শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_৩

0
560

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_৩
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

৩.
বিগত দুবছরে কতিপয় জিনিস পরিবর্তন হয়েছে। জীবন পরিচালনায় আরোপিত হয়েছে বৈচিত্র্যতা। দানীন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা ফেলে জীবনের অনন্য এক অংশের প্রবেশদ্বার অতিক্রম করেছে। পেয়েছে নিজের একলাটি জীবন ও প্রকৃতি থেকে বাহিরের জগতে অবতরণ করার সুযোগ। নিজের পরিবারের বাহিরেও কিছু ব্যক্তিবর্গের গাঢ় ভালোবাসার পাত্র হয়েছে। এই নিগূঢ় ভালোবাসা প্রদানের ক্ষেত্রে তার ভার্সিটি টিচারদের ভূমিকাই বেশি। সালাউদ্দিন স্যার আর রুমি ম্যামের মুখে তো অবিরত দানীনের নাম থাকেই।
আর রানিয়া। এই মেয়েটি ব্যতীত দানীন সামনে আগুসারের কথা কল্পনায় আনতেও নারাজ। ছাত্রজীবন যে প্রাণোচ্ছল, আমোদিত গল্প সবার অন্তরে পুঞ্জিত থাকে, দানীনের সেরকম কোনো গল্প নেই। বন্ধুমহলের একেক সদস্যের একেক মনোভাব সে দেখার সুযোগ পায়নি। তার তো নিজস্ব কোনো বন্ধুমহলই ছিলো। নিজের দেহের কালো রঙ তার মনে প্রতিনিয়ত অনুশোচনাপূর্ণ বাণীমালা উৎপন্ন করতো। ফলে সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় সদা অবিরত থাকতো। তবুও হৃদয়ের গলিতে এই আশা পরিপূর্ণ হতো যে, এই বুঝি কেউ এসে বলবে, ‘চলো দানীন। আজ পুরো টিফিন টাইম আমরা খেলবো।’
সে শব্দহীনভাবে তার সহপাঠীদের প্রাণোচ্ছলতা পর্যবেক্ষণ করে যেতো। তারা হয়ত নিতান্তই অনবগত ছিলো– এই প্রাণবন্ত, প্রাণচঞ্চল শৈশব, এই ছাত্রজীবন প্রখরভাবে একসময় মিস করবে। কিন্তু দানীন অবগত ছিলো ছাত্রজীবনের মতো মিষ্টি শব্দ তার মনে যেই বিভীষিকাময় অনুভূতি সৃষ্টি করে চলছিলো তা সে কখনোই স্মরণ করতে চাইবে না।
রানিয়ার সঙ্গে সে যেনো তার হারানো শৈশবকালীন উচ্ছলতা পুনরূদ্ধার করতে পেরেছে; যদিও তা তার অসংগঠিত মধুর শৈশব।
ক্যাফেটেরিয়ায় পৌঁছে দুই বান্ধবী কারণ ছাড়াই খাবার নিয়ে চটাচটি শুরু করে। মাঝেমধ্যে খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে। গ্রন্থাগারে গিয়ে প্রতিবেশের মনোযোগী ছাত্র-ছাত্রীর মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করতে দুজন একসঙ্গে সশব্দে হেসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই গ্রন্থাগারিকের বকুনি খেয়ে দুজন খুশিমনে হেলেদুলে লাইব্রেরি ভবন ত্যাগ করে। মাঝেমধ্যে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে থেকে ছেলেদের জুতোও চুরি করে। সেই জুতো ভার্সিটির প্রবেশদ্বারে অবস্থিত ছোট পুকুরটিতে নিক্ষেপ করে। আর জুতোর মালিক আফসোস করতে করতে তরকারিতে পেঁয়াজ অবহেলিত হয়ে স্ব-ইচ্ছায় ডুবে মরার অনুরূপ তার জুতোজোড়া ডুবে মরা অবস্থায় দেখে চিৎকার করে ওঠে। আর রানিয়া ও দানীন একাডেমিক ভবনের বারান্দা থেকে আফসোসের সূর মেলায়, ‘আহারে আহারে, কে ফেললো জুতাজোড়ারে..’

এরমধ্যে তার ঘর সংশ্লিষ্ট পরিবর্তন হলো– তার দুই ভাইবোনের বৈবাহিক অবস্থা বিবাহিত পদে উত্তীর্ণ হয়েছে। পারিশা তার কলেজ শেষ হতেই বিয়ের পিড়িতে বসেছে। প্রথমে পারিশার সম্মতি আছে কিনা এই দ্বৈধীভাবে দানীন বাধা প্রদানের প্রচেষ্টা করেছিলো। পরে অবহিত হলো তার বোন পারিশার বিয়ের জন্য আগ্রহই যেনো সবচেয়ে বেশি। সবাই তো কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় না। কেউ কেউ সংসারে কর্তী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, সম্মানিত হতে চায়। কাজ করে নিজেদের মূল্যবান, উপযুক্ত প্রমাণ করতে করতে জীবন শেষ করতে হয় তার মতো যোগ্যতাহীন, অক্ষম মানুষদের। সেই অক্ষমতা যা সমাজে বিচরণ করা কিছু নরপশু বর্ধিত করে পুরো সমাজকে গন্ধযুক্ত চাদরে মোড়িয়ে রেখেছে। আর মানুষ সেই গন্ধযুক্ত চাদরে অভ্যস্ত হওয়ার প্রচেষ্টা করে; তবুও তা পুড়িয়ে দিয়ে সমাজের বর্জিতাংশ পরিত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান দেয়।
সে চায় তার বোন সংসারে দাসী হয়ে জীর্ণশীর্ণ হয়ে জীবনের অকৃতকার্যতা গ্রহণ নয়, বরং কর্তী হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করুক। সারাদিন অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বামী ঘরে ফিরে যেনো তার বোনকে তার রাগের শিকার না করুক। বরং ভালোবাসার ছোট পরশ প্রসারের দ্বারাই যেনো এক আকাশ সম নিশ্চয়তা প্রদান করে। অবশ্য বর্তমানে সবাইকেই প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। অকুল পাথরে পতিত হলে যেনো আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে হাত পাততে না হয় তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। কারণ সংসার নামক কর্মক্ষেত্রে কর্তী ও দাসীর আসনের আকস্মিক পরিবর্তন হলেই বিপত্তি। প্রায় কথিত হয়, পুরুষের মন আর পাঁকা আম এক তালে দোদুল্যমান। আকস্মিকভাবেই দৃঢ় বন্ধন থেকে বিচ্যুত হয়। স্বামী নামক পরিচালকের প্রোগ্রামেই যদি ভুলত্রুটির সো কলড নৈতিক বিষ উৎপাদিত হয়, তবেই কর্মের পর অর্জিত লাভে ধ্বস নামে।

তবে তার ভাই ও ভাইয়ের বউয়ের জন্য সৌভাগ্য কামনার অভিলাষে কোনো অভিরুচি হয় না। এরূপ নিষ্ক্রিয় মনোভাবের দায় দানীন তার ভাবির উপরই বর্তায়। ভাবি নোয়াখালীর বাসিন্দা। টেনে টেনে যেকোনো বাক্য উচ্চারণ করে। তার উচ্চারণভঙ্গি ঠাহর করে সারসের মতো আকস্মিক গতিতে পুকুরে লাফ দেওয়ার জন্য ইচ্ছা জাগে।

দানীন বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে মাকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ বাদে লক্ষ্য করলো মা তার ভাইয়ার রুমে আছে। গম্ভীর মুখে তার ভাইকে কিছু বলছে। দানীন সেখানে গেলে তার মায়ের চেহারা আরও থমথমে রূপধারণ করলো।
দানীন সবার চেহারা নিরীক্ষণ করে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“মা, এদিকে আসো তো।”
তার মা সঙ্গে সঙ্গেই তার ভাইয়ের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
তিনি আসতেই দানীন বলে ওঠলো,
“ভার্সিটির কাছে বাসা নেওয়া যায় না মা? প্রতিদিন কতখানি সময় নষ্ট হচ্ছে। আবার বাসেও কিছু ছেলে ইদানীং বিরক্ত করে যাচ্ছে।”
দিলরুবা খাতুন বিষাদভারাতুর দৃষ্টিতে দানীনের দিকে তাকালো। মেয়েটির কন্ঠস্বর কি সুমধুর! যেকোনো কথাই সুশ্রাব্য ঠেকে। সুস্বরপূর্ণ কণ্ঠে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে তার এই মেয়েটি। তার এই মেয়ের মেধাও মাশাল্লাহ অসাধারণ। শুধু গায়ের রঙের কারণে পরের মেয়ে ঘরে এসে তার পেটের মেয়ের বিয়ে সমন্ধে কৃত্রিম হাঁ-হুতাশ প্রদর্শন করে। দিলরুবা খাতুন জানে তার ছেলের রূপবান বউ কেন, তার অন্য সন্তানও গুণগত মানে দানীনের যোগ্যতার আশেপাশেও পদর্পণের যোগ্যতা রাখে না। প্রতিবেশীদের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়া কুরুচিপূর্ণ স্বভাবের জন্য নিজেও মেয়েটিকে কতো কথা শুনিয়েছেন।
দানীনের ভাবীর উচ্চ হাসি কানে আসতে দিলরুবা খাতুনের ভাবনার সুতো দ্বিখণ্ডিত হলো। তিনি কক্ষের বাহিরে, কিন্তু দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
দানীনের ভাবি উপহাস করে দানীনের উদ্দেশ্যে মন্তব্য ছুঁড়ল,
“তোমাকেও বিরক্ত করে? আসলেই পাগল-ছাগল। এদের বুদ্ধি নাই।”
বলেই আবার উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়লো। নাকিদ বিছানায় বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে এক পায়ের হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। মুখমণ্ডল জুড়ে উদাসীন অভিব্যক্তি প্রকাশের প্রচেষ্টা থাকলেও মস্তিষ্কের ধৃষ্টতা স্পষ্ট। ভাবী দানীনকে প্রায়ই কটুকাটব্য দ্বারা আঘাত করে। কিন্তু নাকিদ পক্ষপাতশূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধু পর্যবেক্ষণ করে। বউয়ের এরূপ বিশ্রী মনোভাব জাহির ও ত্রুটিপূর্ণ বাচনভঙ্গির জন্য কখনো বাধা প্রদান করে না।
কিন্তু দানীন জানে। কখনও যদি সে নিজের জন্য প্রতিহত করার প্রয়াসে কিছু বলার করলে, তার ভাই থিতিয়ে আসবে। এরপর তা নিয়ে এলাহী কান্ড ঘটিয়ে তাকে বেয়াদব হিসেবে উপস্থাপন করবে। বাবার কাছে একবার পরিবারের অশান্তির প্রতীকস্বরূপ তাকে জাহির করতে পারলেই ক্ষান্ত হবে।
ভাই তার নিজের ভালোটা বুঝতে শিখেছে যে। পরশ্রীকাতরতার চাদরে নিজেকে মোড়িয়ে নিয়েছে। তার সঙ্গে তো দানীনের কখনোই ভাইবোনের নিগূঢ় সম্পর্ক প্রতিস্থাপিত হয়নি। পারিশার প্রতি নাকিদের যে উপচে পড়া আদর, অধিপ্রবাহিত ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে– তা-ও বর্তমানে কৃত্রিম। এটাকেই বুঝি বলে, ‘মুখে মধু, অন্তরে বিষ।’
দানীনের ইচ্ছে করছে তার ভাবীকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দিতে। শ্বশুরবাড়ি থেকে যে কারচুপি করে জিনিসপত্রের সঙ্গে স্বামীর পকেটও শূন্য করে বাপের বাড়ি পাঠায়, সেই নিয়ে জিগ্যেস করলেই তো চুপসে যাবেন। মা প্রায়ই বলেন– স্বামীর অর্থ-ভান্ডার শূন্য করে বাপের বাড়ির খালি কলস পূর্ণ করায় উদ্যত যেই সংসারের গৃহিণী, সেই সংসারে অগ্রগতি হয় না; কখনও উন্নয়নের মুখ দর্শন করতে পারে না।

দিলরুবা খাতুন ঘরের আঙ্গিনা ঝাড়ু দিচ্ছেন।
দানীনের উপস্থিতি লক্ষ্য করে তার মা কপট কুপিত কণ্ঠে বলে ওঠলেন,
“সকোলের ওঠতে খোডা বইতে খোডা। তোর বিয়াটা আল্লাহ আল্লাহ কইরা দেওন যাইলে.. কোনহানে যামু উদ্দিস পাইনা মোডেও।”
দানীন সশব্দে হেসে ওঠলো। তার মার এই চিন্তিত বাণী, উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, সংবিগ্ন মুখায়ব নতুন কিছু নয়।
“তাহলে পাত্রের খোঁজ করো। পাত্র আনলেই আমি এখনই বিয়ে করে নেবো। কিন্তু তোমার এই কালী মেয়েকে ঘরের লক্ষী না করে যদি ছুকরি করে তুলে?”
দিলরুবা খাতুনের অন্তরে যেনো শতশত ছিদ্রাবলী হলো।
দানীন তার মায়ের অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করে কথা ঘুরানোর প্রযত্নে বললো,
“যাতায়াতের জন্য কি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেই না?”
দিলরুবা খাতুন এক চোখের আকৃতি সঙ্কুচিত করে বললেন,
“হ, এহান দিয়া ভার্সিটি তো বেমালা দূর। হলের কতা ভাইবা থাকলে বাদ দাও। মোর লগে ঘ্যানর ঘ্যানর না হইরা বাপের কাছে যাও দেহি।”
এই বলে উনি উনার কাছে পূর্ণ মনোনিবেশ করলেন। দানীন জিহ্বা মেলে মাকে দেখালো। হলের কথা বললে যে বাবা তাকে তিনশো ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরিয়ে এনে থাপ্পড় মারবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং, সপাৎ সপাৎ করে গালদ্বয় লাল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
দানীন মৃদু চেঁচিয়ে বললো,
“শোনো মা, প্রতিদিনের এতো কষ্টকর যাতায়াতের অবসান না ঘটলে তোমাকে আমি তোমার বাপের বাড়ি পাঠাবো।”
তার মাও চেঁচিয়ে বললেন,
“ঘরে থাইকা ফার্মের মুরহার লাহান হইতাছো। ভালাই হইবো তইলে।”
দানীন তার মার প্রত্যুত্তরে হতাহত হলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here