নিরবতায়_হৃদয়_কোনে #জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা #পর্ব_১২

0
263

#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১২

আবছা কুয়াশায় ঘেরা মেঠোপথ ধরে হাঁটতে গিয়ে একটা ব্যাপার জেনে মনঃক্ষুণ্ন হলো ইশরাক। আজ আর সকালে মিতালীর দেখা পাবেনা। মিতালীর আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। ক্যাম্পাসে যেতে হচ্ছে তাকে। সকাল সকাল তাজা খবর খানা মিললো মাহার কাছে।
সে সকালের টিউশনে যাচ্ছিলো। মাঝপথে ইশরাকের সাথে দেখা। মাহার খুব ভালোলাগে লোকটাকে। তার সাথে খুব ভাব হয়েছে ইদানীং। তবে মাহা চায় নিজের অনুভূতি গুলো চাপা রাখতে। অনুভূতি ব্যক্ত করলে হয়তো তাকে হ্যাংলা অথবা নীচ প্রকৃতির মেয়ে ভাববে।
ইশরাক খবর পেয়ে আর দাঁড়ালোনা। মাহাকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলো বাড়ির পথে। অফিস যাওয়ার জন্য গাড়ি ধরতে হবে। সদর এলাকায় চাকরি নিয়েছে শুধু মিতালীকে চোখে চোখে রাখার জন্য।

★★★

নির্ভীকের আজ ভীষণ ব্যস্ত সময় কা*ট*ছে। মিতালীর আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস ছিলো। সে ক্যাম্পাসে গিয়েছে বিধায় তার ভাগের ক্লাসগুলো ও আজ নির্ভীকের নিতে হচ্ছে।

★★★

ক্যাম্পাসে আসার পর থেকেই প্রিয়াকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখলো মিতালী। ক্লাসে ও কেমন অমনোযোগী ছিলো। তাই ক্লাস শেষ করেই ক্যাম্পাসের পেছনে তাদের আড্ডা দেওয়ার সেই জায়গায় টে*নে নিয়ে গেলো। সোজাসাপটা প্রশ্ন করলো মিতালী,

-“কী হয়েছে তোর? এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? তোদের কী হয় আমি বুঝিনা। গতকাল নির্ভীকের মন ভালো ছিলোনা, আজ তোর। সমস্যা কী তোদের?”

প্রিয়া চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করেও পারলোনা।
“বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করেছে”
বলতে বলতেই দু’ফোঁটা চোখের জল ঘাসের ওপর ভোরের শিশির বিন্দুর মতো গড়িয়ে পড়লো।

ভীষণ অবাক হলো মিতালী। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বলল,
-“কিন্তু কেন? তোর পরিবার তো এত তাড়াতাড়ি বিয়ের দেওয়ার কথা নয়!”

-“ভালো পাত্র পেলে তাদের আর কিছু ভাবার সময় থাকেনা।”

মিতালী বুঝলো এটাই বুঝি নির্ভীকের মন খারাপের গল্প! অথচ সে এতটুকু বোঝার চেষ্টা করলোনা গল্পটি প্রিয়া নয়, বরং সে।

-“নির্ভীক কী বলেছে?”

প্রিয়া বলল,
-“জানাইনি ও কে।”

আশ্চর্য হলো মিতালী।
-“জানাসনি মানে? তুই ভাবতে পারছিস, তোর বিয়ে হয়ে গেলে নির্ভীক কতটা কষ্ট পাবে!”

চমকে উঠলো প্রিয়া। নির্ভীক কেন কষ্ট পাবে? সে তো ভালোবাসার কথা নির্ভীককে জানায়নি।
ভ্রু’দ্বয় আপনাআপনি কুঞ্চিত হলো। অস্ফুটস্বরে আওড়ালো,
-“কী!”

মিতালী মাথা দুলিয়ে বলল,
-“কষ্ট পাবে না? দুজন যদি দুজনকে ভালোবেসেই থাকিস, তাহলে কেন কষ্ট পাবেনা? তাছাড়া তুই একবার বাসায় নির্ভীকের কথা বলে দেখ।”

-“তুই পা*গ*ল হয়েছিস মিতা। নির্ভীক কেন আমায় ভালোবাসতে যাবে? আমার প্রতি কোনোদিন ও কে আগ্রহ দেখাতে দেখেছিস? তাছাড়া আমিও তো নিজের মনের কথা ও কে কখনো জানাইনি। সেদিন কী বলেছিলাম মনে নেই? তোকে ছাড়া কথাটি আমি কাউকে বলিনি, এমনকি নির্ভীককে ও না।”

চরম আশ্চর্য হয়ে হতবিহ্বল চাহনিতে চাইলো মিতালী। কিছু বুঝতে না পেরে বলল,
-“মানে?”

-“আমার ভালোবাসা একপাক্ষিক। নির্ভীক কিছুই জানেনা। আর এমুহূর্তে তাকে আমি জানাতেও চাইনা। আমি জানি ও আমায় কোনদিন ও চাইবেনা। শুধু শুধু কেন ছেলেটাকে বিব্রত করতে যাবো?”

এতোগুলো দিন কী ভেবে এসেছিল মিতালী। যাইহোক সত্যটা সামনে আসায় তার ভারী বুক শীতল হলো। প্রিয়ার জন্য ভীষণ খা*রা*প লাগা কাজ করলেও কেমন প্রশান্তি লাগছে ভেতরটায়। মিতালী প্রশ্ন করলো,
-“ছেলেটা তোর পছন্দ?”

-“সবার যেখানে পছন্দ, সেখানে আমার পছন্দ না হয়ে যাবে কোথায়?”

-“তারমানে বিয়েটা তুই করছিস?”

-“হুম। শীঘ্রই তারিখ পড়বে।”

মেয়েটার চেহারায় তাকাতে পারলোনা মিতালী। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁ*দে ফেলবে। তাকে কাঁদতে দেওয়া উচিত। অন্তঃকরণের ভালোবাসা পুষে রেখে নিঃশেষ হওয়ার চেয়ে কেঁদে হালকা হওয়া ভালো। তাকে স্পেস দিতে এমন করুণ মুহূর্তে সান্ত্বনা না দিয়ে স্বা*র্থপরের মতো মিতালী বলল,
-“আমার তাড়া আছে, উঠছি এখন।”

মিতালী দৃষ্টি সীমানা অতিক্রম করতেই চেপে রাখা কান্না উগলে দিলো প্রিয়া। মুখচেপে কান্নার শব্দ প্রতিহত করতে চাইলো। দীঘির স্বচ্ছ, টলটলে জলে তাকিয়ে নিজেকে আরেকটু উন্মুক্ত করে দিলো সে।
-“তুই এত স্বা*র্থপর কেন মিতা? আমায় একটু সান্ত্বনা দিলিনা। তোর জন্য আমি নির্ভীককে ছে*ড়ে দিলাম, শুধু তোর জন্য। নির্ভীকের চোখে তোর জন্য উথাল-পাতাল করা মায়া আমি দেখেছি। আমার মনে কখনো তোর জন্য হিং*সে ছিলোনা। তবুও সেদিন তোকে নির্ভীকের কথা জানালাম, যেন তুই দূরে সরে যাস। শুধু একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। নয়তো আমি তোর ক্ষ*তি চাইনি। সত্যিই ক্ষ*তি চাইনি।
এত কিছু করেও আমি নির্ভীকের মন পেলামনা। আমি চাই তুই ভালো থাক। তাইতো বিয়েতে মত দিয়ে দিয়েছি। যাতে অনেক দূরে চলে যেতে পারি। তোদের মাঝখানে থেকে তোর প্রতি কখনো হিং*সা মনে পুষতে না পারি।”

অনেকটা শব্দ করেই কাঁদলো প্রিয়া। এদিকটায় তেমন কারো আনাগোনা নেই বিধায় সমস্যা হলোনা। যে ভালোবাসা হা*রা*য়, সে শুধু ভালোবাসাই হা*রা*য়না। হা*রা*য় আমি সত্তাকে, নৈঃশব্দে চু*রমা*র হয়ে যায় যতনে গড়া হৃদয়।

★★★

সময় দু’টোর কাঁটায়। স্কুলে পিরিয়ড টাইম। ফোন হাতে ম্যাসেন্জারে টেক্সট পাঠালো মিতালী।

সকাল থেকে ধ*ক*ল যাওয়ায় ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে চেয়ারে বসে ঝিমিয়ে রইলো নির্ভীক। শরীরে শক্তি কুলচ্ছে না বলে খেতে গেলোনা সে। দৈবাৎ মেসেন্জারের টুংটাং শব্দ হলো। ঝিমিয়ে থাকা চোখজোড়া সজাগ হয়ে উঠলো। স্ক্রিন অন করেই দেখতে পেলো মিতালীর কাছ থেকে বার্তা এসেছে।
প্রবল আগ্রহ নিয়ে বার্তাটি ওপেন করলো সে।

-“খেয়েছিস?”

নির্ভীকের অধরকোন প্রসারিত হলো। দ্রুত হাতে টাইপ করলো,
-“একা একা ইচ্ছে করছেনা।”

মিনিট না যেতেই ফিরতি বার্তা,
“স্কুল থেকে বের হ। আমি কাছাকাছি আছি।”

এতক্ষণের ঝিমিয়ে থাকা শরীর যেন মুহুর্তেই চাঙ্গা হয়ে উঠলো। শরীর ঝাড়া মে*রে স্কুলের গেইট পেরিয়ে সামনের দিকে এগোলো। বেশিদূর যেতে হলোনা। তার পূর্বেই মিতালীর দেখা পেলো। মেয়েটা মিষ্টি হেসে এগিয়ে আসছে। তা দেখে নির্ভীকের হৃদয় কোন ‘ছলাৎছলাৎ ‘ শব্দে ধুকপুক করে উঠলো। ভালোবাসায় যাদু আছে। নয়তো সাধারণ বিষয়কেও কেমন অসাধারণ লাগে, সারাক্ষণ মনকাননে ভালোলাগার পাখিগুলো কিচিরমিচির করে।

একসাথে খাবার শেষ করে মিতালী বাকি ক্লাসগুলো নিতে নির্ভীকের সাথেই স্কুলে ফিরলো।
স্কুল শেষে ফেরার পথেই চেয়ারম্যান চাচার সাথে দেখা হলো। সালাম জানালো মিতালী। তিনিও হাস্যজ্জ্বল মুখে জবাব দিলেন।

স্নেহভাজন কন্ঠে বললেন,
-“তোমার সাথে কিছু কথা বলবো।”

মিতালী নম্র স্বরে বলল,
-“জি চাচা বলুন।”

-“মালিহা আজকাল তোমার মিনা ভাবির কাছে পড়তে চায়না। ভেবেছি ওর জন্য ঘরোয়া শিক্ষক রাখবো। আমরা তোমার কথাই ভাবলাম। তোমার যদি সময় হয়, তাহলে মালিহাকে একটু সময় দিও।”

মিতালী ইতস্তত করে বলল,
-“আসলে আমার তো দিনের বেলায় সময় নেই চাচা।”

নির্ভীক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এখন যদি মিতালী হ্যাঁ করে দিতো, তবে তার কানের নিচে দু*টো দেওয়ার ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতোনা সে।
চেয়ারম্যান চাচা বললেন,
-“তুমি না হয় সন্ধ্যার পর পড়িয়ে দিও। বাড়ির কারো কাছেই সে পড়বেনা। আর বাইরের কাউকে ভরসাটা ঠিক করতে পারছিনা। তুমি সময় দিলে উপকৃত হতাম। পড়ানোর পর তোমায় ইশারাক বা নির্ভীক নাহয় বাড়ি পৌঁছে দেবে।”

এতটা অনুরোধ ফেলতে পারলোনা মিতালী। হ্যাঁ করে দিলো সে। চেয়ারম্যান সাহেব কথা পাকা করে নিজ গন্তব্যে পা চালালেন। রা*গ হলো নির্ভীকের। নাকের পাটা ফুলে উঠলো তার। মিতালীর সাথে কথা না বলেই আগে আগে হাঁটলো। পেছনে পড়ে যাওয়ায় একপ্রকার দৌঁড়ে নির্ভীকের পাশ ধরলো মিতালী। হাঁফিয়ে যাওয়া গলায় বলল,
-“তুই আমায় ফেলে এমন ঘোড়ার মতো ছুটছিস কেন?”

নির্ভীক তে*ড়ে তার দিকে এগোতে গিয়েও দমে গেল। দাঁতে দাঁত চেঁ*পে বলল,
-“সারাদিন গাধারখাটুনি খে*টে ও রাতে আমাদের বাড়িতে কেন তোকে যেতে হবে? না করে দিতে পারলিনা?”

মিতালী আমতা আমতা করে বলল,
-“চাচা এত করে বলল। উনার দ্বারা আমি অনেকবার উপকৃত হয়েছি। এতটাও অকৃতজ্ঞ আমি নই। তাছাড়া দু’টো পয়সা বেশি পেলে আমারই লাভ।”

ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো নির্ভীক। মেয়েটার সাথে কথা বলে খুব একটা লাভ নেই মনে করে আর কথা বাড়ালোনা নির্ভীক। তবে তার আরও একটা দায়িত্ব আজ থেকে যোগ হলো। চেষ্টা করতে হবে যাতে মিতালীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ইশরাকের নয়, তার হয়।

★★★

গোছানো পড়ার টেবিল। হাতের কাছে কয়েকটা বই-খাতা নিয়ে গোলগাল চেহারা আর মরম রূপে বসে আছে মালিহা। মিতালীকে দেখেই মিষ্টি হাসলো।
মিতালীও হাসলো। প্রথম ধাপেই পড়ায় গেলোনা। মালিহার সাথে ছোট বাচ্চা হলো। গল্প ছন্দে কিছুটা সময় কা*টা*লো। প্রথমেই বাচ্চাদের পড়াতে গেলে এরা পড়াতে মনযোগ দিতে চায়না। অনীহা প্রকাশ করে। মে*রে*ধ*রে কিছু শেখানো যায়না। বরং আরো বেঁকে বসে। একটু গল্প করার বা পড়ার শেষে খেলার লো*ভ দেখালে এরা দ্রুত পড়াটা শেষ করতে চায়। মনযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করে।

পড়ানোর একপর্যায়ে মিতালীর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় জানান দিলো তাকে কেউ গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করছে। লোকটি যাতে দৃষ্টি এদিকসেদিক করে পার পেয়ে যেতে না পারে সেজন্য নড়াচড়া করলোনা সে। হুট করেই চোখ তুলে তাকালো লোকটির দিকে।
আচমকা মিতালী এভাবে তাকিয়ে যাবে বুঝতে পারেনি ইশরাক। দ্রুত দৃষ্টি স্বাভাবিক করে হাসলো সে। এগিয়ে এসে মালিহার কাঁধে হাত রাখলো।
-“বলোতো আম্মু কেমন লাগছে মিসকে? পড়তে ভালোলাগছে?”

মিতালী দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অস্বস্তি হলো তার। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে কেউ না পড়ুক। ইদানীং ইশরাক ভাই তার দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। যেটা মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না মিতালীর। মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়। আচ্ছা সে কি সরাসরি প্রশ্ন করবে? যে আপনি আমায় কিছু বলতে চান? কিন্তু তাকে কী -বা বলার থাকতে পারে?

সময় দেখে ইশারাক বলল,
-“চল তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।”

মিতালী সায় জানালো। আশেপাশে নির্ভীক নেই। তারমানে ইশরাকের সাথেই পৌঁছাতে হবে।

★★★

বাজারের কাজ সেরে দ্রুত বাড়ি ফিরলো নির্ভীক। মিতালীকে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু তা আর হলো কই? মায়ের মুখে শুনলো একটু আগেই নাকি ইশরাক মিতালীকে পৌঁছে দিতে গেলো।
গোপনে ধপ করে উঠলো নির্ভীক। বাড়ি ছেড়ে ত্রস্তব্যস্ত পায়ে বের হলো।

#চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here