শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_২৪

0
203

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_২৪
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২৪.
দিবালোকের সর্বশেষ অরূণে উদ্যানতরুবিশেষ রঙের আকাশের খেলা দেখায় ব্যস্ত দুই জোড়া চোখ। দানীন তার বোনপোকে নিয়ে আকাশমণ্ডলের অন্তিমকালের প্রতিরূপ দেখতে ব্যস্ত। দানীনের উষ্ণ কোলে স্থানলাভ করা বাবুটি আঁখি পিটপিট করে প্রতিবেশ ঠাহরের প্রযত্নে নিরত। পাশেই ছাদে পা ছড়িয়ে দিয়া তার কাঠি দ্বারা পুতুলের প্রতিকৃতি দানকৃত বস্তুতে কাপড় প্যাঁচাচ্ছে। থেকে থেকে ছোট্ট ভাইকে নানা কল্পকাহিনীর বিবরণ দিচ্ছে। তার পুতুল, তার নিজস্ব তৈরি করা কল্পনা জগতের বিষয়বস্তু ভাইকেও শুনাচ্ছে। ভাই বোধহয় তার বোনের কথায় খুব আগ্রহবোধ করছে। বারবারই ছোট ছোট কনীনিকা বড় করে বোনের মুখ পর্যবেক্ষণ করছে।
দানীনের ভাবে, এই অপাপবিদ্ধ শিশুর নির্মল মুখমণ্ডল নিরীক্ষা করে এবং তাদের বিচিত্র ও হরেকরকম আখ্যায়িত উপাখ্যান শ্রবণ করে এক যুগ অনায়াসে অতিবাহিত করা যায়।
হঠাৎ তার ভাবীর ডাক কানে এলো। তিনি দানীন দানীন বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন। দানীন দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“দিয়ামণি নিচে যাও তো একটু। মাকে জিগ্যেস করো, ‘মা তুমি কাকের মতো কা কা করছো কেন?’”
দিয়া তার ফুপুউ’র দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মহা উৎসাহে নিচে দৌঁড়ে গেলো। ‘মা তুমি কাকের মতো কা কা, মা তুমি কাকের মতো কা কা’ বলতে বলতে ছুটছে। দিয়ার এই মহা উৎসাহ কিছুক্ষণের মধ্যেই মিইয়ে পড়তে যাচ্ছে। মাকে সম্মানের সহিত কাকের স্থানে বসানোতেই নিশ্চয়ই গালে খানিক আদর পড়বে।

দিয়া কিছুক্ষণ বাদেই পূর্বের ন্যায় লাফিয়ে লাফিয়ে ফুপুউ’র কাছে ফেরত এলো। আদরের সৌভাগ্য তার হয়েছে এটা বুঝা যাচ্ছে। তবে চেহারায় বিস্ময়াভিভূতের ছাপ কিসের জন্য তা স্পষ্ট বুঝা গেলো না। বুঝা গেলো দিয়ার মুখ থেকে নির্গত দুটো বাক্য দ্বারা,
“মা চিঠি, তোমার চিঠি ফুপুউ।”
দিয়া দানীনের দিকে একটা খাম এগিয়ে দিলো। চিঠির ব্যাপারটা দিয়ার নিকট নিতান্তই নতুন। তাই এরকম খাম ও মায়ের কাছ থেকে শোনা চিঠি শব্দে সে বিস্মিত। দানীনও খানিক চকিত। খামের ওপর সুন্দর করে তার নাম লেখা– আয়েশা দানীন ওয়াফিয়া। বরিশালের ঠিকানায় চিঠি এসেছে বলে তা নিয়ে খানিক চিন্তিত। অফিশিয়ালি কোনো চিঠিও না। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তার কিছু বন্ধুবান্ধব ছাড়া তো অন্য কারও এই ঠিকানায় চিঠিপত্র বা অন্য কিছু পাঠানোর কথা নয়। আর তার বন্ধু বলতে তো শুধু.. দানীন শঙ্কিত হলো। তার দুঃচিন্তা যে নিতান্ত অমূলক তা প্রমাণের প্রযত্নে খাম ছিঁড়তে যাবে তখনই তার বোনপো সশব্দে কেঁদে ওঠলো। দানীন আহত ভঙ্গিতে তাকালো।
“এখন আবার শুরু করছিস বাপ? দাঁড়া, তোকে তোর মার কাছে দিয়ে আসি। কাঁদবি আর ঠাস-ঠুস থাপ্পড় খাবি। এই বয়সেও তো খালামণির থাপ্পড়ের ধার ধারো না তুমি। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে ইনশাআল্লাহ বড় হলে এই সব ভ্যা ভ্যা’র শোধ নেবো আমি।”
বাবুকে নিচে পারিশার কোলে দিয়ে এসে চেয়ার ছেড়ে দিয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও পা ছড়িয়ে ছাদে বসলো। ফুপুউ’র উষ্ণ কোল খালি পেয়ে দিয়া সেখানে আসন গ্রহণ করলো।
দানীন খাম ছিঁড়ে তিনভাগে ভাজকৃত কাগজ মেলে ধরলো। একটা কাগজ নয়, অনেকগুলো কাগজের পাতা সুন্দর করে পিন করা। পড়ার পূর্বেই তার ওষ্ঠাধর অনেকটা ফাঁক হয়ে গেলো। এতো সুন্দর লেখা, শুধু তাকিয়ে থাকতেই মন চাচ্ছে! সবগুলো ধ্বনি যেনো একতালে পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে গমন করেছে। যে লিখেছে তার লেখা কী সত্যিই এতো মনোমুগ্ধকর, চোখ ধাঁধানো? না, চিঠটাই যত্নসহকারে লিখেছে বলে এতো মোহিনী মায়ার আকর্ষণীয়তা পরিলক্ষিত? যার ফলে প্রতিটা শব্দ, বাক্য অভ্রান্ত নিয়ম বজায় রেখে বিচরণ করে স্থিত।
দানীন এই মনোমোহন লেখনীর প্রশংসা বন্ধ করে এবার পড়ায় মনোযোগ দিলো।

“প্রিয়,
এই দেখো, উত্তেজনায় হাত কাঁপছে। ভয়ে হৃদয় একতালে কম্পনে ব্যস্ত। উত্তেজিত কারণ আমার মনে একান্তভাবে প্রচ্ছন্ন অনুভূতিগুলো আজ প্রতিভাসিত হতে যাচ্ছে। আমার নিরালা অনুভূতিগুলোর দায়ভার আজ কাঙ্ক্ষিত মানুষটির নিকট হস্তান্তর করতে যাচ্ছি। গোপনীয় এই অনুরাগ অনুভূতির মালা তুমি কীভাবে গ্রহণ করো তা জানার জন্য অধিরতায় ঝটপট করছি। ভয় কারণ তুমি যদি ভুল বুঝো, যদি রেগে যাও। আমার ভালোবাসার পুষ্পমালা যদি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করো, হৃদয়ের অস্পৃশ্য অনুভূতিগুলো যদি খণ্ড-বিখণ্ড করে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও! তোমার সামনে উপস্থিত হয়ে তোমাকে চাওয়ার যে লোভ অন্তরে ধারণ করেছি তা কখনো ব্যক্ত করতে সক্ষম হবো না। তাই চিঠি লিখলাম। হয় তো এতে খানিক সাহস সঞ্চিত হবে এবং একদিন সত্যি সত্যি তোমার সম্মুখীন হয়ে তোমার ওই বিষণ্ণতায় ভরপুর তীক্ষ্ণ আঁখির দিকে তাকিয়ে বলতে পারবো। মনের বন্ধ দোয়ার খুলে তোমার নামে লেখা হাজারো কবিতা দেখাতে পারবো। তোমার ঐ গাঢ় চোখের চাহনিতে দৃষ্টি স্থাপন করলেই আমার কেঁদে দিতে মন চায়। তাকাতে পারি না আমি।
এতো অসাধারণ তুমি! তোমার এই অসাধারণত্ব কবে সর্বপ্রথম আবিষ্কার করি জানো?
ক্লাস ভর্তি ছাত্র-ছাত্রী, যাদেরকে তুমি গরুর পাল মনে করো। গরুগুলোকে শিক্ষা নামক ঘাস মুখে দেওয়া অবস্থায় আমি তোমাকে প্রথম দেখি। দরজার আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। ক্লাসের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছিলাম অন্যজনের খোঁজে, পেয়ে গেলাম তোমাকে!
চোখে-মুখে ক্ষিপ্রতা ফুঁটিয়ে চওড়া গলায় পড়াচ্ছিলে। কি তেজস্বী কণ্ঠ তোমার! উদ্ভিদ প্রাণরসায়ন সম্পর্কে পড়াচ্ছিলে। বই সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি বাদ দিয়ে হঠাৎ তুমি প্রাণ তথা হৃদয়ের যত্নের কথা বলতে লাগলে। কথাগুলো সুস্পষ্টরূপে এখনও আমার কানে বাজে, ‘তোমরা আমরা সবাই জানি শরীরের যত্নের সঙ্গে মনের যত্নও জরুরি। তবে এটা কী জানি মনের যত্ন নিলে শরীরের যত্ন অটোমেটিকলি চলে আসে? ইট ম্যাজিকলি হেপেনস। যখন তোমার প্রাণে বেঁচে থাকার স্পৃহা নিহিত থাকবে, তখন তুমি শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে আগলে রাখবে। যখন তোমার মন পরিশুদ্ধ হবে, তখন তুমি শরীরকে শুদ্ধতা দানের জন্য দিক-বেদিক ছুটে দেহযষ্টির পুরোপুরি যত্ন নেবে।’
কেউ একজন গলায় দ্বৈধীভাব নিয়ে তোমাকে প্রশ্ন করলো,
‘কিন্তু ম্যাম অনেকে তো মন না চাইতেও খারাপ কাজ করে। যেমন ফিজিক্যালি ব্যাপারটা। কেউ যখন ইনটিমেট টাইপ খারাপ কাজ করে তার মন না করে, তবুও জাস্ট ফিজিক্যালি নিডের জন্য করে ফেলে।’
‘গুড কোশ্চেন। সিট ডাউন। শোনো, তার মনের স্বল্পদৈর্ঘ্য বা দীর্ঘস্থায়ী চিন্তাচেতনাই কিন্তু তাকে অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হতে ধাবিত করে। ফিজিক্যালি নিডের ব্যাপারের আগে তোমার শারীরিক ক্ষত-অক্ষতের ব্যাপারটা আগে চিন্তা করো। এটা দিয়ে উদাহরণ দেই।
যখন তোমার শরীরের কোনো অঙ্গচ্ছেদ হবে, তখন শুধু তোমার মনের পরিচ্ছন্নতা, অনাড়ম্বরতার জন্য এসব দৈহিক সৌন্দর্য নগণ্য হবে। তুমি এগিয়ে যাবে। সৌন্দর্যের রাজধানী কি? আমাদের এই চেহারা। যখন তাতে আঘাত হানবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে লাইক পুড়ে যাওয়া ওর সামহোয়াট লাইক দ্যাট..তখন পুরো দুনিয়ার মানুষ নাক ছিটকালে তুমি উল্টো তার মনোভাবে নাক ছিটকাবে। এগিয়ে যাবে বহুদূর। তারা নাক ছিটকাচ্ছে কেন? তাদের মনোভাব। তুমি নাক ছিটকাচ্ছো কেন? তোমার মনোভাব। ডিড ইউ গেট দ্যা পয়েন্ট? তারা তাদের অসুস্থ মনের চিন্তার প্রতীক স্বরূপ একটা মানুষের প্রতিবন্ধকতা দেখে তাকে সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে যায়, একটু দূরে গিয়ে আরেকজনের সঙ্গে কানাঘুষা করে। এসবের উদ্যোক্তা কিন্তু মন। এবার তুমি যেই প্রশ্নটা করি সেটা সম্পর্কে বলি.. ইউ গাইজ আর গ্রোওন আপ। তোমরা অনেক কিছু জানো এবং বুঝো। তোমাদের প্রতিবেশে এই সময়কালে নানা অনৈতিক কর্মকান্ড ঘটবে আর তার জন্য কিছু একটাকে দোষারোপ করতে চাইবে। প্রতিবেশের মানুষজন বুঝাতে চাইবে, ‘তোমার কোনো দোষ নেই! দোষ ঐ ব্যক্তিটার, ঐ বস্তুটার। তুমি নিষ্পাপ। তুমি তো মরুভূমিতে চলমান এক ফোঁটা পানি মুখে দিয়েছো। ইউ আর সিনলেস।’
এতে কি হয় তুমি তোমার দোষ স্বীকার করে অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগটা মাটিচাপা দিচ্ছো। কারণ তুমি তোমার মনের যত্ন নাও নি। মনটা তো তোমার তাই না? তোমার প্রাণ, হৃৎপিন্ড, হৃদয়। কিন্তু পরিচালিত হচ্ছে অন্য মানুষ দ্বারা। ছিঃ, লজ্জা লাগে না! লজ্জা লাগে? যারা ল্যাঙড়া তারাও নিজেরা স্ক্র্যাচ নিয়ে নিজে নিজে হাঁটে। অন্যের কোলে চড়ে বিচরণ করে না। দৈহিক যে ব্যাপারটা…আজকাল ফরনিকেশন এতো পরিমাণে বেড়েছে, আর তা শুদ্ধ প্রমাণের জন্য এতো তোড়-জোড়! ও মাই গুডনেস!
যেখানে দুটো বাক্য মানুষের মনকে প্রভাবিত করে, সেখানে শারীরিক চাহিদা মেটানোর সময় তার মন জানে না, তার দেহ জানে– ব্যাপারটা হাস্যকর না? সে কুকর্ম করছে এটা তার সজ্ঞানেই করছে। সে তা আটকাতে পারছে না, কারণ সে তা চাইছে না। সে তার মনের খোড়াক শরীরের মাধ্যমে পূরণ করতে চায় এবং করে থাকে। এটা কেন? বিকজ অফ হি ডিডেন্ট কেয়ার অফ হিজ সোল, হিজ হার্ট! তার অন্তর বিভিন্ন অনৈতিক চিন্তাচেতনা সঙ্গে জড়িয়ে যায়, মোবাইলে খোলামেলা নানা জিনিস দেখে, এরপর মনের চাহিদা শরীরের মাধ্যমে মেটায়। কালো অন্ধকারে, গন্ধযুক্ত ময়লার স্তুপে তাদের হৃদয় এমনভাবে আটকে যায় সে তারা সজ্ঞানে খারাপ কাজটাকে ভালো জ্ঞান করে থাকে। এমন অনেক দেখবে পাপটাকে স্বীকার করেও বলবে, ‘মন তো জানে, শরীর তো মানে না।’ অর্থাৎ তার কুকর্ম, খারাপ সঙ্গ সৎকর্ম, সৎসঙ্গ হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু অন্যরা তো এই খারাপ-ভালোর পার্থক্য জানে।
ডিড ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড!
তাই কখনো ঐসব আধ্যাত্মিক পর্যায়ের পীর বাবাদের মতো বলো না, ‘মন তো জানে, শরীর তো মানে না।’
বিভিন্নভাবে জিনিস বা কর্ম যা মানুষ করে ফেলে তা মরুভূমির মধ্যে এক ফোঁটা পানির ন্যায় হলেও ফিজিক্যাল নিড কখনো তা হতে পারে না! এখন অনেকে অবশ্যই বলতে পারে ইটস এ নিড, ভেরি ভেরি ইম্পেরট্যান্ট থিং এন্ড ব্লা ব্লা ব্লা…কারণ তাদের নষ্ট মনের নষ্ট চিন্তাভাবনাকে তো সৎ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। তারাও জানে সৎ ছাড়া অসৎ এর ভাত নাই। তাই তারা নোংরা কাজকর্মকে জায়েয হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। জাস্ট প্লিজ রিমেম্বার! এই পৃথিবীতে যতো ভালো কর্মের উৎপত্তি সব একটা সুন্দর মনের একটা উদ্দেশ্যের ফলে সংঘটিত। আর যতো নোংরামি, অশ্লীলতা, হানাহানি সব ওই একই মনের দ্বারা পরিচালিত। একটাই মন। তোমার একটাই হৃদয় এবং তোমার হৃদয়ের প্রতি হৃদয়ের যত্ন জানান দেয় তোমার আগামী। মনকে কী হাত-পা দিয়ে মালিশ, পাখা দিয়ে বাতাস করতে পারবে?’
তোমার গরুর পাল নামক ছাত্র-ছাত্রী হাসিতে ফেঁটে পড়লো।
‘এই যে তুমি একটা ভালো চিন্তাভাবনা করবে যেমন– মোবাইল দিয়ে আমি পিডিএফে বই পড়বো, ইউটিউবে হ্যান্ড ক্রাফটস শিখবো, মা-বাবাকে কল দিয়ে সুখবর শুনাবো। অন্যদিকে, অতি আধ্যাত্মিক ব্যক্তিবর্গ বলবে– মোবাইল দিয়ে আমি বাংলাদেশ বসেই দেশ-বিদেশ ঘুরবো, রঙ নম্বরে কল দিয়ে জান, সুইটি, পুইটি বলবো।
তুমি একটা ব্যক্তি কিন্তু চিন্তা হতে পারে দুই রকম। নৈতিক ও অনৈতিক। তুমি তোমার অন্তরে কি ধারণ করেছো তার প্রকাশবোধ ঘটবে তোমার শরীর দ্বারা। তুমি মার্ডার করেছো এতে প্রকাশিত হবে কোনো ব্যক্তির ওপর তোমার মনে ধারণ করা অনেক দিনের প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের নেশা। তুমি পর্ণগ্রাফিতে আসক্ত, রাত জেগে জনপ্রিয় লেখক-লেখিকার জনপ্রিয় রোমান্টিক জনরা নামক চটি পড়ো। এর প্রকাশবোধ ঘটবে তোমার বোন বা মেয়ের বয়সী কাউকে সর্বনাশের মাধ্যমে, সামনে দিয়ে স্কুল ড্রেস যাওয়া কোনো মেয়ের চোখের জলের মাধ্যমে। এরকম কখনো কর্ণপাত হয়েছে কী যে একটা কখনো ফোনে আজেবাজে জিনিস দেখেনি, হুট করে একটা একটা মেয়েকে সে তুলে নিয়ে গেলো। কারণ কী তার শরীর তার মনকে বলেছে যা বাপ যা? না, বরং তার মন তার শরীরকে বলে যা বাপ যা। এই পুরোটাই কিন্তু তোমার চিন্তার ওপর ডিপেন্ড করে। বুঝেছো পোলাপাইনস!’
তোমার পোলাপাইনস একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে,
‘ইয়েস ম্যাম!’
সঙ্গে আমিও। ইশশ, লজ্জা লাগছে! কি বলদের মতো হেসে ছিলাম সেদিন!

এতটুকু পড়েই দানীনের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সে এসব কবে বলেছিলো? সে ক্লাসে পড়াশোনা বাদ স্টুডেন্টদের এসব শুনাতো বুঝি! কিন্তু তার তো এসব কিছুই মনে নেই। আল্লাহ, আল্লাহ!
এতো সুচারুরূপে একটা মানুষ মনেই বা কীভাবে রেখেছে। প্রথম দেখায় কেউ এতো মনোযোগ দিয়ে কী কখনো তার কথা শুনেছে, এতো যত্ন করে? তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কতোদিন তার মনের কথাগুলো কেউ যত্ন করে শুনে না।

দানীন পৃষ্ঠা উল্টে পরের লেখাগুলো পড়ায় মনোনিবেশ করলো।
“আর তুমি তোমার মুখের কাঠিন্যতা সরিয়ে সবার সঙ্গে খিলখিল করে হেসে ওঠলে এবং আমি সেই হাসিতে নিহত। আমি শেষ দানীন! তোমার সুদৃঢ় মনোভাব, শুভ্র চিন্তাভাবনা মানুষরূপী এই শুভ্রকে পুষ্পের নরম আঘাতের ন্যায় আহত করেছে। এরকম আহত আমি বারবার হতে চাই। তবে তা আরও শুদ্ধতার সঙ্গে। তুমি আছো বলেই বোধ হচ্ছে আমার এই শুভ্র নাম সার্থক। এতোদিন শুভ্রতার চাদরে বেষ্টিত কালো দুনিয়ার রঙ দেখেছি। তোমার সাক্ষাৎ যেনো আমার সর্বাঙ্গ, সর্বস্বত্ব সত্যিই শুভ্রময় করে তুলেছে। এই শুভ্রের আত্নারামে দানীন নামক রাজকুমারীর স্থায়ী বসবাস চাই। সেই সঙ্গে রাজকুমারী দানীনের অন্তরতম অঁচলে এই শুভ্রের রাজত্ব চাই।
ইতি,
তোমার পুরঁজন শুভ্রময় করে নিজের নাম তোমার হৃদয়ে চিরতরে গেঁথে দেওয়ার জন্য ব্যাকুলতায় অপেক্ষমান এক প্রেমিক পুরুষ(প্রেমিক স্বামী হতে চাওয়া পুরুষ)।”

চিঠিটা পড়া শেষ হতেই দানীনের একজনের কথাই শুধু মনে পড়ছে। এরকম মনে হওয়ার কারণে সে-ও বিস্মিত। তবুও কেন যেনো মনে হচ্ছে ওই ব্যক্তিটি ছাড়া এই চিঠির প্রেরণকর্তা অন্য কেউ হবে না। হতেই পারে না। ভার্সিটিতে প্রথম সাক্ষাৎ, আর এতো সুস্পষ্টভাবে তার কথা মনে রাখা সে ব্যক্তিটি ব্যতীত আর কে হবে। নাকি দানীন মনেপ্রাণে প্রার্থনা করছে ব্যক্তিটি যেনো সে-ই হয়!..এরপরও যাচাইকরণের উদ্দেশ্যে দানীন ফোন হাতে নিলো।

আদ্রিয়ান ফোন ধরে লম্বা করে একটা সালাম দিলো। করুণ গলায় যথাযথ কৈফিয়ত চাইতে লাগলো,
“আপনি দুইদিন ধরে আমার কল কেন ধরছেন না ম্যাম? আপনি কী আমার সঙ্গে রাগ করেছেন?”
দানীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলো। রাগ সে করেনি, তবে এখন রাগ ওঠছে। সরাসরি পুরো নাম জিগ্যেস করলে গরুটা কোনোভাবেই বলবে না। পরে অন্যভাবে জানার সুযোগও বোধহয় সহজে দেবে না। কিভাবে ফাঁদে ফেলা যায়?
“ম্যাম আপনি ঠিক আছেন? কথা বলছেন না কেন ম্যাম! আপনি কী কোনো বিপদে..”
দানীন আদ্রিয়ানকে ধমকে ওঠলো,
“আহ, আদ্রিয়ান স্যার। আমি কোনো বিপদে পড়িনি। আমি সুস্থ-সবল দেহ নিয়ে ছাঁদে রোদ পোহাচ্ছি।”
আদ্রিয়ান ক্ষীণ গলায় বললো,
“ওহ।”
সে আর কিছু বলার পূর্বেই দানীন বলে ওঠলো,
“আপনার আইডি কার্ডের একটা ছবি পাঠান তো।”
আদ্রিয়ান বিস্মিত গলায় জিগ্যেস করলো,
“কেন ম্যাম?”
“আসলে কি হয়েছে, আমার এক খালার মেয়ের আইডি কার্ডে বাবার জায়গায় উঠেছে তার নাম, আর মায়ের জায়গায় তার হাজব্যান্ডের নাম। আর শুধু নামের জায়গায় উঠেছে তার মেয়ের। কি আশ্চর্য ব্যাপার বলুন তো। আমি বললাম ইহা কোনো সমস্যা নহে। তারা বললো, ইহা গুরুতর সমস্যা ওহে। আমার কার্ডের ছবি চাইছে। আমারটা পাচ্ছি না। তাই আপনারটার ছবি দিন। তাদেরকে স্বান্তনা স্বরূপ পাঠাই। নাকি আমি চাওয়াতে দেবেন না? এখন বলবেন যে আপনিও পাচ্ছেন না?”
আদ্রিয়ান থতমত খেলো। সে সত্যিই এই মূহুর্তে বলতে যাচ্ছিলো যে তার আইডি কার্ডও হারানো গিয়েছে। এখন যদি সে কার্ড সত্যি সত্যিই মাটিতে পুঁতে আসে, আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে সে ছাই দ্বারা রান্না করে দানীনকে খাওয়ায়, তবুও তা তার নিকট বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
দানীন তাচ্ছিল্য স্বরে বললো,
“কি হলো আদ্রিয়ান স্যার? সত্যি সত্যি হারিয়ে গেছে, তাই না? নিশ্চয়ই বাংলা কমোডে উবু হয়ে বসতে গিয়ে পড়ে গেছে?”
আদ্রিয়ান কুণ্ঠিত কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“না না ম্যাম। আছে আছে, আমি এক্ষণই ছবি তুলে পাঠাচ্ছি।”

দিয়ামণি শব্দহীনভাবে তার ফুপুউকে পর্যবেক্ষণ করেই যাচ্ছে। তার ফুপুউ’র কথা বলার ভঙ্গিমা, অধীরতা সবকিছু তার কাছে অজানা ঠেকছে। ফুপুউ’র হাতের কাগজের গুটি গুটি অক্ষরগুলো তার খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু এগুলো কি তার কিছুই সে বুঝতে পারলো না।

দানীনের হোয়াটসঅ্যাপে টুং করে আওয়াজ করে মেসেজ এলো। ছবি দেখেই সে দিয়াকে কোলে নিয়েই লাফিয়ে ওঠলো। পরক্ষণেই নিজের প্রফুল্লিত মনকে সামলে নিলো। তার এতো লাফালাফি কিসের। একজন তার প্রেমিক স্বামী হতে চাইলেই সে বানাবে নাকি, হুহ! কিন্তু একটা গিট্টু তো লাগানোই যায়। সুচেতায় পরিপূর্ণ চিঠির কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দানীনও আমোদজনক মনে সুন্দর করে একটা চিঠি লিখলো, যাকে বলে অতি সুন্দর। অতি কোনো কিছুই সুখকর নয় সেটা মাথায় রেখেই খানিক অপ্রীতিকর তথা ‘অতি অতি’ সুন্দরতম একটা চিঠি লিখে ঢাকার এক ঠিকানায় পোস্ট করলো। এবার লে হালুয়া হওয়ার অপেক্ষা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here