ডাইনি – ৩

0
536

ডাইনি – ৩

মিলা বেরিয়ে যেতেই প্রতিভা চেয়ারের হেডব্যাকে মাথা দিয়ে দুলতে থাকলেন।

—- কী হলো এটা!

নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছেন কিন্তু উত্তর পাচ্ছেন। নিজের শিক্ষা, জ্ঞান বা স্বাভাবিক যুক্তি কোনোটা দিয়েই নিজের অনুভূতির স্বপক্ষে উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। মন শুধু কু গাইছে। ‘খুব খারাপ, খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে।’ কে যেন মাথার ভেতর একটানা বলে চলেছে!

কিন্তু মিলার জীবনের খুব খারাপের সাথে তার মন কেন অস্থির হবে এই সম্পর্ক খুঁজে পেলেন না কিছুতেই।

রুম থেকে পঁচা গন্ধটা সরে গেছে। একটানা বেলীফুলের সুবাস আসছে টেনেটেনে, ভেসেভেসে। বুকভরে নিঃশ্বাস নিলেন প্রতিভা। এসিট্যান্ট রোমেনা কি জেসমিন ফ্রাগরেন্সের রুম ফ্রেশনার দিয়েছে? ক্লান্ত মনটা তরতাজা হয়ে উঠল নিমেষেই। বাইরে বর্ষার ঢল নেমেছে। পানির তোড়ে জানালার গ্লাস ঝাপসা হয়ে আছে। বাইরেটা দেখা যাচ্ছে না। শেষ বিকেলটাকে ভরসন্ধ্যা মনে হচ্ছে।

ফোনটা বের করে ড্রাইভারকে কল দিলেন গাড়িটা একেবারে এক্সিটের সামনে এনে রাখার জন্য। তাহলে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচা যাবে।

লিফট থেকে নেমে এক্সিট এরিয়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন তখন হাজবেন্ড সমীরের ফোন। ফোন কানে নিতেই সমীর হতাশ গলায় বললেন,

– এখনো বের হওনি তুমি। পিক আওয়ার, জ্যামে আটকে গেলে কী হবে?

— তোমরা রেডি তো?

— হ্যাঁ আমরা রেডি। কিন্তু তুমি একবার চেক করে নেবে তো সব।

—- রিতা সব জানে। চেকলিস্ট ওর কাছে। ওই পারবে।

— তুমিও তো রেডি হবে!

— আমার আর কী? আমি তো শুধু শাওয়ার নেবো। জার্নিতে আমি যে শুধু পাজামা আর টিশার্ট গলিয়ে নেবো সে কী ভুলে গেছো?

— হুম। এসো তাড়াতাড়ি। দেরি হলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে অনেক। তখন কাউকে বিব্রত করতে ভালো লাগবে না।

— এই তো। রতন ভাই গাড়ি নিয়ে এসেছে। আমি আসছি।

ফোনটা পার্সে ঢোকাতে ঢোকাতে গাড়িতে উঠতে যাবেন তখনই কোথা থেকে একেবারে উড়ে এলো মিলা। হঠাৎ করে এলো বলেই চমকে উঠলেন প্রতিভা সান্যাল। অনেকটা এরকম মনে হলো যেন লুকোচুরি খেলা চলছে। মিলা পেছন থেকে এসে ধাপ্পা দিলো প্রতিভাকে!

— ডক্টর, আপনার গাড়িটাতে একটু লিফট দেবেন প্লিজ? না মানে, কোনো রিকশা, সিএনজি কিছু যাচ্ছে না এখান থেকে। বাচ্চাটা ভিজে যাবে বলে ওকে কোলে নিয়ে কিছু খুঁজতেও তো যেতে পারছি না। প্লিজ!

প্রতিভা লিফট দিতে অস্বীকার করতেন না, কিন্তু মিলা তার অনুমোদনের অপেক্ষাতেও থাকল না। আয়েশাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। প্রতিভা একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, একটু দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন, মিলাই উঁকি দিয়ে ডাকল,

—- ডক্টর, চলে আসেন। অনেকটা রাস্তা যেতে হবে আমাদের।

প্রতিভাও আর অপেক্ষা করলেন না। তার আসলেই তাড়া আছে। গাড়িতে বসতেই মিলা খনখনে গলায় হেসে উঠে বলল,

—- থ্যাঙ্কিউ ডক্টর, আপনি তো জানেনই বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি একা নিরিবিলিতে থাকা বাচ্চাটার জন্য কতটা বিপদজনক। অফিস এরিয়া একদম ফাঁকা হতে শুরু করেছে!

বলেই মিষ্টি করে হাসল।

মিলার হাসিতে প্রতিভা অপ্রস্তুত হলেন। কী ভয়ংকর ইশারা দিচ্ছে মিলা ওকে, হাসিমুখে! আরও খানিক স্টাডি না করে প্রতিভা ওকে কিছু না বলাটাই ভালো বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। মিলার হাসির বদলে নিজেও হালকা হাসি বিনিময় করলেন শুধু।

গাড়ি স্টার্ট নিতেই পচা গন্ধটা নাকে এসে বাড়ি দিলো আবার, বমি ঠেলে আসতে চাইলো প্রতিভার, তাড়াতাড়ি ওড়না দিয়ে নাকচাপা দিলেন আর ড্রাইভারকে বলে উঠলেন,

—- রতন ভাই আপনি খেয়াল রাখেন না? কারওয়াশ করেন না ঠিকমতো? কী একটা পচে গন্ধ বেরোচ্ছে। কখনো টিফিন এনেছিলেন বাসা থেকে? খেতে ভুলে গিয়েছেন এমন হয়েছে? পচছে হয়তো!

—- না দিদি, আমি তো কিছু রাখিনি। আর গন্ধ কীসের? আমি তো পাচ্ছি না!

—- কী বলছেন? আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। গাড়ি দরজা খুলে রেখেছিলেন নাকি? কুকুরটুকুর ঢুকে নোংরা করে গেছে নাকি? ইশ উইন্ডো গ্লাসও তো নামাতে পারব না।

—- হ্যাঁ দিদি। অনেক বৃষ্টি। কিন্তু আমি কোনো গন্ধই পাচ্ছি না।

— আপনার সর্দি লেগেছে? নাকবন্ধ হয়ে আছে। ফ্রেশনার স্প্রে করুন। উফ!

নাক চেপেই, চোখমুখ কুঁচকে বসে রইলেন প্রতিভা। একটু বাদে নাক সয়ে গেলো দুর্গন্ধটা। মিলা বলে উঠল,

—- ডক্টর বৃষ্টি তো কমার কোনো লক্ষণই নেই। আপনি কি আমাকে আমার বাবার বাসায় নামিয়ে দেবেন প্লিজ!

চট করে না বলতে পারাটা অনেক কষ্ট করে আয়ত্ত্ব করেছেন প্রতিভা, অনেক অনেক বড় বড় ঢেঁকি গিলে তারপরে। এখন যেটা পছন্দ হয় না, চোখকান বন্ধ করে না বলে ফেলেন। তবুও মানসিক ভারসাম্য টলমল করা মিলাকে না বলতে একটু বাধল তার, সাথে দুধের বাচ্চাও আছে। ইতস্তত করেই বললেন,

—- কিন্তু আজ তো আমার তাড়া আছে। আমরা একটু বাইরে যাবো, আমার অলরেডি দেরি হয়ে গেছে।

—- না না না। আপনার দেরি হবে না।

হাত দিয়ে প্রতিভার কথা আটকালো মিলা। সেক্টর দশেই আমার বাবার বাসা। সাত নম্বর রোডে। বায়ান্ন নম্বর বাসা। লিফটের চার তলায় উত্তর পাশের ফ্ল্যাট।

বলেই যেন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো। আর সাড়াশব্দ করল না।

প্রতিভা একেবারে জমে বরফ হয়ে গেলেন। তার বাড়ি সেক্টর দশেই। এগারো নম্বর রোডে। মিলা কী করে জানল? কী উদ্দেশ্য মিলার? কোনোভাবে কি আগে থেকেই চেনে প্রতিভা সান্যালকে? হতে পারে। প্রতিভার নাম আছে সাইকিয়াট্রিতে। হয়তো খোঁজখবর নিয়েই মিলা এসেছে তার চেম্বারে। কত কী ভেবে নেন আজকাল তিনি, নিজেকে একটু বকে দিলেন প্রতিভা। রিল্যাক্স হয়ে বসলেন। বাইরে তাকালেন। বৃষ্টির থামার নাম নেই একেবারেই।

একটু তন্দ্রামতো লেগে এসেছিল প্রতিভার, মিলার ডাকে তাকালেন। মিলা বলছে,

—- ডক্টর, এই রকম আবহাওয়ায় গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে বলেন? দাদির কোলে শুয়ে গল্প শুনতাম ছোটোবেলায়। যদিও তিনি আমার নিজের দাদি না। তবুও আদর করেই গল্প শুনাতেন। তার গল্পে রাজা রাণি থাকত। রাজকন্যা থাকত। সাদা ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্রও আসতো! আর থাকতো ডাইনি বুড়ি!

হাত নেড়ে অকারণ হাসল মিলা, তারপর বলল,

—- আচ্ছা ডক্টর আপনি ডাইনিতে বিশ্বাস করেন? হ্যারি পটারের উইচ না, সত্যিকারের যাদুবিদ্যায় পারদর্শী ডাইনি? বিভন্ন তন্ত্রমন্ত্র ফুঁ করে যে লতাপাতা দিয়ে ওষুধ বানায়, যে মানুষের রক্ত দিয়ে পোশন বানায়, কালোযাদু করে, বুনো পশুর হাড়গোড় জড়ো করে পুজো করে, তাজা রক্ত পান করে অমর হতে চায় আর নৃশংস প্রতিশোধ নেয়?

ঘুমন্ত আয়েশা একটু নড়েচড়ে ওঠে মিলার কোলে। প্রতিভা তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলেন,

—- মিলা, আপনি অনেক উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন। উত্তেজনা ভালো হবে না আপনার জন্য। প্লিজ!

— ম্যাম, আমি আপনাকে এনসিয়েন্ট যুগের উইচের গল্প বলি? মেডিয়া। যাকে বলা হয় প্রাচিনতম ডাইনি। সরাসরি দেবতাদের আশির্বাদে ডাইনি হয়েছিল যে।

নানারকম ভেষজ পোশন বানাতো সে দেবতাদের জন্য, প্রাণিজ পোশন বানাতেও সমান পারদর্শীতা ছিলো মেডিয়ার। ওই যে গল্পে পড়ি না, প্রাণীর রক্ত, মাংস, হাড় দিয়ে পোশন বানায় ডাইনিরা। মানুষের রক্ত খেয়ে অমর হয়ে যায়? সেইরকম!

শেষ কথাটা অদ্ভুত জড়ানো গলায় বলল মিলা। হাসল খানিকটা। দুলে দুলে ঘুমন্ত আয়েশাকে আরাম দিলো।

তারপর আবার গল্প বলতে শুরু করল,

—- ভালোই দিন কাটছিলো মেডিয়ার, তারপর ও প্রেমে পড়ল। অন্ধপ্রেম। সবকিছু শেষ করে দেয় যেই প্রেম। বুদ্ধি, বিবেক, চেতনা সব! যেমন আমার প্রেম। বাবার স্নেহ, আদর, বিশ্বাস সব মাটিতে ফেলে, তার হৃদয়টাকে খুন করেছিলাম আমি একদিন। ক্যানিবালিজমের চাইতে তা কি কম নিষ্ঠুরতা ছিল সেটা?

প্রলম্বিত শ্বাস টেনে নিলো মিলা।

প্রতিভার মন অস্থির, দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে, তবুও মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনছেন মিলার গল্প। মিলার জন্য কমফোর্ট জোন তৈরি করছেন। ও কথা বলুক। কথা বললেই অনেকটা সহজ হবে মনের বদ্ধ জায়গাটা খুলে ফেলতে। যে জায়গাটাতে জট লেগেছে সেটা বলে ফেলুক। নির্ভরতার জায়গা হতে হবে প্রতিভাকে, একান্ত বিশ্বাস করে মিলা সব খুলে বলবে তবে। মনটা ফুটো হওয়া টায়ারের মতো। ছিদ্রটা কোথায়, জানলেই সমাধান!

— গ্রীক মিথোলজিতে মেডিয়া আর জেসনের গল্পটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একদম শুরু থেকে বলি, শুনছেন ডক্টর?

প্রতিভা হেসে জানালেন, তিনি শুনছেন। বেশ মনোযোগ দিয়েই শুনছেন।

— তবে বলি? ইয়োলকাস রাজ্যের রাজা ছিলেন ইসন। সে মারা যাওয়ার সময় পুত্র জেসন ছোটো ছিলো বলে তার ভাই পেলিয়াস এর কাছে রাজ্য হস্তান্তর করে। পেলিয়াস তখন জেসন কে ইসনের কথামতো লেখাপড়া করতে বাইরে পাঠায় এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত রাজ্য সামলানোর ভার নেয়।

কিন্তু জেসন ফিরে এলে পেলিয়াস ক্ষমতা ছাড়তে চায় না এবং কৌশলে জেসনকে মারার উদ্দেশ্যে গোল্ডেন ফ্লিস আনতে বলে যেটা আদতে অসম্ভব কাজ। কিন্তু জেসন বেশ কিছু সাহসী ক্রুমেট, গ্রীক বীর বলা যায়, তাদের নিয়ে ‘আর্গো’ নামক জাহাজে করে কল্কিস এ যায়। যেখানে রয়েছে সেই গোল্ডেন ফ্লিস। কিন্তু গেলেই কি পাওয়া যায়? এতো সহজে কেউ দেবে কেন গোল্ডেন ফ্লিস? কলকিসের রাজা প্রথমে নাবিকদের আপ্যায়ন করলেও গোল্ডেন ফ্লিস নিতে আসার কারণ শুনে তিনিও অখুশি হন। কারণ,গোল্ডেন ফ্লিস ছিলো তাদের রাজ্যের সম্মানের জিনিস। তাই সেই রাজাও গোল্ডেন ফ্লিস দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং জেসনকে অসম্ভব কার্যের মাধ্যমে সেটি জয় করতে বলেন।

সেই রাজার নাম এটিস আর এটিস এর কন্যা ছিলো আমাদের গল্পের নায়িকা এই মেডিয়া। জেসনের সাথে সবসময় দেবি আফ্রোদিতি ছিলেন, আফ্রোদিতির খুব প্রিয়পাত্র ছিল সে, আফ্রোদিতিই জেসনকে সাহায্য করেন তার ছেলে কিউপিড এর মাধ্যমে। কিউপিডের তীর যাকে বিদ্ধ করে তার তো আর বাঁচার যো নেই। আগুনকে প্রেম বলে ঝাঁপ দেয় মানুষ ওই তীরে বিঁধে। মিডিয়া যখনই সমস্ত নাবিকদের মধ্যে জেসনকে দেখে তখনই কিউপিডের তীরে বিদ্ধ হয়। কলকিস এর রাজকন্যা মেডিয়া জেসন এর প্রেমে পড়ে যায়!

মেডিয়া জেসনকে আড়ালে ডেকে বলল, তুমি সহজে সোনালি মেষের চামড়া পাবে না। আমি তোমায় সাহায্য করব। তার বদলে তুমি আমাকে কী দেবে?

জেসন বলল, আমি সারাজীবন তোমাকে ভালোবাসব।

আমাকে তোমার দেশে নিয়ে যাবে? মেডিয়া জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ। আমি তোমাকে গ্রিসে নিয়ে যাব, জেসন বলল।

সত্যি?

সত্যি।

মেডিয়া জেসনের শরীরে জাদুকরি মলম মাখিয়ে দিল। যে কারণে সেই ব্রোঞ্জের পাওয়ালা নিঃশ্বাসে আগুন ছড়ানো ষাঁড়টিকে লাঙ্গলে জুতে দিতে পারল জেসন। এটি সোনালি মেষচর্ম পাবার একটি শর্ত ছিল।

মনক্ষুন্ন রাজা এটিস এবার বললেন, জানো তো জেসন, অনেক দিন আগে থিবসের রাজা ক্যাডমাস একটি ড্রাগন হত্যা করেছিল।

জানি।

জেসন বলল।

তোমাকে এখন মাটিতে সেই ড্রাগনের দাঁত পুঁততে হবে।

জেসন রাজি হলো।

রাজা এটিস জানতেন ড্রাগনের দাঁত পুঁততেই সশস্ত্র সৈন্যরা মাটি ফুঁড়ে বেরুবে। তারপর তারা জেসনকে আক্রমন করবে।

মেডিয়া জেসনকে জাদুকরী সব অস্ত্র দেয় এবং জেসন সশস্ত্র সৈন্য দের ধ্বংস করে।

কলকিস এর একটি পবিত্র কুঞ্জে সেই স্বর্ণলোম রাখা ছিলো। কুঞ্জটি পাহারা দিত একটি ড্রাগন; যে ড্রাগনটি কখনোই ঘুমাত না। মেডিয়া মায়াবলে ড্রাগনকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। ড্রাগনের দুচোখে দুফোঁটা ন্যাক্রোটিক মায়াপানি ফেলে দিলো। জেসন সোনালি মেষচর্ম নিয়ে জাহাজে ওঠে । সঙ্গে মেডিয়া … মেডিয়া তার ছোট ভাই এপসারটাসকে সঙ্গে নিয়ে ছিলো। রাজা এটিস পিছু নেয়। পিতাকে বিভ্রান্ত করার জন্য ছোট ভাই এপসারটাসকে হত্যা করে সাগরে ফেলে দেয় মেডিয়া। রাজা এটিস ছেলের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ জড়ো করতে থাকে। এই ফাঁকে জেসনরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।

গোল্ডেন ফ্লিস নেওয়া তো হলো, বাকি রইল কী? জেসনের নিজের রাজ্য ফিরে পাওয়া। কিন্তু জেসন নিজ রাজ্যে ফিরে আসার পরে রাজা পেলিয়াস রাজ্য দিতে চাইলেন না। তখন ডাইনি মেডিয়া আবার ত্রানকর্ত্রী হলো। জেসনকে রাজ্য দেওয়ার জন্যে পেলিয়াসের মেয়েদের মাতাল করে তাদের মাধ্যমেই তাকে হত্যা করে এবং মৃতদেহের মাংস রান্না করায়।

কিন্তু তখন সেই রাজ্যের জনগণ ক্ষেপে গেলো। পেলিয়াস খুব প্রজাবৎসল রাজা ছিল্লেন। রাজার মৃত্যুতে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা জেসন-মেডিয়াকে করিন্থে নির্বাসনে পাঠায়।

আচ্ছা, ডক্টর মেয়েরা প্রেমে এতোটা পাগল হয় কেন? আমি এমনও মেয়েকে চিনি যে বাবার সব জমানো টাকা পয়সা নিয়ে বেকার প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যায়। টিউশনি করে নিজের আর বরের পড়ার খরচ যোগায়। চাকরি করে সংসার টানে। তারপর সেই বেকার স্বামী একদিন বড় চাকরি করে আর তার বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে সবচেয়ে নামি ফার্মাসিউটিক্যালসের চাকরিটা ছেড়ে মেয়েটা পরিণত হয় একটা জ্যান্ত পাশবালিশে। চেনেন এমন কাউকে, ম্যাম?

প্রতিভা কিছু বললেন না। তার নিজের সংগ্রামটাও তো অনেকটা মিলে যায় এই গল্পের সাথে। নিজে কোনো উচ্চতর ডিগ্রির জন্য পড়লেন না, বিসিএসের জন্য চেষ্টা করতে পারলেন না, ষোলো হাজার টাকা বেতনের চাকরি একসেপ্ট করলেন, বেসরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের। কারণ সমীরের অনেক পড়ার ইচ্ছা ছিলো সবসময়ই। ওকে সাপোর্ট দিতে গিয়ে নিজের ইচ্ছেগুলো, স্বপ্নগুলোকে গলা টিপে মেরেছেন!

মিলা আবার গল্প শুরু করল,

—- ততদিনে জেসন মেডিয়া দুই পুত্রের জনক। কিন্তু মেডিয়ার এত পরিশ্রম আর সাধের জেসন কী করল? কীভাবে মেডিয়ার সমস্ত কষ্ট আর ভালোবাসার দাম দিলো? করিন্থে এসে জেসন সেই দেশের রাজা ক্রেয়নের মেয়ে গ্লাওসির প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগল আর বিয়ে কর‍তে চাইলো তাকে! যা মেনে নিতে কোনো মেয়ে পারে না, মেডিয়াও পারল না।

জেসন অনেকভাবে মেডিয়াকে বোঝালেও মেডিয়া নিজের দাবী রাখল এই বলে, সে জেসনের জন্যে নিজের বাসভূমি ছেড়েছে,ভাইকে হত্যা করেছে এইজন্যে? জেসন তখন মেডিয়ার সব অবদান অস্বীকার করল, বলল তার সব পাওয়া, দেবী হেরা আর আফ্রোদিতির আশির্বাদ!

জেসন আর রাজা ক্রেয়ন তখন মেডিয়াকে রাজ্য থেকে বের করে দেওয়ার ঘোষণা দিলো।

হায় মেডিয়া হায় জেসনের প্রেমিকা, এই তার পাওনা ছিল? কোথায় এপোলোনিয়াস, যে জেসনকে বলেছিল, মেডিয়া ছাড়া তাকে আর কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। কোথায় দেবী হেরা, কোথায় আফ্রোদিতি আর কোথায় গেল কিউপিড! বিপদে ঠেলে ফেলল ঠিকই মেডিয়াকে কিন্তু ন্যায়বিচার করতে তো কেউ এলো না! পাগলপ্রায় মেডিয়া তখন নিজের প্রতি নিজেই ন্যায় করার প্রতিজ্ঞা করল। সবকিছু মেনে নিয়ে, একদিনের সময় চাইল রাজার কাছে। নিজের ডিজাইন করা জামা উপহার পাঠালো জেসনের হবু বউ গ্লাওসিকে। কিন্তু ডাইনি মেডিয়া তো যাবতীয় পোশন, ওষুধ আর বিষ তৈরিতে সমান পারদর্শী। সেই জামা পরার সাথে সাথেই গ্লাওসির শরীর থেকে মাংস খুলে খুলে পড়তে থাকল। মেয়ের অবস্থা দেখে তার বাবা তাকে বাঁচাতে আসলে তার অবস্থাও একই হয়। বলেন তো ডক্টর, মেডিয়া নামের সেই প্রাচীন ডাইনিটা কি ভুল করেছিল? আপনি ওই জায়গায় থাকলে কি ঠিক সেটাই করতেন না, যেটা মেডিয়া নামের জাদুকরী ডাইনিটা করেছে, বা আমারও তো তাই করা উচিত, বলুন?

মিলার চোখে অদ্ভুত নৃশংসতা। কেঁপে উঠলেন প্রতিভা সেদিকে তাকিয়ে। আশ্চর্য, রাস্তার আলো মুখে পড়ে মিলাকে যেন কোনো বিশুদ্ধ ভাস্করের হাতে তৈরি গ্রীক কোনো দেবীর মূর্তির মতোই দেখা যাচ্ছে। একটুও কাঁপছে না চোখের পাতা, পলকহীন তাকিয়ে তার কাছে উত্তর চাইছে মিলা।

পাথরের মতো নিশ্চলাবস্থা থেকে হুট করে ছটফটিয়ে উঠল মিলা, যে প্রতিভা চমকে গেলেন,

—- ম্যাম আপনার মোবাইলটা একটু দেবেন, মজার জিনিস দেখাবো একটা, আমার সেটে লো ব্যাটারি দেখাচ্ছে।

ইচ্ছে হলো না প্রতিভার কিন্তু যন্ত্রচালিত মানুষের মতো তিনি নিজের মোবাইলটা মিলার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মিলা টপাটপ কোথা থেকে একটা ভিডিও পোস্ট অন করে প্রতিভার হাতে দিলো। একটা নিউজ স্ট্রিমিং হচ্ছে। আজকেরই ঘটনা হয়তো। রিপোর্টার বলে যাচ্ছে, —- রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার এক স্টুডিও এপার্টমেন্টে একজন উচ্চপদস্থ কর্পোরেট কর্মকর্তা আমীরুল ইসলাম ও এপার্টমেন্টে বসবাসরত তার বান্ধবী নাদিয়া হোসেনের লাশ পাওয়া গেছে। শরীরে ধারালো অস্ত্রের এলোপাথাড়ি আঘাতের চিহ্ন। প্রত্যক্ষদর্শি গৃহকর্মী জানিয়েছে দরজা ভেতরদিক থেকে বন্ধ ছিলো। পুলিশ দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। আততায়ী ঢোকার কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। আদৌ হত্যা নাকি আত্মহত্যা তা এখনো নিশ্চিত করে জানা যায়নি। ফরেনসিক বলছে, গতকাল রাত আটটা থেকে বারোটার ভেতর তাদের মৃত্যু হয়েছে। খুব শক্তিশালী মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে তাদের শরীরে। তবে মাদকটি বিশেষজ্ঞদের কাছে একেবারেই নতুন। এই মাদকের প্রভাবে তারা নিজেরা নিজেদের ধারালো কিচেন নাইফ দিয়ে আঘাত করলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।

নিহত কর্মকর্তা বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক। এই বান্ধবির সাথে এই ফ্ল্যাটে তাকে একান্ত সময় কাটাতে অনেকেই দেখেছে। এই বিষয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। এলাকাবাসী বলছে, এই জুটিকে প্রায়ই ঝগড়া করতে দেখা যেত। প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেওয়া না দেওয়া নিয়ে বচসা অনেকেই শুনতে পেয়েছে।

নিউজ রিপোর্টার আরও যোগ করলেন,

—- এই ব্যাপারে মৃত আমীরুল ইসলামের স্ত্রী মিলা ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাকে তার বাসায় পাওয়া যায়নি। তার সন্তানকেও পাওয়া যায়নি।

একটা হাসিখুশি পরিবারের ছবি ভেসে উঠল স্ক্রিন জুড়ে। মিলা, মিলার কোলে আয়শা আর পাশে খুন হয়ে যাওয়া লোকটা!

প্রতিভা কেঁপে উঠলেন। মিলা চুকচুক একটা শব্দ করল। তারপর বলল,

—- বিয়ে তো একটা চুক্তি। স্বামী স্ত্রী দুজনে পার্টনার। একটা পার্টনারশিপে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে অন্য কারো সাথে নতুন পার্টনারশিপে যাওয়া তো উচিত না তাই না? হ্যাঁ, ভালো লাগছে না, বনছে না। পার্টনারশিপ ভেঙে দিক। তালাক নিক। তারপরে অন্য রিলেশনে যাক। একজন বর্তমান থাকতে অন্য কাউকে পছন্দ করা, সময় দেওয়া – চুরি, প্রতারণা, শঠতা এইসব কাজকেও ছাড়িয়ে যায় তাই না? কাউকে হত্যা করাটা অপরাধ, এভাবে যে কারো হৃদয় বিশ্বাস, আত্মা, অনুভূতিকে হত্যা করা হয় সেটা অপরাধ না? আমার সাথে বিয়ের সম্পর্ক আছে, তবে অন্য কারো সাথে কীভাবে প্রেম করে? আমার আবেদন ফুরিয়ে গেছে, ভালো লাগছে না আমাকে! ছেড়ে দিক। তারপর পছন্দের সঙ্গী খুঁজে নিক? নাহ, নামকাওয়াস্তে আমি সাইনবোর্ড হিসেবে থাকব। নইলে লোকের কাছে সাধু পুরুষের ইমেজ নষ্ট হবে তো! যে কাজ সবার সামনে স্বীকার করা যায় না, সেই কাজ করো কেন বাপু? যা গোপন তাই পাপ! আর পাপের শাস্তি তো মৃত্যুই!

— কে মেরেছে ওদের? কীভাবে মারা গেল ওরা? তোতলাতে থাকলেন প্রতিভা।

— মেডিয়া হচ্ছে সবচেয়ে প্রাচীন, সবচেয়ে ক্ষমতাধর, সবচেয়ে নির্মম ডাইনি, জানেন ম্যাম? জাদুবিদ্যার আধার সে! তার মতো মায়া তৈরি করার ক্ষমতা কার আছে? একজন কেমিস্ট হিসেবে আমি জানি, পৃথিবীতে প্রায় একশো বিশেরও বেশি হার্বস আছে যা দিয়ে শক্তিশালী হ্যালুসিনেটিং ড্রাগস তৈরি করা যায়। আর মেডিয়া তো হার্বসের রাণি। ওর সাথে একফোঁটা সেই গ্লাওসিকে দেওয়া নরকের বিষ মিশিয়ে দিলেই, স্পর্শেও সংক্রমন হবে বিষের! ফিইইইহ!

অপ্রকৃতস্থর মতো হাসতে থাকে মিলা। তারপর কঠিন সুরে বলল,

—- মেডিয়া তাই হাজার হাজার বছর ধরে বারে বারে ফিরে ফিরে আসে। পুজো নেয়, ন্যায়বিচার করে, প্রতিশোধ নেয়, বলি নেয়… নিষ্ঠুরতম বলি!

মিলার কথার আগামাথা বুঝলেন না প্রতিভা। তাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রেখে মিলা আবার কাঁদতে শুরু করল, বুক চাপড়ে চাপড়ে,

—- মেডিয়া নিজেও বলি দিয়েছিল জানেন ডক্টর? তার দুই নাড়িছেঁড়া ধনকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিল, জেসনকে শিক্ষা দিতে! জেসনের খুব প্রিয় ছিলো কীনা তার ছেলেরা। আসলে জেসনকে হত্যা করাই ঠিক ছিলো, বলেন? মেডিয়া গ্লাওসিকে হত্যা করেছে, গ্লাওসি কি মেডিয়াকে মেরে ফেলেনি? বিবাহিত জেনেও জেসনকে প্রেমে জড়ায়নি? শুধু মেডিয়ার কেন দোষ হবে? তাইতো জেসন যখন মেডিয়াকে পাকড়াও করতে যায়, মেডিয়ার দাদামশাই, সূর্যদেবতা স্বয়ং সোনালি রথ পাঠায় মেডিয়াকে নিয়ে যেতে!

অদ্ভুতভাবে তাকায় মিলা। বিষন্ন চোখের দৃষ্টি! ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকল আয়েশার দিকে। মিলার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকিয়ে প্রতিভা থরথর করে কেঁপে উঠলেন। চেম্বারে বসে তখন মিলা আয়েশার ডানহাত দেখিয়েছিল প্রতিভা সান্যালকে। বামহাত ঢাকা ছিলো মিলার ওড়নার নিচে। আয়েশার বামহাতে গভীর ক্ষতচিহ্ন। খুব পুরোনো না। নতুনই বলা চলে ক্ষতটা। দুই বা তিন দিন আগের। কোনো জন্তু যেন কামড়ে খুবলে নিয়েছে খানিকটা মাংস!

মিলা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে ফুঁপিয়ে উঠে বলল,

—- মেডিয়ার শুধু রক্ত চাই, মাংস চাই, মৃত্যু চাই। খুব নৃশংস, নির্মম আর পাশবিক ডাইনি সে। তার পুজো চাই, বলি চাই। কালোযাদুর অভিশাপ গ্লাওসিকে ছাড়ে না, জেসনকে ছাড় দেয় না, মেডিয়াকেও ক্ষতবিক্ষত করে রেখে যায়। আমাকেও বলি চড়াতে হবে। চড়াতেই হবে! হয় নিজেকে বলি দিতে হবে নইলে সবচেয়ে প্রিয়তমকে। কালো যাদু কাউকে মাফ করে না!

মিলার অনেক রূপ দেখেছেন প্রতিভা একদিনেই। কিন্তু এই শেষটুকুই মনে হলো আসল মিলা। মমতাময়ী মিলা!

আয়েশার কপালে চুমু ছোঁয়ালো মিলা তারপর খুব কোমল কন্ঠে বলল,

—- ম্যাজিক শব্দটা শুধু ভালোবাসাতেই থাকতে হয় জানেন ম্যাম? কখনো প্রতিশোধে নয়। চয়েস ইজ ইয়োরস!

মিলার কথা শেষ হতেই কোথা থেকে এক টুকরো মেঘ উড়ে এলো আর কুয়াশার মতো। ঢেকে নিলো মিলাকে। অটল পাথরের মতো প্রতিভা তাকিয়ে থেকে দেখলেন, সোনার রথ থেমেছে গাড়ির জঙ্গলের মাঝে। গাড়ি ভেদ করে সেই রথে চেপে বসল মিলা আর সুদূরে মিলিয়ে গেল!

আর কিছু মনে করতে পারেন না প্রতিভা। রতনের ডাকে ঘোর ভাঙল তার। রতন বলছে,

—- দিদি, কোথায় যেতে হবে বলেছিলেন? এই বাচ্চাটাকে কোথায় নামিয়ে দিয়ে আসতে হবে বলছিলেন? কোথায়? এর বাবা মা কোথায়?

সবটা একটা স্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিতে পারতেন প্রতিভা। এতক্ষণ যা ঘটল, যা শুনলেন সবটাই ডিলিউসন বলে মেনে নিতেন। যার কোনো যুক্তি নেই, ভিত্তি নেই তা কীভাবে মানবেন তিনি? যদি না আয়েশাকে দেখতেন! গাড়ির সিটে চার হাতপা চারদিকে ছড়িয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসছে আয়শা। সেদিকে তাকিয়ে প্রতিভার ঠোঁটের কোণায় অদ্ভুত এক হাসি এলো। তিনি স্বগোতক্তি করলেন,

—- সেক্টর দশ। সাত নম্বর রোড। বায়ান্ন নম্বর বাসা। লিফটের চার তলায় উত্তর পাশের ফ্ল্যাট!

চলবে…
আফসানা আশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here