ভালোবাসা #সূচনা_পর্ব

0
517

#ভালোবাসা
#সূচনা_পর্ব
#ফারজানা_আক্তার

সকালে আযানের ধ্বনিতে কেয়া ঘুম থেকে জেগে যায়। ঘুমঘুম কন্ঠে আল্লাহু আকবার বলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কেয়া। নামায পড়ে চকলেটগুলো ব্যাগে গুছিয়ে নেই। তারপর মা আর ছোট দুই বোন কে ডাকে।

“আম্মু উঠে যাও ঘুম থেকে, বেলা হয়েছে। এই ফুল, পাপড়ি তোরাও উঠ”

তারপর কেয়া চা করে নেয়। মা আর ছোট জমজ দুই বোন ফুল আর পাপড়িকে নিয়ে রং চা খায় মুড়ি দিয়ে।

ফুল বেশ মন খারাপ করে বলে “আপু প্রতিদিন মুড়ি দিয়ে ভালো লাগেনা, বিস্কিট খেতে ইচ্ছে করে।”

পাপড়িও কিছুটা মনমরা হয়ে বলে “আপু রং চা খেতে খেতে অসহ্য লাগে এখন। সবাই তো দুধ চা খায়, আমাদেরও দুধ চা খেতে মন চাই।”

কথাগুলো শুনে কেয়ার হৃদপিণ্ড টা যেন ছিড়ে যাচ্ছে এমন ব্যাথা অনুভব করছে। সে দ্রুত সেখান থেকে উঠে ব্যাগ হাতে নেয় চলে যাওয়ার জন্য। মায়ের চোখে জল টলমল করছে। অশ্রুসিক্ত চোখে মা বলেন “মা কেয়া এদিকে আয়, তারপর কেয়ার কপালে চুমু খেলো।”

কেয়া উঠে চলে যেতে নিলে মা আবার ডাকে “মা আমার ঔষুধ শেষ।”

কেয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা হাসির রেখা টেনে বলে “চিন্তা করো না মা, নিয়ে আসবো। ফুল পাপরি তোরা খেয়াল রাখিস মায়ের।”

কেয়া বেড়িয়ে পরলো। কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছেই এক বস্তিতে ভাঙ্গাজোড়া এক রুমের একটা ঘরে বসবাস করে মা বোনকে নিয়ে কেয়া। এখন সে রেলস্টেশনেই যাচ্ছে সেখানে বিভিন্ন ট্রেনে ট্রেনে উঠে যাত্রীদের হাতে চকলেট আর একটা চিরকুট ধরিয়ে দেয়, চিরকুটে লেখা থাকে “আসসালামু আলাইকুম,, আমি ঘরের বড় মেয়ে, মা আর ছোট দুই বোনকে নিয়ে আমার ছোট্ট সংসার। মা অসুস্থ প্যারালাইসেস, ছোট বোনদের পড়ালেখা, সংসার সামলানো, সব আমাকেই দেখতে হয়। তাই ভিক্ষা না করে চকলেট বিক্রি করে ২/৪টাকা চাই আপনাদের কাছে, দয়া করে কেউ ফিরিয়ে দিবেননা।”

দ্রুত পায়ে হাঁটছে কেয়া আর ভাবছে ” জীবনটা কেন এতো অভাবের, বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো একটু অন্যরকম হতো জীবনটা। দেখি আজকে কয়টাকার চকলেট বিক্রি করতে পারি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কেয়া।

যাওয়ার পথেই দেখা হয় রিকশাওয়ালা ফিরোজ ভাইয়ের সাথে। ফিরোজ ভাই মানুষটা কেয়াকে ভীষণ ভালোবাসে যদিও কেয়া সেটা জানেনা। কেয়াও মোটামুটি পছন্দ করে ফিরোজ ভাইকে, তবে সেটা নিয়ে কেয়া কখনোই ভাবেনা। কেয়া সম্পূর্ণ খাস পর্দা করে, ফিরোজ কখনো কেয়ার চোখ পর্যন্ত দেখেনি তবুও পরিবারের প্রতি কেয়ার দায়িত্ব ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ ফিরোজ।

ফিরোজ হঠাৎ পেঁছন থেকে কেয়াকে বলে উঠে “আরে কেয়া যে, এতো দ্রুত গতিতে কোথায় যাও?”

কেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে “আর কোথায়, যেখানে গেলে ভাত জোগার হবে, পেট চলবে কমলাপুর রেলস্টেশনে।

ফিরোজ কিছুটা মন খারাপ করে বলে “আচ্ছা রিকশায় উঠো, আমি পোঁছে দিচ্ছি”

কেয়া কিছুটা ইতস্তত বোধ করে, হাঁটা শুরু করে বলে “তার প্রয়োজন নেই। মাত্র ৫মিনিটের পথ।”

এটা বলই কেয়া চলে যাচ্ছে, ফিরোজ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে। “এই মেয়েটা কিভাবে পারে এতো দায়িত্ব আর কষ্ট নিয়ে সারাক্ষণ হাসিমুখে থাকতে। এই কারণেই হয়তো মেয়েটাকে এতো ভালোবাসি।” ফিরোজ কেয়ার চেহারা না দেখেই বুঝে যায় পর্দার আঁড়ালে কথা য়া হয়তো ঠিকই হাঁসে। এমন সময় একজন আধবয়সী পুরুষ এসে ফিরোজকে বলে “এই রিকশা যাবে?”

ফিরোজ হাঁসি মুখেই বলে “জি চাচা বসুন।”
ফিরোজ যাচ্ছে তার গন্তব্যে

কেয়া রেলস্টেশনে এসে চারিদিকে চোখ বুলায়। একটা ট্রেন ছাড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে, যাত্রী ভরপুর। কেয়া মুচকি হেঁসে ট্রেনে উঠে যাত্রীর হাতে হাতে ২টা ২টা করে চকলেট ধরিয়ে দেয় আর চিরকুট টা দেয়, আবার একজন একজন করে সবার থেকে টাকা আর চিরকুট গুলো নিয়ে নেই। ট্রেন ছেড়ে দিবে, কেয়া দ্রুত নেমে যায়।

এভাবে সারাদিন বিভিন্ন ট্রেনে উঠে চকলেট বিক্রি করে নেমে যায়। আজকে আর দুপুরে ভাত খেতে গেলোনা, প্রচুর ক্লান্ত লাগছে। তাই স্টেশনে বসে পরলো।

ফিরোজ এক যাত্রী নিয়ে স্টেশনে আসলো,
যাত্রী ফিরোজ কে ৫০টাকা দিয়ে বলে “২০টাকা রেখে বাকি ৩০টাকা দাও।

ফিরোজ খুব অসহায় কন্ঠে বলে “কি যে বলেন, এতো দূর থেকে আনছি আপনারে ২০টাকা দিয়ে কি চলবো?”

যাত্রী অহংকারী কন্ঠে উচ্চস্বরে বলে ” বেশি বাড়াবাড়ি না করে টাকা দে। যত্তসব ভিখারির দল”

ফিরোজ চুপচাপ কথা না বাড়িয়ে টাকা দিয়ে দেয় মুখটা শুকনো করে।

এমন সময় কেয়া এসে যাত্রী কে কর্কশ কন্ঠে বলে “ভাইয়া ভিখারি উনি নয় প্রকৃত ভিখারি তো আপনি। উনি একজন খেটে খাওয়া মানুষ। আর এতোই যখন ভিখারিদের ঘৃণা করেন তবে ভিখারিদের ভাঙ্গা রিক্সায় না চড়ে বড়সড় একটা গাড়ি কিনে নিতেও তো পারেন। মানুষকে মানুষের চোখে দেখতে শিখুন, রাব্বুল আলামিন আপনার ভালো করবেন।

যাত্রী রেগেমেগে বলে “কে তুমি?

কেয়া “আমি যেই হয়না কেন, আপনি বলুন আপনি একজন খেটে খাওয়া মানুষের রিকশা করে নিজের গন্তব্য পর্যন্ত এসে তাকে তার ন্যায্যমূল্য না দিয়ে ভিখারির মতো হাত পাতছেন কেন? লজ্জা করেনা আপনার? আপনাদের মতো অমানুষদের জন্যই গরীব খেটে খাওয়া মানুষরা দু’বেলা চারটা ভাত পাইনা খেতে, আর আপনারা খান সকাল সন্ধ্যা দামি দামি হাজারটা খাবার। আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু আপনাদের মতো নিকৃষ্ট নয়।

যাত্রী কিছু না বলে ফিরোজ কে তার ন্যায্যমূল্য দিয়ে চুপচাপ চলে গেলো। হয়তো খুব লজ্জিত হয়েছে নিজের বাজে ব্যবহারের জন্য।

ফিরোজ কিছুটা মন খারাপ করে, চোখ থেকে দুফোটা জল গড়ায় পরে তবুও কিছুটা হাঁসার চেষ্টা করে কেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে “আজ দুপুরে খেতে যাওনি যে?”
আজকে থেকে দুপুরে যাবোনা, কয়েকমাস পর ঈদ আর এই ঈদে আমি আম্মাকে একটা হুইলচেয়ার উপহার দিতে চাই, আজ দু’বছর আম্মা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেনা, খুব কষ্ট হয় আমার। এই বলে কেয়া একটা টুলে বসে আর খুব সাবধানে পর্দা ঠিক রেখে একটা বিস্কুট খেয়ে পানি খাই, পাশে ফিরোজ দাঁড়িয়ে

“আপনিও কি আমার মতো বিস্কুট খাবেন নাকি বাড়িতে যাবেন?”

“না আমিও যাবোনা। কে আছে এখানে? মা আর বোন থাকে গ্রামের বাড়িতে।”

ধরেন বিস্কুট খান। এটা বলে ১০টাকা দামের বিস্কিটের পেকেটটা ধরিয়ে দিলো ফিরোজের হাতে, মনে মনে ভাবছে “থাক ফুল পাপড়ির জন্য কালকে নিয়ে যাবো বিস্কুট।”

এভাবে কেটে গেলো সারাদিন। রাতে ৯টার দিকে কেয়া বাড়ি যাচ্ছে মায়ের ঔষুধ আর বোনদের জন্য চা খাওয়ার দুধ নিয়ে। এমন সময় দেখে ফিরোজ একটা শপিংমলের সামনে দারোয়ান এর বেশে দাঁড়িয়ে আছে। কেয়া একটু অবাক হলো।

“আরে ফিরোজ ভাই না?”

“ফিরোজ কেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল হুম, কিন্তু তুমি এতো রাতে এখানে।”

“আমি এখানে একটা টেইলারি দোকানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ২ঘন্টা করে কাজ করি।”

“আচ্ছা, কি কাজ?”

“এইতো ব্লাউজ, জামা এসবের হাতের কাজ টা করি আর কি। আম্মাকে হুইলচেয়ারে বসা দেখার স্বপ্ন টা যে পূরণ করতেই হবে। আমারটা বাদ দিন, আপনি বলুন এখানে কি?”

“দারোয়ানের কাজ নিয়েছি। ছোট বোনটাকে ওয়াদা করেছি এবারের ঈদে ওকে একটা সাইকেল কিনে দিবো। আসলে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে স্কুলটা একটু দূরে, হেঁটেই যেতে হয় বোনটাকে। তাই একটা সাইকেলের খুব প্রয়োজন ওর।”

“তো ঘুমান কখন?”

“আমার আর ঘুম, বিকালের দিকে একটুখানি করে ঘুমায়। রাতেও একটু একটু করে ঘুমানো হয়।”

“আমাদের গরীবের জীবনটাই এমন। চিনি ছাড়া চায়ের মতো।”

“হুম। কখনো কালো মেঘে ঢাকা আর কখনো ঝড়বৃষ্টি ”

“আচ্ছা আমি আসি তাহলে। মহান আল্লাহ তায়া’লা ভালো রাখুক আপনাকে আর আপনার মা বোন কে”

ফিরোজ শপিং মলের সামনে এদিক থেকে ওদিক হাটাহাটি করছে। কেয়া যাওয়ার পর ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে কিন্তু নিজেকে নিজেই বলে “না, পুরুষদের কাঁদতে নেই, কথাটা বলতে গলা ধরে আসছে ওর।”

কেয়া একটু যেতেই কিছু বখাটে ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে একটু পাশ হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে হাঁটতে লাগলো, রাস্তায় বখাটে ছেলেগুলো ছাড়া আর কেউ নেই।তাদের মধ্যে একটা ছেলে বলে-
“হেই সুন্দরী এক রাতের কত নিবে”
কেয়া কিছু না বলে হাঁটতে লাগলো, চোখে মুখে প্রচুর ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফোটে উঠেছে, তারা চারজন দৌড়ে গিয়ে কেয়াকে ঘিরে ধরেছে, ভয়ে হাত পা কাঁপছে কেয়ার
তাদের মধ্যে আরেকটা ছেলে বলল
“আমরা চারজন আছি, এক হাজার করে দিলে চার রাতে চার হাজার পাবে, বলেই তারা হাসতে লাগলো।”
কেয়া কোনোমতে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে দৌড় দিলো। তারা কেয়ার পিঁছনে যেতে চেয়েও যায়নি আবার কেননা কেয়া অন্ধকারের সাথে মিশে গিয়েছিলো ওইদিকে কোনো বাত্বি না থাকায়।

কেয়া ঘরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পরলো, মা আর বোন ভাত খেতে ডাকলেও উঠেনা। মা আর বোনেরা ছোট্ট একটা খাটে থাকে আর কেয়া অন্যপাশে একটা শীতলপাটি বিছিয়ে থাকে।

মা ভাবতে লাগলো “জানেন কেয়ার বাবা আজ কয়দিন মেয়েটা দুপুরে ভাত খেতে আসেনা, রাতেও দেড়িতে আসে, আর আজতো না খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছে, আর কত করবে আমাদের জন্য মেয়েটা, ওরও তো একটা জীবন আছে।” এসব বলে কাঁদতে লাগলো খুব, কিন্তু পাশে ছোট মেয়ে দুটা শুয়ে থাকায় শব্দ করে কাঁদতে পারছেনা, বোবা কান্নায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

মাঝরাত, কেয়ার চোখে ঘুম নেই, কান্না আসছে খুব তার, অঝোরে কাঁদতে লাগলো বালিশে মুখ ডুবিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বাহিরে চলে যায় আর খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজে নিজে বলে “কেন গরীব ঘরে জন্ম হলো আমার? কেন বাবা হারা হলাম আমি? কেন অন্য সব মেয়েদের মতো বাঁচতে পারিনা আমি? কেন মানুষের কাছে বাজে কথাগুলো শুনতে হয় প্রতিনিয়ত, কেন মানুষ আমার শরীর নিয়ে বাজে কথা বলবে কেন কেন কেন? আমি গরীব বলে??? কাঁদো কাঁদো কন্ঠে অম্বরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিৎকার করে বলে কেয়া।
এভাবে অনেকক্ষণ কান্না করে কেয়া।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

[[ভুল গুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি ]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here