ভালোবাসা #অন্তিম_পর্ব

0
569

#ভালোবাসা
#অন্তিম_পর্ব
#ফারজানা_আক্তার

অন্য দিন সকালে টিনের ছিদ্র দিয়ে আলো এসে কেয়ার মুখে পরতেই কেয়া জেগে উঠে। ইস আজ এতো বেলা হয়ে গেছে আর আমি এখনো ঘুমে। আমাকে যে স্টেশন যেতে হবে।
কেয়ার শোয়া থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না কিছুতেই। শরীর টা ভালো লাগছেনা একদম তবুও সাতপাঁচ ভেবে উঠে গেলো।

মা আর বোনদেরকে বিদায় দিয়ে চলে গেলো রেলস্টেশনে। চকলেট বিক্রি করে ট্রেন থেকে নামতে নিলেই এক বয়স্ক মহিলা কেয়াকে ডেকে দাঁড় করায়। ভদ্র মহিলা এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে চিরকুট টা পড়েছিলো।

“মা শুনো একটু এইদিকে।”

কেয়া ভদ্র মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে “জি বলুন খালাম্মা।”

“মা তোমার বাবা নেই?”
কেয়া মাথা নাড়িয়ে বলে “না।”
“কোথায় তোমার আব্বু?”

“২বছর আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায় আর তখনই আম্মু স্টোক করে। আল্লাহ আম্মাকে বাঁচিয়েছে কিন্তু প্যারালাইসেস রোগি বানিয়ে।” কথাগুলো বলতে গিয়ে কেয়ার গলা ধরে আসছে।
ট্রেন ছেড়ে দিবে। ভদ্র মহিলা কে আল্লাহ হাফেজ বলে দ্রুত নেমে যায় সে।

এদিকে ফিরোজ অসহ্য রোদে রিকশা চালাতে চালাতে ক্লান্ত। “কিন্তু কিছু করার নেই স্বামী মরা মা আর বাবা মরা বোনের জন্য হলেও আমাকে রিকশা চালাতেই হবে।” যাত্রী নামার পর ফিরোজ পানি খেলো, গামছা দিয়ে মুখ মুছে আবার রিকশা চালাতে শুরু করলো।

আজকে রাতে বাসায় ফেরার সময় আবারো দেখা হয় ফিরোজ ভাইয়ের সাথে। কেয়া পাশকেটে চলে যেতে নিলেই ফিরোজ ভাই ডাক দেয়।

“কেয়া দাঁড়াও”

“কিছু বলবেন?”

“কি হয়েছে? এতো বিষন্ন কেনো লাগছে তোমায় আজ?”

“আজকে শরীরটা ভালো লাগছেনা, জানেন ফিরোজ ভাই আজ একটা মহিলা ট্রেনে খুব ভালোভাবে কথা বলেছে আমার সাথে, আর সবসময় তো মানুষ শুধুই ধুর ধুর করতো।”

“হুম পৃথিবীতে কিছু মানুষ ভালোও আছে”

“আচ্ছা আসি আমি, আল্লাহ হাফেজ”
ফিরোজ তাকিয়ে আছে কেয়ার যাওয়ার দিকে। আর একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে “যদি তুমি আমার হতে,, তবে জীবনটা একটু হলেও গোছানো হতো।”

তারপরদিন কেয়া স্টেশনে একটা টুলে মাথায় হাত দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, আজ সব ট্রেনে অনেক ভিড় থাকায় সে চকলেট বিক্রি করতে উঠতে পারেনি ট্রেনে, বারংবার উঠতে চেয়েছে আর বারেবারই মানুষের ধাক্কা লেগে পরে যায়। “মায়ের ঔষুধ আর ছোট বোনদের জন্য বিস্কিট নিয়ে যাবো কি দিয়ে?”
চোখে জল চিকচিক করছে, হাত পা কাঁপছে খুব, মাথায় হাত দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে সে, কাঁদতে কাঁদতে যেন নিঃশ্বাস আঁটকে যাচ্ছে। এমন সময় এক আধবয়সী লোক এসে তার মাথায় হাত দিতেই সে চমকে উঠে মাথা তুলে।”
” আ আপনি? একটু একটু কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে
“হ্যাঁ আমি, তুমি কাঁপছো কেন মা? আর কান্না বন্ধ করো মা, এভাবে কান্না করলে দূর্বল হয়ে পরবে তুমি।”
“আজকে হেরে গেছি আমি চাচা, হেরে গেছি।” কাঁদতে কাঁদতে বলে।
“চিন্তা করো না, আল্লাহর উপর ভরসা করো, জিত তোমারই হবে।”
” আপনি তো।”
কেয়াকে কিছু বলতে না দিয়ে ভদ্রলোক বলল
“আমি এখানে ঝালমুড়ি বিক্রি করি। তোমার মতো আমিও যুদ্ধ করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত বাস্তবতার সাথে। কিন্তু দেখো মোটেও ভেঙ্গে পরছিনা আমি, কারণ আমিই যে পরিবারের একমাত্র ভরসা।”
” জি দেখি আপনাকে সবসময়। ধন্যবাদ আপনাকে, অচেনা হয়েও এতো আপন হয়ে ভরসা দেওয়ার জন্য। আচ্ছা চাচা আমি আসি, সন্ধ্যা হয়ে গেছে” এটা বলেই সে হাটা ধরলো টেইলারি দোকানের দিকে, দোকানে আজ ঠিক ভাবে কাজ করতে পারছেনা কেয়া, জলে চোখ ভরে আসছে বারেবার, কতবারই বা মুছা যায়, দোকানের মালিক বলে “অসুস্থ লাগছে তোমায়, আজ যাও বাসায়, কাল একটু দ্রুত আসলেই হবে।”
কেয়া কিছু না বলে চুপচাপ বাসার দিকে যেতে নেই,, ফিরোজ যেখানে দারোয়ানি করে সেটুকু পর্যন্ত গিয়ে কেয়া আবার চিন্তায় ডুব দিলো “আরে আজ যে ফিরোজ ভাই আসেনি, কিছু হয়নি তো উনার, উনার বাসায় গিয়ে কি দেখবো? না থাক, আজকে হাত খালি আর খালি হাতে তো যাওয়া যাবেনা এভাবে।” এসব ভেবেই সে বাসার দিকে এগুলো।

এদিকে ফিরোজের প্রচুর জ্বর আসছে। শোয়া থেকে উঠতে পারছেনা, পুরো শরীর কাঁপছে তার। তবুও অনেক কষ্টে শোয়া থেকে উঠে কাজে যায়। হাঁটতে পারছেনা ভালো করে
“ইস আজ দেড়িতে আসায় কেয়ার সাথে দেখা হলোনা। শরীরটাও ম্যাচম্যাচ করছে কেমন।” এসব বলেই সে একটা টুলে গিয়ে বসলো।
_________

এভাবে কেটে গেলো কয়েকটা মাস। ঈদের আর মাত্র ১০দিন বাকি আছে।
আজ খুব খুশি মনে হুইলচেয়ার কিনতে যাচ্ছে কেয়া, ফিরোজ ভাইয়ের রিকশাতে যাচ্ছে। রিকশা চলছে আর তারা দুজন টুকটাক কথা বলছে। দুজনের মুখেই হাসির রেখা। রাত তখন নয়টা পনেরো

“জানেন ফিরোজ ভাই আজ আমি মেলা খুশি। আজ স্বপ্ন পূরণ হবে, আম্মার জন্য হুইলচেয়ার কিনতে যাচ্ছি যে।”

“হ্যাঁ কেয়া আজ আমিও খুব খুশি। আজকেই সাইকেল কিনে বাসায় রেখে দিবো, ঈদে গ্রামে যাওয়ার সময় নিয়ে যাবো।”

কেয়া রিকশা থেকে নেমে বলে “ফিরোজ ভাই আপনিও আসেন আমার সাথে।”

“তুমি ভেতরে যাও আমি রিকশাটা পাশ করে রেখে আসি।”

কেয়া তিন চার পা এগুই, ফিরোজ রিকশা ঘুরাতেই একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে ছিটকে পরলো রিক্সা থেকে। মাথায় আর হাতের কনুইতে আঘাত লাগে বেশ। কেয়া চিৎকার দিয়ে ছুটে আসে, ফিরোজ চোখ মিটিমিটি করেই বন্ধ করে নিলো। কেয়া ভয়ে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো
“দয়া করে কেউ সাহায্য করুন, নয়তো মরে যাবে মানুষটা। কেউ তো সাহায্য করুন। একটা গাড়ি বা এম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করে দিন কেউ।” কেয়া চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথাগুলো বলতে লাগলো। অনেক গাড়ি থামানোর চেষ্টা করলেও গাড়ি থামেনা।

শেষে এক ভেনগাড়ি চালক দাঁড়ায়। দুজনে ধরাধরি করে ফিরোজ কে গাড়িতে তুলে। ফিরোজের রিক্সাটা বেশ ভেঙে গেছে। সাথে কেয়া আর ফিরোজের মনটাও। ভেনগাড়ি চলছে কেয়া অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছে “একজন গরিবই একজন গরিবের সাহায্যে এগিয়ে আসে, আল্লাহ ফিরোজ ভাইকে ভালো করে দাও।”

কেয়া একটা চেয়ারে বসে বসে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছে, এমন সময় ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে বলে “এখন সুস্থ আছে রোগি, শুধু মাথায় আর কনুইতে একটু আঘাত পেয়েছে, পায়েও একটুখানি ব্যাথা আছে, খুব দ্রুত সেরে যাবে।” ডাক্তার কেয়ার হাতে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে বলে “ঔষুধ গুলো নিয়ে আসুন, ১ঘন্টা পর নিয়ে যেতে পারবেন রোগিকে।” কেয়া দ্রুত চোখমুখ মুছে নেই।

ডাক্তার চলে গেলো। কেয়া ভেনগাড়ি চালক কে বলে “চাচা আপনি অনেক উপকার করেছেন, আপনার উপকারের ঋণ শোধ করতে পারবোনা, শেষবার আরেকটা উপকার করবেন?”

“কও মা, কিভাবে উপকার করতে পারি”

কেয়া ভেনগাড়ির চালক কে নিয়ে এক্সিডেন্টের সেই জায়গায় গিয়ে ফিরোজের রিক্সা নিয়ে একটা গ্যারাজে গেলো। কাজ শেষ করে কেয়া বলে
“চাচা আমি আসি, অনেক উপকার করেছেন আল্লাহ আপনার ভালো করবেন।”

বলেই কেয়া হাসপাতালে চলে গেলো। কেয়া ধীর পায়ে কেবিনে ঢুকে। ফিরোজ মন খারাপ করে বসে আছে।
” চলুন, আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।
ফিরোজ কিছু না বলে চুপচাপ উঠে দাঁড়ায় ধীরে ধীরে, কেয়া ধরতে গেলে বলে “আমি পারবো নিজে নিজে। কেয়া ফিরোজের কথায় পাত্তা না দিয়ে এক হাত ধরে ফিরোজের। ফিরোজ একটু কুঁরিয়ে কুঁরিয়ে হাঁটে।

ল্যামপোস্টের আলোই মুখরিত চারিপাশ, রাস্তার পাশে হাঁটছে দুজন।

“আমি আর হাঁটতে পারছিনা কেয়া”
“আচ্ছা কিছুক্ষণ বসুন এখানে, এতো রাতে গাড়ি পাওয়া যাবেনা।”
” টাকা সব শেষ, রিক্সাটাও ভেঙ্গে গেলো।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ফিরোজ।
“চিন্তা করবেননা, আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।”
ফিরোজ কেয়ার দিকে তাকায়, আজকে চশমা নেই কেয়ার চোখে, স্পষ্ট চোখদুটো দেখা যাচ্ছে কেয়ার তবে কেমন জানি ফুলে ফুলে আছে চক্ষুদ্বয়। ফিরোজ খুব করে বুঝতে পেরেছে কেয় কান্না করেছে। আর মনে মনে ভাবছে, “মেয়েটা কি আমার জন্যই কান্না করেছে?”
“তুমি হুইলচেয়ার কিনেছো?” ফিরোজের এমন কথায় কেয়া মুখ কালো করে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“কিছুতো বলো।”
“আসলে অর্ধেক টাকা আপনার চিকিৎসা ঔষুধে লেগে গিয়েছে আর বাকি টাকা আপনার রিক্সা ঠিক করতে দিয়ে আসছি।” কেয়া একটু থেমে থেমে কথাগুলো বলছে, আর চোখে অশ্রু চিকচিক করছে দুজনের
“কেয়া এমনটা কেন করলে, আমার জন্য নিজের স্বপ্নের বিসর্জন দিয়ে দিলে?”
” কিছু কথা কিছু অনুভূতি বুঝে নিতে হয়। আর স্বপ্ন..” এইটুকুই বলে কেয়া থেমে যায়।
ফিরোজ বলে “স্বপগুলো ভেঙে গেলো দুজনের, এটাই হয়তো গরীবের নিয়তি।”
কেয়া বলে ” স্বপ্ন ভেঙ্গেছে কি হয়েছে, আমরা তো ভাঙ্গিনি, একবার ভেঙ্গেছে স্বপ্ন, আবার দেখবো, যতবার ভাঙ্গবে ততবারই দেখবো স্বপ্ন, তবুও স্বপ্ন পূরণ করবোই। ফিরোজের চোখে চোখ রেখে বলে কেয়া কথাগুলো
ফিরোজ মুচকি হেঁসে বলে “গরীবের জীবনটা অন্যরকম,, গরিবের ভালোবাসা প্রকাশ করার নিয়মটাও অন্যরকম”

#সমাপ্ত

গঠনমূলক মন্তব্য করার অনুরোধ রইলো।।
[[ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি ]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here