THE_BOOK #পর্ব_৬

0
226

#THE_BOOK

#পর্ব_৬

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

অভিনবকে রুমের মধ্যে রেখে ওরা তিনজনই বাইরে বেরিয়ে আসলো। পূর্ণাশা আর লাবন্যর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। অভিনবের এরকম অবস্থা দেখে সবাই চিন্তিত। কারণ যেই অভিনব ওদের সাথে একদিন কথা না বলে থাকতে পারে না। হাজার ঝগড়া হলেও আগ বাড়িয়ে ওই এসে কথা বলে আজ সেই অভিনব ওদের গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা বোধ করছে না। রা’দের চোখমুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। যেকোন সময়ই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়বে। পূর্ণাশার গাল লাল হয়ে গেছে।তিন আঙুলের ছাপ উঠে গেছে ওর গালে।
লাবন্য ধরা গলায় বলল,”অভিনব এতো ভায়োলেন্স হয়ে যাচ্ছে কেন?? ওকে দেখে মনে হচ্ছে কোন এক হিংস্র পশু। ওই জলপরীটা ওর ব্রেন ওয়াশ করে দিয়েছে।”

পূর্ণাশা গালে হাত দিয়ে বলল,”আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না যে অভিনব আমাকে থাপ্পর মেরেছে। রা’দ এবার কি হবে?? আমরা যে বড় ধরনের জালে ফেসে গেছি। তাহলে কি আমাদের ও মরতে হবে ওই বইটা পড়ার জন্য??বাকি পাঁচজনের মতোই কি আমরা ও মারা যাব??”
রা’দ কিছুটা চিৎকার করে বলল,”জানি না আমি কিচ্ছু জানি না। এখন আমাদের কি করা উচিত তাও জানি না। তবে অভিনবকে বাঁচাতে হবে। কোনমতেই ওকে সমুদ্রে ছাড়াটা ঠিক হবে না।”
“তাহলে যেকরেই হোক ওকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে।”
লাবন্য বলল,”রা’দ এই বইটার একটা ব্যবস্থা কর। দরকার পড়লে আবার ইংল্যান্ডে গিয়ে ওই কবরেই বইটা রেখে আয়। না হলে আমরা সবাই মারা পড়ব।”
বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো লাবন্য।
পূর্ণাশার ও একই অবস্থা। তিনজনেই চুপ করে আছে। তখনই দেখলো রুমে থেকে অভিনব বেরিয়ে এসেছে। সবাই চমকে তাকালো অভিনবের দিকে। হাত পায়ের বাঁধন খুললোই বা কি করে??এতোটা শক্তি ও পেলো কোথায়??অভিনব সমুদ্রের দিকে দৌড় মারলো। ওর পিছু পিছু রা’দ পূর্ণাশা আর লাবন্য ও দৌড়ে যায়। রা’দ দ্রুত গিয়ে অভিনবকে টেনে ধরে সাথে লাবন্য আর পূর্ণাশাও। কিন্তু এবার ওরা কেউ অভিনবের সাথে পেরে উঠছে না। এতোটাই শক্তি অভিনবের গায়ে যে ওরা তিনজন ধরে থাকা সত্ত্বেও সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে অভিনব। পানির কাছে আসতেই জলকন্যা মাথা উপরে তুলে মিষ্টি হাসি সমেত তাকালো।অভিনবের মুখেও হাসি ফুটলো। সবাই অবাক হয়ে জলপরীকে দেখছে। অসম্ভব সুন্দর মেয়েটা,না ভয়ংকর সুন্দর। যার কারণে অভিনব এতো ভায়োলেন্স হয়েছে। জলকন্যা হাত বাড়িয়ে বলল,”এসো প্রিয় তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি যে।”

জলপরী কে দেখে অভিনব কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়। সামনে এগোতে নিলেই রা’দ পূর্ণাশা লাবন্য আরো চেপে ধরে অভিনবকে।অভিনব চেঁচিয়ে বলল,”তোরা ছাড় আমাকে। আমাকে যেতে দে।”
পূর্ণাশা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,”না অভিনব তুই যাস না আমরা তোকে হারাতে চাই না।”

লাবন্য অভিনবের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,”ওই জলপরী তোকে ভালোবাসে না অভিনব। ও তোকে মেরে ফেলবে। আমরা তোকে হারাতে পারব না। প্লিজ অভিনব।”

ওদের কথা অভিনবের কান অবধি পৌঁছালো না। সে তার প্রেয়সির কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। রা’দ চেঁচিয়ে জলকন্যাকে বলল, “কেনো তুমি এরকম করছো?? অভিনবকে মেরে তোমার কি লাভ?? আমাদের পেছনে কেন পড়েছো??”

রা’দের কথা শুনে জলপরী হাসতে লাগলো।আর অভিনব মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। জলপরী হঠাৎ হাসি থামিয়ে দিলো। সাথে সাথেই চোখে মুখে রাগ এসে ভর করলো।সূর্যের আলোয় যেন ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। জলপরী বলল,”আমি তোমাদের পিছনে পড়িনি বরং তোমরাই আমাকে স্বেচ্ছায় ডেকে এনেছো। আমার উপর যে অভিশাপ পড়েছে সেই অভিশাপ তোমাদের উপরেও পড়তে চলেছে। হয় আমাকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করে নিজেরা মুক্ত হও আর না হয় তোমাদের বন্ধুকে আমাকে দিয়ে দাও।”
রা’দ চেঁচিয়ে বলল,”কখনো না। অভিনবকে তুমি কখনোই পাবে না। আমরা তা হতে দেব না।”
রা’দের কথা শুনে জলপরী গগণ কাঁপানো হাসি হাসলো বলল,”আমি স্বেচ্ছায় তোমাদের বন্ধুকে নিয়ে যাব না। বরং সে নিজের ইচ্ছায় আমার কাছে আসবে নয়তো পাগল হয়ে ধীরে ধীরে মরে যাবে‌। আমাকে কাছে না পাওয়ার বেদনা ওকে মৃত্যু দেবে। সেই মৃত্যু যন্ত্রনা সইতে না পেরে ও হাজার বাধন ভেঙে আমার কাছেই ফিরে আসবে। এক মৃত্যু পুরি থেকে আরেক মৃত্যু পুরিতে।”
জলপরী আবার হাসলো। তারপর অভিনবের দিকে তাকিয়ে বলল,”কি হলো এসো প্রিয়।”

অভিনব সব ভুলে আবার এগিয়ে যেতে লাগলো। আবার নিজের শক্তি প্রয়োগ করছে অভিনব। লাবন্য আর পূর্ণাশা মিলে চেঁচাতে লাগলো। আশেপাশের কিছু মানুষ দৌড়ে আসতেই জলপরী টুপ করে ডুব দিলো। লোকজনের সাহায্যে অভিনবকে নিয়ে ওরা কক্সবাজার পৌঁছায়। সেখান থেকে একটা হসপিটালে এডমিট করে অভিনবকে।আপাতত ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে অভিনবকে। করিডোরের বাইরে রা’দ পূর্ণাশা আর লাবন্য দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ পরিমাণ চিন্তা ওদের মাথায়। না জানি এরপর কি হবে ওদের সাথে।লাবন্য রা’দকে বলল,”আমাদের তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরতে হবে রা’দ তুই অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা কর। আমরা এভাবেই অভিনবকে ঢাকায় নিয়ে যাব। এখানে থাকলে ও বারবার সমুদ্রে যাওয়ার চেষ্টা করবে।”

রা’দ বলল,”তোর কি মনে হয় এরপরেও অভিনব জলপরীর কথা ভুলবে?? তাছাড়া জলপরী তো পানিতেই থাকে আর ঢাকায় কি নদ-নদী কম আছে??ওই জলপরী কি বলে গেল শুনিসনি??অভিনব ওর কাছে যেতে না পারলে পাগল হয়ে যাবে।”

“তবুও ওখানে আমাদের অনেক চেনা জানা মানুষ আছে কিছু একপা ব্যবস্থা করা যাবে।”

রা’দ আর কথা বাড়ালো না তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে অভিনবকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে এবং একটা হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেয়। কিন্তু দিন যতোই পার হচ্ছে অভিনবের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চোখের নিচে কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। বারবার পানির কাছে যেতে চাইছে। কক্সবাজার থেকে আসার পরই অভিনব হসপিটালে এখন পর্যন্ত বাড়িতে ফেরেনি।অভিনবের মা এসে ছেলের অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। পূর্ণাশা আর লাবন্য ওনাকে নানাভাবে বুজ দেয়। কিন্তু উনি সবকিছু মানতে নারাজ। অভিনব এখন পাগলপ্রায়। ওর হাতে পায়ে শিকল পরানো থাকে সবসময়। এর আগে ঘুমের ইনজেকশন দিতো কিন্তু তাতে লাভ হতো না তাই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। অভিনবের মা সবসময় হসপিটালে থাকে। ছেলের চিন্তায় উনি নিজেও শেষ হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন নিয়ম করে রা’দ পূর্ণাশা আর লাবন্য অভিনবের সাথে দেখা করতে আসে। আজকেও এসেছে। ডক্টরের সাথে কথা বলে অভিনবের কেবিনে ঢুকলো তিনজন। বেডে শুয়ে রয়েছে অভিনব । হাত পা বেডের সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা। চুলগুলো উস্কো খুস্কো হয়ে গেছে। মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে।অভিনবের এরকম অবস্থা দেখে ওরা আর চোখের পানি আটকাতে পারলো না। রা’দ চোখের পানি মুছে অভিনবের মাথায় হাত রাখলো। সাথে সাথে অভিনব চোখ মেলে তাকালো। ওদের দেখেই লাফ দিয়ে উঠে বসে রা’দের হাত ধরে মিনতি করে বলল,”আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল রা’দ। আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে এভাবে থাকলে আমি মরে যাবো। আমাকে ওই মেয়েটার কাছে নিয়ে চল না??”

রা’দ দুহাতে অভিনবকে জড়িয়ে ধরলো।পূর্ণাশা আর লাবন্য এসে অভিনবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। পূর্ণাশা কাঁদতে কাঁদতে বলল,”কিছু একটা কর রা’দ আমি অভিনবকে এভাবে দেখতে পারছি না। চোখের সামনে এভাবে বন্ধুর মৃত্যু কিভাবে দেখব??”

পূর্ণাশা জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। লাবন্য বলল,”অভিনব ঠিক হয়ে গেলে আমরা আর এই কাজ করবো না ছেড়ে দেব। তবুও যেন অভিনব ঠিক হয়ে যায়।”

রা’দ কি বলবে কিছু বলতে পারছে না।অভিনব বারবার ওদের কাছে আকুতি মিনতি করছে যেন ওকে এখান থেকে নিয়ে যায়। ওরা অভিনবের কথা উপেক্ষা করেই কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। অভিনব চিৎকার করে ওদের ডাকছে। বাইরে এসে রা’দ রাস্তার পাশে ঘাসের উপর বসে পড়ল। নিজেকে আজ খুব অসহায় লাগছে। এখন মনে হচ্ছে কেন যে ওরা ইংল্যান্ড গিয়ে ওই বইটা আনতে গেল??

লাবন্য হাঁটু মুড়ে রা’দের পাশে বসে বলল, “আমাদের অভিনবকে বাঁচাতে হবে। তুই কিছু কর।”

রা’দ মাথার চুল টেনে ধরে বলল,”কি করব আমি?? আমার মাথায় কিছু আসছে না। কি করলে ওই জলপরীর চিন্তা অভিনবের মাথা থেকে বের হবে??”

পূর্ণাশা রা’দের অপর পাশে বসে বলল, “সবকিছুর মূলে ওই বইটা। তাই বইটাকে আগের স্থানে রেখে এলেই সব সমস্যার সমাধান হবে বোধহয়। রা’দ তুই বইটা ওই কবরস্থানে রেখে আয়। আমরা অভিনবের খেয়াল রাখবো।”
রা’দ সন্দেহের চোখে পূর্ণাশার দিকে তাকিয়ে বলল,”এতে যদি কাজ না হয়??”

“জানি না কি হবে?? তবে ওই বইয়ের হাত থেকে তো মুক্তি পাবো।”

“বইটা তো অভিনবের ফ্ল্যাটে।”

“চল তাহলে আমরা যাই।”

অভিনবের মায়ের থেকে চাবি নিয়ে ওরা তিনজনই অভিনবের ফ্ল্যাটে গেল। পুরো ফ্ল্যাট তন্নতন্ন করে খুঁজেও বইটা পেল না। হঠাৎ করে বইটা কোথায় গেল??লাবন্য বলল,”অভিনব বইটা ফেলে দিলো না তো??”

রা’দ বলল,”সেটা কিভাবে সম্ভব??বইটা পড়ার পরদিন তো আমরা চট্টগ্রাম চলে গেলাম।”

পূর্ণাশা বলল,”হয়তো ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলো পরেরদিন। অভিনবকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে??”

“ও এখন সেই সেন্সে নেই। আমরা আরেকটু খুঁজে দেখি পাই কি না??হয়তো কোন খানে রেখে দিয়েছে।”

তিনজনে আবার খুঁজতে লাগলো। বেডরুম বাথরুম কিচেন কোনটাই বাদ রাখলো না। হঠাৎ কি যেন মনে করে পূর্ণাশা ময়লার ঝুড়িতে উঁকি মারলো। অভিনব বইটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে রেখেছে। পূর্ণাশা বইটা হাতে নিয়ে বলল,”রা’দ লাবন্য বইটা পাওয়া গেছে।”

সাথে সাথে লাবন্য আর রা’দ ছুটে আসলো।পূর্ণাশা রা’দের হাতে বইটা দিয়ে বলল,”দ্রুত টিকিট বুক কর। এই বইটাকে আমার এক মুহুর্তের জন্য সহ্য হচ্ছে না।”

“হুম,চল এখন যাওয়া যাক।”

লাবন্য কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,”অভিনব বাঁচবে তো??”
লাবন্যর এই উক্তিটি সবাইকে আবারও ভেঙে চুরমার করে দিলো। বুক ফেটে কান্না আসছে ওদের। চোখের সামনে চার বন্ধুর কাটানো মুহূর্তগুলো ভেসে উঠলো। চারজনের একসাথে ঘুরতে যাওয়া,মজা করা,হন্টেড প্লেসে গিয়ে ইনভেস্টিগেশন করা। হইহই করে একে অন্যের বাড়িতে আড্ডা দেওয়া। এসবের মধ্যে তো ভালোই দিন কাটছিলো ওদের।

কিন্তু হঠাৎ এক ঝড় এসে সবকিছু ওলট পালট করে দিলো। ঝড়টা এতোটাই শক্তিশালী যে তার সাথে পেরে ওঠা যাচ্ছে না।এই ঝড় ওদের মধ্যে থেকে একজনকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে। কিন্তু ওরা ওদের বন্ধুকে ছাড়তে নারাজ।
এখন ওরা পড়েছে বিপদে। না পারছে এই ঝড়ের মধ্যে থাকতে আর না পারছে এই ঝড়ের মোকাবেলা করতে।

রা’দ দরজায় হেলান দিয়ে বসে পড়লো।লাবন্য ও মেঝেতে বসে পড়লো। লাবন্য বলল, “আমাকে প্রিতম বাবা মা অনেকবার বলেছিল এই চাকরি ছেড়ে দিতে কিন্তু আমি ছাড়িনি।এটাই আমাদের উপর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।উফফফ ভগবান,,,,”

পূর্ণাশা লাবন্যর কাঁধে হাত রেখে বলল, “অভিনবকে সুস্থ করতে পারলে আমরা কেউ এই চাকরিতে থাকব না। এতে যা হয় হবে আমরা এর মধ্যে নেই। শুধু অভিনবকে চাই আমরা ব্যস।”

রা’দ চুপ করে ওদের কথা শুনতেছে। ওর কথা বলতে ভালো লাগছে না। এই মুহূর্তে অভিনবকে খুব মিস করছে। কিন্তু অভিনব নেই ওকে এখানে আনার কোন পথ ও নেই।
বইটার দিকে তাকিয়ে বড় একটা শ্বাস ফেললো।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here