শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_১

0
853

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_১
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

১.
ল্যাপটপের পর্দায় নির্দিষ্ট রোল নং দেখার পর এতোক্ষণ কম্পিত হৃৎপিন্ডের কম্পন ধীরগতি লাভ করলো। এলোমেলো চিন্তা-ভাবনাগুলো স্থির হয়ে এলো। দানীন বরিশালের ঝালকাঠিতে পরিবারের সঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে দ্বিতীয় সন্তান। বাকি দুই ভাইবোনের কাছে পড়াশোনা তুচ্ছতাচ্ছিল্য হিসেবে স্থান লাভ করলেও দানীনের কাছে ভাইবোনের এই অপাংক্তেয় পড়াশোনা বিশেষ স্থানে উত্তীর্ণ হয়। কিছু দিন পূর্বে সে গুচ্ছ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলো। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছে, যদিও তার ইচ্ছে ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু চান্স পায়নি। অবশ্য, তার বাবা নাইমোল্লাহ সাহেব তাকে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে অন্য শহরে পাঠাতেন কি না এই নিয়ে দানীনের মনে যথেষ্ট সংশয় ছিলো। সেই দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। অন্যথায়, অযথাই মন খারাপ হতো।

তার বড় ভাই নাকিদ ল্যাপটপের পর্দা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দানীনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এটা তো তোরই রোল।”
সে চান্স পেয়েছে নিশ্চিত হয়ে দানীনের ছোট বোন পারিশা লাফিয়ে উঠে মায়ের কাছে ছুঁটলো। নাকিদও রুম থেকে বের হয়।
দানীন বারবার ক্রমিক নম্বরে তার রোল দেখছে এবং একই সঙ্গে পুলকিত হচ্ছে। তার এই ফলাফল শুনে নিশ্চয়ই প্রতিবেশের সবাই অবাক হবে। তার এতো কষ্ট পরিশেষে সফলতা লাভ করলো বুঝি।
সে-ও রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো তার মা-বাবার ঠোঁটে আনন্দের হাসি ঝুলে আছে।
তার মা দিলরুবা খাতুন তাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,
“মোর মাইয়া এতো ভালো রেজাল্ট হরছে। মোর কতো হপ্পন ছিলো মোর মাইয়া বড় ভার্সিটিত পড়বো। মোর সোনা মা!”
তার বাবা নাইমোল্লাহ তার ভাইকে নিয়ে বাজারে মিষ্টি আনতে গেলেন। পাড়া-প্রতিবেশি সবাইকে খুশির সংবাদ সম্পর্কে অবগত করতে হবে তো।
প্রতিবেশী চাচী-জেঠী সবাই দানীনকে দেখতে এলো। পেটে বিশাল স্থুল ধারণ করা তার সুরাইয়া খালাকেও দেখা যাচ্ছে। সবার মাঝে তার বোনের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে মিষ্টি বিতরণ করছেন। আর সবাই সেই মিষ্টি মুখে পুরে দানীনকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।
লোকসম্মুখে উপস্থিত হতে দানীন রীতিমতো আতঙ্কিত। তবে এবার সবার বিসদৃশ বাচনভঙ্গি লক্ষণীয়। এই তো আল্লাহ’র নাম নিয়ে সবে সফলতার আগলে পা ফেললো। সবার কাছে এতো প্রশংসিত হচ্ছে; সব আনন্দের লেশ যেনো তাকে ঘিরে ধরেছে।
কিন্তু তার এই সুখকর অনুভূতির সময় দীর্ঘায়িত হলো না।

তাদের ঘরের পাশে ঘর, সম্পর্কে দানীনের জেঠী। উনার বাসায় তার বোন বেড়াতে এসেছেন। জেঠীর সঙ্গে তার বোনও এলেন।
আচমকা তার মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“আমহের কী এই এউক্কা মাইয়াই?”
দিলরুবা খাতুন প্রত্যুত্তরে সহজ ভঙ্গিতে বললেন,
“না, মোর দুই মাইয়া এক পোলা।”
মহিলা চোখ-মুখ সঙ্কুচিত করে বলে ওঠলেন,
“মাইয়া দেহি কালা। বাপ-মার লাহান তো না।”
সঙ্গে সঙ্গে তার মা-বাবার চেহারা কালো হয়ে গেলো। এই উক্তি এই প্রথম দানীনের দিকে নিক্ষেপিত হয়নি। ছোট থেকেই সে এসব শুনে আসছে। এখন এসব শুনেও না শোনার ভান করে। মা-বাবা আগে সান্ত্বনা দিলেও এখন তাদের নিকট ফোঁড়া ন্যায় বোধ হয়। তারা বিরক্ত। প্রচন্ড তিক্ত। তার মা উজ্জ্বল শ্যামলা তবে তার কেনো এমন রঙ হতো হলো যা সমাজের কাছে পরিত্যক্ত!
দানীনের খালা সামনে এগিয়ে এসে বললেন,
“থুতমাডা কালা হইলেও মোরার মাইয়ার গুণ আছে। দেহেন না কতো বড় কলেজো টিকছে?”
দানীন তার খালার মুখে দৃষ্টি স্থির রেখে প্রশ্ন করে,
“কালো শব্দটা উচ্চারণ করা কী আবশ্যক খালা?”
তার খালা বিরস মুখে জবাব দেন,
“এতো প্যাচাল পোডো কা আয়? তো কালারে কালা কওমু না? তোর বোইন ধলা, ধলা কই। তোর লাহান কাইজ্জা বাজায়?”
জেঠীর বোন পারিশাকে সামনে এনে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললেন,
“আমহেরার এই মাইয়া তো ভালা সুন্দর, মাশাল্লাহ।”
পারিশা রূপের প্রশংসা শুনে লজ্জায় মিইয়ে গেলো। এতোক্ষণ পর তার মা-বাবার চেহারায় তৃপ্তির আভাস খেলে গেলো। এমন সুন্দরী মেয়ে জন্ম দিয়ে তারা যে সার্থক।
ঐ মহিলা জিগ্যেস করলেন,
“বিয়া দিবেন নি?”
দানীনের খালা ঐ মহিলাকে ঘেঙচানো মুখমণ্ডলে উত্তর দিলেন,
“বেবুদ্যানি? মাইয়া ছোডু। মোরার নাকিদের জন্য আগে দেহেন। একখান ভালা ছেড়ি পাইলে বিয়া পড়ায় দিমুনে। পরে আমাগো মাইয়াগো কাম ধরুম।”
তাদের কথাবার্তার মাঝখানে দানীনের ফুফা-ফুফির আগমন ঘটলো।
তার মা তাদের লক্ষ্য করে ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“সুরাইয়া, ওশ্যা ঘর থেইকা আরও মিষ্টি আন তো।”

আর দানীন? সে সবার সম্মুখীন হতে আবার নিজেকে লুকানোর প্রযত্নে প্রস্থান নিলো। তার ভাইবোনের গুণ সম্পর্কে আলোচনা হতে হতে কখন না আবার তার ত্রুটিপূর্ণ গুণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সবসময় থেকে এরকমই হয়ে এসেছে। সে প্রথম দফায় ভেবেছিলো আজ তার একান্ত আনন্দময় দিন। একান্তভাবে তার হাস্যোজ্জ্বলের দিন। কিন্তু নাহ..

আচমকা পিছন থেকে তার ফুফাতো ভাই এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
“হেই কিউটু।”
দানীন তাকে সামনে এনে কোলে বসালো। তার ফুফাতো ভাই ফারিহ। এই বছর সপ্তম শ্রেণীর পাঠ সমাপ্তির আশায় মনপ্রাণ ঢেলে আশাতীত। গায়ের রঙের জন্য সবাই দানীনের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করলেও ফারিহ তাকে খুব ভালোবাসে। দানীনকে অনুসরণের ফলেই একসময়ের ‘পড়াশোনায় চূড়ান্ত ফাঁকিবাজ’ ট্যাগ হটিয়ে ভালো, নম্র-ভদ্র ছাত্র হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।
ফারিহ হাত তালি দিতে দিতে বললো,
“আপু, তুমি বরিশালেই থাকবে।অবস্থান করবে। ঢাকা তো কপালে জুটলো না।”
দানীন ফারিহ’র নাক চেপে ধরে বললো,
“তা তোর জন্য মুলতবি করা হলো। তোকে চান্স পেতে হবে। আর এতোদূর যদি আপু যাই তুই কেঁদে পুরো বরিশাল বন্যায় ভাসাবি না? এই যে এতো এতো চকলেট, বই তোকে দেই। কান্নাকাটি করা তো তোর জন্য আবশ্যক।”
ফারিহ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
“যথার্থ কিউটু।”
এরপর দুই হাত উপরে তুলে আমোদিত গলায় বললো,
“আমার কিউটু আপুটাকে এতো দূর যেতে হবে না। তুমি যে এতো সুন্দর করে কথা বলো এবং আমাকে শিখাও তা কার থেকে শিখতাম? জানো কিউটু, ঢাকায় ইয়া বড় বড় গোফওয়ালা চোর আছে? তবে তারা মানুষ চুরি করে। তুমি তো পড়াশোনা ছাড়া সব কাজে বলদ। তুমি ঢাকা যেতে না যেতেই চুরি হয়ে যেতে।”
পরক্ষণে আনন্দে খাবি খাওয়ার মতো হয়ে বললো,
“ভালোই হয়েছে।”
দানীন অবাক হয়ে বললো,
“কি বললি, আমি বলদ? বেয়াদপস! এখনই কান ধরে পঞ্চাশ বার উঠ-বস করবি।”
আরও কিছুক্ষণ তাদের খুনসুটি চললো। দানীনের মন খারাপ ভাব ক্রমেই চলে গেলো।
নিজের ত্রুটিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য মুছতে পড়াশোনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার ফলে দানীন তার আপন ভাইবোনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। সেই সঙ্গে তাদের মস্তিষ্কেও এঁটে গেলো যে সে কৃষ্ণবর্ণ ও সমাজের জন্য বোঝার প্রতীকস্বরূপ।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here