শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_৬

0
291

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_৬
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

৬.
দানীনের পা দুটো পুরো ঘরজোরে বিচরণ করছে। মাথায় একদল অবিশ্রান্ত প্রশ্নের সৈন্যবাহিনী এসে বারবার অভিঘাত হানছে। ঐদিন রানিয়ার জেরা থেকে বাঁচতে দ্রুত ভার্সিটি পৌঁছালেও সেই উচ্চহাস্যের ধ্বনি তার মন থেকে বিস্মৃত হয়নি। পিছন ফিরে সেই মুখটি দর্শন করতে গিয়েও করেনি। কিন্তু প্রশ্নের সৈন্যদল বারবার শ্রবণগোচরের জন্য মস্তিষ্কের পাটাতনে লাফালাফিতে ব্যস্ত। কিছুতেই ক্ষান্ত হচ্ছে না।
ছেলেটি এভাবে সশব্দে হেসে উঠলো কেন? আর ‘ঠিক, ঠিক’ কথাটিই বা কার উদ্দেশ্যে বললো? ছেলেটি কী বিশ্ববিদ্যালয়ের? কোন বর্ষের? জুনিয়র না তো? এটা ভেবে দানীন সচকিত হলো। পরক্ষণেই নাক-মুখ সঙ্কুচিত করলো। সে একটা বাচ্চা ছেলে নিয়ে এতোসব চিন্তায় নিমগ্ন হচ্ছে, ছিঃ! আবার ভাবলো, দেখতে তো জুনিয়র মনে হয় না। বরং তার চেয়ে বড়ই মনে হয়। দানীন প্রার্থনা করলো এরকম অযাচিত কান্ড যেনো না ঘটে। ছেলেটি যেনো তার সমবয়সী হলেও হয়।

“এই নীল গুটিটার সমস্যা। অযথাই ছক্কা ওঠে। আমি মানি না।”
কথার উৎসের দিকে দানীন তার মাথা ঘুরিয়ে তাকালো।
ফারিহ আর ইউসরা তার বিছানার উপর লুডু বোর্ড বিছিয়ে হাত-পা অক্টোপাসের মতো চতুর্দিকে প্রসারিত করে খেলায় মগ্ন। দানীনের এই লুডু খেলা খুব অপছন্দ। তাদের দুজনকে কঠিনভাবে নিষেধও করা হয়েছিলো। কিন্তু কে শুনে কার কথা।
ইউসরা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আশ্চর্য! গুটিকে কী আমি তাবিজ করেছি যে আমার ইচ্ছা অনুযায়ী চলে?”
“তুমিই কোনো কারসাজি করেছো। না হলে আমার পাঁচ রাউন্ডে একবারও ছক্কা উঠবে না; সেখানে তোমার কোল ভর্তি ছক্কা। আসলে লুডু বোর্ডও মেয়েদের কলের পুতুল। হতচ্ছাড়া, বেয়াড়া গুটি!”
ইউসরা দাঁত কেলিয়ে ফারিহ’র উদ্দেশ্যে বললো,
“নাচতে না জানলে কি যেনো বাঁকা ফারিহ ভাইয়া? উঠোন বাঁকা নাকি তোমার কোমরের মতো নাট-বল্টুর সংযোগ ঢলকো?”
দানীন তাদের দিকে এগিয়ে এসে আদুরে গলায় ডেকে ওঠলো,
“ফারিহ ভাইয়া।”
ফারিহ মনোযোগী ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
“ইয়েস কিউটু।”
ফারিহ’র সম্পূর্ণ মন লুডু বোর্ডে নিবেশিত। দানীন তা দেখে হেলেদুলে হেঁটে বোর্ডের উপর বসে মুখ দিয়ে আনন্দসূচক ধ্বনি বের করলো। ফারিহ আর ইউসরা একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে আর্তচিৎকার দিলো। দুজন দুই দিক থেকে দানীনকে উঠার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে লাগলো।
দানীন অনুরোধ আমলে না নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আচ্ছা ফারিহ, ওই সামনের বিল্ডিংটির পাঁচতলা দেখেছিস?”
এইরূপ প্রশ্নে ফারিহ আঁখি গোলাকৃতি করে দানীনের উপর নিবদ্ধ করলো।
ইউসরা মুখ ফুলিয়ে বললো,
“দেখবে না কেন? অন্ধ নাকি এই ছেলে?”
ইউসরার মৃদু ক্রোধিত স্বরে দানীন থেকে চোখ সরিয়ে ফারিহ ইউসরাকে তার অনুরূপ রাগান্বিত স্বরে বললো,
“এই ছেলে এই ছেলে আরেকবার উচ্চারণ করলে ছাদে তুলে সেখান থেকে ধাক্কা মেরে ফেলবো। একেবারে চিৎপটাং! বেলুনের মতো চুপসে যাবে। সুতরাং, সম্মান প্রদর্শন করে চলবে। সম্মানকরণের উদ্দেশ্যে সর্বদা ভাইয়া বললে সম্বোধন করবে।”
ইউসরা নিজ হাত দ্বারা হাওয়া দেওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
“আসছে সম্মান প্রার্থী। বিড়ালের মতো মিউ মিউ করবে, তা না। গোঁ গোঁ শব্দ করে বাঘ সাজতে চায়। দেশী বিড়াল তো। প্রকৃতি তো অবিনয়ী হবেই।”
দানীন দুজনের মাথায় চাপড় মেরে হামকি-ধামকি দিয়ে চুপ করালো।
“প্রশ্নের উত্তর ব্যতীত অন্য কোনো কথা বলবি তো দুজনকে তৎক্ষণাৎ দন্তচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবো। সঙ্গে বলে আসবো যেনো দুইটার দুই পাটির দাঁত জায়গা থেকে তুলে নেয়। তখন কথা বলার সময় বায়ুদূষণের ন্যায় ফেড়ফেড়-ভ্যাড়ভ্যাড় ধ্বনি উৎপন্ন হবে। তখন মজা বুঝবেন দুজন।”
দানীনের রাগী স্বরে কথা শুনে ইউসরা ফিক করে হেসে ওঠলো। ফারিহ ‘ছিঃ, কিউটু’ বলে চিৎকার করতে গিয়েও বাক্যের বাকি শব্দ উচ্চারণ স্থগিত করলো। তার উপর নিশ্চল দানীনের দৃষ্টি বিপদ সংকেত জাহির করছে। অর্থাৎ, তার কিউটু আপুর দয়ায় সে ফোকলা উপাধি লাভ করলেও করতে পারে।
ফারিহ মুহূর্তেই গুমোর মুখে বললো,
“ঠিক আছে, আর কিছু বলবো না। কি প্রশ্ন আছে করো।”
দানীন সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে জিগ্যেস করলো,
“সামনের বিল্ডিংটা যে, তার পাঁচ তলায় কে থাকে বলতে পারবি?”
দানীন যেই রুমে থাকে তার মাঝ বরাবর বিছানা। বিছানায় বসে বারান্দার দৈর্ঘ-বরাবর ওই বিল্ডিংয়ের চার তলা বারান্দা পুরোটা দেখা যায়। তবে পাঁচ তলার বারান্দার আংশিক দেখা যায়। ফারিহ সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে দানীনের হাসি হাসি মুখমণ্ডলের উপর রাখলো। ইউসরাও ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক পাশের বিল্ডিংটি অবলোকন করে নিলো।
ফারিহ হাত বুকের কাছে আনলো এবং যন্ত্র মানবের ন্যায় বললো,
“মানুষ থাকে।”
দানীনের পূর্বেই ইউসরা কটমট করে বলে ওঠলো,
“আরে গর্দভ! বিল্ডিং দেখে কী চিড়িয়াখানা মনে হয়? এমনভাবে বললে যেনো মানুষের বদলে পশুপাখি থাকলেও থাকতে পারে।”
ফারিহ পাল্টা গলাবাজি করে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“থাকতেও তো পারে। হতেও তো পারে হিংস্র জীবজন্তু বড় কোনো চক্রের তত্ত্বাবধানে পালিত হচ্ছে। আর মানুষকে বাসা ভাড়ার কথা বলে সেসব প্রাণীর খাদ্য হিসেবে সংরক্ষণ করছে। দেশ-বিদেশে কতো রকম ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কোনো ধারণা আছে? সারাদিন তো পাঠ্যবই নিয়েই মগ্ন থাকো।”
ইউসরা নাক-মুখ সঙ্কুচিত করে বললো,
“বাড়িওয়ালা আর তোমার কাল্পনিক চক্রকে তো গোল কৃমি পাকাশয়ে খাবল মারে; এই আটপাড়ায় এসব অবান্তর চিন্তায় চিন্তান্বিত হবে তাই।”
ফারিহ সচকিত হয়ে বললো,
“আটপাড়া! রূপাতলী তোমার নিকট আটপাড়া ঠেকছে ইউসরা?…”
এরপর দুজনের বাকবিতন্ডার সূত্রপাত হলো। এই দুইজন ঝগড়া-ঝাঁটি আরম্ভ করল একাধারে সমাজ, রাজনৈতিক, কুটনৈতিক সব বিষয় নিয়ে ঘুরে আসে। আকাশ-পাতাল, পাহাড়-সমুদ্র সর্বত্র পরিভ্রমণ সমাপ্ত করে। এরপর ক্ষান্তি দেয়। অবশ্য এই বাকবিতন্ডার অন্তিম ফারিহকেই করতে হয়। ইউসরা ফারিহ থেকে বয়সে ছোট হলেও অধিকতর অধিবিদ্য। এমনভাবে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে যে ফারিহ অবশেষে হাঁসের মতো হাঁস-ফাঁস করতে করতে কপট রাগ দেখিয়ে জায়গা ত্যাগ করে। আর ইউসরা ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসে।
দীর্ঘকালীন উপাখ্যান সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই দানীন দুজনকে ভাবলেশশূন্য মুখায়বে বললো,
“এই মূহুর্তে দুজন আমার চোখের সীমানা থেকে দূর হবি। অন্যথায়, দাঁতের সঙ্গে দুইটার মাড়িও বিচ্ছিন্ন করা হবে।”
ফারিহ এবার তার গলাবাজি থামিয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,
“মানুষ থাকে। আই মিন, পরিবারসহ একটা ভাইয়া থাকে।”
ইউসরা ভ্রূ নাচিয়ে প্রশ্ন নিক্ষেপ করলো,
“তুমি কিভাবে চেনো?”
ফারিহ ইউসরার প্রশ্নের উত্তর দানীনের দিকে তাকিয়ে দিলো,
“মোরের যে দোকানটা আছে সেখানে সর্বপ্রথম দেখা হয়েছিলো। এরপর থেকে প্রায়ই দেখা হয়, কথাবার্তা হয়। ভাইয়াটা অনেক ভালো।”
দানীনের মুখ জোড়ে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেলো। যা ইউসরা ও ফারিহ উভয়েরই দৃষ্টিগোচর হলো।
দানীন ঝলমলানো দৃষ্টিতে জিগ্যেস করলো,
“কেমন ভাইয়া? মানে দেখতে কি রকম? উজ্জ্বল শ্যামলা? ফর্সা ও শ্যাম বর্ণের ঠিক মাঝামাঝি? উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত-আটের নিকটবর্তী তো?”
ফারিহ ঢোঁক গিলে মাথা খানিক হেলিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, এটাই।”
দানীন আগ্রহী কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,
“নাম কি? নাম কি?”
“মাহবুব।”
দানীন এবার নিশ্চুপ হয়ে গেলো। তার প্রশ্রয়শীল কণ্ঠের কারণে ফারিহ সাহস নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“তুমি কী প্রেমে পড়েছো কিউটু?”
ভেবেছিলো দানীন হুঙ্কার মেরে ওঠবে। কিন্তু তার পরিবর্তে ইউসরা হুঙ্কার মেরে ওঠলো।
“আপু তুমি প্রেমে পড়েছো! অর্থাৎ তুমি এখন লাইলি-জুলিয়েট টাইপ আচার-আচরণ করবে? আশ্চর্য! তা-ও ঐ মাহবুব আঙ্কেলের জন্য?”
ফারিহ ভেঙচি কেটে বললো,
“কিউটু প্রেম করলে তোমার কি পিচ্চি? আর উনি আঙ্কেল না খোকা তুমি তা জানো?”
ইউসরা জবাব না দিয়ে খুব গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে দানীনের উদ্দেশ্যে বললো,
“মাহবুব! নাম শুনেই বিবাহিত আঙ্কেল বোধ হচ্ছে। রহিম, করিম, লোকমান নানাদের মতো অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। আর আপু এই নামের আঙ্কেলগুলো কিন্তু চূড়ান্ত অপকর্মা। আপাদমস্তক বদমাইশিতে পরিপূর্ণ। তুমি কিন্তু ভুলক্রমেও এই ফাঁদে পা দেবে না।”
দানীন মৃদু হেসে মৃদু দীপ্তিমান মুখায়বে রুমে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলো। মাহবুব! এই নামটুকু জানার জন্য কয়েকদিন ধরে কতো ঝটপট করেছে। হৃদয়-সিন্ধুকে গোপনে মজুত করা তার অপরিস্ফুট মুখায়ব নাম শোনার পর হৃদয় জুড়ে নিষ্প্রতিভ-মিট্মিটে থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠলো। মনে এখন একটি নামই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারবার। তার ইচ্ছে করছে পুরো ঘরময় কাঙ্ক্ষিত নামটি লিপিবদ্ধ করতে। দানীন টেবিল থেকে তার ডায়েরি কাছে টেনে আনলো। কলম চালিয়ে পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে লিখে চললো মাহবুব, মাহবুব, মাহবুব…
ফারিহ ইউসরার পাশ ঘেঁষে তার নাম উচ্চারণ করলো,
“ইউসরা।”
ইউসরা হতবুদ্ধি হয়ে একইভাবে বললো,
“ফারিহ ভাইয়া।”
“কিউটু আর প্রেম? লাইক সিরিয়াসলি!”
“আপু তো একদম গেছে.. টোটালি রান আউট!”
“হু, এক্কেবারে..”
ফারিহ মাথা ঝাঁকিয়ে বললো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here