শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_২

0
376

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_২
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২.
দানীন তার দেহের কালো রঙের মতো লাভ করেছে চিত্তহারী মেঘমেদুর কেশ। এ যেনো আকাশের আড়ালে অবস্থান নেওয়া মেঘ যা এক সময় আয়োজন করে নিজেকে উপস্থাপন করে এবং সে যে অস্তিত্বশীল তা অবহিত করার প্রযত্নে তার স্নিগ্ধ, মনোরম জাহির করা মেঘবতী। এক পলক তার মুখমণ্ডল নীরিক্ষা করলে বোধ হয় সে অনেক বুদ্ধিমতী। একলহমায় দানীনের এই মুখায়বের সঙ্গে পড়াকু উপাধি নিমেষেই যায়। আলাদাভাবে তা মানুষকে বলে বেরানোর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু ঐ আঁখি দুটোতে দৃষ্টি রাখলে অনুভব করা যায় তার অতলে সুপ্তাবস্থায় বিদ্যমান অবনমিত কষ্ট। প্রতিদিন নিশ্রামের পরও যেনো হাজার বছরের শ্রান্তি। সে যেনো সুবিশাল আকাশের অধোদেশে সীমাহীন মহাসমুদ্রে ভাসমান লক্ষ্যহারা তরীতে একাকী ভেসে চলা তরুণী। কিন্তু সবাই সেই পড়াকুর পরিবর্তিত সীমা অতিক্রম করে ঐ চোখের জটিলতা উপলব্ধি করতে পারে না।

দানীন তার কক্ষে রাখা চতুষ্কোণাকার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার দীর্ঘ কৃষ্ণবর্ণ কেশ পর্যবেক্ষণ করে চলছে। সে তার এই সৌন্দর্য-সৌষ্ঠব চুল সম্পর্কে একশো ভাগ অবগত। লোক সমাগমে উপস্থিত হতে আতঙ্কগ্রস্থ হলেও তার এই অনিন্দিত চুল ঢাকার প্রচেষ্টা সে কখনও করে না। এই সুশোভন চুল দ্বারা নিজেকে শোভাময় করার খানিক প্রচেষ্টা, এই যাহ।

ঝালকাঠি থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব অনেকখানি। প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হয়। এখন দানীন রূপাতলি বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে।
গ্রীষ্মকালের পরিসমাপ্তি ঘটতে চললো বলে। অংশুমালীর আবেগের প্রাবল্য বিস্তারে আকাশে বিরাজমান দয়াময়ী মেঘবতী তাকে ধমকে ক্ষণে ক্ষণে মিইয়ে দিচ্ছে। ব্রীজের গোড়ায় গীষ্মকালীন ফলফলাদি নিয়ে কিছু বিক্রেতা বিক্রির প্রয়াসে বসে আছে। ক্রেতা-বিক্রেতা তাদের দাম নিয়ে গড়িমসির সময়কালে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে অভুক্ত দাবি করে হাত পাতছে।

তার সামনে বাস এসে থামলো। ইদানীং বাসে যাতায়াত করা অসহ্যকর ঠেকছে। কয়েকটা ছেলে বাস স্ট্যান্ড থেকে ভাঙা-বরিশাল হাইওয়ে অবধি বাসে অবস্থান করে। আর ততক্ষণ অবধি উঁচু-নিচু ভঙ্গুর রাস্তার মতো ভাঙা রেডিও বাজাতে থাকে।
“তোমার ঐ কেশ কালো চুলের রূপ পাগল করলো আমায়..”
প্রতিদিন এই একই কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে।
দানীনকে উদ্দেশ্য করে একটা ছেলে বলে ওঠলো,
“চানাচুর খাবেন আপু?”
দানীন বিরস মুখে জবাব দিলো,
“না ভাই। রোজা রেখেছি। রোজাদার ব্যক্তিকে খাবার সাধতে নেই।”
তার পাশের ছেলেটি বিগলিত হেসে বললো,
“ইফতারের সময় না হয় খাবেন।”
দানীন ভ্রু কুঁচকে তাদের দেখলো। তার মতো কালো মেয়ে বর্ণহীনের মতো অদৃশ্য না হয়ে এই ছুকরাগুলোর নজরে কি করে পড়লো, দানীন তা ভেবে পায় না।
“ইফতারের সময় চানাচুর? শরীরের উপরের তিন অংশবিশিষ্ট বস্তুটির অবস্থান কি উপরেই আছে নাকি বাসের ঝাক্কি খেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে রেচনতন্ত্রের কাছাকাছি এসে অবস্থান নিয়েছে?”
তারা বিস্ফোরিত চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। দানীনের কথার অর্থোদ্ধার করতে এখনও পারেনি। কিন্তু দানীন জানে যখন এই অপারগতা কাটিয়ে তিন অংশবিশিষ্ট বস্তু কাজে লাগিয়ে সেটারই অর্থ উদ্ধার করবে, তখন ভার্সিটি যাওয়া তার আরও দুর্বিষহ ঠেকবে। তাদের এই ময়লা-আধোয় মুখমণ্ডলের মতো চিন্তাভাবনাও ময়লা হলে তো আর কোনো কথাই নেই।

ভার্সিটি পৌঁছেই দানীন রানিয়ার দিকে এগিয়ে গেলো। রানিয়া হলো তার বেস্ট ফ্রেন্ড। একাদশ শ্রেণী থেকে তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের সূচনা হয়েছে। অবশ্য দানীনই তার অনুভূতিহীন, শব্দহীন বৈশিষ্ট্য ক্ষণকালের জন্য পাশে স্থির রেখে প্রথমে অগ্রসর হয়েছিলো। কলেজে উত্তীর্ণ হওয়ার পর রানিয়াকে প্রায়ই পড়ার জন্য স্যারের কাছে দাবড়ানি খেতে দেখা যেতো। পরবর্তীতে দানীন অবসরের সময়টুকু রানিয়ার জন্য বরাদ্দ রেখে তার পড়াশোনায় সঙ্গ দিতো। ব্যস, এভাবেই হয়ে উঠলো একে অপরের বেস্টফ্রেন্ড।

“বাহ, মহারাণী! আপনার চলাচলের দ্রুততা ঠাহর করে আমি হতভম্ব। নিজের শরীরের উপর এতো চাপ প্রয়োগ না করলেও পারতেন।”
দানীন রানিয়ার কপালে আঙুল দ্বারা মৃদু আঘাত করে বললো,
“আমাকে কতোখানি পথ অতিক্রম করে আসতে হয় জানিস? তার উপর যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য বাসের ছুকরাগুলো তো আছেই।”
“হ্যাঁ, বুঝেছি। এবার ক্লাসে চল।”
দুজন একই অনুষদের হলেও ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের, তাই দুজন দুই পথে অগ্রসর হলো।
দানীন বায়োকেমিস্ট্রি ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের কক্ষে প্রবেশ করলো।
সালাউদ্দিন স্যার প্রবেশ করে সর্বপ্রথম দানীনকে ডাকলো,
“আয়েশা দানীন ওয়াফিয়া।”
সে দাঁড়িয়ে জবাব দিলো,
“ইয়েস স্যার।”
“গুড জব দানীন, ইউ হ্যাভ এনচেনটেড দ্য হোল ডিপার্টমেন্ট। পরবর্তীতে যেনো একই রেজাল্ট বজায় থাকে।”
দানীন মাথা নেড়ে আসন গ্রহণ করলো।
এরপর স্যার সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
“সো গাইজ, শুধু পাবলিক ভার্সিটিতে পড়াশোনা করলেই তো হবে না। উপর দিয়ে ফিটফাট নিচে দিয়ে সদরঘাট হলে কী হবে? হবে না। দানীনের মতো সবার পড়াশোনার গতি ঊর্ধ্বমুখী হওয়া চাই..”
এভাবে স্যার আরও কিছুক্ষণ বক্তৃতা অব্যাহত রাখলো। পড়াশোনায় দুর্দান্ত হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার ফলে ডিপার্টমেন্টের সব শিক্ষক-শিক্ষিকা দানীনকে অত্যন্ত পছন্দ করে।
আশ্চর্য!
স্কুল কিংবা কলেজে থাকাকালীন তার রেজাল্ট সবচেয়ে ভালো থাকলেও টিচাররা তাকে কথায় কথায় নিচু করতো। কটুকাটব্য দ্বারা তাকে খুব আঘাত করতো। অন্য ছাত্র-ছাত্রীকে ব্যর্থতা, বিফলতার উদাহরণস্বরূপ তাকে উপস্থাপন করতো।
এই টিচার জাতকেই সে প্রচন্ড ঘৃণা করতো। কিন্তু এখানে সে যেনো টিচারের এক বিসদৃশ রূপ আবিষ্কার করলো।
কিন্তু এই বৈসাদৃশ্যটা প্রকৃতপক্ষে কিসের? উচ্চ শিক্ষার নাকি সুশিক্ষার?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here