#জীবনের জলছবি
#পর্ব ৩৫
সকাল থেকে অন্তত বার চারেক বুথ থেকে তপু কে ফোন করেছে টুসি, প্রতিবারই কাকিমা ধরে বলেছে, এখনও ফেরেনি বাড়িতে, এবার রাগ হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ। হসপিটালে ফোন করলে আবার রেগে যায় তপু, তাই সাহস করে, করে উঠতে পারছে না টুসি।
মুসল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে গত দুদিন ধরে, শিলিগুড়ির বৃষ্টির এই এক সমস্যা, একবার শুরু হলে আর থামতে চায়না সহজে। তার মধ্যেই ভিজে ভিজে বুথে এসেছে টুসি, একবারও পায়নি এখনও। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না ও। এইবার শেষ বারের মত চেষ্টা করবে ভেবেই এসেছে, মা ও খুব বিরক্ত হচ্ছিলো,
এত ভিজিস না, তোর ঠান্ডা লাগার ধাত, শেষে আসল সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়বি দেখিস।
অবশেষে ফোন টা ধরলো তপু।
গাড়ি টা নিয়ে এসো শিগগির, আমি পার্লারে যেতে পারছিনা, মেহেন্দি আর পরা হবে না আমার,
তপু হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো টুসি।
ঠিক জানতাম তুই ফোন করেছিস মানেই কোনো উল্টোপাল্টা দরকারে ইউজ করবি আমাকে, এই বৃষ্টি তে আর কেই বা তোর খিদমত খাটবে আমি ছাড়া
কপট রাগের গলায় বলে উঠলো তপু।
প্লিজ, এসো তাড়াতাড়ি, সত্যি বলছি মেহেন্দি টা একটুও শোকাবে না এক্ষুনি না পরলে,
প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললো টুসি।
আসছি দাঁড়া, রেডী হয়ে থাক বলে ফোন নামিয়ে রাখলো তপু।
টুসি কে পার্লার থেকে বেরাতে দেখেই গাড়ির দরজাটা খুলে ধরলো তপু, হাতে মেহেন্দি নিয়ে দরজা খোলা যথেষ্ট কঠিন।
চল বৃষ্টি টা ধরেছে যখন তখন আইস ক্রিম খেয়ে আসি একটু, তুই তো ভালবাসিস,
টুসি সত্যিই আইসক্রিম ভালোবাসে, কিন্তু মেহেন্দি হাতে তো আর খাওয়া সম্ভব নয়,
তুমি খাইয়ে দিলে খেতে পারি,
মুচকি হেসে বললো টুসি, তপুও হেসে ফেললো।
বড্ড ভুল ভাল কাজ করাস তুই আমাকে দিয়ে, কি হতো এই বৃষ্টির মধ্যে মেহেন্দি না পরলে?
কি যে বলো, ইস এগুলো আমি কবে থেকে প্ল্যান করে রেখেছি, আর শুধু বৃষ্টি হচ্ছে বলে সব নষ্ট হয়ে যাবে, তাই হয় নাকি আবার!! আর যখন সত্যিকারের বিয়ে হবে না, তখন তো আরও অনেক কিছু করার প্ল্যান আছে, বুঝলে?
তপুর কথার উত্তরে বললো টুসি, তপু একদম অবাক হয়ে গেলো!
সত্যিকারের বিয়ে মানে? এটা কি মিথ্যে নাকি, তুই আর বড়ো হবি না কোনোদিনও।
আমি না জানো তো, সত্যিই বড়ো হতে চাইনা কোনো দিনও, সেই ছোটো বেলাতেই থাকতে চাই, খুব ইচ্ছে করে আবার আগের মত ছোটো হয়ে যাই। মাম কে মনে আছে তোমার? আমার বন্ধু ছিলো? কতদিন দেখিনি ওকে, খুব দেখতে ইচ্ছে করে জানো।
ঠিক আছে, তোকে নিয়ে যাবো একবার, যার যার সঙ্গে ইচ্ছে, সবার সঙ্গে দেখা করে নিস নাহয়।
নাহ! যাবনা, ফিরে গেলেই আমার ছোটবেলা টা হারিয়ে যাবে, ওই স্কুল বাড়িটা, বন্ধুরা, খেলার মাঠ, পুজোর মণ্ডপ, সব্ আমার স্মৃতি তে ঠিক যেমন করে আছে, সেই ভাবেই মনে রাখতে চাই। আমি জানি, ওখানে সব বদলে গেছে এতদিনে, ওই বদলানো ছবি টা একবার দেখলেই ছোটবেলা টা মুছে যাবে একদম, আর কোনোদিনও চোখ বন্ধ করেও সেই রাস্তা, সেই পাড়া, সেই মাঠে ফিরতে পারবো না আমি।
সত্যি টুসি যেতে চায় না কখনো, যে ছোটবেলাটা কে ও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায়, ফিরে গিয়ে বদলে যাওয়া শহরটা কে দেখে সেটা কে হারিয়ে যেতে দিতে চায় না ও। তাই জন্যেই তো মাম কতবার বলা সত্বেও আজ পর্যন্ত ও কখনো যায়নি ওখানে!
তুই সত্যিই বড় হয়ে গেছিস টুসি!
তপুর খুব অবাক লাগছিলো, হাসি খুশি উচ্ছল টুসি কে সব সময়ই ইমম্যাচিওর ভেবেই এসেছে ও, তার মনের গভীরতা ওকে অবাক করছিলো আজ।
যখন ছোট ছিলাম তখন খুব বড়ো হতে চাইতাম, মায়ের শাড়ি পরে, মাথায় গামছা বেঁধে খোঁপা করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতাম নিজেকে, কিন্তু এখন আর চাইনা, এখন আমি আবার আগের মত ছোট হতে চাই, কিন্তু চাইলেও সব কিছু হয় না বলো?
হয় তো, ইচ্ছে থাকলেই হয়, আমিও তোকে সেই আগের টুসিই দেখতে চাই সারা জীবন, শোন এরকমই থাকিস তুই, যতই বড় হোস না কেনো, মনের বয়েস টা বাড়তে দিস না কোনোদিনও।
আজ টুসি আর তপুর রেজিস্ট্রি ম্যারেজ, টুসি এখনও পড়াশুনা করতে চায় তাই আপাতত এই ব্যবস্থা। বাবার শরীর খারাপ বলে বাবা দেরি করতে চাইছিলো না আর।
তপু গাড়ি থেকে নামলো, কি সুন্দর লাগছিল, ওপর থেকে লুকিয়ে দেখছিলো টুসি। ঘরে ঢোকা থেকেই তপুর চোখ ওকেই খুঁজছিলো বুঝতে পারছিল ও, কিন্তু না, এখনি সামনে বেরোবেনা, আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করুক তপু, খুব মজা লাগছিলো টুসির।
রেজিষ্টার আসার পর সামনে এলো টুসি, এত সুন্দর লাগছিলো, একদম চমকে গেলো তপু। এই কি সেই টুসি, যাকে ও সেই ছোট্ট বেলা থেকে ভালোবেসে এসেছে, যার জন্য নিজের বাবা কে ছেড়ে আসার কথা ভাবতেও সময় নেয়নি একটুও, মনে মনে ভাবছিলো তপু।
রেজিস্ট্রি পর্ব শেষ হবার পর দুজনে প্রণাম করছিলো মা কে।
আমার ছোট্ট মেয়েটা কত্ত বড়ো হয়ে গেলো দেখেছো শীলা,
চোখে জল নিয়ে কাকিমা কে বললো মা, শুনেই কেঁদে ফেললো টুসি। একসময় মা কে কত ভয় পেত ও, আর সেই মা কে আজ একদম অন্যরকম লাগছিলো।
দূর বোকা, কাঁদছিস কেনো, আমি তো আছি, তোর এখন দুটো বাড়ি হলো, বলেই ওকে জড়িয়ে ধরলো কাকিমা।
বাবাকে প্রণাম করতেই জড়িয়ে ধরলো বাবা,
আমার মেয়েটা বড্ড ছেলেমানুষ তপু, একটু দেখে রাখিস কিন্তু, শুনেই আবার কান্না পেয়ে গেলো টুসির।
বিকেলে বাবার ক্লাবে রেজিস্ট্রি উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান আছে, সকালের করা সাজ প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তাই তপু কেই ধরে বসলো টুসি,
তপু দা, প্লিজ আর এক বার নিয়ে চলো এক্ষুনি,
এখনও দাদা? খবরদার তপু, দাদা বললে একদম নিয়ে যাবিনা ওকে, আর তোকেও এবার তুই বলাটা ছাড়তে হবে বুঝলি!
কাকিমা হেসে বললো, সবার হাসিতে লজ্জায় পড়লো টুসি, তপু দুজনেই, এই কাজটা সত্যিই খুব কঠিন ওদের দুজনের পক্ষেই।
এমনিও যাবো না, আর ইউজ করতে পারবেনা আমাকে, এবার আমি যা বলবো সেটাই শুনতে হবে ওকে,
বলেই হেসে পকেট থেকে গাড়ির চাবি টা বার করে দরজা খুলে বেরোলো তপু। টুসি ও পিছু নিলো, কারণ ও জানেই তপু দা কিছুতেই না বলতে পারেনা ওকে।
আজকের অনুষ্ঠানে তপুর মামার বাড়ির সবাই, মাসি এমনকি সীমার বাবা, মাও উপস্থিত ছিলো, সেখানে সীমার অনুপস্থিতি একটু হলেও চোখে লাগছিলো টুসির। জিজ্ঞেস করবে না ভেবেও আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো না ও,
সীমা এলোনা কেনো?
গাড়ি চালাতে চালাতে টুসির দিকে ফিরে তাকালো তপু,
তুই খুব দুঃখ পেয়েছিস মনে হচ্ছে! ও আসেনি কেনো সেটা নিয়ে তুইই তো বেশি চিন্তিত দেখছি!
তুমি জানোনা, আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না, ও তোমাকে ভালোবাসে,
তপুর বিদ্রুপ টা একদম গায়ে না মেখেই বললো ও,
আমি বুঝলাম না আর তুই বুঝে গেলি!
এবার একটু বিরক্ত গলায় বললো তপু, টুসি চুপ করে গেলো কিন্তু সেদিনের সীমার কথাগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছে না ও। ও যেটা বুঝেছে সেটা তপু কে বোঝানো সম্ভব নয়, কিন্তু সেটা একটুও মিথ্যে নয় ও জানে।
কি ভাবছিস? ওই একই কথা তো! আসলে আমি তোকে রাগানোর জন্যে কয়েকদিন ওর সঙ্গে একটু বেশি কথা বলেছি তো, তাই তোর এরকম একটা ভুল ধারণা হয়ে গেছে। আর যদি বলিস ও তোকে সেদিন ওগুলো বলেছিলো কেনো, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় ও ও তোর সঙ্গে মজা করতেই চেয়েছিলো,
তপুর কথায় একটু অন্য মনস্ক হলো টুসি, মজা! নিজেকে নিয়ে! কেউ করে নাকি!
তোর অন্য কোনো কথা নেই? ছেড়ে দে না এগুলো এবার!
তপুর বিরক্ত স্বরে এবার লজ্জা পেলো টুসি, সত্যি! আজকের দিনেও ও এইসব ভাবছে!
এই যে সীমা আমাকে ভালোবাসে এটা তুই নাকি নিজে থেকেই বুঝে যাস, আর আমি যে তোকে ভালবাসি এটা তুই বুঝিস নি কেনো বলতো?
মজার গলায় বললো তপু, টুসি একটু রেগেই গেলো,
মেয়েরা মেয়েদের মনের কথা বুঝতে পারে, কিন্তু ছেলেদের টা পারবে কি করে? তুমি নিজে আমাকে না বললে বুঝবো কি করে!
সব কিছুই কি মুখে বলতে হয়? মুখে না বললে বোঝা যায় না বুঝি! ভালোবাসা একটা এক্সপ্রেশান, বুঝলি তো! সেটা মুখে বলে নয়, প্রকাশ করে দেখাতে হয়। আমরা যাদের ভালোবাসি, তাদের কি সারাক্ষন ভালোবাসি, ভালোবাসি বলি? বলি না তো! সেটা তাদের প্রতি করা আমাদের ব্যবহারে প্রকাশ পায়। যেমন ধর, এই যে তুই সন্ধ্যে হলেই বাড়ি ফিরতে চাস, কেনো বলতো? কারণ তুই কাকিমা কে ভালবাসিস, তাই চিন্তায় ফেলতে চাস না। সেদিন বললি না, কাকু অপমানিত হয়েছেন, সেটাতে তুই কষ্ট পেয়েছিস, কাকু কে তুই ভালবাসিস বলেই তো পেয়েছিস তাই না!
টুসি ভাবছিলো, এই ভাবে ও কি ভেবেছে কখনো! মন টা ভালো হয়ে যাচ্ছিলো ওর,
এই যে তুই আমাদের বাড়িতে এলেই তোকে বাড়ি পৌঁছে দিই আমি, একা ছাড়তে চাই না, বাবা কে কোনোদিনও ভবিষ্যতে বাড়িতে নিয়ে এলে তোর অসুবিধা হবে কিনা জানতে চাই, তুই তনুর সঙ্গে আছিস জেনে কষ্ট হলেও,তোকে সেবক থেকে নিয়ে আসার কথায় না বলতে পারিনা এগুলো তোকে ভালোবাসি বলেই, বুঝলি?
ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললো তপু, টুসি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো, সত্যিই ও বোঝেনি কেনো সেদিন!
টুসি পার্লার থেকে বেরিয়ে আসছিল, গাড়িতে বসে দেখছিলো তপু, ভীষণ সুন্দর লাগছে, চোখ ফেরাতে পারছেনা ও, গাড়ির দরজা খুলে উঠে এলো টুসি।
কেমন লাগছে বলো আমাকে?
কাছে না এলে বুঝবো কি করে,
টুসি কে জড়িয়ে ধরে কাছে নিয়ে এলো তপু, দুহাতে ওর মুখটা তুলে ধরলো, চোখ বন্ধ করে নিলো টুসি,
লিপস্টিক টা মুছে যাচ্ছে, প্লিজ,
মুছে যাক, তুমি এমনই সুন্দর!
সমাপ্ত
( একজন সদ্য কিশোরীর তরুণী হয়ে ওঠার গল্প ছিলো এটা, এই যাত্রাপথে যারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন, তাদের সবাই কে অসংখ্য ধন্যবাদ। কেমন লাগলো সম্পূর্ন গল্পটা আজ সবার কাছে জানতে চাইবো, যাঁরা এতদিন শুধুই পড়েছেন, আজ তাঁদেরও মতামত দেবার অনুরোধ রইলো। আর নতুন গল্পের আপডেট থাকবে কাল এই সময়েই, নতুন গল্পেও সবাই কে সঙ্গে পাবার আশা রাখলাম 🙏)