বিষ_করেছি_পান(১১)

0
610

#বিষ_করেছি_পান(১১)

(কপি করা নিষেধ)
রাগে ছুটির মাথা ফেটে যাচ্ছে। রিতী শুয়ে শুয়ে ব্যাথায় আহ!ইস! করছে। রুম্পা আঁচলে মুখ ঢেকে গুনগুনিয়ে কেঁদে চলছে। ছানোয়ার নাকের ডগায় চশমা এনে প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধ মেলাচ্ছে। আর মুখে একের পর এক গাঁজাখুরি বকাবকি করে যাচ্ছে।
— তোর বয়সে আমি লাফিয়ে লাফিয়ে গাছে উঠতাম। এক লাফ দিয়ে নদীর মাঝখানে গিয়ে পড়তাম। ছাদের থেকে মাটিতে লাফ দিতাম ‌‌। ট্রেনের ছাদে উঠে বাড়ি আর কলেজ যাতায়াত করতাম। কোনদিন আমার কিছু হয়নি। আর তুই আমার মেয়ে হয়ে কিভাবে রিকশা থেকে পরে গিয়ে পা ভাঙস? তোর লজ্জা হওয়া উচিত। তুই আমার মেয়ে হতেই পারস না। তুই তোর মায়ের মেয়ে। আলসে। অষ্টরম্ভা। আমার মেয়ে হলো ছুটি। পাখির মতো চলন বলন। আজ থেকে তুই ঘরের বাইরে বের হবিনা। তোর বাইরে বের হওয়া বন্ধ।
— বড়াপু বলেছে বিছানা থেকেই নামবে না।
তমাল কথাটা বলার সাথে সাথেই খায় এক রামধমক।
— তোমার পড়া নেই? অ আ সব শিখে ফেলেছো? যাও পড়তে বসো।
— আমি পড়বোনা।বড়াপু কাঁদে। বড়াপুর কাছে থাকবো।
— না করেছি তোমাকে?

রুম্পা মুখ থেকে আঁচল সরায়। ভাঙা গলায় বলে,
— ও রিতী? ভাত নিয়ে আসি মা? খেয়ে ঔষধ খা। নয়লে ব্যথা কমবেনা।
— আনো।
রুম্পা থালা ভরা ভাত নিয়ে আসে। রিতী চার-পাচ লুকমা খেয়ে আর খেতে চায়না। বাকি ভাত তমাল ছুটিকে খাওয়ায়। ছানোয়ার রিতীকে ঔষধ এগিয়ে দেয়। ঘুমাতে বলে সবাই চলে যায়। ছুটি যখন যাবে তখন রিতী খ্যাক করে উঠে।
— তুই কোই যাস?
— ঘুমাবোনা?
— না ঘুমাবিনা। এখানে বসে বসে আমাকে পাহারা দিবি।মশারী টানাবিনা। সব মশা মারবি। একটা মশাও যেনো আমার গায়ে না বসে।
— আমি ঘুমাবোনা?
— না বললাম তো। তোর পেয়ারের মাস্তানটার জন্য আজকে আমার এই অবস্থা। শয়তানটা টেনে টুনে বাইকে বসালো। আবার ফেলে দিয়ে কোমড় টাও ভাঙলো। কত্তো বড় পাজি জানিস? ওর জন্য তোর এতো দরদ না? এখন তুই সারারাত জেগে আমার সেবা করবি।
ছুটি অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। সত্যি সত্যিই ছুটি রিতী কেউই সারারাত ঘুমোতে পারেনা। রিতী এপাশ ওপাশ ঘুরতে গেলেই মাগো বলে চিৎকার করে উঠে। সোজা হয়েও থাকতে পারেনা। ব্যথায় মুখটা শুকিয়ে গেছে। পেইন কিলারে কাজ হয়না।আপুকে দেখে ছুটির চোখ টলমল করছে। মাঝরাতে রিতীর গা কাঁপুনি জর আসে। রুম্পা ছানোয়ার অস্থির হয়ে উঠে। টানা চারঘন্টা মাথায় পানি দিয়ে জ্বর কমাতে হয়। প্রতিবেশীরা এক এক করে রিতীকে দেখে যাচ্ছে। বীনা এসে রিতীর মুখে লেবুর টুকরা ঢুকিয়ে দেয়। মুখে রেখেই চুষতে বলে। ছুটির শরীর আর টানে না। থপ থপ পা ফেলে নিজের বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পরে। দুদিন আর স্কুলে যাওয়া হয়না।

আজ বাঁধন ঝিমাকে নামিয়ে দেয়নি। বাঁধন গেছে বান্দরবান। অফিসের কাজে। ঝিমা ছুটি একসাথে স্কুলে এসেছে। আসার সময় শিপ্রুকে বলে এসেছে বিকালে সবাইকে মিটিং এ ডাকতে। আজ প্রথম ক্লাস মেহের স্যারের। মেহের স্যার গণিত ক্লাস নেন। রোল কলের সময় ছুটির পেজেন্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন। যতক্ষন না রোল কল শেষ হচ্ছে ততোক্ষন ছুটি দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু কেনো দাঁড়িয়ে থাকবে? ছুটিতো কিছু করেনি। আজ গল্প ও করেনি যে স্যার দাড় করিয়ে রাখবে। স্যার স্যার বলে ছুটি দুবার ডেকে উঠলো। মেহের স্যারের চোখ করে তাকানো দেখে ছুটি আর ডাকলোনা। সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলো। রোল কল শেষ হলো। মেহের স্যার ছুটির দিকে নজর দিলো। ছুটি বললো,
— স্যার? বসি?
— না দাঁড়িয়ে থাকো।
— কেনো স্যার? আমি কি করেছি?
— তুমি এপ্লিকেশন না জমা দিয়েই দুদিন ক্লাস মিস করেছো। ইম্পর্টেন্স চ্যাপ্টারগুলো মিস করেছো। এমনিতেই তুমি ফেল। তোমার কাছে আশা করাই বেকার। তবুও তো চেষ্টা করতে হবে। তোমার বোনের সম্মানটাতো রাখবে।
মেহের স্যার রিতী সবসময় গণিতে আটানব্বই পেয়ে আসছে বলে রিতীকে খুব পছন্দ করেন। রিতীর উপর যেমন ছিলেন সন্তুষ্ট ছুটির উপর ও তেমন বিরক্ত। ছুটিকে বাঁশ দিতে সদা সর্বদা সচেষ্ট। ছুটি সেই ব্যপারটাই কাজে লাগায়। মিথ্যা মিথ্যা কান্না শুরু করে। মেহের স্যার সহ ছাত্রীরা হকচকিয়ে উঠে।
— আরে আরে তুমি কাঁদছো কেনো? কি অবস্থা!
— আপুর জন্য কাঁদছি স্যার।
— কেনো তোমার আপুর কি হয়েছে?
— আপু হসপিটালে ভর্তি স্যার। কাল তাকে হসপিটাল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। আপুর কাছে ছিলাম জন্য ই তো স্কুলে আসতে পারিনি। মার বয়স হচ্ছে। হসপিটালের খাটুনি কি আর খাটতে পারে বলুন?
— কি বলছো? এখন তোমার আপু কেমন আছে?
— ভাঙা কোমড়। কেমন আর থাকবে? বিছানাতেই পরে আছে। বিছানাতেই থাকা খাওয়া গোছল এমনকি টয়লেট ও সারে। আর এসব কিছু আমাকেই করতে হয় স্যার।
— ইসসস রে… তোমার বাবার সাথেও বোধহয় এই কারনেই দেখা হয়না এখন।
— জি স্যার। এইযে আমি স্কুলে আসছি।সেটা জানাতেই তো আসছি। এপ্লিকেশন দিয়ে এই ক্লাসটা করেই চলে যাবো দু তিনদিনের ছুটি নিয়ে।
— থাক মন খারাপ করোনা। আমরা দোয়া করি তোমার আপু তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে। বসো বসো।
ছুটি বসে পরে। ঝিমা গুতা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
— কেয়া এক্টিং দোস্ত! এই ক্লাস শেষেই চলে যাবি?
— তুইও যাবি।
— আমার সম্ভব না।
— বাঁধন ভাই নেই। ভয় পাস নাতো। পেট ব্যথার কথা চালিয়ে দিলেই হবে।

বিকালের মিটিং টা বসে ভর দুপুরে। ছুটি ঝিমা স্কুল থেকে এসে বাড়িতে না ফিরে মাঠে গিয়ে বসেছে। রতন মাথায় হাত দিয়ে আছে। মলি হতভম্ব।
— আবার এই সোহাগ্গে!
শিপ্রু কপাল থেকে চুল সরিয়ে বলে,
— এই হারামজাদা আবার রিতীদিরে আঘাত দিছে?ব্যাটা খারাপ! মেয়ে মানুষের উপর টর্চার করে। আমার কিন্তু এবার রাগে ধুর ছিড়ে যাচ্ছে।
ঝিমা ব্যাগ থেকে ওয়াটারপট বের করে শিপ্রুর হাতে দেয়।
— নাও। ধুর ভিজাও।
শিপ্রু ছু মেরে নিয়ে নেয়। গলা ভিজিয়ে নেয়। আবার ঝিমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
— মসকরা করস আমার সাথে?
— আমি আবার কই মসকরা করলাম?
— চল। আজ সরাসরি কথা হবো।
— আমার ভয় লাগতাছে।
— আমরা এতোগুলা মানুষ। ভয় পাবার কি আছে? ঐ ভীতুরে ভয় পাস? দেখিস নাই সেবার কি ভয়টাই পেলো।
সেবারের কথা মনে করেই সবাই একসাথে খিলখিল করে উঠলো।

পঁয়ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করে সোহাগের দেখা পাওয়া গেছে। সবাই একজোটে সোহাগের সাথে কথা বলতে যায়। সোহাগ এদের দেখে ভ্রু কুচকায়। সোহাগের পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্কেন করে ছুটি গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
— সোহাগ ভাই। আপনি কবে আমার আপুর পিছু ছাড়বেন?
— ছাড়বোনা।
শিপ্রু বলে,
— তো কি করবেন?
— তোমাগো বোনের সাথে প্রেম করবো। লাইলি মজনুর প্রেম। প্রেমে আমরা ভেসে যাবো।
— রিতীদি আপনার সাথে প্রেম করবোনা। স্পর্শ দেখবেন না। আপনি খারাপ মানুষ সবাই বলে। কিন্তু আমরা আপনাকে সম্মান করি। আপনি সিনিয়র মানুষ। আমাদের মোড়েই আড্ডা দেন। তাই বলতাছি রিতীদির পিছু ছাড়েন।
মলি বলে,
— আপনার জন্য রিতী আপুর কোমড় ভাঙছে। আপনি আর রিতী আপুরে ডিস্টার্ব করবেন না। ওর আশেপাশে যাবেন না। নয়তো…
— নয়তো?
— নয়তো আপনার এমন হাল করমু চিন্তাও করতে পারবেন না।
— ওমাগো ভয় পাইলাম।
সোহাগ একপা পিছিয়ে ভঙ্গি করে বলে। উপস্থিত সবাই বিরক্ত হয়। সোহাগ পাশের হোটেলে ডেকে বলে,
— ঐ টেবিলে খাবার লাগা। মেহমান আসছে।
রতন বলে,
— আমরা মেহমান না। খাবোনা।
— আরে শালা শালী তো।
ঝিমা বলে,
— আমরা আমাদের আপুর সাথে আপনার বিয়ে দিবো না।
— তুমি খুকি চুপ করো। এসব বড়োদের ব্যাপার । চলো হোটেলে চলো।
— না আমরা খাবো না।
— আরে বড় ভাই লাগি তো। আসো।
সোহাগের কথায় কেউই যায়না। বরং উল্টো ঘুরে চলে আসে। সোহাগ হো হো করে হেসে উঠে।

রিতীকে দেখতে মেহের স্যার উপস্থিত। সাথে করে নিয়ে এসেছে একগাদা ফলমূল,জুস,ব্রেড। সবগুলো রোগীর পথ্য। ফ্রিজ উপচে পড়ছে। মেহের স্যার ছানোয়ারের সাথে ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছে। একটু পর পর হো হো করে হেসে উঠছে। উপর থেকে রিতী শুনে জিজ্ঞেস করে,
— কে এসেছে রে? গলাটা চেনা চেনা লাগছে।
— মেহের স্যার এসেছে।
— বাবার কাছে?
— না তোমার কাছে। স্যারকে বলেছি তোমার কোমড় ভেঙেছে। তাই স্যার রোগীর পথ্য নিয়ে চলে এসেছে।এখন থেকে তোমাকে ওসব ই খেতে দেওয়া হবে। ভাত ক্যান্সেল।
— স্যারের সাথে তো দেখা করা উচিত।যাবো কিভাবে?
— স্যার ই আসবে। তুমি কেনো যাবে? তোমার মুখদর্শন না করে তো আর যাবেনা।
— এভাবে কেনো বলছিস? তোকে দেখতে পারেনা জন্য?
— তো কিভাবে বলবো? যে স্যার ছাত্রীর উপর কুদৃষ্টি দেয় সেই স্যারের সাথে আর কিভাবে কথা বলা যাবে? শোনো আপু যে ব্যক্তি আমাকে একদমি সহ্য করতে পারেনা তার কাছে আমি আমার বোন দিবোনা। আমার বোনকে তার কাছে দিবো যার কাছে আমার বোনের পর পরই আমার প্রায়রিটি থাকবে।
— উল্টাপাল্টা কথা বলবিনা। দিবো এক চড়।
— আমি তোমার মতো অন্ধ না। বাবার সাথে কেনো এতো খাতির? কেনো তোমাকে নিয়ে এতো পসিসিভনেস? স্কুলে থাকতে তো দেখেছি আজ এটা,কাল ওটা টিফিনে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরিক্ষা হলে সাইন করার সময় টুক করে জিজ্ঞেস করেছে,’ রিতী কোনটা পারছোনা?’ এসব কি আর এমনি এমনি?
— ভালো ছাত্রী হওয়ায় আদর করেন আর কিছু না।
ছুটি আর কথা বলেনা। রিতী বইয়ে মুখ গুঁজে। পড়তে ইচ্ছা করছেনা। বন্ধ করে টেবিলে রাখে। ছুটির দিক তাকিয়ে বলে,
— মেহের স্যারের দৃষ্টি কুদৃষ্টি হলে সোহাগের দৃষ্টিকে কি বলবি? সুদৃষ্টি?
— কোনটাই না। যদি একটারো কিছু হতো শুধু শুধু এরকম বিহেভিয়ার করতো না।
— তাহলে এসবের মানে কি?
— বিকৃত মস্তিষ্কের ভীমরতি। বলতে পারো ফ্যান্টাসি। একেকজনের একেক বিষয়ে ফ্যান্টাসি।
রিতী বালিশে ঘাড় এলিয়ে দেয়। চোখ বুঝে থাকে। কিছুক্ষন পর চোখ না খুলেই বলে,
— বড়দের মতো কথা বলেছিস ছুটি।

চলবে,
লাবিবা_তানহা_এলিজা~

ছবিয়াল: তরু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here