ডাইনি – ২।

0
451

ডাইনি – ২।

ড. প্রতিভা চেম্বার করেন বনানীতে। সাইকিয়াট্রিস্ট। অল্পদিনেই বেশ ভালো পসার তার। মানুষ আগের তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্যসচেতন হয়েছে। মানসিক রোগ বলতেই পাগল ভেবে নিচ্ছে না। জিন, ভুতের আছর, বাতাস লাগা বা ঢঙের উপর দোষ না চাপিয়ে মনের অসুখের কারণ খুঁজে সমাধান বের করতে চায়। আর প্রতিভা তাদের সাহায্য করেন। রাত আটটা পর্যন্ত রোগী দেখেন প্রতিভা। আজ বিকেলেই চেম্বার শেষ করে বাড়ি যাবেন। অনেকদিনের ব্যস্ততার পরে হাজবেন্ডের সাথে একটা ট্যুরপ্ল্যান করেছেন, কাছাকাছিই, রাত আটটায় রওনা হয়ে গেলে গাজিপুরের জ্যাম ছাড়িয়ে ঘন্টা খানেকের রাস্তা। ফোন করে কীভাবে কী গুছিয়ে দেবে সব ইন্সট্রাকশন দিলেন মেইডকে। তারপর তাকালেন মিলার দিকে। মিলার কোলে আয়েশা, ওর হাতে একটা কলম, সেটা নিয়েই চুপচাপ খেলছে। বেশ হাসিখুশি লক্ষি বাচ্চা। প্রতিভার ছেলেটা একই বয়সী কিন্তু একটু ফুসি আর হাইপার এক্টিভ। দুটো কাজের লোক মিলেও সামাল দিতে পারে না। পেশাগত কাজে প্রতিভাও খুবই ব্যস্ত থাকেন, তারপরও যতটা সম্ভব সময় দেন তিনি পরশকে। প্রায়ই নিজের সাথে করে কর্মস্থলে নিয়ে আসেন।

আয়েশা ‘দাদাদাদা’ সাউন্ড করে কলমটা নিয়ে খেলছে। ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন প্রতিভা। আদুরে গলায় বললেন,

—- ওহ! খুব এডোরেবল বাচ্চা তো। আপনার মেয়ে?

—- হুম!

মাথা নাড়ল মিলা। চোখে পানি এলো ওর।

— আপনি মিলা?

—- হ্যাঁ।

— বলবেন আমাকে কী হয়েছে?

মিলা কিছু বলল না। আয়েশার মাথার উপর চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরল আলতো করে।

প্রতিভা বুঝলেন, সমস্যাটা বাচ্চাটাকে নিয়ে। কিন্তু মিলা এখনো সবকিছু বলার জন্য প্রস্তুত করতে পারছে না নিজেকে। আচ্ছা, আস্তে আস্তেই বলুক। হাতে সময় আছে অনেক। ওকে সহজ করতেই ড. প্রতিভা বললেন,

— মিলা আপনি কি চা খাবেন অথবা কফি? আমরা নাহয় গল্প করি একটু। তারপর সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে যাবে।

—- চা। কফি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল মিলা।

প্রতিভা হাসলেন। তিনি নিজেও প্রথম বাচ্চাটার জন্মের সময় কনসিভ করার পরেই কফি ছেড়েছেন। বেল টিপে এসিস্ট্যান্টকে দুটো চা আনতে বলে মিলার দিকে তাকালেন আবার,

—- ও কি হাঁটতে শিখেছে? নামিয়ে দিতে পারেন কিন্তু। আমার ছেলের অনেক খেলনা আছে এখানে, ও খেলতে পারবে।

—- আমি চাইছিই ওকে আমার কাছ থেকে দূরে সরাতে। নইলে আমি ওকে মেরে ফেলব। শুধু মেরে ফেলব না, খেয়ে ফেলব চিবিয়ে চিবিয়ে।

হুট করে বলল মিলা।

প্রতিভা চমকালেন না, এরকম কথা উনি প্রতিদিনই শোনেন। বিভৎস সব বর্ণনা নোট করেন। কিন্তু মিলার চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন বিব্রত লাগল। কেমন পিশাচ পিশাচ চাহনি। সেই অনুভূতিটা ঝেড়ে ফেলে প্রতিভা মিলার দিকে তাকালেন। মিলা চোখ নামিয়ে নিয়েছে। প্রতিভা বললেন,

—- নাম কী ওর?

— আয়েশা।

— প্রথম বাচ্চা?

—- হ্যাঁ।

— বাচ্চার বাবা কোথায়?

—- অফিসে। অনেক ব্যস্ত।

— আপনি এখানে এসেছেন, তিনি জানেন?

—- না।

— আপনার সমস্যার কথা জানেন তিনি?

মিলা জোরে জোরে মাথা নাড়ায়।

— জানেন না? কথা বলুন প্লিজ। ইশারায় বলবেন না!

— না, ওকে বলিনি।

চোখ না তুলেই বলে মিলা।

— আচ্ছা। কোনো সমস্যা নেই। পরে কোনো একসময় ডেকে নেওয়া যাবে।

— না! জোরে চিৎকার করে মিলা।

এসবেও অভ্যাস আছে প্রতিভার। অনেকসময় অনেক রোগীই হাইপার হয়ে যায়। তখন সেই পার্টিকুলার সেগমেন্টটা ছেড়ে দিতে হয়। প্রতিভা চুপ করে থাকলেন তবে আয়েশা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল। মিলা খানিকটা সময় চেষ্টা করল ওকে ঠান্ডা করার, পারল না। মিলা ক্ষেপে যেতে থাকল,

—- এই মেয়েটাই যত নষ্টের গোড়া!

বলে আক্ষেপ করল।

প্রতিভা ধারণা করলেন মিলা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দশ হাজার জন নতুন মায়ের উপর করা একটা গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি সাতজনে একজন মা এই পিপিডি বা প্রসবপরবর্তী বিষন্নতার ভেতর দিয়ে যান। প্রতিভা জোর দিয়ে বলতে পারেন এই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। উন্নত দেশের মায়েদের উপর করা পরীক্ষা এই সাবকন্টিনেন্ট প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই মিলবে না, যেখানে প্রতিটি মায়ের প্রয়োজনীয় বিশ্রামকেও ঢং হিসেবে দেখা হয়। শারীরিক পরিবর্তনটা স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়, মানসিক পরিবর্তনের খোঁজ কেউ রাখে না। প্রতিভা নিজেও ভুক্তভোগী। বড়ো মেয়েটা স্বর্ণ, এবার কেজি ওয়ানে পড়ছে। ছেলে পরশ ছোটো। মেয়েটার জন্মের সময় মা বেঁচেছিলেন, আর হাজবেন্ড সমীরও এত ব্যস্ত ছিলো না। সমীর অপথমোলজিস্ট, রাশিয়া আর কানাডার দুটো ডিগ্রি নামের সাথে এড হওয়ার পরে তাকে আর সংসারের বা বাচ্চাদের কোনো দরকারেই পাওয়া যায় না। নিজের তো আর উচ্চতর পড়াশুনা হলোই না, উলটো পরশ হওয়ার পরে হাসপাতালের চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন প্রতিভা, শুধু বনানীর এই চেম্বারটাই আঁকড়ে রেখেছেন বড়ো কষ্টে। অথচ একাডেমিক রেজাল্ট সমীরের চাইতে অনেক ভালো ওর। দিনের শেষে ব্যাচমেটদের বড়ো বড়ো এচিভমেন্টের খবর পেলে মনটা আনমনা হয়ে যায়। কারো সাথে যোগাযোগ করার সময়ও পান না প্রতিভা সান্যাল, কিন্তু তারই ব্যাচমেটরা কেউ কেউ কত কী করে ফেলছে! ভাগ্যিস কাজিন রিতাকে পেয়েছিলেন, মেয়েটা নিজের পড়াশুনার পাশাপাশি স্বর্ণ আর পরশের খেয়াল রাখছে, নইলে সার্টিফিকেটগুলো আলমারিতে ভরে সেই হাউজওয়াইফ তকমা লাগিয়ে ঘুরতে হতো ওকে। কাজের লোকেদের কাছে বিশ্বাস করে বাচ্চা রেখে কাজে আসে যেসব ওয়ার্কিং মায়েরা তাদের স্যাক্রিফাইস চিন্তা করে তাদের প্রতি সম্মান বেড়ে যায় অনেক। এ যেন মন এক জায়গায় আর দেহ আরেক জায়গায়। সারাক্ষণ বাচ্চাদের চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে। রিতা খেয়াল রাখে বলেই একটু ভরসা পান প্রতিভা।

সব মিলিয়ে ভালোই আছেন প্রতিভা, তবুও এই যে মন কেমন করাটাকেই এড়াতে পারেন না কিছুতেই। আরেকটু প্রশংসা পেতে ইচ্ছে করে, একটু কেয়ার, একটু অকারণ ভালোবাসা! মাঝেমাঝে তারও তো ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে চা-বাগানের পথে হাঁটতে। লেমন টি গার্ডেনের কচি সবুজ পাতাগুলোকে হাতে জড়িয়ে নিতে! বাগানঘেষা কমলা লেবুর গাছ থেকে চুরি করে কাচা কমলা পাড়তে ইচ্ছে হয়! গরমের দিনে সবুজ ঘাসের কার্পেটে খালি পায়ে হাঁটতে, ঝুম বর্ষায় সমীরের কাঁধে মাথা রেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘন দুধ চায়ে টোস্ট বিস্কিট ডুবিয়ে খেতে, কোনো কোনোদিন রাতে সমীরের সাথে ছাদের বাতাসে বসে থাকতে ইচ্ছে করে, একা একা টিভিতে ‘তিতলি’ সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে। দোকানির ছাব্বিশশো টাকা দাম বলা জামাটা মুলোমুলি করে আটশো টাকায় কিনতে নিউমার্কেট যেতে মন চায়। বিয়ের প্রথম বছরের মতো চায়নায় গিয়ে প্রাচীন গ্রামগুলোর উঠোনে বসে সেদ্ধ নুডুলস খেতে ইচ্ছে করে অথবা যাস্ট কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে।

এন্টিডিপ্রেসেন্ট ট্যাবলেট গিলে ফেলে সেসব ভুলে পেশেন্টের সামনে হাসিমুখে বসে যান প্রতিভা।

অনেক বলেকয়ে, জেদ করে, ঝগড়া করে সমীরের ব্যস্ত শিডিউল থেকে তিনটে দিন বের করিয়েছেন এই বেড়াতে যাওয়ায় জন্য। মিলার জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে। একেও নিজের মতো দুটো এন্টিডিপ্রেসেন্ট লিখে দিয়ে সামনের সপ্তাহে আসতে বলবেন ভাবতেই মিলা মুখ খুলল,

—- আমি খুব সমস্যায় আছি ডক্টর। আমার খাবারে রুচি নেই কিন্তু কাঁচা মাছ-মাংস খেতে ভালো লাগে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর হলো…

চুপ করে যায় ও।

আয়েশা ঘুমিয়ে গেছে মিলার কোলে। প্রতিভা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন মিলার কথা কিন্তু মিনিটখানেক ও কোনো কথাই বলল না। আস্তে আস্তে মিলার মুখের ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি পরিবর্তন হতে লাগল আর প্রতিভা বিস্মিত হতে হতে দেখলেন মিলার মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে আর ও বলছে,

—- আমার এই বাচ্চাটাকে খুব লোভনীয় খাবার মনে হয়। মনে হয় কচকচকচ করে খেয়ে ফেলি!

পেশাগত কারণে অনেক রকম বিকৃত কথা, নোংরা পরিকল্পনা, ভয়ংকর আলোচনার সম্মুখিন হতে হয়েছে প্রতিভাকে, কিন্তু এমন গায়ে কাঁটা দেওয়া অনুভূতি কখনোই হয়নি। মিলার চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক না একেবারেই। প্রতিভার মনে হতে থাকে বইয়ের পাতায় যে পিশাচের গল্প পড়েছেন, ওর সামনে একটা সেই জলজ্যান্ত পিশাচ বসে আছে। ডিপ্রেশনে ভোগা মায়েরা নিজের বাচ্চাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে, ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে, কেটে দুটুকরো করে ফেলেছে, মেডিকেল হিস্ট্রিতে এমন অনেক কেসই আছে, অজানা নয় কিছুই প্রতিভার, তবুও কেমন জানি লাগল। অনেকদিন বদ্ধ থাকলে মরাদীঘির শ্যাওলা পচে যেমন গন্ধ বের হয়, তেমনি একটা পচা গন্ধ তার আশেপাশেই ঘুরতে লাগল। বিকট নয় গন্ধটা কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে প্রতিভার। চট করে ডাকলেন তিনি,

—- মিসেস মিলা?

মিলার ঘোর কাটল। ও চমকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল, —- গত কয়েকটাদিন আমার উপর দিয়ে যে কী যাচ্ছে! আমার মনে হচ্ছে আমি পজেসড। কোনো ডাইনি ভর করেছে আমাকে। আমি আমার বাচ্চাটাকে যেকোনো সময় খেয়ে ফেলব! আগে ওর খাওয়া, পুষ্টি, ওজন নিয়ে আমার অনেক অভিযোগ ছিলো। এখন ওকে অনেক হেলদি মনে হয়। তেলতেলে, গোলগাল। মনে হয় খুব টেস্টি কিছু। এপেটাইজিং। আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান প্লিজ!

— কাঁদবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

— কিছু ঠিক হবে না ডক্টর। আমি আয়েশার হাত কামড়ে জখম করে দিয়েছি দেখেন?

আয়েশার হাতটা তুলে ধরল মিলা। কেঁদে কেঁদে বলল, —- এইখান থেকে কামড় দিয়ে রক্ত, গোশত খেয়ে ফেলেছি আমি। আমার বাচ্চাটা যন্ত্রনায় কেঁদেছে আর আমি মজা করে ওর মাংস চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছি। দেশি মুরগির গিলা যেমন দাঁতের নিচে কচকচ করে, সেইরকম করে!

ফুলেফুলে কাঁদতে থাকল মিলা।

প্রতিভা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটা মেয়ে এসেছিল কয়েক দিন আগে চেম্বারে, আঠারো বছর বয়স, হাজবেন্ড নিয়ে এসেছিল। একটা বাচ্চা আছে তিন মাসের। মেয়েটা বাচ্চাটাকে সাপের বাচ্চা মনে করত। দুধ খাওয়াত না, কোলে নিতে চাইত না। কোলে কেউ দিলেই ফেলে দিতো। ফেলে দিয়ে মাথাও ফাটিয়ে দিয়েছিল বাচ্চাটার।

আরেকটা মেয়েও এই পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন নিয়েই এসেছিল, সেও সিভিয়ার অবস্থায় ছিলো, তার মনে হতো ওর খাবারে সবাই বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। ওকে হসপিটালাইজড করতে হয়েছিল, স্বাভাবিকভাবে খাবার খাচ্ছিল না, আশ্চর্যের বিষয় হসপিটালে খুব কড়াকড়ি অবজার্ভেশনে থেকেও ওর শরীরে বিষের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে মেয়েটা।

আয়েশার মাখন নরম, তুলতুলে হাতটা একদম অক্ষত! তার মানে সবই মিলার কল্পনা। ডিলিউসন বলা যায়। ও যা ভাবছে, যা দেখছে, যা করছে তার কিছুই বাস্তবে ঘটছে না, কল্পনায় হচ্ছে। আর বাস্তব, কল্পনা মিলিয়ে ও নিজের মতো করে আরেকটা বাস্তব তৈরি করে নিয়েছে। এখন কয়েকটা টেস্ট দিয়ে ডিলিউশনের মাত্রা বুঝতে হবে। সিজোফ্রেনিয়া স্টেজে চলে গেলে কিউর করাটা কঠিন হয়। তখন ডাক্তার, রোগী, রোগীর এটেনডেন্ট সবার সম্মিলিত চেষ্টা ছাড়া রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব হয় না।

— মিসেস মিলা?

— হুম

—- হুম না, স্পষ্ট করে বলেন জি?

— জি?

—- আপনার হাজবেন্ডকে সাথে নিয়ে আসবেন।

— না!

আঁতকে ওঠে মিলা।

—- আচ্ছা বেশ। বাবা, মা? ভাইবোন? বন্ধু?

— আমার কেউ নেই ডক্টর!

— আচ্ছা। আপনি নিজেই যথেষ্ট। আপনি যে কতটা সাহসী বুঝতে পারছেন? নিজের সমস্যা আইডেন্টিফাই করেছেন নিজে নিজেই, সমাধানও বের করেছেন নিজেই, আমার কাছে সাহায্যের জন্যে এসেছেন, আপনি তো অনেক স্মার্ট। নিজের সমস্যার অর্ধেক সমাধান তো নিজেই করে ফেলেছেন? বাকি যতটুকু আমরা কথা বলেই ঠিক করে ফেলব? বন্ধু নেই বললেন, কাউকে না কাউকে তো আপনি আপনার সমস্যার কথা বলেছেনই। আমার খোঁজ কে দিয়েছে আপনাকে? সেই বন্ধুটির সাথেই নাহয় কথা বলি একবার?

খিকখিক করে হেসে উঠল মিলা।

—- আপনাকে তো আমার খুঁজতেই হতো অথবা আপনি আমাকে! আমাকে যার দরকার হয় আমি ঠিক তার কাছে চলে যাই। আপনাকে আমার দরকার আর আমাকে আপনারও খুব দরকার, ডক্টর!

চিড়িয়াখানার মাংসাশী জন্তুগুলোর খাঁচার সামনে যে বোঁটকা গন্ধ বেরোয় সেইরকম দুর্গন্ধে ঘরটা ভরে গেল। নাক সিঁটকে গন্ধের উৎস খুঁজতে থাকলেন প্রতিভা সান্যাল।

মিলা গুণগুণ করে গান গাইছে,

—- ঘুম পাড়ানি মাসীপিসি মোদের বাড়ি এসো, খাট নেই পালং নেই আসন পেতে বোসো।

বাটাভরা পান দেবো গালভরে খেও।

আমার বাবুর চোখজুড়ে ঘুম দিয়ে যেও।

সাথে সাথে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে পেট করছে আয়েশার গায়ে।

মিলার অবস্থা সঙ্গিন মনে হচ্ছে প্রতিভার। আরেকটা সেশন দরকার হবে, রোগটা বুঝতে। আর মিলার হাজবেন্ডকে দরকার বেশি সবচাইতে। মিলা না চাইলেও তার সাথে কন্টাক্ট করার ব্যবস্থা করতে হবে। নিজের একজন পেশেন্টেকেও সামান্যতম বিচ্যুতির সুযোগ দিতে নারাজ প্রতিভা। কিছু কিছু আনসলভড কেস থেকে গেছে, রহস্য হয়ে। কিন্তু কোথাও প্রতিভার আন্তরিকতায় বিন্দুমাত্র খুঁত থাকে না। আর মিলার কেসটা যথেষ্ট জটিল মনে হচ্ছে ওর। পিপিডি বা বেবি ব্লুজ না আরও জটিলই মনে হচ্ছে।

বাইপোলার ডিজঅর্ডার হতে পারে। হঠাৎ হঠাৎ মুডচেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে দুজন আলাদা মানুষ। এক জনের সাথে আরেক জনের কোনো মিল নেই। থাইরয়েড লেভেলটা চেক করতে হবে। আর কয়েকটা সাইকোলজিক্যাল টেস্ট। ইপিডিএস লিখলেন। তবে সবচেয়ে দরকার পরিপূর্ণ বিশ্রাম আর পর্যাপ্ত সাপোর্ট। পার্টনারের সাপোর্ট বেশি দরকার।

প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে প্রতিভার ফোনটা বেজে উঠল। বাসা থেকে ফোন এসেছে, কখন বেরোচ্ছে প্রতিভা সেটাই হয়তো জানার জন্য। প্রতিভা ভুরু কুঞ্চিত করে কলটা কেটে দিলেন। বাচ্চারা, রিতা, কাজের লোক, সমীর, সবাই হয়তো তৈরি হয়ে বসে আছে প্রতিভার অপেক্ষায়। ইশ বিকেল গড়িয়ে গেছে, থাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি।

মিলা গুণগুণ করে গান গেয়ে উঠল,

—- রিতা ও রিতা তুমি আমার মিতা!

প্রতিভা চমকে উঠলেন। মিলা শুধু একের পর এক বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছে ওর জন্য। সে তো একবারও রিতার নাম নেয়নি আর ফোনেও ‘সমীর ওল্ড’ লিখে কন্টাক্টটা সেইভ করা। রিতা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসলে সমীরেরই একটা পুরনো সিম, পুরোনো একটা হ্যান্ডসেটে ভরে ওকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। পরে রিতা অনেকগুলো সেট চেঞ্জ করেছে কিন্তু সিমকার্ড সেটাই রয়ে গেছে আর প্রতিভার কন্টাক্ট লিস্টেও নামটা চেঞ্জ করা হয়নি।

মিলা কীভাবে বলল এটা? বিজ্ঞানে টেলিপ্যাথি বা থটরিডিং এর সঠিক ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি, রহস্য পুরোটাই। প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে। সেরকম কোনো রহস্যের মুখোমুখি কি প্রতিভা?

মিলা চোখ নামিয়ে নিয়েছে। আয়েশার দিকে তাকিয়ে আছে। এক টুকরো চতুর কিন্তু মায়াবী হাসি ঠোঁটের কোণায়….

চলবে…
আফসানা আশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here