলগিরিতে কাটাবেই। তার উপর চাঁদের হিসেবে ভরা পূর্ণিমা থাকবে। এমন সুন্দর জায়গায় জ্যোৎস্নাবিলাসের লোভ সে কিছুতেই সামলাতে পারছেনা। একমাত্র বোনের আবদার রাখতে কতজনের সঙ্গে কথা বলে কিভাবে যে দুটো রুম জোগাড় করেছে তা কেবল সে-ই জানে। মেয়েদের এক কঠিন দোষ এরা কোথাও যাবে বলে অনেক আগে থেকে তৈরি হওয়া শুরু করলেও লেট করবেই! বাসা থেকে বের হবার কথা সকাল সাতটায় কিন্তু নয়টায় ও কারো খবর নেই! তার উপর নীরা যেই ঘুমকাতুরে ওকে ঘুম থেকে তোলা তুবার জন্য যুদ্ধের ন্যায়।
জাহানারা বেগম বারবার করে বলে দিয়েছেন, একা একা কোথাও যাবিনা,পাহাড়ের কিনারায় গিয়া খাড়াবিনা। ভালোমতোন দোয়াদুরূদ পড়ে গা বন্ধ করবি। পাহাড়ী এলাকায় জ্বীনভূতের প্রকোপ থাকতে পারে।
নীরা দাদীর কথায় ভীত চেহারায় বলে, ওমা সত্যি? তাহলে একটা জ্বীনের বাচ্চা এডপ্ট করি দাদী? আমার অনেক শখ জ্বীন পুষবো। ওরে বলবো যা আমার জন্য রসমালাই নিয়ে আয় অমনি নিয়ে আসবে। কি মজা হবে না?
জাহানারা নীরার এসব ফাজলামিতে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন। নীরা হাসতে থাকে।
বাস চলছে চট্টগ্রামের পথে। পুরোটা পথ নীরা ঘুমিয়েই কাটিয়েছে বাকিরা গল্পগুজবে ব্যস্ত ছিল। চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। প্ল্যান মোতাবেক রাতটা তারা বান্দরবান কটেজে অবস্থান করবে।

“ভাইরে ভাই তুই এতো ঘুমাতে পারিস! এতো ঘন্টা যে ঘুমালি এখন রাতে করবি কি? আমাদের কাল ভোরে বের হতে হবে মনে আছে তো?”

“মাশাআল্লাহ বল রিমির বাচ্চা। তোর বদনজর যদি আমার ঘুমে পড়ে তোর খবর আছে। আর দিনে ঘুম হলে রাতে হবেনা কে বলছে?”

“তোমরা ভেবোনা। আমার ননদীনী ঘুমের রাণী। দশটা বাজতেই দেখবা কেমন ঢুলে পড়ে।হিহিহি”

তুবার কথায় রিমি পুজা মুন্নি সবাই হাসতে লাগলো।

“তোর বরের কপালে দুঃখ আছে। বেচারা রোমান্টিক মুডে এসে দেখবে তুই ঘুমে পানি। হাহাহা”

“রিমি তোর ইদানীং সবকথা বর রিলেটেড কেন বলতো? সারাক্ষণ কি বিয়ের ভাবনায় ডুবে থাকিস নাকি?”

“বিয়ের ভাবনায় ডুবে থাকা দোষের নাকি? আমি তো পারলে এখুনি বিয়ে করে বরের সঙ্গে হানিমুনে চলে যেতাম। Ab toh mera dil jage na sota hai, keya karoo hay kuch kuch hota hai..”

“আরো বেশি করে দেখ লাভ স্টোরিস। প্রেম না করেও যে রোমান্টিক মুডে থাকোস! করলে যে কি করতি আল্লাহ!!”

“সবাই তোদের মতো আনরোমান্টিক খালাম্মা না। পুজারে দেখ সেতির যে এক ভালোবাসার দেবদাস আছে সেতি একবারও খেয়াল করছে?”

“মানে কি আমার ভালোবাসার দেবদাস পয়দা হইছে কবে?”

“ন্যাকা? অভিদা তোরে এমনি এমনি লাল গোলাপ দিয়ে ওমন সুন্দর উইশ করে? ফেভারিট ফুচকা খাওয়ায়? কই আমাদের কারো বার্থডেতে তো এসব কিছু করেনা!”

“আমার সঙ্গে খাতির বেশি তাই আমারে করে। তোদের এতো হিংসা হায় ঈশ্বর!”

“হিংসা না ফইন্নি। তোরে বুঝাচ্ছি যে,সারাক্ষণ অন্যের প্রেম না দেখে নিজেরটা যে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তাকাই দেখ”

“ধুরর তোরা কোন কথা থেকে কোন কথায় যাচ্ছোস। আমার অনেক ক্ষুধা লাগছে। চল তো কিছু খাই গিয়ে”

“আমরা খাই সুজি কখন কে পালিয়ে যায় একটু হলেও বুঝি! হেহেহে”

“ঘোড়ার ডিম বুঝোস।”
🍁🍁🍁🍁

বেডের উপর চারটা ছবি ফেলে রেখে তাশফিক ডুবে আছে অন্য ভাবনায়। মনের দৃশ্যপটে বারবার সেই মেয়েটার কথা আর হাসি স্পষ্ট বাজছে। দিনার পর এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে এতোটা ভালো লেগেছে তার। কিন্তু মেয়েটার নাম ঠিকানা কিছুই তো সে জানেনা। এমন ক্ষণস্থায়ী চোখের দেখায় কারো প্রতি ভালোলাগা জেগে উঠা বোকামী ছাড়া আর কি! তবুও মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছেনা সেই মুখটা। আলেয়া তার ছোটছেলে আলিফের কাছে গিয়ে বললো, হ্যাঁরে আলিফ খোকা কিছু বলেছে? ওর পছন্দের কেউ আছে?

“পছন্দের নেই বলা যাচ্ছেনা আপাতত। তোমার খোকার মনে নতুন একজন এসেছে বোধহয়”

“কি বলিস? কে সে? নাম পরিচয় জানিস কিছু?”

“আমাদের ভার্সিটির ব্যাচমেট। মুখ চেনা তবে নাম ঠিকানা জানিনা। দেখি সে যদি আগ্রহী হয় ইনফরমেশন বের করা ব্যাপারই না।”

“ও রাজী থাকলে আমারো আপত্তি নেই।আমি শুধু চাই বিদেশ বিভুঁইয়ে আর একা পড়ে না থাকুক। সেখানে কি খায় না খায় টেনশনে থাকি খুব। বৌকে নিয়ে থাকলে অন্তত যত্ন করার কেউ আছে ভেবে নিশ্চিন্তে থাকবো।”

“বড় ছেলের বৌয়ের উপর কর্তৃত্ব ফলাবানা? সে সোজা কানাডা চলে যাবে? তো তোমার সেবাযত্ন করবে কে?”

“ধুর বোকা ছেলে। কর্তৃত্ব ফলানোর কিছু নাই। আমি আমার দুই ছেলের জন্য বৌ আনবোনা আমার জন্য মেয়ে আনবো। আর তোর মা এতো বুড়ো হয়নি তাকে সেবাযত্ন করতে ছেলের বৌকে কাছে রেখে দিতে হবে। ”

“তবুও মা এমন ছেড়ে দিও না। টিপিক্যাল শাশুড়ি হবা। এখনকার মেয়েরা যেই! পরে কিন্তু কন্ট্রোল করতে পারবানা।”

“ফাজিল। আমারে ইচ্ছে করে এসব বলছিস তাইনা? শোন বাবা পৃথিবীর সব প্রাণীকে দু চার খাইয়ে পড়িয়ে পোষ মানানো যায়। কিন্তু মানুষই একমাত্র প্রাণী যাকে পোষ মানাতে হয় মুখের ব্যবহার আর ভালোবাসা দিয়ে। আমি এই নীতিটাই সবসময় মেনে চলি। আমার ছেলের বৌয়েরা আমার ভালোবাসার মায়ায় পড়ে নিজেই সেবাযত্ন করবে, তাদের জোর করে শিখিয়ে দিতে হবেনা। আর যদি তারপরো করতে না চায় আমার আফসোস নেই। মেয়েরা মায়েদের যত্ন বেশি করে নাকি?”

“তুমি খুব ভালো মা! তোমার চিন্তাধারা সত্যিই অনেক ব্রডমাইন্ডের।”

“তুই ভালোমতো খোঁজ নে। তোর ভাই যেন এবারো এড়িয়ে যেতে না পারে।”

“আচ্ছা আচ্ছা দেখছি আম্মাজান”
______________

কুয়াশার চাদরে ঢাকা পাহাড়ের শহরটা এতো সুন্দর হবে কল্পনাই করেনি নীরা। শীত উপেক্ষা করে এতো ভোরে উঠার কষ্টে মনে মনে হাজারটা গালিদিলেও এখন মনে হচ্ছে বাসায় ঘুমিয়ে থেকে সে কত কি মিস করেছে! রিমি সবসময় বলতো নীলগিরির কথা ও ততোটা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে রিমি কমই বলেছে। এমন সুন্দর দৃশ্য তাঁর সামনে এ যেন বিশ্বাসই হতে চাইছেনা। দূরের পাহাড়গুলো কুয়াশার জন্য স্পষ্ট দেখা না গেলেও পরিবেশটা এতোটাই মনোরম তার মনে হচ্ছে সে স্বর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে। দিন বাড়তেই সবকিছু সুস্পষ্ট হয়ে গেল। নীলগিরির চূড়ায় দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়-সাগর সবকিছু মিলে নীলসবুজের মিশ্রন মনে হচ্ছে। এজন্যই বুঝি নীলগিরিকে বাংলার দার্জিলিং বলা হয়? নীরা খুশিতে চিৎকার করে বললো, বাংলাদেশের প্রকৃতি আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি। আমি স্বার্থক এমন সুন্দর দেশে জন্মে।
ইশ এই সুন্দর সময়টা যদি দীর্ঘ হতো!!

“রিমি থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। তুই এই জায়গায় আসার জন্য জোর না দিলে হয়তো কখনোই এখানে আসতে পারতাম না। দেখ খুশিতে আমার চোখে পানি চলে আসছে!”

রিমি নীরাকে পাশে জড়িয়ে বললো, তুই বেশি ইমোশনাল। পরিবেশটা উপভোগ কর কান্নাকাটি করে সময় নষ্ট করিস না।
পুজার মনে হলো এই দৃশ্যটা একা দেখে মন ভরছেনা। ইচ্ছে করছে বিশেষ কাউকে নিয়ে ফের এই জায়গায় আসতে। আচ্ছা সেই বিশেষ মানুষটা কে? দেখিতো কল্পনায় কে আসে!

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here