শিমুল_ফুল #পর্ব_০৬,০৭

0
675

#শিমুল_ফুল
#পর্ব_০৬,০৭
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
০৬

শিমুল পুষ্পর হাত ধরে বাঁশ জাড়ের আড়ালে গিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়ে।পুষ্প খুব ভয়ে কেঁদে দেয়,
“আব্বা জানতে পারলে মেরে ফেলবে শিমুল ভাই।”

শিমুলের বুকেও টিপটিপ করছে।প্রিয় মানুষকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা আছে কিন্তু এভাবে রাতের আধারে ধরা খেয়ে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা নেই।পুষ্পর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,”চুপ।”

দুইজন পুরুষ টর্চ লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে আসে।লাইটের আলোয় দেখে বাঁশের জার থেকে ঘেউঘেউ করে দুইটা কুকুর বেড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।বয়ষ্কমতোন লোকটা বলে,
“আরে,দেখ দেখ এটা কুত্তা।”

অন্যজন সন্দেহে কপাল কুচকে লাইট এপাশে ওপাশে মারে।কাউকে দেখতে না পেয়ে বলে,
“সালার কুত্তা দাড়াই আছে!আর আমি কিনা ভাবলাম ঘুঘু পাখি ফাদে ফালামো”

বয়ষ্ক লোকটা বললো,
“তুই হারামজাদা,কুত্তার প্রেম পিরিতে ডিস্টাব করলি।”

দুজনেই কথা বলতে বলতে চলে যায়।পুষ্প বুকে থু থু ছিটিয়ে শিমুলের দিকে তাকায়।
শিমুল তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
“ভয় পেয়েছিলি?”

“খুব।”

শিমুল হেসে বললো,
“ভয়ের কি আছে?দেখলে বিয়ে পড়িয়ে দিতো।”

পুষ্প ভড়কে চোখ খোচ করে তাকায়।
“শখ কতো।”

পুষ্পর কথা শুনে শিমুল বললো,
“শখের আবার কি?তোর কপাল খুলে যেতো আমার মতো বর পেলে।”

“লাগবে না।”

“বুঝলে এই কথা বলতি না গাধী।”

পুষ্প তাকিয়ে থাকে কিন্তু কিছু বলেনা।

শিমুল আবার আফসোসের সুরে বললো,
“শেষমেষ কুত্তা বানায় দিলো।কি কপাল!”

পুষ্প হেসে ফেলে।মাথা নেড়ে বললো,
“ভালো হয়েছে।”

“বজ্জাত পিচ্ছি তোর জন্যই এই শিমুলকে কেউ কুত্তা বলার সাহস পেয়েছে।”

পুষ্প অবাক হয়ে বললো,
“আমি কি করলাম!”

“প্রতিদিন দেখা করতে ডাকিস তাই তো আসি।আর আজকে ধরা খাচ্ছিলাম।”

শিমুলের কথা শুনে পুষ্পর ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফাক হয়ে যায়।গলায় অবাক হওয়ার রেশ লাগিয়ে বলে,
“আমি কবে ডাকলাম?”

শিমুল ট্রাউজার থেকে ময়লা ঝেড়ে বললো,
“সামনে যা।আমি তাকিয়ে আছি এক দৌড়ে ঘরে যাবি।”

পুষ্প আবার বলে,
“আমি কবে ডাকলাম।”

শিমুল মাথা নাড়িয়ে হাসে।তারপর সামনে ঝুকে বললো,
“আপনিই তো প্রতিদিন ডাকেন ম্যাডাম।এখন যান আবার কেউ কুত্তা তাড়াতে চলে আসবে।”

পুষ্প শিমুলের কোকড়া চুলের দিলে তাকায় এক ঝাকড়া চুল মাথা ভরে আছে।মাথা নাড়িয়ে হাসলে হাসির সাথে চুল দুলে উঠে।এমন পরিস্থিতিতেও তার ইচ্ছে করে এলোমেলো চুল আরো এলোমেলো করে দিতে।কিন্তু সব ইচ্ছা পুরন করতে মানা,ইচ্ছাটা টুপ করে গিলে ফেললো।
“আর রাতে আসবেন না।”

শিমুল ভ্রু কুচকে বললো,
“কেন?”

“একদিন না একদিন কেউ দেখে ফেলবে।”

শিমুল কিছু একটা ভাবে।
“সেটা পড়ে দেখা যাবে।এখন যা।”

পুষ্পর মনমতো হয়নি উত্তরটা।দ্রুত পা ফেলে ঘরে চলে যায়।শিমুল কোন কথাই স্পষ্ট করে বলে না।অথচ পুষ্পর ব্যাকুল মন স্পষ্ট করে সবকিছু শুনতে চায়,জানতে চায় শিমুলের মনের সুপ্ত অনুভূতি।কিন্তু শিমুল তাকে এক সাগর পরিমাণ দ্বিধাদ্বন্দে ফেলে চলে যায়।

শিমুল পুষ্পর যাওয়ার পথে তাকিয়ে হেসে ফেলে।মনে মনে ভাবে “আল্লাহ!আর একটুর জন্য ধরা খাওয়া থেকে বাঁচলাম।”এই পুষ্পটা যদি বুঝতো শিমুল কিসের টানে ছুটে আসে তাহলে আরো কিছুক্ষণ শিমুলকে নিজেই আটকে রাখতো।সে আনমনে ভাবে আর রাতে দেখা করা ঠিক হবেনা,দরকার হলে পুষ্পকে তার কাছে নিয়ে রাখবে।সে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যায়।তার ইচ্ছা নির্বাচনের পরেই তার আব্বাকে পুষ্পর কথা জানাবে।পুষ্পকে দূরে রেখে আর থাকা যাচ্ছে না,মেয়েটা যেন তার শান্তির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর পরে শিমুল আর রাতে দেখা করতে আসেনি।কলেজে যাওয়ার পথে একটু চোখের দেখা এইটুকুই।দুজনের কথা হয়না অথচ চোখে চোখে যেন কথার ছড়াছড়ি।পুষ্প আড়চোখে যখন শিমুলকে দেখে শিমুলও তখন পাগলের মতো তাকে দেখে।পুষ্পর মুখে ফুটে উঠে লাজুক হাসি আর শিমুলের মুখে হালকা মুচকি হাসির রেশ।ভালোবাসার কথা বলা হয়নি,কিন্তু দুজনের মুখেই সুখের ছোঁয়া।এভাবেই কেটে যায় কিছুদিন।
এর পরের কয়েক সাপ্তাহ শিমুলের খুবই ব্যস্ততায় কাটে সামনে তার আব্বার নির্বাচন।এই ঝামেলায় প্রতিদিন পুষ্পকে দেখতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।মোবাইলে ছবি দেখেই নিজেকে দমিয়ে রাখছে।একদিন হুট করে রাস্তায় আটকে বললো,

“এই পিচ্ছি দাঁড়া।”

পুষ্প দাঁড়ায়।নির্বাচনের কাজে যে শিমুল খুবই ব্যস্ত এটা জানে।

“তোকে একটা এন্ডোয়েড মোবাইল কিনে দেই?”

পুষ্প মাথা নেড়ে বললো,
“কেন?”

“কথা বলার জন্য।”

“কথা বলবো কেন?”

শিমুল বাইকের আয়না ঠিক করে বলে,
“কেন কথা বলা দরকার তুই জানিস না?”

“না।”

শিমুল হেসে বললো,
“কেন জানিস না।”

পুষ্প চোখ তুলে শিমুলকে দেখে,
“এমনি।”

“আচ্ছা ছোট দেখে একটা বাটন ফোন দিবো।লুকিয়ে রাখতে সহজ হবে।”

পুষ্প মাথা নেড়ে বললো,
“আম্মা খুব চালাক।দেখে ফেলবে।”

“কিভাবে দেখবে?লুকিয়ে রাখবি।”

পুষ্প মাথা নেড়ে বললো,
“সম্ভব না শিমুল ভাই।”

শিমুল মাথা নেড়ে বলল,
“জ্বালা যন্ত্রনার শেষ নেই।”
তারপর আর কিছুক্ষণ কথা বলে দুজনে বাড়ি চলে যায়।

পুষ্পর বাবা মিজান শেখ আজকে দোকানে যায়নি।অবশ্য উনি না গেলেও খুব বেশি একটা সমস্যা হবে না।দুইজন বাবুর্চি চারজন কর্মচারী তার হোটেলে কাজ করে।উনি শুধু ক্যাশে বসে থাকে।আজকে উনার বড় মেয়ে মুন্নী ঢাকা থেকে আসছে। সাথে মুন্নীর জামাই সাজ্জাদ আর মামাতো দেবর সাফিন আসছে।প্রায় এক বছর পরে মেয়ে আসবে বিধায় বাড়িতে যেন বিয়ে বাড়ির আয়োজন করা হয়েছে।পুষ্প খুশীতে বাক-বাকুম হয়ে বোনের জন্য অপেক্ষা করে।মুন্নী আপা মানে তার ভালো আপা।সব আবদারের জায়গা হলো মুন্নী।দশটার দিকে মুন্নীরা আসে।পুষ্প খুবই খুশী হয় মুন্নীকে পেয়ে।দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে সবাই গল্প জমায়।সাফিন পুষ্পকে বলে,
“পুষ্প তোমাদের গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাবে না?”

পুষ্প সাফিনের দিকে তাকায়।সাফিন বোধহয় পুষ্পকে পছন্দ করে,এই যে কথা বলার সময় কতো আগ্রহ দেখায়,কেমন করে যেন তাকায়।মুন্নী বলে,
“কি বলছো সাফিন?দেখাবেনা কেন?পুষ্প বিকালেই নিয়ে যাবি।”
পুষ্প মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়।

বিকালে পুষ্প সাফিনকে সাথে নিয়ে ঘুরতে যায়।পুষ্পের মনে শুধু ঘুরছে,শিমুল যেন না দেখে,শিমুলের চোখে যেন না পড়ে।”

বাড়ি থেকে হাটতে হাটতে দুজন কলেজের রাস্তায় চলে আসে।সাফিন পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বলে,
“পুষ্প তোমার বিশেষ কেউ নেই?”

সাফিন কায়দা করে বয়ফ্রেন্ডের কথা জানতে চাইছে।পুষ্পর শিমুলের কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো,যদিও শিমুল তার বয়ফ্রেন্ড না।কিন্তু সাফিন যদি দুলাভাই আপাকে বলে দেয়,মাথা নাড়িয়ে বললো,
“না।”

সাফিন মুচকি হাসে।দাঁড়িয়ে হেসে বললো,
“তাহলে তো প্লাস পয়েন্ট।”

তখনি শো করে প্রচন্ড গতিতে বাইকটা এসে তাদের থেকে কিছুটা দূরে থামে।শিমুলকে দেখে পুষ্পর বুকটা ভয়ে কেঁপে ওঠে।সাফিনের দিকে তাকিয়ে দেখে সাফিন শিমুলের দিকেই তাকিয়ে আছে।শিমুল ঘাড় ঘুরিয়ে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে আবারো প্রচন্ড গতিতে বাইক স্ট্রাট দেয়।বিকট শব্দ করে চলে যায়।পুষ্প চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নেয়।সাফিন ভ্রু কুচকে বললো,
“পুষ্প লোকটা তোমার পরিচিত নাকি?”

পুষ্প মাথা নেড়ে বললো
“এলাকার ভাই।”

সাফিন সামনে হাটতে হাটতে বললো,
“যেভাবে এসে থামলো আর যে মারাত্মক দৃষ্টি দিয়ে তাকালো মনে হচ্ছে যেন বয়ফ্রেন্ড।”

পুষ্প পারেনা রাগে সাফিনের চুল ছিড়ে ফেলে এই ছেছড়ার জন্যই বিপদে পড়তে হলো।
সাফিন বললো,
“আচ্ছা এসব বাদ দাও,এখন বলো আমাকে তোমার কেমন লাগে?”

পুষ্প কিছু বলার আগে,শিমুলের বাইকটা আবারো প্রচন্ড স্প্রিডে এসে থামে।তিয়াশ পেছন থেকে কিছু একটা বললে শিমুল জোড়ে একটা ধমক দেয়,পুষ্প ভয়ে কেঁপে উঠে।তারপর আবার চলে যায়।

সাফিন বিরক্তিতে মুখ কালো করে বললো,
“বাজে ছেলে নাকি?”

পুষ্প বললো,
“ভাইয়া চলেন বাড়িতে ফিরে যাই।”

বাড়িতে এসে পুষ্প ভয়ে ভয়ে সময় কাটায়,তার কেন জানি মনে হচ্ছে,শিমুল আজকে যেকোনো ভাবেই দেখা করবে।হলোও তাই।সন্ধ্যায় শিলা আসে।সবার সাথে কথা বলে পুষ্পকে একা ডেকে নিয়ে বলে,
“শিমুল ভাই দাঁড়িয়ে আছে।চল”

পুষ্প আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“কোথায়?”

“আমাদের বাড়ির পাশে।”

পুষ্প তার মাকে বলে শিলাদের বাড়ি যাচ্ছে,দুই মিনিটেই চলে আসবে।ধুরুধুরু বুক নিয়ে শিলার সাথে যায়।শিলাদের বাড়ির কাছে গিয়ে দেখে তিয়াশ আর শিমুল দাঁড়িয়ে আছে।পুষ্প গিয়ে শিমুলের কাছে দাঁড়ালে তিয়াশ আর শিলা দূরে চলে যায়।পুষ্প ভয়ে মাথা নিচু করে রাখে,কিন্তু শিমুল চুপ করে আছে দেখে মাথা উঠিয়ে তাকায়।শিমুলের দিকে তাকিয়ে পুষ্পর ভয় হয়,চোখগুলো লাল হয়ে আছে,মুখটা কঠিন করে তাকিয়ে পুষ্পকেই দেখছে।তখন শিমুল বললো,
“ছেলেটা কে?”

“আপুর দেবর।”

“পছন্দ হয়ে গেছে?”

শিমুলের কথায় পুষ্প চমকে বলে,
“না।”

“না কেন?হেসে হেসে তো ঠিকি কথা বলছিলি।”

পুষ্প ভয়ে ভয়ে বললো,
“এমন কিছু না।”

শিমুল একটু জোড়েই ধমকে বলে,
“তাহলে কি হ্যাঁ?কিসের ঘুরাঘুরি?আমারে ভালো লাগেনা?ঢাকাইয়া পেয়ে পটে গেলি।”

শিমুলের ধমকে পুষ্পের চোখ জ্বলে পানি পড়ে।কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“শিমুল ভাই…”

পুষ্পর কথা শেষ হবার আগেই শিমুল বলে,
“আমি দেখা করতে চাইলে সমস্যা,কথা বললে সমস্যা,আমি যা বলি তাই সমস্যা।কিন্তু একদিনের পরিচয়ে ওই ছেলের সাথে কলেজ রোডে চলে গেলি?আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসাহাসি।”

পুষ্প কিছু বলতে গেলে শিমুল তাকে থামিয়ে বলে,
“এক কাজ করি আমি ম,রে যাই তখন যা খুশী তাই করিস।আর আমি তোকে এগুলা বলতেছি কেন?আমি কে?বা*ল।যা সর”

চলবে…

#শিমুল_ফুল
#০৭
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

পুষ্প সেখানে দাঁড়িয়ে শিমুলের চলে যাওয়া দেখে।তারপর নিশ্বব্দে কেঁদে দেয়।তিয়াশ আর শিলা সামনে এগিয়ে আসে।তিয়াশ পুষ্পকে বলে,
“আরে কাঁদিস না।মাথা গরম হয়ে আছে,পরে ঠিক হয়ে যাবে।”

পুষ্প চুপচাপ বাড়িতে চলে আসে।রাতে সাফিন বলে,
“পুষ্প গ্রামের চাঁদের জ্যোৎস্না দেখতে নাকি আলাদা সুন্দর লাগে।চল দেখে আসি।”

পুষ্প মনে মনে মুখ ভেঙ্গচায়,কেন রে ভাই ঢাকায় কি চাঁদ নেই?নাকি চাঁদ উঠে না?গ্রামের চাঁদ দেখতে হবে কেন?তোর জন্য একজন রাগে রাগে লাল মরিচ হয়ে জ্বলেপুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে এখন আবার তোর সাথে জ্যোৎস্না দেখতে গেলে মেরেই ফেলবে,সুতরাং যাওয়া টাওয়া অসম্ভব।মুখে বললো,
“ভাইয়া আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।আপনি আপু ভাইয়াকে নিয়ে যান।”

এটা বলে আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝটপট গিয়ে শুয়ে পড়ে।কিন্তু ঘুমায় না,বিছানায় শুয়ে ছটফট করে,শিমুলের রাগ কিভাবে ভাঙ্গানো যায় এই চিন্তা করে।শিমুল রাগ করে আছে পুষ্পর শান্তি লাগছে না,অনেক ভেবে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পুষ্পর মায়ের রুম থেকে মোবাইলটা চুপি চুপি নিয়ে আসে।পুষ্প রুমে এসে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়ায়,তার ভাবতে অবাক লাগছে শিমুলের জন্য মোবাইল চুরি করে এনেছে!তারপর নোটবুক থেকে শিমুলের নাম্বার টাইপ করে ডায়াল করে,দুরুদুরু বুকে রিসভ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

শিমুল কিছুক্ষণের মাঝেই এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলে।মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে।বেয়াদব মেয়ে।এই মেয়ের জন্য শিমুল বছরের পর বছর অপেক্ষা করছে আর সে কিনা এক দিনের পরিচয়ে ওই ছেলের সাথে হাটতে যায়!কলিজা কাঁপলো না?শিমুল যে এই বয়সেও ওর পিছনে এভাবে ঘুরে এটা কি চোখে পড়ে না?তখনি মোবাইলের স্কিনে পুষ্পর মায়ের নাম্বার ফুটে উঠে।শিমুল খানিক চেয়ে থাকে।রিং হতে হতে কেটে যায়।আবার বেজে উঠে।শিমুল দম ফেলে নিজেকে শান্ত করে মোবাইলটা রিসিভ করে চুপ থাকে।
পুষ্প শিমুলের গলার স্বর শুনতে না পেয়ে নিচু গলায় ফিসফিস করে বললো,
“শিমুল ভাই!প্লিজ কথা বলেন।”

শিমুল কথা বলেনা চুপ করে থাকে।উচ্ছল শিমুলের এমন নিশ্চুপভাবে থাকা পুষ্প মেনে নিতে পারেনা,ডুকরে কেঁদে দেয়।ফুপিয়ে বলে,
“আমার উচিত হয়নি যাওয়া প্লিজ।”

শিমুল হিসহিস করে বললো,
“তাহলে গেলি কেন?”

পুষ্প ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে,
“এখন দেখা করবো।”

পুষ্প কাঁদলে শিমুলের ভালো লাগেনা।বুক জ্বলে।ধমকে বললো,
“কাঁদার কি আছে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতেছিস কেন?”

পুষ্প মাথা নাড়ে।তার এখনি দেখা করতে হবে।মনে হচ্ছে শিমুলের রাগ অভিমান যেন তার গলা চেপে ধরে রেখেছে।কান্না জড়ানো গলায় বললো,
“আমি দেখা করবো।”

শিমুল চুপ করে পুষ্পর ভেজা গলার কথাগুলো শুনে।
“রাত হয়ে গেছে।এখন দেখা টেখা করা সম্ভব না।”

“প্লিজ”

“ওইদিনের মতো কেউ দেখে নিবে।”

পুষ্প ত্যাড়া গলায় বলে,
“দেখলে দেখুক।আমি দেখা করবই।”

শিমুল নির্লিপ্ত গলায় বললো,
“আমি জানি না।”

“আমি হিজল গাছের নিচে যাচ্ছি আপনার মন চাইলে আসেন।”

“আমি আসবো না।”

পুষ্প মাথায় ওরনা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।ফিসফিস করে বলে,
“আমি বের হয়ে গেছি।”

এটা বলে ফোন কেটে দেয়।তারপর গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়।শিমুলের চক্করে পড়ে তার অন্ধকারের ভয় কেটে গেছে।সবারই কি এমন হয় প্রেমে পড়লে সাহস বেড়ে যায়।এই যে নিঝুম রাতের স্তব্ধতাও তাকে ভয় পাওয়াতে পারছেনা,মনটা শিমুল শিমুল জপ করে অস্থির হয়ে আছে।পুষ্পর এখন এতো অশান্তি লাগছে যে মনে হচ্ছে শিমুলকে না দেখলে,তার ভুল না ভাঙ্গালে পুষ্পর মরন হবে।হিজল গাছের নিচে দাঁড়ানোর পরে কয়েকটা পেঁচা শব্দ করে ডানা ঝাপটে উড়ে যায়,পুষ্প ভয়ে কেঁপে ওঠে।মনে মনে ভাবে শিমুল আসবে তো?পুষ্পর মন বলছে শিমুল আসবে।শিমুল যে তার জন্য কতো পাগল এটা পুষ্প বুঝতে পারে।বুঝতে পেরে মনে সুখ সুখ বাতাস বয়।গাছের উপরে নাম না জানা পাখি নড়ে উঠে সাথে ভয়ে নড়ে উঠে পুষ্পর ছোট্ট প্রাণ,মাঠে দলে দলে শিয়াল দৌড়ে যাচ্ছে।পনেরো মিনিট হয়ে গেছে শিমুল আসেনা কেন?তখনি দূরে মোবাইলের স্কিনের আলো পুষ্পর নজরে পড়ে।শিমুল খুব দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে আসে।পুষ্পর সামনে এসে মোবাইল পকেটে রাখে।
পুষ্প ভয়ে ভয়ে শিমুলকে দেখে।কিছু বলেনা।

শিমুল চুপ করে চাদেঁর আলোয় সামনের মাঠে শিয়ালের দৌড়াদৌড়ি দেখে।পুষ্প বুঝতে পারছেনা শিমুল কতটুকু রেগে আছে।আস্তে-ধীরে বললো,
“আর কখনো কোন ছেলের সাথে হাটতে যাবো না।”

পুষ্পর কথা শুনে শিমুলের কোন হেলদোল নেই।অন্ধকারে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখছে।শিমুল পুষ্পর দিকে তাকাচ্ছে না এটা পুষ্পর সহ্য হলো না।ছটফটিয়ে বললো,
“এদিকে তাকান না।”

শিমুল যেন আজকে পণ করেছে তাকাবে না।পুষ্প উতলা হয়ে বলে,
“শিমুল ভাই প্লিজ তাকান।”

শিমুল পুষ্পর দিকে তাকায়।থমথমে গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।তারপর বলে,
“ডেকেছিস কেন?ঢাকাইয়া ছেলে চলে গেছে?”

পুষ্প দু’দিকে মাথা নেড়ে বুঝানোর জন্য বললো,
“সাফিন ভাই ঘুরতে চেয়েছিলো,সবাই বললো তাই গিয়েছিলাম আর কিছু না।”

শিমুলের নাকের পাটাতন ফুলে উঠে,
“তুই কি গাইডের চাকরি নিছিস যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গ্রাম দেখাবি?নাকি শহুরে ছেলে পেয়ে পটে গেছিস?মনে ধরে গেছে?”

পুষ্প ফট করে কানে ধরে বললো,
“এই যে কানে ধরছি শিমুল ভাই,আর কখনো এমন কিছু হবে না।”

পুষ্প থেমে আবার বললো,
“এই যে উঠবস করছি,প্লিজ।”

এটা বলেই পুষ্প ফটাফট তিন চার বার উঠে বসে।
শিমুলের মুখ অভিমানে ছেঁয়ে আছে।পুষ্প শিমুলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই ভিষন সুখ সুখ লাগলো।তার জন্য সামনের মানুষটার বুকের জ্বলন,অন্য কারো সাথে সামান্য হাটাতে চোখে কি রাগ,গলায় সুচালো বর্শার নিক্ষেপ।এই সবকিছু যেন পুষ্পকে বলে দিচ্ছে,”শিমুল তোকে ভীষন ভালোবাসে পুষ্প,তাইতো অন্যকাউকে সহ্য করতে পারে না।”
যেমনটা সুইটিকে দেখে তার জ্বলন অনুভব হয়েছিলো সেই জ্বলন এখন শিমুলের বুকে।পুষ্পর কান্নার দাগ শুকিয়ে পড়া মুখে আলতো মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠে।সেদিন শিমুলের মতো করে পুষ্প বললো,
“জ্বলছে?”

পুষ্পর কথা শুনে শিমুল চোখ কটমটিয়ে বললো,
“আমার জ্বলবে কেন?আমি কে হ্যাঁ?”

পুষ্প শিমুলের অভিমান করা চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে।ছেলেদের অভিমান করার দৃশ্য খুবই চমৎকার।যে না দেখেছে সে কখনো কল্পনাও করতে পারবেনা কতটা সুন্দর!এই মূহুর্তে শিমুলকে তার সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ বলে মনে হচ্ছে।সবার কাছে সুন্দর লাগবে কিনা সেটা জানা নেই,কিন্তু শুনেছে মেয়েরা যার প্রেমে পড়ে,যাকে নিজের প্রেম কলি দিতে চায়,সেই সর্বনাশা প্রেমিক পুরুষ দেখতে যেমনি হোক মেয়েটার চোখে বরাবরই সুন্দর,সুদর্শন,একটু বেশীই সুন্দর।পুষ্প তাকিয়ে থাকে তার প্রেমিক পুরুষের দিকে,হয়তো প্রেমের কথা বলে প্রেমটা শুরু হয়নি কিন্তু দুজনের মন জানে তাদের মনের খবর,যদি নাইবা জানে তাহলে এতো রাগ,অধিকার,অভিমান কই থেকে আসে?দুজন দু’জনকে নিজের একান্ত আপন ভাবে বলেই তো।পুষ্প শিমুলকে আরো রাগিয়ে দিতে বলে,
“আসলেই তো আপনি কে?”

শিমুল রেগে লাল মরিচের গুড়ো আসমান জমিন ছিটিয়ে বললো,
“আমি কে তুই জানিস না?”

পুষ্প শিমুলের মুখ থেকে ভালোবাসার কথাটা বের করতে কায়দা করে মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বললো,
“কখনো কিছু বলেননি।তো কিভাবে জানবো?”

শিমুলের মনে হলো তাইতো।এতো ভালোবাসে কখনো পুষ্পকে বলাই হয়নি।কিন্তু ওই যে পুরুষ হার মানতে নারাজ অন্যজন যেন মনের কথা সব নিখুত ভাবে বুঝতে হবে,
“বলতে হবে কেন?তুই কি খুকি?দেখি নাক টিপলে কিছু পড়ে কিনা?”

শিমুল সত্যি সত্যিই পুষ্পর নাক টিপতে হাত বাড়ায়।পুষ্প এক পা পিছিয়ে বলে,
“পাগল নাকি?”

শিমুল হাত দিয়ে তার কোকড়া চুল নেড়ে দেয়।গলার স্বর আগের থেকে কিছুটা নরম করে বলে,
“সেটাও তুই’ই ভালো জানিস।”

পুষ্প মনে মনে ভাবে আমি সত্যিই জানি শিমুল ভাই।আপনার চোখের দৃষ্টিই বলে দেয় আপনি কতোটা পাগল।পুষ্প ফিক করে হাসে।পুষ্পর হঠাৎ হাসির কারনটা শিমুলের বোধগম্য হয় না।ভ্রু কুচকে বললো,
“ভুতে ধরেছে নাকি?”

পুষ্পের বলতে ইচ্ছে করে,হ্যাঁ ভুতে ধরেছে প্রেমের ভুতে।মাথা নেড়ে বললো,
“রাগ কমেছে শিমুল ভাই?”

শিমুল অবাক হয়ে খেয়াল করলো পুষ্পর সংস্পর্শে এসে তার রাগ কমে গেছে।শুধু রাগ কমেনি মনের মধ্যেও ফুরফুরে বাতাস বইতে শুরু করেছে।
নিচু গলায় বললো,
“হুম।”

“আচ্ছা!এখন তাহলে বাড়ি যাই।”

শিমুল পুষ্পর দিকে তাকায়,
“আমার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য ডেকে এনেছিস?”

“হ্যাঁ ”

“কেন আমি রেগে থাকলে তোর কি?”

পুষ্প মনের কথাই বললো,
“অশান্তি লাগে,নিশ্বাস নিতে পারিনা।”

পুষ্পর এমন সহজ উত্তর শুনে শিমুলের ইচ্ছা করছে পুষ্পর গালে ঠোঁটে টুপ টুপ করে কয়েকটা চুমু খেয়ে ফেলতে।তার প্রেমের অফুটন্ত ফুল আজকে নিজ থেকে কিছু বললো।শিমুল চাইলেই এই বড় হিজল গাছের নিচে পুষ্পর নরম ঠোঁটে নিজের পুরু ঠোঁটে মিশিয়ে দিতে পারে কিন্তু শিমুল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,সবে মাত্র প্রেম কলির উঁকি দিয়েছে,ফুলটা ফুটোক, তাহলেই শিমুল নিজেকে বেশামাল হওয়ার সুযোগ দিবে,অভদ্র হওতার তকমা না হয় তখনি লাগাবে।শিমুলের চায় এই পিচ্ছিই তার খরা লেগে মরে যাওয়া গাছে লাল লাল শিমুল ফুলে ভরিয়ে দিক।পানি ঢেলে সতেজ করে দিক আজন্ম উপোস মনটাকে।শিমুল পুষ্পর দিকে তাকায়,দুজনের চোখে চোখ মিলে যায়।শিমুলের চোখের মাতাল বন্য দৃষ্টি দেখে পুষ্প চোখ বন্ধ করে নেয়,এই দৃষ্টি তার ভেতরটা সুনামির মতো নাড়িয়ে দেয়।সইতে না পেরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“শিমুল ভাই।প্লিজ অন্যদিকে তাকান।”

শিমুল পুষ্পর কাঁপা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে তার নিজের শরীরে ঝিনঝিন করে হরমোনেরা আলোড়ন তুলে।মাথাটা নিচের দিকে করে,ঠোঁট হালকা ফাকা করে একটু তাড়াতাড়ি নিশ্বাস নেয়।নিচের ঠোঁট দাত দিয়ে কামড়ে ধরে চুপ করে ভাবে”একবার ফুল ফুটে যাক পুষ্প আমার আজন্ম উত্তাপে তোকে একদম জ্বালিয়ে ফেলবো।সুখে সুখে কাঁদিয়েই ছাড়বো।”

তারপর পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বলে, “চল,একটু এগিয়ে দেই।”

শিমুলের শরীরের বুনো ঘ্রানে পুষ্পর অন্তর পুড়ে যায়,পুষ্পর বলতে ইচ্ছে করে,শিমুল ভাই এমন সুন্দর ঘ্রান কেন আসে?আমি মরে যাচ্ছি,জ্বলে যাচ্ছি,দেখেন না?আজকাল পুষ্পর মনেও যে উতলা বাতাস দিক দিশা ভুলে ছুটে,এই উন্মাদ পাগলা বাতাসকে সামলাতে পুষ্পরও যে কষ্ট হয়।মাথা নিচু করে চুপচাপ দুজনে হাটে।প্রিয় মানুষ কাছে থেকেও যদি ছোঁয়া না যায়,তাহলে কি ভিষণ যন্ত্রনা!কি ভিষণ যাতনা।
বাড়ির কাছে এসে শিমুল পুষ্পর হাত ধরে কাছে আনে,দু’গালে হাত রেখে ভালোবাসার কাতরতার গহীনে ডুবে গলা ভিজিয়ে খুব নরম গলায় বলে,
“সন্ধ্যায় খুব জোড়ে বকা দিয়ে ফেলেছিলাম।সরি,সরি।”

পুষ্পর মুখে হাসি ফুটে উঠে।ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
“আচ্ছা।”

শিমুল পুষ্পকে ছেড়ে বলে,
“যা।”

পুষ্প সামনে এগিয়ে যায়।রাগ দেখিয়ে কয়জন পরে ভুলটা বুঝতে পারে?কয়জন সরি বলে আগের কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে?এই যে শিমুল সরি বললো এই সামান্য সরিটাই অনেক শান্তি দেয়।এই সামান্য সরিটা বলতেই কেউ চায় না ইগো দেখিয়ে নিজে জিতে থাকতে চায় আর যারা পারে তাদের সম্পর্ক কখনোই শেষ হয় না।রাগ দেখানোর জন্যও একটা একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ দরকার।শিমুলের সেই মানুষটা কিনা পুষ্প।পুষ্পর মনটা খুশীতে কানায় কানায় পূর্ন হয়ে যায়।

ঘরে এসে চুপচাপ দরজা বন্ধ করে। সাথে সাথেই তার আম্মা তার দরজায় থাপ্পড় দিয়ে ডাকে।পুষ্পর হাসিখুশি মুখ সাথে-সাথেই চুপসে যায়,আন্দাজ করা ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যায়।পুষ্পর মা রোকসানা সমানে দরজা ধাক্কিয়ে ডাকছে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here