স্বপ্নতরী (পর্ব:8)

0
379

#স্বপ্নতরী (পর্ব:8)

♡আরশিয়া জান্নাত

ঝলমলে রোদের একটা বিশেষত্ব হলো কাঁচা হলদে আলোটা যেখানে পড়ে সেটাই মোহনীয় হয়ে উঠে। হোক সেটা প্রাণী কিংবা কোনো জড় বস্তু। এই মুহূর্তে নীরা ছাদে বসে আছে এক গামলা বরফ পানি নিয়ে। পানিতে রোদের প্রতিফলন হয়ে মুখে পড়ছে এই বিষয়টা বেশ উপভোগ করছে। জাহানারা বেগমের হাতের চুরির মৃদু শব্দ টের পেয়ে নীরা চুল ছেড়ে সামনে আনলো।
এইডা কি করোস বুবুন? এই ভরদুপুরবেলা এমন চুল ছাইড়া ছাদে বইয়া আছোস? এহনের রোইদের যে তেজ শরীল পুইড়া কালা হইবো তো ঘরে আয়!

নীরা চুল সামনে রেখেই মাথা তুলে চাইলো।গলার স্বর বদলে বললো, আস্সালামু আলাইকুম দাদীজান! আপনি এখন এখানে এসেছেন কেন? এমন রোদ আপনার শরীরের জন্য মোটেও ভালো না। যান ভেতরে গিয়ে বসুন আমি নীরাকে একটু পরেই পাঠিয়ে দিবো।

একদম ফাইজলামী করবি না বুবুন। চল কইতাছি।

আপনার নাতনীর চিন্তা করবেন না সে এখন সমুদ্রের বাতাস উপভোগ করছে।

জাহানারা বেগম ভয়ার্ত গলায় বললো, ও নীরা নীরা বোইন আমার দুষ্টামি করিস না। আমার ভালা লাগে না এসব। দেখি উঠ
বলেই নীরার হাত ধরতেই তিনি আৎকে উঠলেন। নীরার হাত বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে। তিনি চিৎকার করে ওখানেই সেন্সলেস হয়ে গেলেন।

আলিফের মন আজ বেশ ফুরফুরে, সে মনের আনন্দে শিস বাজাতে বাজাতে পার্কিং লটে যাচ্ছে তখনই দেখে সেখানে তিনটা গাড়ি এসে ঢুকলো। বাসায় হঠাৎ কে এলো?

গাড়ি থেকে দুজন গার্ড নামার পর মোস্তফা সাহেব নামলেন। আলিফ প্রথমে চিনতে না পারলেও তার বেশভূষায় বুঝলো কোনো বিশেষ লোক হবে।
আলিফ বিশেষ পাত্তা না দিয়ে বাইকের দিকে যাচ্ছিল। তখনই ভদ্রলোক তাকে বললেন, আলিফ?

জ্বি আমিই আলিফ বলুন?

তোমার বাবা মা কি বাসায় আছেন?

জ্বি আছেন। আপনাকে ঠিক চিনলাম না?

পাশের থেকে একজন বললো, উনাকে চেনেন না! উনি হচ্ছেন,,,

মোস্তফা সাহেব তাকে থামিয়ে বললো, ভেতরে চলো কথা আছে।

আলিফ তাকে সঙ্গে করে বাড়িতে প্রবেশ করলো।
তৌকির আহমেদ তখন টিভিতে নিউজ দেখছিলেন। আলিফের পাশের ভদ্রলোককে দেখেই তিনি উঠে সালাম দিয়ে বললেন, এ কি সৌভাগ্য আমার আপনি আমার বাসায়?!

আলিফ- তুমি চিনো না কি উনাকে? ওহ তোমার কাছেই এসেছে তাহলে। আচ্ছা আঙ্কেল আপনারা তাহলে কথা বলুন আমি যাই।

মোস্তফা সাহেব- নাহ। তোমার বিষয়েই কথা বলতে এসেছি তাই তোমার থাকাটা আবশ্যক।

তৌকির সাহেব খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও মুখে প্রকাশ করলো না। আলিফের সাথে মন্ত্রী সাহেবের কি কথা থাকতে পারে?
“দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন না।”
এসিসট্যান্ট পারভেজ কে উনাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার কথা বলে তিনিও বসলেন।

মোস্তফা সাহেব হেসে বললেন, আপনার ছেলের কথা অনেক শুনেছি আজ স্বচোক্ষে দেখলাম। সামনেই তো ফাইনাল দিবা তাই না?

জ্বি!

তোমাদের মতো মেধাবী ছাত্ররাই তো দেশের ভবিষ্যত। যাই হোক সরাসরি আসল কথায় আসি। আমার আলিফকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি চাই আমার মেয়ে নাতাশার সঙ্গে ওর বিয়ে দিতে।

আলিফ কিছুটা অবাক হয়ে বললো, নাতাশা? আপনি নাতাশার বাবা!

হ্যাঁ। আমি জানি নাতাশার সঙ্গে তোমার ঝামেলার কথা।

তাহলে বিয়ের কথা ভাবছেন কিভাবে? দেখুন একটা মিসান্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার মেয়ে আমাকে ভালোবাসে বাট সত্যিটা ভিন্ন। ঐটা একটা প্র্যাঙ্ক ছাড়া কিছুই ছিল না।

আমি জানি নাতাশা তোমাকে ভালোবাসে না। এটাও জানি ঐটা ওর প্র্যাঙ্ক ছিল। কিন্তু একটা কথা কি জানো তোমার মতো করে ওকে কেউ শিক্ষা দিতে পারেনি। তুমি ওর পরিচয়ের তোয়াক্কা না করে যেভাবে সবার সামনে ওকে ইনসাল্ট করেছ ঐটা হয়তো সাধারণ কোনো বাবাই মেনে নিতো না। কিন্তু আমার মেয়েকে আমি চিনি। আর চিনি বলেই তোমার মতো ছেলেকেই ওর জন্য চাইছি।

দেখুন আপনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি এমনটা হবে না। আমি নাতাশাকে বিয়ে করতে পারবো না। তাছাড়া আপনার নিজের ব্যক্তিগত মতামত আমাদের দুজনের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ফল ভালো হবে বলে আমি মনে করছিনা। সন্তানকে সুশিক্ষা দেওয়া বাবা মায়ের দায়িত্ব। ঐটা যখন হয়নি এখন আমি দুদিনের ছেলে কতটুকুই বা পারবো? এমন ধারণা রাখা আসলেই অদ্ভুত!

দেখো বাবা এখনই মতামত দিতে হবে না। সময় নিয়ে ভাবো তারপর নাহয় বলো। আমার তাড়া নেই। তৌকির সাহেব আপনিও ভেবে দেখুন, ছেলেকে বোঝান। আসছি আস্সালামু আলাইকুম।

লাইক সিরিয়াসলি বাবা! উনি এমন অদ্ভুত প্রপোজাল নিয়ে এসেছেন?

এখানে অদ্ভুত তো কিছু দেখছি না আমি।

তোমার কাছে এটা স্বাভাবিক লাগছে?

হ্যাঁ। তুই নিজেই ভেবে দেখ বড়লোক বাবার বখে যাওয়া মেয়েকে তোর মতো ছেলের সাথেই তো বিয়ে দিবে। বাংলা সিনেমায় দেখিস না?
হো হো হো

বাবা তুমি এই সময়ে এমন জোক্স বলছো। তোমার হাসিও পাচ্ছে?

শোন বোকা ছেলে। এজ এ ফাদার আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড হিজ ইনটেনশন। টেনশন নিস না তার মেয়েই রাজি হবে না। দেখিস

আলিফের মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল।
🌿🌿
নীরা গালে হাত দিয়ে বসে আছে দাদীর বেডের পাশে। তাঁর ফানটা আজ সিরিয়াস পর্যায়ে চলে গেছে। জাহানারা বেগমের এখনো জ্ঞান ফেরেনি।
নীরার দুষ্টুমির জন্য নীরার মা তার গালে সজোরে চড় মেরেছে। নীরা মনে মনে ওয়াদা করলো সে আর কখনো দাদীকে ভয় দেখাবে না। এই যাত্রায় দাদী সুস্থ হয়ে ফিরুক।

সায়মন সাহেব বাসায় ফিরে পুরো ঘটনা শুনেই নীরাকে বকঝকা করতে লাগলেন, এটা কেমন দুষ্টুমি নীরা? সবসময় ছাড় দেই মানে এই না তুমি লিমিট ক্রস করবে। এখন তুমি বাচ্চা নেই! জানো তোমার দাদী তোমাকে নিয়ে কতোটা কনসার্ন তারপরো কিভাবে পারলে এমন করতে? এখন উনার যদি কিছু হয়ে যায় বুঝতে পারছো ব্যাপারটা কোন পর্যায়ে গেছে?

নীরা এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেললো। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিলো না। বরং সবাই তার এমন কাজের জন্য বিরক্তবোধ করলো। নীরার কান্না শুনে কারো কিছু না হলেও জাহানারা বেগমের ঠিকই জ্ঞান ফিরলো তিনি উঠেই নাতনিকে জড়িয়ে বললেন, ও বুবুন কান্দস ক্যান? কি হইছে তোর?

নীরা কাঁদতে কাঁদতেই বললো, দাদী আমি আর কোনোদিন তোমারে ভয় দেখাবো না প্রমিজ। আমাকে তুমি মাফ করে দাও।

ধুর পাগল এতো বড় মাইয়া এমনে কান্দে। দেখি চোখ মোছ

সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলের রুম থেকে চলে গেল
🌿🌿🌿

রিমি দেশে ফিরেছে ফাইনাল এক্সাম এটেন্ড করতে। সে আসার আনন্দে পুজা আর নীরা রিমির ওখানে ছোটখাটো একটা পার্টি এরেঞ্জ করেছে। সেখানে অন্যান্য ক্লাসমেটদের পাশাপাশি আলিফ ও এসেছে। যদিও আলিফের মনমেজাজ ভালো নেই কিছুদিন ধরে তবুও নীরাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ সে মিস করতে চায় না। তাই সবকিছু একপাশে ফেলে কেবল নীরার জন্যই এই পার্টিতে সে জয়েন করেছে।

কি ব্যাপার বলতো আসার পর থেকেই দেখছি আলিফের মুড ঠিক নেই। ওকে তো এমন কখনও দেখি না!

আর বলিস না একটা উটকো ভেজাল কাঁধে পড়েছে বেচারার। ঐ যে একটা মেয়েকে দিয়ে ক্যান্টিন ক্লিন করাইছিল মনে আছে? তার বাবা আসছিল প্রপোজাল নিয়ে। সেই নিয়েই বাসায় সবাই টেনসড।

কি বলোস! উনিতো মেবি সাংসদ সদস্য না?

হুম।

রিজেক্ট করবি কিভাবে? আবার মানাও সম্ভব না নাতাশা যেই ধাঁচের। ও যদি আলিফের বৌ হয় তোর ও প্যারা হবে। এমন অহঙ্কারী মেয়েকে ঝাঁ হিসেবে পাওয়া দূর্ভাগ্য ছাড়া কিছু না।

আলিফ বা বাসার কারোই মত নেই। কিন্তু কোনো ভেজাল করে যদি! যাই হোক তোর কথা বল অভিদার সঙ্গে কতদূর এগোলি?

অভিদার এখন সময় নেই পুজার জন্য। সে এখন মহাব্যস্ত মানুষ। সারাদিন জব নিয়েই বিজি।

তোর জন্যই তো খাটছে। জবের পাশাপাশি এমবিএ ও করছে। শুধুমাত্র তোর জন্য আর তুই কি না এমন সুরে বলছিস!

হুহ ছাই! আচ্ছা একটা কথা বলবি? এই প্রথম তোকে কোনো একটা কথা এতবার জিজ্ঞাসা করেও উত্তর বের করতে পারছিনা।

কি করতাম বল টপ সিক্রেট। কথা দিয়েছি বলবোনা। কিভাবে বলি!

শুধু এইটুকুই বল রিউমার টা সত্যি ছিল?

হয়তো!

ওহ মাই গড! সিরিয়াসলি। তাহলে আমার সন্দেহই ঠিক।

হুশশ কেউ যেন টের না পায়। নীরাকে এখন ভুলেও বলবিনা।

তখনই নীরা এসে বললো, কি বলবেনা নীরা কে?

পুজা হেসে বললো, শুনবি? আরেহ বলেই দেই না রিমি ও তোর বান্ধবী না? আরেহ শোন কানাডাতে আমাদের জামাইবাবু,,,,

নীরা- হইছে বুঝছি তোদের ঘুরেফিরে সেই টপিকই চলে উফ!

রিমি আর পুজা হেহে করে হাসতে লাগলো। যাক বাঁচা গেল!!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here