শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_২৫

0
263

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_২৫
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২৫.
“শুভ্র, এই শুভ্র! শাহ! এই শাহের বাচ্চা!”
আদিলা বেগম কোনো সাড়া না পেয়ে ড্রয়িং রুম থেকে আবার চেঁচিয়ে ওঠলেন,
“এই শুভ্রের বাচ্চা!”
তখনই মূল দরজা দিয়ে আদ্রিয়ান ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। ফরমাল পোশাক পরিহিত আদ্রিয়ান মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করলো,
“কি হয়েছে মা? এভাবে চিৎকার করছো যে।”
আরসালানও সিঁড়ি ভেঙে নিচে এসে মায়ের দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকালো।
আদিলা বেগম আবার চেঁচিয়ে ওঠলেন,
“দুই ভাইয়ের কানের নিচ ফাটিয়ে লাল করে দেবো। বেয়াদপগুলো! আস্কারা পেয়ে পেয়ে ঘাড় চেপে মাথায় উঠে পা দুলাচ্ছ।”
আদ্রিয়ান, আরসালান দুই ভাই-ই হতবিহ্বল। কারণ তারা দুজনই মায়ের বাধ্য সন্তান। যাকে বলে মামা’স বয়। যে মা দুই ছেলের অনবসর গুণকীর্তন গেয়ে গেয়ে গুণানুবাদে রত, সে মায়ের মুখ থেকে নির্গত এরূপ হৈ-হট্টগোল ভরা বাণী শ্রবণ করে দুই ভাই-ই হতবিহ্বল।
আরসালান বিস্ময়করতার ধাপ অতিক্রম করে মাকে নমনীয় গলায় জিগ্যেস করলো,
“কি হয়েছে মা? এতো হাইপার হচ্ছো কেন? কে কি বলেছে জাস্ট একবার বলো। এরপর দেখো..”
বাক্যের ইতি টানার পূর্বেই আদিলা বেগম তার কান চেপে ধরলেন।
“ত্যাঁদড় ছেলে। মেইন কালপ্রিট তো তুই। বড়ো ভাই-বোনেরা নাকি শান্তশিষ্ট, লাজুক প্রকৃতির হয়। কিন্তু তুই? সঙ্গে সঙ্গে ছোটটাকেও তোর মতো বেয়াড়া বানাচ্ছিস। এবার বল বরিশালের মেয়ের সাথে ঠুকরা-ঠুকরি বাজিয়েছিস কে? তুই নাকি তোর অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তোর নেউটা ছোটো ছাগলটা?”
আরসালান কোনোমতে মায়ের থেকে কান ছাড়িয়ে স্তম্ভিত হয়ে তাকালো। এবারও দুই ভাই বিস্ময়ে মুখের আকার হাতি ধারণ করার অনুরূপ করে মার দিকে তাকিয়ে বারকয়েক একে অপরের দিকে তাকালো।
আদ্রিয়ান খানিক ভয়ার্ত ও খানিক বিমর্ষতাপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কোন বরিশালের মেয়ে আম্মু? কোন মেয়ের কথা বলছো?”
আদিলা বেগম চোখ ঝলসানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতের কাগজটি আদ্রিয়ানের দিকে এগিয়ে দিলো। আদ্রিয়ান দ্বৈধীভাব নিয়ে কাগজটির ভাঁজ প্রসারিত করে মেলে ধরলো। অনন্য সম্বোধন দ্বারা প্রথম বাক্যের সূচনা।

“হেই আনএডোরাবল ‘শ’,
কিরে শ’র ছাওপোনা। ভালা আছোনে? মুই জানি তোর মতো ভালা এহন আর কেউ নাই। কারণ তোর পিঠে মুরহার নাহান পাখনা হইছে। তুই হইলি উন্দুর। তুই উগোইর ঘরে পইড়া ফাডালে কু কু করবি। কিন্তু তুই কি হরছ? বরিশালের মাইয়ার পিছনে হাতোর পারোছ।
ওরে শ!
তোর নামের এই অক্ষরের লাহান ডান্ডি ভাইঙগা পিছার লগে বাইন্দা তোর পিঠে আল্লাডি সারুম। তোর পাখনা মুই বরিশালের মাইয়া ক্যাক্কের ক্যাক্কের কইরা ভাইঙগাম। এই শ! (এই ‘শ’ এর মাথা চ্যাড়াং চ্যাড়াং কইরা কাইট্টা তোর পিছন দিয়া নাহোইলের কেনু দিয়া ভরমুরে গোঙ্গা!) ব্রেকেটের লাইনডা চোখটি মেইল্লা পড়িস না কিন্তু। নাইলে তোর হৌড়ের হাতে তোরে আছোলা বাঁশ দিমুরে হাম্বা! যাইহোক, যা কইতাছিলাম। ভালা হইয়া যা মনা, ভালা হইয়া যা। এম্বায় মাইয়াগো ইভ-টিজিং করা কী ভালা কাম? উহু। ভালা হইতে মন না টানলে আন্টিরে বল তোরে ছ্যাঁইচ্চা ফ্রিজে ফ্রিজ করতে। বাকি কাম আমি সারাম। উক্কে টাটা শ। ইয়াক, তোর এই শ অক্ষর দিয়া নামডা কেডা রাখছেরে রাওয়া, হ্যাঁ হ্যাঁ!”

আদ্রিয়ান চিঠির লেখাগুলো পড়ার সমাপ্ত টানতেই চোখ-মুখ শুকিয়ে গেলো। আরসালান আদ্রিয়ান থেকে নিয়ে কাগজের লেখাগুলো পড়লো। তার চেহারা নিরীক্ষণের পর মনে হচ্ছে এখনই অক্ষিগোলক ছিটকে পড়ে গ্রহ-কক্ষে ঘূর্ণায়মান হতে থাকবে। তার শরীরের যোজক কলা বুঝি গ্যাস হয়ে গেছে। এক্ষণই বেলুনের মতো দূর আকাশে উড়তে থাকবে।
যোগাযোগের জন্য চিঠির মতো এরূপ মনোহর ও অভিরাম পন্থার কেউ এরকম সদ্ব্যবহার করতে পারে, এই অনন্যসুলভ চিঠির সংস্পর্শে না এলে দু’ভাই অনবগতই থাকতো। সুন্দরতম পদ্ধতিকে যে কেউ এতো ভয়ানকভাবে উপস্থাপন করতে পারে তা এই চিঠি না দেখলে জানাই হতো না। এতো সুন্দর, এতো মাধুর্য লেখা। দুই ভাই ঘেমে গেলো।
আদিলা বেগম এবার ধমকে ওঠলেন,
“এতো সাহস! দুইটাকে কতক্ষণ ধরে প্রশ্ন করে যাচ্ছি। অথচ নো পাত্তা।”
আরসালান ভয়ার্ত কণ্ঠে অনুচ্চ স্বরে বললো,
“ভুলবশত ভুল ঠিকানায় চলে এসেছে মা। এখন তো সব মানুষ ফাঁকিবাজ। সামান্য কাজটুকুতে ফাঁকিবাজি না করলে তাদের কর্মজীবন যেনো ষোলো কলা পূর্ণ হয় না।”
আদিলা বেগম ডান ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
“ফাঁকিবাজ তোমরা দুজন কম কিসে? আর তোমার তো বরিশাল থেকে এখানেই বেশি ঘুরাঘুরি। কিসের শিক্ষকতা করাস তুই। তোর স্টুডেন্টরা তো ফেইল করে তোকে অভিশাপ দিতে দিতেই শেষ করে দেবে।”
শাফায়াত হোসেন ড্রয়িংরুমে চশমার গ্লাস মুছতে মুছতে এসে দাঁড়ালেন। বিরক্ত গলায় বলে ওঠলেন,
“চেঁচামেচি এখনও শেষ হয়নি? আমি লক্ষ্য করেছি আমি বই পড়তে বসলেই তোমাদের রাজ্য পরিচালনার নানা আলোচনা নিয়ে বসতে হয়। অন্য সময় সুচ ফুঁটিয়েও মুখ দিয়ে কথা বের করা যায় না।”
আদিলা বেগম রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন,
“তোমার এই দুই ভদ্র ছেলে অঘটন ঘটিয়েছে। আর তুমি ঢঙের বই পড়া নিয়ে বসে আছো! ছেলে আমার কোন না কোন মেয়ের হাত ধরে গৃহত্যাগ করলে তুমি ক্ষান্ত হবে?”
স্বামী ছেড়ে ছেলেদের বড় বড় চোখ করে নীরিক্ষা করে বললেন,
“এবার বল তো, এই শ কে? শুভ্র না শাহ? কোন উল্লুকের ছাও মেয়ের পিছনে পড়েছিস?”
আরসালান তো মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, মরে কেটে সমুদ্র ভাসিয়ে দিক। তবুও সে বলবে না। যেই মেয়ে এরকম ভয়ানক চিঠি লিখতে পারে তার কথা ভুলেও মুখে আনবে না। তার পেট এতো ফোলা ফোলা লাগছে কেন? ভয় পেয়ে সত্যিই রক্ত, হরমোন, নাড়িভুড়ি গ্যাসে রূপান্তরিত হলো নাকি!
অন্যদিকে, আদ্রিয়ান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আজ সে সবকিছু স্বীকার করবে। এতো লুকোচুরির কোনো মানেই হয় না। বরং ব্যাপারটা আরও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। বৈধ সম্পর্ক কামনায় এতো লুকোচুরি কিসের। আজ মাকে সব বলবেই বলবে!

শাফায়াত হোসেন স্ত্রীর কথায় বাঁধ সাধলেন।
“আদি, তুমি কিন্তু ইনডাইরেক্টলি নিজেকেই উল্লুক বলছো। এরা যদি উল্লুকের ছাও হয় তো তোমার সন্তান হিসেবে তুমিই কিন্তু বড় উল্লুকটা।”
“আমার ছাও! এই দুষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন ফক্কড় দুটো আমার ছেলে হতেই পারে না। এদের আমি মেয়ে ধরে ধরে টিজ করতে শিখিয়েছি? শিখলি বাপের কাছ থেকে শিখেছে। বাপের যে স্বভাব তা কী আমি বড় করে বিবৃতি প্রদান করবো শাফায়াত স্যার?”
শাফায়াত হোসেন খুক খুক করে কাশলেন। তিনি মোটেও কাউকে কখনো টিজ করেননি। শুধু নিজের বর্তমান স্ত্রীকে বিয়ে করার জন্য শান্তশিষ্ট ছেলে হয়েও শেষে খানিক পাগলামি করে বসেছিলেন। আর এই খোটা পীড়ন বিগত পয়ত্রিশ বছর ধরেই সন্তর্পণে প্রদান করা হচ্ছে। তবুও বুঝি খোটার কূপ নিঃশেষিত হওয়ার নয়।
আদ্রিয়ান অবাক আঁখিতে বাবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন নিক্ষেপণ করলো,
“বাবাও কাউকে টিজ করেছো? কবে কবে ভার্সিটি লাইফে? মেয়ের হাতে মাইর খেয়েছো বাবা?”
আদিলা বেগম ধমকে ওঠলেন,
“চুপ বেয়াদপ! বাবাকে কেউ এসব বলে! ছিঃ, ছিঃ! এতো অবনতি হয়েছে ছেলে দুটোর। এবার বল এই শ কে? এই তোরা না মাস কয়েক আগে একটা মেয়ের কথা বলেছিলি, তোর বরিশাইল্লা ভাই যে মার টার খেয়ে এলো। এই মেয়েই এই চিঠিদাতা নাকি?”
শাফায়াত হোসেন আগ্রহী দৃষ্টিতে দুই ছেলের দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন,
“চিঠিও আদান-প্রদান হচ্ছে নাকি। বেশ তো। চিঠির মতো মনের ভাষা প্রকাশের সুদৃশ্য পন্থা ও সুশোভিত সুন্দর মাধ্যম আর কিছু হয় না। মুখ দ্বারা বলা যায় না কথা চিঠিতে খুব যত্ন করে ফুঁটিয়ে তোলা যায়। কি বলো আদি?”
আরসালানের দিকে ফিরে বললো,
“দেখি তো চিঠিটা। মেয়ের হাতের লেখা দেখি। আর মনের ভাব আদান-প্রদান শেষ হলে ঘরের বউ করে নিয়ে আসো। পুত্রবধু্র রূপে আমি আর তোমার মা একটা মেয়ে পেয়ে গেলাম।”
শাফায়াত হোসেন চিঠি নিতে হাত বাড়ালেই আরসালান লাফিয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলো। হাঁহ, পুত্রবধু্ রূপে মেয়ে! যেই চিঠি লিখেছে বউ হওয়ার আগেই বউসহ দুই ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করবেন।

শাফায়াত হোসেন ভ্রু কুঞ্চিত করে শান্ত স্বরে জিগ্যেস করলেন,
“কি ব্যাপার? লাফালাফি করছো কেন?”
আদিলা বেগম খর্খরে গলায় বললেন,
“লাফালাফি করবে না? চিঠিতে তোমার দুই ছেলের সব কুকর্ম লেখা। এসব দেখালে এই দুই ছাগলের মান থাকবে? বেচারা মেয়েটাকে এই দুই বাদর কিভাবে হেনস্থা করেছে আল্লাহ জানে। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ!”
আদিলা বেগম নাক-মুখ কুঁচকে ফেললেন।
আদ্রিয়ান কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন,
“দুই ভাই কেন বলছো মা? আমি তো ম্যাডামকে খুব সম্মান করি মা। আমি তো কথা বলার সময় চোখে চোখ কি, উনার মুখের দিকেও তাকাই না।”
“দুই ভাই বলবো না? চিঠিতে মেয়ে শ দ্বারা কাকে ইঙ্গিত করেছে তা তো বলছিস না। এই এক সেকেন্ড! ম্যাডাম মানে?”
আদিলা বেগম কোমরে হাত রেখে চোখ পাকিয়ে জিগ্যেস করলেন,
“এতোক্ষণ নাটক করলি মেয়েটাকে চিনিসই না.. চিঠি ভুলবশত এসেছে.. আর এখন ম্যাডাম?”
আদিলা বেগম আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করলে আরসালান আদ্রিয়ানের দিকে কিড়মিড় করে তাকালো। এই দৃষ্টির অর্থ, ‘তোকে শুধু একবার একা পাই ভাই। চিঠিতে উল্লেখিত ছ্যাঁচাছেঁচি, গড়াগড়ি সব আমি তোকে দিয়ে পরীক্ষা করবো!’
শাফায়াত হোসেন হাই তুলতে তুলতে বললেন,
“ছেলেদের প্রেমপত্র তোমার একদম পড়া উচিত হয়নি আদি। হয়তো ছেলে-মেয়ের মধ্যে মান-অভিমান হয়েছে, তাই অভিমান ভরা চিঠি লিখেছে। তুমি কেন এসব পড়তে যাও বলো তো।”
“আশ্চর্য কথা! কোন ছেলের প্রেমপত্র সেটাই তো জানি না। এক ঘণ্টা ধরে চিৎকার করে যাচ্ছি তবুও দুই খচ্চরের একজন থেকেও কথা বের করতে পারলাম না। ছোটো ছাগল তো তবুও ভুলে ভুলে ম্যামের কথা উল্লেখ করলো।”
শাফায়াত হোসেন হেসে বললো,
“রিল্যাক্স আদি। যার প্যারা সে-ই বুঝবে। এখন ছাগল দুটো কিচ্ছু বলছে না। পরে যার দরকার লাগবে সেই ছাগল দেখবে তোমার পায়ে পরে ম্যা ম্যা করছে। তখন ছাগলের বর্তমানে নিশ্চুপ থাকার শোধ নিও। ম্যা ম্যা করলেই হুশ হুশ করে তাড়াবে। তখন বুঝবে বাবারা।”
আরসালান সন্তর্পণে ঢোঁক গিললো। কপালে জমে থাকা ঘামগুলোও মুছলো।
“যাইহোক, এখন আমি পড়তে যাচ্ছি। আর কোনো ডিস্টার্ব হলে ছাগলসহ ছাগলদের মাতাকে ঘর বন্দী করে রাখা হবে। গেলাম আমি।”
আদিলা বেগম দুই ছেলের দিকে চোখ বুলিয়ে স্বামীর সঙ্গে স্থান ত্যাগ করলেন। তাদের যাওয়ার পথ তাকিয়ে দুই ভাই একসঙ্গে ফুস করে নিঃশ্বাস ফেললো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here