শুভ্রময়_পু্রঁজন পর্ব_৭

0
266

#শুভ্রময়_পু্রঁজন
পর্ব_৭
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

৭.
দানীন তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি ভেঙে চার তলা থেকে তিন তলা নামছিলো। গন্তব্যস্থান তার বেস্টফ্রেন্ড রানিয়ার ক্লাসরুম। বিশ ধাপের দশ ধাপ পাড় হয়ে বাঁক নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ ফেলার পূর্বেই তার পথ স্থগিত হলো। কেউ তার পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়েছে। পুরুষোচিত অবয়ব ঠাহর করে দানীন চমকে চোখ তুলে তাকালো। সে অবাক হয়ে তার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাহবুব!
মাহবুব হেসে জিগ্যেস করলো,
“কেমন আছো দানীন?”
দানীন নিরূত্তর থেকে আচমকা উল্টো পথে দৌড় দিতে উদ্যত হলো। কিন্তু পারলো না, তার আগেই সুদীর্ঘ চুলে টান লাগলো। আকস্মিক বাধায় তার চিন্তায় যুক্ত হলো–
‘একটা ছেলে কোনো মেয়ের চুল টেনে ধরেছে’– ব্যাপারটা ভাবতেই তার একটা বিচ্ছিরি অনুভূতি অনুভূত হলো। একলহমায় মাহবুব নামের ছেলেটিকে দুষ্ট মানুষের তালিকায় ফেলে দিলো। মনে মনে আচমকা তাকে খারাপ ছেলে হিসেবে আখ্যা দিয়ে দিলো। সে নিশ্চয়ই বিগলিত হেসে রয়েছে এবং অচেনা মেয়ের চুল টেনে ধরার মতো আরও অযাচিত কাজ করার পরিকল্পনা করছে।
দানীন চেহারা কাঠিন্য করে পিছনে ঘুরে আবারও চমকালো। সে ভেবেছিল মাহবুব নোংরা হেসে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু না। তার গম্ভীর চেহারা দেখে দানীনের কাঠিন্য মুখাকৃতি নমনীয় হয়ে এলো। ভ্রুকুটি মিশ্রিত চাহনি বিস্ময়ে পরিণত হলো।
মাহবুব তার চুল ছেড়ে দেওয়ালে কাঁধ ঠেকিয়ে বলে ওঠলো,
“কথা বলতে না চাইলে ডিরেক্ট বললেই হয় যে, আমার সঙ্গে কথা বলতে তোমার রুচিতে বাধে। বিরক্ত হয়ে উল্টোপথে দৌড়ানোর তো কোনো দরকার নেই।”
দানীন হতভম্ব। সে কখন বিরক্ত হলো? আর এই মানুষটার সঙ্গে তো তার আগে কখনো কথাই হয়নি। রুচি হওয়া না হওয়া বিষয়াদি কোথা থেকে এলো? দানীনকে বিহ্বলতায় রেখেই মাহবুব গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো।
দানীন অনুচ্চ স্বরে দ্বৈধীভাব নিয়ে তাকে ডাকলো,
“এই যে.. এই যে শুনুন।”
দানীন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। সে কী রানিয়ার জন্য অপেক্ষা করবে নাকি মাহবুব ছেলেটির অবান্তর রাগ ভাঙাতে তার পিছনে যাবে? রানিয়া তাকে না পেলে ক্ষেপে যাবে।
হঠাৎ করেই মন তাকে জানান দিলো তার উপর শ্যামবর্ণা মানুষটি রেগে আছে মানে ব্যাপারটি নিতান্ত মন্দ। সে আর কিছু না ভেবে বড় বড় উল্লম্ফনে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলো।

মাহবুব একাডেমিক ভবন থেকে বের হয়ে হাতের ডানে বাঁক নিলো। ভবন প্রবেশপথের দুই ধারে সরু মাটির পথ গিয়েছে। তা অতিবাহিত করে মহাসড়কে উঠা যায়। সে তা না করে আবার বাঁক নিয়ে বিল্ডিংয়ের দেওয়াল ঘেঁষে পথ চলছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণকে নির্দেশ করে। দানীনও আগুপিছু করে তাকে অনুসরণ কর চলছে। আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহসিকতা আপাতত দেখাচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহে পরিবেষ্টিত মাঠে দুজন বিশ্রামহীন হেটে চলছে। সূর্যের আতপে গা ডুবিয়ে দূর-দূরান্তের গুচ্ছবদ্ধ সবুজাভ বৃক্ষরাজি তাদের ঝলকানি দ্বারা আঁখি জোড়ায় স্নিগ্নতা প্রদান করে যাচ্ছে। খোলা মাঠের আকস্মিক প্রবাহিত পবন জামার ভাঁজ এলোমেলো করে দেওয়া শুরু করলো। দানীন তার রাশভারী অবাধ্য চুলগুলোকে যথাযথ স্থানে রাখার প্রযত্নে ব্যাগসহ দুই হাতে মাথায় হাত চালালো। পথ চলা খানিক বিরতি দিয়ে দুই পায়ে ব্যাগ চেপে ধরে খোপা করতে যাবে ঠিক তখনই মাহবুব হাঁটা থামিয়ে পিছন ফিরে তাকালো। দানীন তার অনিয়ন্ত্রণীয় চুলগুলো ছেড়ে আরও অদমনীয় পথে ধাবন করলো। মনে মনে সে মাহবুবকে খানিক বকাও দিলো। পিছনে ফেরার আর সময় পেলো না!
শব্দহীন মাহবুব তার মুখাপানে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। তা লক্ষ্য করে দানীন তার সঙ্গে কথা বলার প্রচেষ্টা করলো। জিগ্যেস করলো,
“আপনি কী মসজিদে যাচ্ছেন?”
মাহবুব হুট করে হেসে ফেললো। হেসেই প্রত্যুত্তরে বললো,
“না, লাইব্রেরী যাচ্ছিলাম। মানুষ আমার মুখ দেখে নাক কুঁচকে যেনো দৌড়ে না পালায় তার উপর যাদুমন্ত্র শিখবো। লাইব্রেরীতে পাওয়া যাবে তো এরূপ যাদুকরী বই?”
দানীন অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলো।
“আসলে.. আমি আচমকা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“এখন ভয় করছে না?”
দানীন মাথা নাড়ালো। তার ভয় করছে না।
“তখন ভয় পাওয়ার কারণ?”
দানীন অভিমানী স্বরে বলে ওঠলো,
“হুট করে কেউ লাফিয়ে এসে কেমন আছো জিগ্যেস করলে কে না ভয় পাবে। আর আপনি আমার নাম ধরে সম্বোধন করায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে পালানোর প্রয়াসে উদ্যত হয়েছিলাম।”
দানীন এবার ভ্রু নাচিয়ে জিগ্যেস করলো,
“কিন্তু আপনি আমার নাম কি করে জানেন?”
মাহবুব বাঁকা হেসে বললো,
“শুধু নাম কেন, তোমার সম্পর্কে আর অনেক কিছু আমার জানা আছে।”
দানীন অবাক হয়ে জিগ্যেস করলো,
“তা কিভাবে?”
“তুমি তো সকল শিক্ষকদের চোখের মণি। সালাহউদ্দিন স্যার তো সারাক্ষণ তোমার কথা বলে। তোমার অধ্যবসায়, কঠিন পরিশ্রম সবকিছুর গল্প উদাহরণস্বরূপ বলে।”
দানীন অধরে অমায়িক হাসি দৃশ্যমান হলো। সে তার এই পড়াশোনা নিয়ে যখন প্রশংসিত হয় তখন সবচেয়ে খুশি হয়। এই একটাই তো তার গর্ব করার স্থান।
পরক্ষণেই হাসি বন্ধ করে দানীন জিগ্যেস করলো,
“আপনি কী আমার জুনিয়র?”
প্রশ্ন শুনে মাহবুব হো হা করে হেসে ওঠলো।
“উহু, আমি তোমার থেকে দুই ক্লাস বড়। ব্যবসা শিক্ষা অনুষদে একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে পড়ছি। আমি কিন্তু তোমার ফ্যাকাল্টি, সাবজেক্ট এসবও জানি।”
এরপর দুজনেই এক সঙ্গে হেসে ওঠলো।
“টিচার ছাড়াও কিন্তু তোমার তথ্যাদি আমি অন্য জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছি। মনে আছে একদিন তপ্ত বিকেলে গ্রিলের নকশার ফাঁকে উভয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি আদান-প্রদান?”
দানীন সচকিত হয়ে মাহবুবের দিকে তাকলো। যেদিন সে প্রথম মাহবুবকে লক্ষ্য করেছে মাহবুবও তাকে লক্ষ্য করেছিলো?
মাহবুব তার দিকে খানিক অগ্রসর হয়ে আমোদিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কি হলো ম্যাম? স্তব্ধ হয়ে গেলেন যে।”
দানীন তার থেকে দৃষ্টি নামিয়ে অনুচ্চ স্বরে বললো,
“বাসায় যেতে হবে। বান্ধবী অপেক্ষা করছে।”
“বান্ধবী ছাড়া আজ এই অধমের সঙ্গে যেতে কী ম্যাম সম্মতি প্রদান করবে? রিকশায় বসে, অবাধ্য অনিলে, তার তিমিরাচ্ছান্ন উড্ডীন চুলের নৃত্য দেখার যে বড্ড ইচ্ছে জেগেছে এই অধমের অন্তরে।”
দানীনের পুরো মুখজুড়ে লজ্জায় লালাভ ফুঁটে ওঠলো।
ধীর কণ্ঠে বললো,
“সম্মতি প্রদান করা হলো।”
“গ্রেট! তবে যাওয়া যাক ম্যাম।”
দানীনের বিশেষ দিনগুলোর নথিতে আজকের দিনটিও স্থানলাভ করলো। হুট করে দেখা, হুট করে কথা, হুট করেই দুজনের সম্পর্কে গভীরতা স্পষ্ট হয়ে এলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here