স্বপ্নতরী (পর্ব:5) ♡আরশিয়া জান্নাত

0
415

#স্বপ্নতরী (পর্ব:5)

♡আরশিয়া জান্নাত

তাশফিকের মনমেজাজ কোনোটাই ভালো নেই। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যের উপর রাগ হলে তাও কন্ট্রোল করা যায় নিজের উপর রাগ হলে কোনোভাবেই সেটা আয়ত্তে আনা যায়না, ইচ্ছে করে নিজের মাথা ফাটিয়ে বসে থাকি! তাশফিক খুব নম্র ছেলে। এই নম্রতার মাসুল সবসময়ই তাকে গুনতে হয়েছে ত্যাগ করে কিংবা চুপচাপ মেনে নিয়ে। সে যদি আলিফের মতো স্পষ্টবাদী হতো তবে কি আজ বলতে পারতোনা এদের মধ্যে কাউকেই আমার পছন্দ নয়। তো মিট করবো কেন? কিন্তু না সে ভদ্রছেলের মতো চুপচাপ রেস্টুরেন্টে বসে অনাকাঙিক্ষত মানুষের অপেক্ষা করছে! নিজের উপর তার কি পরিমাণ বিরক্ত লাগছে তা আসলেই বলে বোঝানোর মতো না। ফোনের স্ক্রিনে টাইমটা দেখে আরেক দফা রাগ উঠলো। চারটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অথচ এখনো সেই মেয়ের খবর নেই! এতো কেয়ারলেস মেয়ের সঙ্গে বিয়ে তো দূর কথাও বলতে ইচ্ছে করছেনা।
“হ্যালো আলিফ কোথায় তুই?”

“আছিতো রেস্টুরেন্টের বাইরে। কি হয়েছে?”

“আর কতক্ষণ? এখানে কেউ আসবে নাকি আজাইরাই বসাই রাখছোস?”

“আরেহ এতো হাইপার হচ্ছো কেন। কুল ডাউন। সবর করো সবুরে মেওয়া ফলে!”

“ফাজলামি রাখ দশ মিনিটের মধ্যে যদি কেউ না আসে আমি বেরিয়ে যাবো। মেজাজটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে, এমন আনপাংচুয়াল মেয়ের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা নাই আমার,,,,,

“Excuse me. Mr Tashfiq?”

কথা বলতে বলতে ঘাড় ফিরিয়ে হাই ভোল্টেজের শক খেল তাশফিক। সামনে তার কে দাঁড়িয়ে আছে?

“I’m extremely sorry. আর বলবেন না আমি এমন গল্পবাজ মেয়ে আসবার সময় পথে এক পুরোনো ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা। ওর সঙ্গে টুকটাক গল্প করতে গিয়ে কখন যে আধ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে বলতেই পারিনি। আপনি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলেন তাইনা?”
ফোনের অপরপাশে আলিফ হাসি দিয়ে বললো, ভাই হাবলুর মতো হা না করে কথা বল,রাখছি।

তাশফিক ফোন রেখে আমতা আমতা করে বললো, No no no any problem. It’s okay. please have a seat..

“Thanks.”

“আপনিই তাহলে জান্নাতুন নাহার রিমি?”

“হুম। কেন সন্দেহ আছে নাকি হিহিহি”

“নাহ মানে এমনি!”

“আচ্ছা শুনুন আমি স্ট্রেটকার্ট কথা বলতে পছন্দ করি। আপনার কি কি জিজ্ঞাসা করার আছে করেন তবে তার আগে আমি দুটো প্রশ্ন করবো।”

“করুন।”

“দেখুন হুমায়ুন আহমেদের অনেক বড় ফ্যান আমি। তাঁর বই থেকে একটা দারুণ প্রশ্ন পেয়েছি। তখনই ঠিক করেছিলাম আমিও সেই প্রশ্ন করবো। দেখি কেমন পারেন?”

“আমি বই পড়িনা তেমন। তারপরও চেষ্টা করবো!”

“ওকে। এক নম্বর প্রশ্ন আমি কেন আপনাকে বিয়ে করবো?ব্যাখ্যা করুন!
আর দুই নম্বর প্রশ্ন হলো, মাকড়সা জাল বুনে পোকামাকড় শিকার করতে। সে নিজেও তো পোকা তবু কেন নিজের জালে নিজে আটকা পড়েনা?”

“উত্তর কি এখনই দিতে হবে?”

“ওমা এখন না দিলে কখন? গুগল দেখে জবাব দিলে আর মজা কি? আপনি ভাবতে থাকুন আমি কিছু অর্ডার করছি।”

তাশফিক ভ্রু কুঁচকে উত্তর খুঁজতে লাগলো।
🍁🍁🍁

আচ্ছা পানিতে চোখ মেলে তাকানো যায়? কই নীরা তো পারেনা। টিভিতে কি সুন্দর দেখায় সবাই চারপাশ তাকিয়ে দেখে। নীরার ফুফাতো বোন শিল্পা কি সুন্দর ডুব সাতার দিয়ে একপার থেকে অন্যপারে চলে যায়, কখনো ঘর লেপার জন্য ডুব দিয়ে কাঁদামাটি নিয়ে আসতো। অথচ নীরা পুকুরে নামলে পুরো মাথা ডুবিয়ে ডুব দিতে পর্যন্ত পারেনা। তার মনে হয় সে অসীম পানিতে দমবন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছে। সবাই হেসে বলতো, কাউয়ার মতো মুখ ডুবাইয়া কাউয়া গোসল করোস তুই!হেহেহে
নীরার চোখ ভরে আসতো। সেই জেদ থেকে মনে মনে পণ করেছিল সাতার সে শিখবেই। চেষ্টাও করেছিল দুদিন কিন্তু তার পা কোনোভাবেই ভেসে উঠেনা উল্টো সেই কাঁদা পানিতে হাবুডুবু খায়। তাই জাহানারা বেগম গ্রামে গেলেই নাতনিকে সবসময় কলের গোড়ায় গোসল করাতেন। সারাবছর শহরে থেকে দু চারদিনের জন্য এসে সর্দিজ্বর বাঁধানোর মানে আছে?
নীরার সাঁতার শেখার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।

“ও নীরা হইলো তোর আর কতক্ষণ গোসল করবি। বাইর হ?”

নীরা গলার স্বর মোটা করে বললো, তোর নাতনিকে আজ আর বেরুতে দেবোনারে জাহানারা। তুই এর আশা ছেড়ে দে হুহাহাহা!!!”

“বদমাইশ ছেরি বাইর হ আজকে, বাথরুমে বইয়া এইসব বান্দ্রামী করিস না হাঁচা হাঁচাই হইয়া যাইবো কইলাম।”

“ও দাদীগো আমারে বাঁচাও জ্বীনের বাদশাহ আমারের নিয়া গেল!!!”

জাহানারা জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। নীরা কোনো শব্দ না করে হাসতে লাগলো। একটু পরেই দাদীর চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হবে ভাবতেই পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে তার। হিহিহি

নীরার মা নূরনাহার মুখ ভার করে বসে আছেন। আজ নীরার বাবা ফিরুক নীরার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। তাকে কত করে বলে তার দাদী বুড়ো মানুষ অযথা টেনশনে না ফেলতে, কিন্তু না সে তো ফাজলামি করবেই। আজকে আবার পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছেন, এমনিতেই তার ধারণা নীরার উপর জ্বীনের আছর আছে। তার উপর নীরার অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড। তিনিতো ফোন করে কবিরাজ পর্যন্ত নিয়ে আসছিলেন! ভাগ্যিস ফয়েজ তাকে সামলেছে। না এমন চলতে দিলে হবেনা, কয়দিন পর পরের বাড়ি যাবে এখনো এমন দস্যিপনা করলে চলে?
“শোনো সায়মন তোমার আদরের দুলালীর এমন দুষ্টুমি আর নেওয়া যাচ্ছেনা। তুমি ওকে বোঝাও! ও কি এখনো বাচ্চা? এমন করাটা কি মানায় ওকে?”

“আহা কি হয়েছে বলবা তো। অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতেই আমার মেয়ের নামে অভিযোগ খুলে বসেছ। করেছেটা কি ?”
নূরনাহার সবটা খুলে বলতেই সায়মন সাহেব হোহো করে হাসতে লাগলেন।
“নাহার তুমিও পারো। শোনো এখন ওর এসব তোমার অসহনীয় লাগছে তো ও যখন পরের বাড়ি যাবে তুমিই সবচেয়ে বেশি এসব মিস করবে! আমার বাবা সবসময় বলতেন মেয়েরা হচ্ছে পরের বাড়ির আমানত। আমাদের ঘরে কিছুদিনের অতিথি।এদের ভালোমতো খাতিরযত্ন করতে হয়,খানিকটা স্বাধীনতাও দিতে হয়। জীবনের যে ক’টা বছর ওরা থাকে ওদের শখ পূরণ করতে হয়। সবার স্বামীভাগ্য ভালো নাও হতে পারে,তাই আর কি! আমি সবসময় দেখতাম আপাদের এক্সট্রা কেয়ার করা হতো। বাবা রোজ দুহাত ভরে আপাদের জন্য কত কি আনতো!”

“এসব বলে বলে আরো লাই দাও। এমনিতেই আমার শাসন তোয়াক্কা করেনা। তুমি আর মা মিলে ওকে মাথায় চড়িয়েছ!”

“দাদীর সঙ্গে দুষ্টুমি করবে না তো কি তোমার সঙ্গে করবে? ওদের মাঝে ঢুকো না তো। ওরা দাদী নাতনী ঠিকই একে অন্যের জানপরাণ। তুমি আমি ঢুকে শত্রু হয়ে লাভ নাই। দেখি এক কাপ চা দাও তো। মাথাটা খুব ধরেছে।”
___________

পুজা– কিরে ছেলে কেমন দেখলি? এবার বিয়ের দাওয়াত পাবোতো?
রিমি– আরেহ ধুরর। ঘোড়ার ডিম পাবি। হাবলু ছেলে বুঝছোস। ভাবছি আমার প্রশ্ন দুইটার উত্তর তুড়ি বাজিয়ে বলে দিবে কিন্তু শালায় তো ঠিকঠাক পানির গ্লাসটাই ধরতে পারেনা,,
নীরা– তাই বলে হাবলু বলে দিলি। নার্ভাস ছিল হয়তো!
রিমি– হ্যাঁ তোর মতো আর কি। আমি দেখেই বুঝছি এ তোর কোম্পানির লোক।হাহাহা
পুজা– তোকে কি প্রশ্ন করছে?
রিমি– কিছুই করেনাই। আমার প্রশ্ন শোনার পর যে ভ্রু কুঁচকেছে আর ঠিক করেনি। তোরাই বল এমন ছেলেকে বিয়ে করা যায়? আমারতো বিশ্বাস হয়না সে এতো বড় কোম্পানি চালায়!
পুজা– এতো জাজমেন্টাল হবিনা। আরেকদিন মিট কর। দেখ আঙ্কেল আন্টির খুব আগ্রহ এখানে, ছেলের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও যথেষ্ট ভালো। আমার মনে হয়না ইগ্নোর করা উচিত!
রিমি–দেখি কি করা যায়,,,
পুজা–দেখ দেখ তাড়াতাড়ি দেখ। নাহয় আমরা গ্রুপ ডান্স দিবো “বাবা আমার কি বিয়ে হবে না,,,”
হাহাহাহা

পুজা আর রিমি মাঠের ওদিকে গিয়ে বসলো।নীরা বরাবরের মতো খাতা খুলে আঁকতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আলিফ আর তাঁর গ্রুপের সবাই ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকলো। আলিফের দক্ষিণ কর্ণারের দিকে আড়চোখে তাকানো বাদ গেল না। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সে এই কাজটা করে আসছে। মূলত ওকে দেখতেই এখানে অযথা এসে আড্ডা দেওয়া হয়। আজ আলিফ হুট করে উঠে গিয়ে নীরার খাতা টেনে নিলো। খাতা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো কি করে এই খাতায় এতো বিভোর হয়ে! এই যে রোজ এতো হৈচৈ করে এখানে এসে বসে তাও ম্যামের মনোযোগ নষ্ট হয়না। নীরা বেশ রেগে আলিফের দিকে তাকালো, যেন চোখ দিয়ে ভস্ম করে ফেলবে।
“এটা কেমন অসভ্যতা! আমার খাতা দাও”

“Let me see Miss Nira.”

“Why should I? Did u ask any permission from me?”

“শোনো আর্টিস্টদের আর্ট দেখতে পারমিশন লাগেনা। এটা দেখা দর্শকদের অধিকার। তুমি সবসময় এমন এককোণে বসে এঁকে গেলেই তো হবেনা। আমাদেরকে তো দেখাতেই পারো! After all we are batchmate.”

নীরা চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলে চাইছে টা কি? অযথা নীরার পেছনেই পড়লো কেন আজীব!!

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here