#জল_ফোয়ারা |৯|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan
১৩.
মুগ্ধ ঘরে ফিরে এসে দেখে ওর মা নামাযের বিছানায় বসে কাঁদছে, মায়ের চোখের জল মুগ্ধ কখনোই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। ছোট থেকেই মায়ের প্রতি টান খুব বেশি ওর, তার কিছু হলে নিজেকে সামলাতে পারেনা। আজও সেই অস্থিরতা আবারো কাজ করছে, বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই ওর মা কেমন জানি হয়ে গেলেন। কথা কম বলেন, ওদের প্রতি যত্ন কমে গেলো। হয়তো দিকে তাকালেই ওদের জন্মদাতার দেয়া আ*ঘা*তগুলোর কথা মনে পড়ে যায়, মুগ্ধ ঘরের সামনে থাকা ছোট সিঁড়িতে বসে পড়লো।
মনে হলো এইতো সেইদিনের কথা যখন ওদের পরিবারে সব ঠিকঠাক ছিলো আর তারপর হুট করেই নুরের এ!ক্সি*ডে!ন্ট। ওকে সামলানো দুষ্কর হয়ে পড়লো, অনেকদিন হওয়ার পরও ও ভালো হওয়ার কোন লক্ষণ দেখালো না। নুরের মা আর মুগ্ধ ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সকল কিছু করলো যাতে অন্তত একটু আশার মুখ দেখে, একদিকে পড়াশুনার প্রেশার আরেকদিকে নুরের অস্বাভাবিক অবস্থা সবমিলিয়ে খুব চাপে ছিলো, ঠিক তখনই ওদের বাবা হঠাৎ করে নাই হয়ে গেলেন। সকালে অফিসের কথা বলে আর ফিরেননি, অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো উনি মাসখানেক পুর্বেই চাকরী থেকে রিজাইন করেছেন। প্রায় ছয়মাস তার কোন খোঁজ খবর পাওয়া গেলো না, যেনো উনি উধাও! পু!লি*শ কে*ই!স হলো, অনেক খোঁজয়ার পর তারাও হাল ছেড়ে দিলো।
সম্পূর্ণ পরিবারের ভার ওর উপর এসে পড়লো, কিভাবে কি করবে ভেবে উঠতে পারলো না, যখন ও অথৈজলে হাবুডুবু খাচ্ছিলো তখন ওর ফুফি আর তার স্বামী ওদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। টাকা-পয়সা দিয়ে বেশ সাহায্য করলেন আর মুগ্ধর বর্তমান চাকরী তারই ঠিক করে দেয়া। সে মুহুর্তে উনি সাহায্য না করলে কি উপায় হতো মুগ্ধর জানা নেই, তাদের প্রতি ওর এই কৃতজ্ঞতা আজীবনের। তাই যখন তাদের মেয়েকে বিয়ে করার কথা উঠলো, মুগ্ধ সরাসরি না করতে পারলো না কিন্তু হ্যাঁ ও বলেনি এখনো। ওর সময় দরকার, সবকিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা প্রয়োজন আর তাই মায়ের প্রতিনিয়ত প্রেসারের পরেও মুগ্ধ নিরবতা পালন করে গেছে।
মুগ্ধর ভাবনার মাঝে কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়ালো, দুহাত বুকের উপর ভাঁজ করে তিক্ততা নিয়ে বললো
“শুনেছি আপনার নাকি বিয়ে ঠিক?সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী মাসে বিয়ে?”
মুগ্ধ চমকে উঠলো না, সামনের মানুষটা থেকে আসা বেলিফুলের গন্ধ ওর বেশ পরিচিত। মুগ্ধ শান্ত গলায় বললো
“ভুল কিছু শুনোনি, যা কিছু রটে কিছু হলেও বটে”
মুগ্ধর কথা শুনে রোহিণী চমকে উঠলো, কি সাবলিল ভাবে কথাগুলো বলছে যেনো এই কথা গুলো ওকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে না। ও শান্ত গলায় বললো
“মাত্র কয়দিনে আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন? বাহ বেশ বেশ! তা বিয়ের তারিখটা কবে? দাওয়াত খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন”
মুগ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
“তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এর চেয়ে ভালো উপায় খুঁজে পাইনি”
রোহিণী ভ্রু কুঁচকে তাকালো, কথাটা কতোটা অদ্ভুত! ও একটু জোর গলায়ই বললো
“কৃতজ্ঞতা প্রকাশ? তাও একজনকে বিয়ে করে। নিজের কাছে অদ্ভুত লাগে নি? আর কয়জনের জীবন নষ্ট করবেন আপনি?”
মুগ্ধ কিছু বললো না, নিশ্চুপে রোহিণী দিকে তাকিয়ে রইলো। জবাব না পাওয়ায় রোহিণী শান্ত গলায় বললো
“কিসের শাস্তি দিচ্ছেন আমাকে? আমার দোষ কোথায়? আমার ভাইয়ের হয়ে কথা বলেছি এইটুকু? আট বছর কেটে গেছে তারপরে অথচ ভাইয়ের সাথে সাথে আমার প্রতিও আপনার ঘৃ!ণা তীব্র”
মুগ্ধ তবুও নিশ্চুপ। ভাবতে লাগলো পুরোনো কথা, সৌহার্দ্য যখন চলে গিয়েছিলো তখন ও ভেবেছিলো শুধুমাত্র নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধুকে হারিয়েছে ও কিন্তু নুরের ঘটনা সবকিছু মিথ্যে করে দিলো। নুরের এক্সিডেন্টের বহুদিন পর ও তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারে, রোহিণীকে তখন স্বাভাবিকভাবেই বলেছিলো সবটা, কিন্তু রোহিণীর চাহনিতে বুঝতে পারলো ও সবটা পুর্বে থেকেই জানতো অথচ কেউ ওকে কিছু বলেনি, এমনকি ওর বন্ধুরাও জানতো বিষয়টা শুধু ও ছাড়া। ওর মনে হয়েছিলো ওর সাথে সবাই বি!শ্বাস*ঘাত!কতা করেছে। তার মাঝে হুট করেই রোহিণী বললো সবটা ওর ভাইয়ের দো*ষ নয়, সে পরিস্থিতির চাপে পড়েই এমনটা করেছে আর তাছাড়া কেউ জানতো না নুরের সাথে এমন হবে। মুগ্ধ একপ্রকার রে!গেই বলেছিলো,,
“তুমি তোমার ভাইয়েরই পক্ষ নিচ্ছো তাইনা? সবাই ঠিকই বলে ফল গাছ থেকে বেশিদূর গিয়ে পড়ে না!”
রোহিণীও রা!গের মাথায় বলেছিলো
“আমি কারো পক্ষ নিচ্ছিনা, শুধু বলছি একা ভাইয়ার দোষ দেয়া বন্ধ করুন’
ব্যস তারপর সব বদলে গেলো। স্বাভাবিক সময় হলে বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই হয়তো নিতে পারতো ও কিন্তু নিজের বোনের করুণ অবস্থা দেখে ও বিষয়টা নরমাল ভাবে নেয়নি বরং অতিরিক্ত রিয়াক্ট করে ফেলেছে। সবার সাথে তুমুল ঝ!গ*ড়া হলো ওর আর তার রেশ ধরেই রোহিণীর সাথে কথা বন্ধ। দুজনই অভিমান করে আর কথা বলেনি আর তারপর পাহাড় সমান দুরত্ব, চাইলেও গুচানো সম্ভব হয়নি।
রোহিণী মুগ্ধর চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
“মজার বিষয় কি জানেন? আমার বাবা-মাও পাত্র ঠিক করে ফেলেছে, আমি হ্যাঁ বলে দিলে আজ এখুনি বিয়েটা হয়ে যায়”
মুগ্ধ কথা বললো না, রোহিণীর অভিমান আরো বেড়ে গেলো। শিথিল কন্ঠে বললো
“পাত্র কে তা জিজ্ঞেস করবেন না?”
মুগ্ধ মাথা নাড়ালো, জানতে চাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর নেই। ও শান্তভাবেই বললো,
“তোমার ভালো থাকাটাই আসল রোহিণী, পাত্র কে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়”
রোহিণী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো তারপর হাত দুটো কোমরে রেখে বললো
“পাত্র অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, আপনি আমার বিয়ে হোক এতো করে চাইছেন তাই পাত্রের নাম জানা আপনার অধিকার। তার নাম সৌহার্দ্য রায়হান, পেশায় বিসি*এস ক্যা!ডা!র আর সম্পর্কে আমার চাচাতো ভাই এবং আপনার আদরের বোনের প্রা/ক্ত!ন!”
মুগ্ধ হুট করেই রেগে গেলো, রাগের মাথায় বললো
“তোমার পরিবার আর মানুষ খুঁজে পায়নি? তোমাকে বিয়ে দিতে চায় ওই বি*শ্বাস!ঘাত!কের সাথে? যার কিনা অলরেডি একটা তিনবছরের মেয়ে আছে? আর ইউ কিডিং মি?”
রোহিণী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
“না মুগ্ধ ভাই, সবটা জানলে হয়তো এমন কথা বলতেন না। অদিতা হয়তো পরিচয়ে ভাইয়ার মেয়ে হতে পারে কিন্তু ভাইয়া বিবাহিত নয় আর না কখনো ছিলো। আর থাকলেও আমার বাবা মায়ের খুব একটা যায় আসতো না। সবটা যখন জানেন না সেই বিষয়ে কথা না বলাই ভালো। আর হ্যাঁ আপনি আমি খুব ভালো করেই জানি ভাইয়া ইচ্ছে করে যায়নি, আপনি তো তার বন্ধু ছিলেন তাইনা? তার বাবা-মা কেমন ছিলো সবটাই জানা আপনার, আমি তার পক্ষ নিতে চাইনা কিন্তু তার উপর সবটা চাপিয়ে দেয়াও আমার কাছে ভুল। সে সবটা জানলে অনেক পুর্বেই ফিরে আসতো সেটা আপনিও জানেন আর আমিও জানি, নুরের কিছু হোক সেটা নিশ্চয়ই সে চায়নি। সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আমি মানি, কিন্তু দিনশেষে সেও পরিস্থিতির স্বিকার।”
রোহিণী থামলো, জড়ানো কন্ঠে আবার বললো
“আর এর জন্য যদি আমার উপর আপনি রেগে থাকেন তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই, আসলে আমরা একে অপরের জন্য ছিলামই না। নাহয় এই মতের অমিলের কারণে আমরা আলাদা হতাম না। অবশ্য আপনার ভাষ্যমতে আমাদের মাঝে তো কিছু ছিলোই না! যাইহোক বিয়ের জন্য অগ্রিম শুভকামনা, আশাকরি সে আপনাকে অনেক ভালো রাখবে। আই উইশ ইউ নাথিং বাট হ্যাপিনেস!”
বলে রোহিণী আর দাঁড়ালো না, বরাবরের মতো ফিরেও চাইলো না। এই রোহিণী বড্ড আলাদা। অন্যদিনের মতো তার চোখে জল ছিলো না, তার চাহনী ছিলো নিষ্ঠুর, মাপা! যেনো কোন কঠোর সিদ্ধান্তের পর ও কথাগুলো বলেছে।মুগ্ধর কেনো যেনো মনে হলো এটাই তাদের শেষ দেখা, যেনো রোহিণী অদৃশ্য পণ করে গিয়েছে ও আর এ মুখো হবে না।
সেদিন যদি মুগ্ধ বুঝতে পারতো ওর ভাবনাগুলো সঠিক, তবে হয়তো এতো সহজে সবকিছু হারিয়ে যেতে দিতো। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকতো সবকিছু…
#চলবে…
(ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে লিখেছি, ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)