#স্বপ্নতরী (পর্ব:9)
♡আরশিয়া জান্নাত
সবাই জম্পেশ আড্ডা দিলেও আলিফ একপাশে বসে রইলো। এমন প্রাণবন্ত ছেলের নিরবতা চোখে পড়তে সময় লাগে না। এখানে বলতে গেলে সবাই কাছের। তাই সবাই মোটামুটি জানে নাতাশার বিষয়টা নিয়েই হয় তো মুড অফ। কিন্তু নীরা এই বিষয়ে কিছুই জানেনা। তাই তার কাছে এটা অস্বাভাবিক ই লাগলো। জাস্ট ফর্মালিটি শো করতে সে বললো, কারণ ছাড়াই যে ছেলের চারপাশে হৈ হুল্লোড়ে টেকা যায় না আজ এমন ভরা মজলিশে সে চুপচাপ বসে আছে! অবাক কান্ড।
আরেহ মিস আর্টিস্ট যে! আজ বোধহয় প্রথমবার যেচে কথা বললে।
এটা নেহাতই ভদ্রতা!
হাহাহাহা। ভালো লাগলো এই ভদ্রতা।
পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন?
বেশি ভালো না। মনমেজাজ একদম তেতো হয়ে আছে।
মুখে বলছো আর কি। দেখা যাবে ঠিকই দারুণ সিজিপিএ তুলেছ।
হাহা তোমরা কি সব যে ভাবো!
যা সত্যি তাই।
নীরা!
হুম?
থ্যাঙ্কস।
মানে? কেন?
আমার মনটা ভীষণ খারাপ। তোমার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগছে।
ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার। মেনশন নট।
পরীক্ষার পর প্ল্যান কি? জব করবা নাকি শ্বশুরবাড়ি যাবা?
পরীক্ষার পর কিছু দিন ঘুমাবো। ঘুম শেষ হলে এরপর ভেবে দেখবো কি করা যায়।
আলিফ হেসে ফেলল ওর কথা শুনে। হাসতে হাসতেই বললো, তুমি সিরিয়াসলি এতো ঘুমপাগল!
দেখো এই পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাওয়া আর ঘুমানো। খেতে হবে বলেই মানুষ দিনরাত এক করে খাটে। শুধু খাবারটাই যদি যথেষ্ট হতো এতো কষ্ট হয়তো হতোনা কিন্তু খাওয়ার পর কোথায় ঘুমাবে? তুমি নিজেই দেখো মান্থলি ঘর ভাড়া আর খাবার খরচের মধ্যে কোনটা বেশি? অবশ্যই ঘর ভাড়া। আর ঘর কেন লাগে? ঘুমানোর জন্য। তো লজিক্যালি ঘুমটা কত গুরুত্বপূর্ণ বুঝতে পারছো?
তুমি কি সব লজিক দিচ্ছো!
একটা ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত রুগীকে জিজ্ঞাসা করবা ঘুমপাগল হওয়া চাট্টিখানি কথা না। ঘুমানো একটা আর্ট।
জ্বি ম্যাম সেটা জানি। কিন্তু সবাই আপনার মতো স্লিপিং বিউটি হয় না। এতো সুন্দর জীবনটা ঘুমিয়েই যদি পার করি উপভোগ করবো কখন?
সেটা অবশ্য ঠিক।
তো কি ঠিক করলে?
কোন বিষয়ে!
ইয়া আল্লাহ! মাত্রই না বললাম? জব নাকি বিয়ে!
ওপস স্যরি! বিয়েশাদীতে ইন্টারেস্ট নেই তেমন। আপাতত জব করবো।
তোমরা মেয়েরা হুট করে বিয়েবিদ্বেষী হয়ে গেলে, অপরদিকে আমরা ছেলেরা পারলে বিশ বছরেই বিয়ে করে সংসার শুরু করে দিতাম।
বিয়েবিদ্বেষী না। সবাই সেটেলমেন্ট চায়। এই আর কি!
হুম সেটাই।
বললে না তো কেন মন খারাপ? সব ঠিকঠাক আছে তো?
সব ঠিকঠাক না থাকলেও করে নিবো।
বেশ! শুভ কামনা।
থ্যাঙ্কস।
নীরা চলে যাবার পর আলিফ মনে মনে বললো, তুমি জানোনা নীরা তোমার এইটুকু এটেনশন আমার জন্য কতোটা শান্তিপূর্ণ ছিল। খুব রিফ্রেশ লাগছে।
🌿🌿🌿🌿🌿
বাবা তুমি ভাবলে কি করে আমি আলিফ কে বিয়ে করবো!
তুই যদি সবার সামনে তাকে প্রপোজ করতে পারিস আর আমি এমনটা ভাবতে পারিনা?
না পারো না। আমি ওকে কখনোই বিয়ে করবোনা। তাছাড়া ঐটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল যাতে আমি ফ্লপ খেয়েছি। অনেক দিন লেগেছে সেই ট্রমা কাটতে। তুমি আবার এটা উজ্জীবিত করোনা প্লিজ। তাছাড়া আলিফ অন্যজনের আমানত। আমি ওদিকে ভুলেও যাচ্ছি না।
মানে?
রিয়া আপু আলিফকে ভালোবাসে। সো তুমি এমনকিছু করোনা যাতে ওর সমস্যা হয়। এই বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল প্লিজ।
মোস্তফা সাহেব ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন, রিয়ার বিষয়ে আগে বলো নি কেন?
আমি কি জানতাম নাকি তোমার মাথায় এসব চলছে!
ওকে ফাইন। আমি তাদের মানা করে দিচ্ছি।
থ্যাঙ্কস বাবা।
কোথায় যাচ্ছ?
দুপুরে একটা পার্টি আছে সেখানেই যাচ্ছি।
মোস্তফা সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। আলিফকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল নাতাশার জন্য। কিন্তু নাতাশা বা আলিফ কারোই এদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। যাক ভাগ্যে যা আছে তাই ঘটবে।
নাতাশা বের হতে হতেই রিয়াকে কল করলো, হ্যালো রিয়াপ্পি ডোন্ট ওরি বাবাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। তুমি এখন নিশ্চিন্তে এক্সাম দাও। তোমার আলিফ তোমারই থাকবে।
রিয়া হেসে বললো, থ্যাঙ্কস এ লট পাখিটা। ইনজয় ইওর পার্টি।
রিয়া সাথে সাথে আলিফকে কল করে বললো, আলিফ তোমার টেনশন একদম ঝেড়ে ফেলো। নাতাশার বাবা আর ঝামেলা করবেনা। খুব শীঘ্রই তোমার কাছে খবর আসবে।
কিভাবে?
আমি থাকতে এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তুমি টেনসড হবা? ইম্পসিবল।
তুমি আসলেই আমার খুব ভালো বন্ধু। এটা আসলেই মাথায় বোঝার মতো লাগছিল। I’ll be grateful to you. Thanks a lot.
রিয়া লাজুক ভঙ্গিতে ফোন টা রাখলো। ওর কি যে ভালো লাগছে আলিফের মুখ থেকে ভালো কথা শুনে। এইটুকুও যে কম না।
” ভালো বন্ধু বলেছ খুব শীঘ্রই ভালো গফ বলবা দ্যান ভালো ওয়াইফ ভালো বাচ্চার মা,,,,”
বলেই মুখ ঢেকে ফেলল সে। কবে যে তার স্বপ্ন পূরণ হবে!!
।
।
কি ব্যাপার বলোতো কয়দিন গোসল করোনা তুমি?
মানে কি! একটু আগেই না গোসল করেছি!
তাহলে এতো বাজে গন্ধ আসছে কেন?এতো জঘন্য গন্ধ যে আমার বমি পাচ্ছে!
তাশরিফ বেকুবের মতো নিজের গা শুকতে লাগলো। “কি বলো তুমি রিমি? তোমার ফেভারিট সেন্ট দিয়েছি তাও এই কথা?”
এতো কথা জানিনা যাও গিয়ে গোসল করো। তোমার জন্য এখানে টেকা মুশকিল হচ্ছে!
তাশরিফ অসহায় মুখ করে না চাইতেও গোসলে গেল। রিমি রান্নাঘরে গিয়ে দেখে তার শাশুড়ি ইলিশ মাছ ভাজছেন। ইলিশ ওর খুব প্রিয় মাছ তাই সে আনন্দিত হয়ে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মাছভাজার সুঘ্রাণ পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লেও রিমির কাছে এটা পঁচা বাসি মাছের গন্ধ ঠেকছে। সে কিচেনের সিঙ্কেই বমি করে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আলেয়া চুলায় মাছ রেখেই ওকে সামলানো তে ব্যস্ত হয়ে গেল। ওদিকে রিমির বমি বন্ধ হবার নাম নেই। সেই বেচারি মরার মতো বমি করেই যাচ্ছে। ঠিক সময়ে তাশরিফ এসে চুলা অফ না করলে কি হতো আল্লাহই জানেন!
অর্ধমৃত অবস্থায় রিমিকে এনে বেডরুমে রাখা হলো। সবকিছু শুনে আলেয়ার বুঝতে বাকি রইলো না কি ঘটেছে। রিমি নাকে কাপড় দিয়েই বলে যাচ্ছে, মা আপনার ছেলেকে এখান থেকে যেতে বলেন। ও কয় বছর গোসল করেনা আল্লাহ জানেন!
আলেয়া হাসতে হাসতে বললো, খোকা যা গিয়ে ডাক্তার সুপর্ণাকে খবর দে। সুখবর আছে হয়তো। আমাদের ঘর আলো করে নতুন অতিথি আসতে চলেছে।
তাশরিফ হা করে চেয়ে রইলো। সে কি এই পৃথিবীতে আছে নাকি অন্য জগতে চলে গেছে??
বৌমা যেই আসতেছে সে আমাদের জন্য সৌভাগ্য। আজকেই এতোবড় একটা টেনশন দূর হয়েছে আজকেই এমন খুশির সংবাদ পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ। আমি যাই শোকরানার নামায পড়ি। তুমি লেবুপাতা কচলাও। ভালো লাগবে।
নীরা পড়ার টেবিলে বসে পড়ার বদলে চারপাশের সবকিছু ঘাটছে। পড়তে বসলে বইটা ছাড়া দুনিয়ার বাকিসব হাবিজাবি জিনিসও দেখতে ভালো লাগে। দেয়ালের রংটাও তখন অসম্ভব সুন্দর কিছু মনে হয়। খাতাগুলি ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ সে তার পুরনো আর্টবুকটা বের করলো। আলিফ এই আর্টবুকটা বহুদিন তার কাছে রেখেছিল। এরপর যখন দিয়েছে তারপর আর এটা ধরা হয় নি।
সে পাতাগুলি উল্টে দেখতে লাগলো। আয়নার সামনে একটা মেয়ে বসে আছে, আর আয়নার ভেতর থেকে অন্য একটা মেয়ে হাত বাড়িয়েছে তার দিকে।
পানিতে ডুবন্ত একটা মেয়ে, যার পরনে হলুদ রঙের ড্রেস।
এরকমই নানা ভঙ্গির ছবি, প্রকৃতির ছবি, তাদের ভার্সিটির বিভিন্ন পল্টের ছবি সেখানে আঁকা আছে। শেষের ছবিটা দেখে নীরা চমকে গেল। এই ছবিটা তার আঁকা না। নীরা সোজা হয়ে বসে ছবিটা মন দিয়ে দেখতে লাগলো। এটা কি তবে আলিফ এঁকেছে? এই প্লট সে পেলো কিভাবে? তবে কি কোনোভাবে সেটা আলিফ দেখেছিল! ইয়া আল্লাহ!!!!!!!
চলবে,,,,