#জল_ফোয়ারা |৮|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan
১১.
“আমার সকাল হাসে,
তোমার চিলেকোঠায়!
হুহুম হুহুম~~
আর এক ফালি রোদ-”
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গুনগুন করে গান গাইছে নুর, হঠাৎ করে সাজতে ইচ্ছে হলো খুব। স্যালোয়ার-কামিজ পরে ওড়নাটা এক কাঁধে নেয়া, খুব ইচ্ছে ছিলো শাড়ি পড়ার কিন্তু পড়লে মাকে অনেকগুলো মিথ্যে বলতে হবে। আজ তো কলেজের কোন ফাংশনও নেই আর না বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়ার প্ল্যান, বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না তাই সেই ইচ্ছেতে জলাঞ্জলি। চোখে কাজল দিতে দিতে নুরের মনে পড়লো দুবছর আগের কথা!
তখন ওদের সম্পর্ক শুরু হয়েছিলো কেবল। চিঠি আদান-প্রদান ছাড়া সামনা কোন কথা হতো না ওদের, দুবছর পরেও তাতে তেমন বদল আসেনি। কারো সামনে কেউ কারো দিকে চোখ তুলেও তাকায় না, অথচ একাকীত্বে ওদের কতো ভাব! তার মাঝেই একদিন ও মন খারাপ করে বসেছিলো, অঙ্কে মাত্র চল্লিশ পেয়েছে! মায়ের কাছে কয়েকদফা বকা খেয়ে কাঁদোকাঁদো অবস্থা, টেবিলে ভাত নাড়াচাড়া করেছিলো তখনই মুগ্ধ তার বন্ধুদের নিয়ে ঢুকলো, সাথে সৌহার্দ্যও ছিলো। ওকে দেখেই দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো, নুরও সেই দিকে তাকালো না। কিন্তু ওর মা জননী বিষয়টাতে ছাড় দিলো না, জোরে জোরে বললো
“মুগ্ধ, তোর বোনের রেজাল্ট দিয়েছে আজকে। আপনার আদরের বোন অঙ্কে টেনেটুনে পাশ করেছে। এভাবে চলতে থাকলে ওকে পড়াশুনা করিয়ে কি লাভ!”
নুরের লজ্জায় কান্না পেয়ে গিয়েছিলো, একে তো মন খারাপ তার উপর সবার সামনে এভাবে অপমান করা হলো ওকে। মুগ্ধ হাল্কা হেসে বিষয়টাকে উড়িয়ে দিলো শুধু কিন্তু একজন বিষয়টাকে চটকে ধরে রাখলো। সৌহার্দ্য সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছিলো
“তোর বোনকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দে মুগ্ধ। নাহয় যে হারে ফেইল করে পরীক্ষায়, কেউ বিয়ে করতে রাজি হবে না”
নুর বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে বললো
“ফেইল করিনি আমি”
সৌহার্দ্য চোখ ছোটছোট করে বেশ জোরেই বলে উঠলো
“অঙ্কে চল্লিশ পাওয়া মানে ফেইলই”
নুরের খুব রাগ হলো, কি সুন্দর সবার সামনে অপমান করে দিলো! সিদ্ধান্ত নিলো আগামী তিনদিন কোন চিঠির উত্তর পাঠাবে না। কিছু না বলেই ঘরের বাইরে চলে যেতে লাগলো, উদ্দ্যেশ্য রোহিণীর কাছে গিয়ে নালিশ করবে কিন্তু তার মাঝেই মুগ্ধ খিলখিল করে হেসে ফেললো ,সৌহার্দ্যের কাঁধে হাত রেখে বললো
“কেউ না করলে তুই করে নিবি নাহয়, আমার বন্ধু হিসেবে তোর একটা দায়িত্ব আছে না?”
নুর লজ্জায় এক দৌঁড়ে গেটের বাইরে, সৌহার্দ্য কি জবাব দিয়েছে ওর জানা নেই। কথাটা এখনো ভাবলে লজ্জা পায়, সেদিন কি জবাব দিয়েছিলো সৌহার্দ্য?
দরজায় নক করতেই নুর বাস্তবে ফিরে এলো, কাজলের কৌটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে দরজা খুলতেই দেখলো মুগ্ধ দাঁড়িয়ে। বিষয়টা নুরের কাছে বিস্ময়াবহ হলেও মুগ্ধর তা রোজকার রুটিন। রোজই নুরকে দেখতে আসে ও, আর কথার ছলে নুরকে একশো টাকা দিয়ে যায়। বিষয়টা নুরের অজানা, কারণ নতুন স্মৃতি ধারণের ক্ষমতা ওর নেই।
নুর ব্যাগ কাঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মুগ্ধ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো, এভাবে কতোদিন চলবে ওর জানা নেই। ও চায় নুর আগের মতো হয়ে যাক, নতুন জিনিস জানুক কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই ওর। সৌহার্দ্যর উপর রা*গটা আবারো বেড়ে গেলো, কিন্তু বরাবরের মতো কিছুই করবে না ও।
কারণ নুরের সৌহার্দ্যকে প্রয়োজন, সেটা আর কেউ না বুঝলেও ও ঠিকই বুঝে। নুরকে শুরুতে শুরুতে এমনভাবে ছাড়তে নারাজ হলেও ডাক্তারের পরামর্শ মতো বাধ্য হয়েছে এক প্রকার। স্বাভাবিক হওয়ার জন্য নুরের পুর্বের পরিবেশ প্রয়োজন যেখানে ওর নিজেকে বন্দিনী মনে হবে না, তার থেকেও বড় কথা স্বাভাবিক হওয়ার জন্য নুরকে পুরোনো স্মৃতি ছেড়ে দিতে হবে। নিজেকে যে জিনিসগুলো থেকে ওর মস্তিষ্ক দূরে থাকতে চাইছে ওই সবকিছু মনে করতে হবে, অনুভব করতে হবে। ইশশ এমনটা নুরের না হয়ে যদি ওর সাথে হতো, কতোই না ভালো থাকতো সব ভুলে!
মুগ্ধ মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে ফ্যাক্টরির উদ্দ্যেশে চলে গেলো, বাইকে চড়তে চড়তে আজোও একপলক ছাঁদে তাকালো কিন্তু সেই মানুষটার খোঁজ পেলো না। বিষয়টাতে ও অভ্যস্ত, রোহিণীর কাছ থেকে পিনপিন নিরবতার আজ অনেক যে হতে চললো…
১১.
অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা নিয়ে আবির্ভাব হয় শরতের। এই সময় আকাশের মেঘগুলোকে তুলার ন্যায় দেখা যায়, সাদা মেঘে জড়িয়ে পুরো আকাশ ফুরফুরে মেজাজে থাকে। মাঠজুড়ে কাশফুল আর কাশফুল, সকালের শিশির ফোঁটা তাতে লেপ্টে থাকে বড়ো আদরে। এই দৃশ্য বড়ই দৃষ্টিনন্দনীয়!
সৌহার্দ্য উত্তরের মাঠের শেষপ্রান্তে বসে আছে, কাশফুলের দরুন এ পাশ থেকে ওকে দেখা যাচ্ছে না। ঘড়িতে সকাল সবে আটটা ছুঁই ছুঁই, অন্যদিনের মতো তেমন একটা রোদ নেই তবে বৃষ্টি হবে তাও বোঝার উপায় নেই। এখানে এসেছে ওর একমাস হতে চললো, সেদিন সবটা জানার পর হালিশহর ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আর হয়নি। মেডিক্যাল ছুটির নাম করে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি নিয়ে নেয় হুট করে, কিছু জমানো টাকা আছে বলে বেতন নিয়ে ঝামেলা হবে না। ও জানেনা এতে কি পরিবর্তন হবে কিন্তু অনুশোচনায় ও এখানটা ছেড়ে যেতে পারে নি, ওর জন্য একটা মানুষের পুরো জীবন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে বিষয়টা জেনেও নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার মতো সাহস ওর নেই।
আর তারপরই বিশ দিনের মতো কেটে গেলো, প্রথমে দূর থেকে নুরকে চোখেচোখে রাখলেও সবটা জেনে ও নুরের সামনেই চলে এলো, এরপরই নুরের সাথে সময় কাটানো দৈনিক রুটিন হয়ে গেলো। অদিতা কখনো কান্না করলে ফিরে যায় নাহয় অদিতাকে রোহিণীর কাছেই রেখে আসে। তাদের মাঝে বেশ ভাব হয়েছে এই কয়দিনে, বাবা হিসেবে নিজেকে আবারো ব্যর্থ মনে হলো। সবাইকে কখনোই একসাথে ও ভালো রাখতে পারেনা, কেউ না কেউ কেমন যেনো ছুটেই যায়।
সৌহার্দ্য পাশ থেক একটা কাশফুল ছিঁড়ে নাড়াতে লাগলো, ছোট ছোট অংশ বাতাসে উড়ে যেতে লাগলো। মুগ্ধর সাথে এরপর আর দেখা হয়নি। নুরের সাথে দেখা করার বিষয়টা মুগ্ধ জানে কিনা সেই বিষয়ে ওর সংশয় কাজ করে। যেভাবে থ্রে*ট দিয়েছিলো তাতে না জানার সম্ভাবনাই বেশি, কিন্তু নুর কোথায় আছে তা নিয়ে মুগ্ধর যেনো মাথাব্যথাই নেই। এই অবস্থায় ওকে ছাড়া কি ঠিক? মুগ্ধর হেয়ালিপনা ওর ভালো লাগলো না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চুড়ির ঝনঝন শব্দ শুনতে পেলো, পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো নুর ওর পাশে জড়োশড় হয়ে বসছে। ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো
“খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করে ছিলে?”
সৌহার্দ্য মাথা নাড়লো, হাতে থাকা কাশফুলটা নুরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। নুর তা সাদরেই গ্রহণ করলো, ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো
“কাশফুলটা সুন্দর”
সৌহার্দ্য হাল্কা হাসি দিয়ে বললো
“এখানে থাকা সবগুলো কাশফুলই সুন্দর”
নুর পা মেলে দিয়ে আরাম করে বসলো, ব্যাগ পাশে রাখতে রাখতে বললো
“উঁহু, এইটা বেশি সুন্দর। তুমি দিয়েছো তো তাই!”
সৌহার্দ্য চুপ করে রইলো, নুর একটুও বদলায়নি। সবসময় মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আর হাসে। আচ্ছা যদি কখনো জানতে পারে আজকের দিনের মুহুর্তগুলো সাজানো, ওর পাশের মানুষটাই ওকে ফেলে চলে গিয়েছিলো বহুবছর পুর্বে তবে কি নুর ওর দিকে একইভাবে তাকাতো? কখনোই না! বরং ওর দৃষ্টিতে থাকতো একরাশ ঘৃ*ণা।
নুর ওর দিকে না তাকিয়ে আনমনেই বললো,
“এখানে আসার সময় তোমাদের বাসায় তালা দেখলাম, আংকেল আন্টি নাহয় বাসায় নেই কিন্তু শর্মি আপু কোথায়? কোথাও বেড়াতে গিয়েছে বুঝি!”
শর্মি নামটা শুনতেই সৌহার্দ্য স্থির হয়ে গেলো, চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। চোখের কোনে জল জমলেও একগুঁয়েমি করে বসে রইলো, জবাব না দেয়াতে নুর আর প্রশ্ন করলো না। ভাই-বোনের মাঝে গোসসা হয়েছে ভেবে কথা বাড়ালো না, বরং কাল সারাদিন কি কি করলো তা নিয়ে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সৌহার্দ্য শুধু হু, হ্যাঁ জবাব দিলো। এই বিশদিনে কথাগুলো ও অনেকবার শুনেছে। মায়ের সাথে চা খাওয়া, মুগ্ধর বাদাম নিয়ে আসা, বন্ধুদের সাথে ফুচকা খাওয়া আরো কতো কি!
সৌহার্দ্য নুরের দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো, নুরকে ওদের অতীতের কথা আজও বলতে পারলো না, বলতে পারলো যে ‘নুর মাঝে অনেকগুলো বছর চলে গিয়েছে, তুমি এখনো কোচিংয়ে পড়া ছাত্রী নও” কারণ সবটা জেনে নুরের যদি কিছু হয়ে যায়? তাহলে ওর সকল চেষ্টা বৃথা হয়ে যাবে কিন্তু কোথাও একটা নিজেও জানে ও বড্ড স্বার্থপর মানুষ। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে নুর ওর থেকে বহুদুরে চলে যাবে, যা ভাবতেই ওর শরীর শিউরে উঠে। আরেকটু সময়, আরেকটু সময় ও নুরের সাথে কাটাতে চায়, তারপরই ও নুরকে ছেড়ে যেতে দিবে। শুধু আরেকটু সময় নুরের হাত ধরে থাকতে চায়…
#চলবে…
(প্র্যাকটিক্যাল করতে হয়েছে এই দুদিন, তাই সময় পাইনি। আমি দুঃখিত। ক্ষমাস্বরুপ আজকে আরেকটা পার্ট পোস্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ!)