#স্বপ্নতরী (পর্ব-7)
♡আরশিয়া জান্নাত
ফ্ল্যাশ লাইটের আলো হঠাৎ চোখে পড়তেই নীরা হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললো।
আলো আধারির সেই মোহনীয় সময়ে আলিফ যেন হারিয়ে গেল অন্য এক জগতে।
তার সামনে এটা কে দাঁড়িয়ে আছে? কোনো রাজ্যের রাজকন্যা নাকি কোনো অপ্সরা ভুলক্রমে পৃথিবীতে নেমে এসেছে?
“ও হ্যালো! এমন চোখের উপর লাইট ফেলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? অন্যদিকে লাইট সরান,,”
নীরার কথায় ধ্যান ভাঙলো আলিফের। সে ফোনটা অন্য পাশে সরাতেই নীরা খানিকটা চেঁচিয়ে বললো, কে আপনি? এমন আজব লোক আমি আগে দেখিনি। এরকম অন্ধকারে কেউ মুখের উপর লাইট ফেলে! মেয়ে দেখলে হুঁশ থাকেনা নাকি!!”
আলিফ বাঁকা হাসি দিয়ে বললো, মেয়ে দেখলে ঠিকই হুশ থাকে মিস আর্টিস্ট! কিন্তু আন্ধি দেখলেই হেল্প করতে মন চায়। এরাতো আলোতেই চোখে দেখেনা আর এ তো ঘুটঘুটে অন্ধকার।
নীরা খানিকটা রেগে বললো, আলিফ? তুমি এখানে কি করছো!
“ওমা ভুলে গেলে নাকি? আমার ভাই ভাবীর হলুদ। আমি এখানে থাকবো না তো কে থাকবে?”
“কিন্তু হলুদ তো আলাদা হচ্ছে! তো?”
“হলুদ আলাদা হলেও কি? বুঝলাম তোমার এখনো বিয়ে হয়নি তাই বিয়ের রিচুয়ালস জানোনা। কিন্তু ভাইবোনদের বিয়েও কি দেখোনি? বলদী একটা।”
“কে বলদী? কতগুলি আজিব নাম দিচ্ছো! আকীকা করিয়ে বাবা মা আমার নাম রেখেছে ফাহমিদা হক নীরা। এখানে আর্টিস্ট,আন্ধি,বলদী এসব বললে হবেনা!!”
“তাই বুঝি? হক কথা বলার ফাহমিদা হক ওপস নীরা ম্যাম ভালোর যামানাই রইলো না। কোথায় থ্যাঙ্কস জানাবা তা না উল্টো বকাবকি করছো! মেয়েরা আসলেই নাফরমান।”
“বিয়ে বাড়িতে লাইট গেল কেন? তুমি আসলেই অলক্ষী তোমার পা পড়তেই লাইট গেছে!”
“ওহ আচ্ছা এখন আমি অলক্ষী হয়ে গেলাম? আমার তো মনে হচ্ছে তুমি পেত্নি বলেই এখানে কারেন্ট চলে গেছে।”
“উফফ তোমার সাথে কথা বলাই উচিত না। আবার কে কখন ছবি তুলে গ্রুপে ছাড়ে। দেখি সরো তো!”
“আমিতো ভেবেছিলাম তুমি কাউকে ভয় পাওনা। কিন্তু তুমিতো খুব ভীতু!”
“এখানে ভীতু সাহসীর ব্যাপার না জনাব! আপনার মতো সো কল্ড ফেমাস বয়দের সাথে থাকা খুব রিস্কি। আমাদের মতো জেনারেল কারো তো অন এয়ারে আসার অভ্যাস নেই তাই দূরে থাকাই শ্রেয়।”
“অনেক পিঞ্চ করলে মিস আর্টিস্ট। কথার যে ঘা তোমার! তবে শুনতে ভালোই লাগছে। By the way You are looking good. দেখো এখানে কাউকে পটাতে পারো কি না। বয়স তো কম হচ্ছেনা!!”
নীরা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে চলে গেল। অন্ধকারে রেগে চলতে গিয়ে জুতা উল্টে পড়তে গিয়েও পড়লো না। আলিফ তাকে শক্ত হাতে ধরে বললো, খালি মাঠে কেউ আছাড় খায় তোমারে না দেখলে জানতাম না! নাকি আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে ইচ্ছে করে পড়ে গেছ?
নীরা হাত ছাড়িয়ে নাক ফুলিয়ে চলে গেল। আলিফ হাসতে লাগলো। “মেয়েটা রাগলে এত্ত কিউট লাগে কেন?”
🍀🍀🍀🍀
জাহানারা বেগমের শরীরটা বেশ ক’দিন ধরেই খারাপ। বয়স বাড়লে কত রোগ যে বাসা বাঁধে শরীরে। কথায় বলে জয়কালে ক্ষয় নাই মরণকালে ঔষধ নাই। নীরা দাদীর রুমে উঁকি দিতেই দেখে তাঁর দাদী আনমনে জানালার বাইরে চেয়ে আছে। রিমির বিয়ের ব্যস্ততায় দাদীর সাথে গল্প করার সুযোগ হচ্ছিল না। তাই আজ সময় পেয়ে পানের বাটা নিয়ে এসেছে তাঁর সঙ্গে গল্প করার উদ্দেশ্যে।
“দাদীজান তুমি কি দাদাজানকে মিস করছো নাকি? যেমন উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে আছো যে কেউ দেখলে ভাববে অসহায় নারী!”
“অসহায়ই তো! শেষ বয়সে চইলা আইছি এহন কি আর সহায়সম্বল আছে? তোর দাদায় তো ভালায় ভালায় পার হইয়া গেছে। আমি যে কেমনে যামু সেই চিন্তায় আছি। জানোস তো বুবু ইমান ধইরা রাইখা মরণ ভাগ্যের ব্যাপার। তোর দাদার শেষ কথা আছিল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! এইডা মুখে লইয়া যে মরে তাঁর জীবন সার্থক। আল্লাহগো আমারে সেই তৌফিক দিও।”
“দাদীজান তুমি অনেক ধার্মিক মানুষ। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমায় সাহায্য করবে। এখন এসব মৃত্যুর কথাবার্তা ছাড়ো তো ভাল্লাগেনা। তোমায় আল্লাহ শতবর্ষী করুন। এখনো কত কি করা বাকি তুমি না বলছিলা বিয়ের দিন আমার সাথে শ্বশুরবাড়ি যাবা। একা ছাড়বা না। তাহলে এখনই মরার চিন্তা করো কেন হু?”
“হায়াত মউতের কথা কওন যায় না। আমাগো তো আউশের শেষ নাই। কত কি ভাবি সব কি করতে পারি। যাক খেমা দে, তোর কথা ক কেমন আনন্দ করলি।”
“অনেক মজা করছি। তোমারে কত করে বললাম চলো রিমি কতবার তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছে জানো!”
“আল্লাহ ওরে সুখী করুক। বড় ভালা মাইয়া।
আইচ্ছা বুবু বোইনরে একখান কথা কইবি?:”
“কি কথা?”
“তোর পছন্দের কেউ নাই? বিয়েশাদী করবি না?”
“ছিল তো একজন। সে তো পঞ্চাশ বছর আগে বিয়ে করে বুড়ো হয়ে পরকালেও গমন করছে। এখন আমি তার বৌরে নিয়ে দিন কাটাই। কি যে দুঃখ আমার হাহ!”
জাহানারা বেগমের খানিকটা সময় লাগলো কথাটা বুঝতে।
“তুই অনেক শেয়ানা। কথাডা কোনদিকে ঘুরাই দিলি।”
নীরা পানের খিলি সাজিয়ে দাদীর গালে দিয়ে বললো, দাদীজান আমার মনটা বোধহয় অনুভূতিহীন টুল হয়ে গেছে অথবা আমিই অদৃশ্য। এই শহরের কারো চোখেই আমি পড়ি না আর আমার চোখেও কেউ পড়ে না। একজন ঠিকই বলে আমি আন্ধি!! আমার জীবনে আর যাই আসুক প্রেম আসবেনা।
“বিয়া করবি তাইলে? পোলা দেখি?”
“তুমিও আম্মুর মতো হয়ে গেছ। বিয়ে ছাড়া আর কিছু নাই? আমি তোমারে নিয়ে পুরা দুনিয়া ঘুরে বেড়াবো। এর জন্য তো টাকা লাগবে তাই চাকরি করবো টাকা জমাবো। তারপর দাদী নাতনি মিলে ওয়ার্ল্ড ট্যুর দিবো।
“পাগলি বোইন আমার। ততদিন আল্লাহ বাঁচাই রাখুক।”
নীরা দাদীকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। এই পৃথিবীতে যে তিনিই তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ।
।
।
ক্লাসে এসে পুজার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। রিমিকে ছাড়া ক্যাম্পাসটা পানসেই লাগছে। দুই বান্ধবী মিলে এখানে বসে সবার আসা যাওয়া দেখতো আর গসিপ করতো। নীরা তো সবসময় থেকেও না থাকার মতো!
ওদিকে রিমি বিয়ের এক সপ্তাহ পর পরিবারের সবাইকে ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে সুদূর কানাডায়।
তাই চাইলেও তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। অনেকটা মনমরা হয়েই রিমির কথা ভাবছিল পুজা।
“কিরে এমন মুখ কালো করে বসে আছিস কেন? আমাকে মিস করছিস নাকি?”
রিমির গলা শুনে চমকে উঠলো পুজা। তাকিয়ে দেখে নীরার ফোনে ভিডিও কলে আছে রিমি। সেই চিরচেনা হাসি আর ঝরঝরে গলায় বলে যাচ্ছে কত কি! পুজার চোখ ভিজে আসে রিমিকে দেখে। অভিমানী গলায় বলে,
” কে বলেছিল তোকে এতো আর্লি বিয়ে করতে?
নীরা তুই কিন্তু বিয়ে করবিনা। অন্তত গ্র্যাজুয়েট শেষ না করে তো না-ই। আমি একা একা ক্যাম্পাসে আসতে পারবোনা। তোকে অনেক মিস করছি রিমি।”
রিমি চোখ মুছে বললো,নীরা পুজাকে একটু জড়াই ধরতো। দেখ সেতি কেঁদেকেটে লাল হয়ে যাচ্ছে। এই অভিদা কই তারে খবর দে।পরে তো বলবে তার পুজাকে আমি কাঁদিয়ে মারছি!”
নীরা পুজাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ওলে সোনাবাবুতা কাঁদেনা। তোমাকে বিয়ে দিবো নাতো। আপু আছি না? আপু তোমাকে চক্কেত কিনে দিবোতো। কাঁদেনা লক্ষি!
নীরার আদুরে গলার বাচ্চামী দেখে রিমি আর পুজা চোখে পানি নিয়েই হাসতে লাগলো।
কেন যে সবাই বিয়ে করে বুঝি না বাপু। পৃথিবীটাই যেন বদলে যায় পরিবার পরিজন বন্ধুবান্ধব ছেড়ে নতুন মানুষের ভীড়ে বাস করার কি দরকার? আমিতো বিয়েই করবোনা,,,,
রিমি চোখ মুছে বললো, হইছে ছাড়েন। আবার বৈরাগী হবার পণ নিয়েন না। তখন আবার কতজন দেবদাসের মতো ঘুরবে হিসেব নেই।
“শোন তোর বা পুজার বেলা এসব খাটে আমার বেলা না। আন্দাজি কথাবার্তা বলিস না।”
“রিমি যা বলে তা ফেলনা না। সময় হলে টের পাবি।”
রিমির কথা নীরা অগ্রাহ্য করলেও পুজা সিরিয়াস গলায় বললো, হ্যাঁ রে রিমি কিছু কি ঘটছে নাকি। তুই হঠাৎ এই সুর দিলি?
রিমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, কানাডায় যা শীত পড়েছে। কোনদিন বরফ হয়ে যাই আল্লাহ জানে!
পুজার মনের খটকাটা রয়েই গেল। তবে কি রিমি কিছু লুকোচ্ছে? আলিফের ব্যাপারটাই ইঙ্গিত করলো মনে হচ্ছে!
চলবে,,,,