#বিষ_করেছি_পান(১২)
(কপি করা নিষেধ)
রিতীর ফোন বাজছে।রিতী বসে আছে মেহের স্যারের সামনে। মেহের স্যার রিতীর দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। রিতী মাথা নিচু করে উত্তর দিচ্ছে। বড় মানুষ তার উপর স্যার চোখে চোখ রেখে কথা বলা ভীষণ অস্বস্তির ব্যাপার। রিতীর এমন ভাব গতি মেহের স্যারের পছন্দ হলো না। বললো,
— রিতী চোখে কি হয়েছে? তাকাও আমার দিকে। আহা, যার সাথে কথা বলবে তার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হয়।
রিতী তাকাতে অস্বস্তিবোধ করে। তবুও যখন কথা বলে তখন মেহের স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। চোখের দিকে নয়। মেহের স্যারের মিচমিচে কালো গোঁফ। হয়তো এ সপ্তাহে সেভ করেনি। গোঁফে মেহের স্যারের বয়স বেড়ে গেছে। যদিও মেহের স্যার এখনো বিয়ে করেনি। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তখন উত্তর দেয় কারো বড় হবার অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করা ভালো। তবে সেই অপেক্ষায় বয়স চলে গেলে সেটা ভালো নয়। মেহের স্যার রিতীকে কয়েকটি উপদেশ দেয়। এই যেমন,
— রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটবে। সময় নিয়ে বের হবে। ওড়না গুছিয়ে রাখবে। মানুষের থেকে নিম্মে এক দুই ইঞ্চি দূরত্ত্ব রেখে চলবে। রিকশার মাঝখানে বসবে।সাবধানে উঠবে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে চলবে। সবসময় পাশে কাউকে রাখার চেষ্টা করবে।
তার ভাষ্যমতে দিক নির্দেশনা। আর রিতীর কাছে বিরক্তিকর কথাবার্তা। ঠিক এভাবেই ছানোয়ার প্রায়ই রিতীর কানের সামনে ঘ্যান ঘ্যান করে। শুনতে শুনতে রিতীর মুখস্থ হয়ে গেছে। রিতী এখনো ছোট নয় যে তাকে বলে বলে দিতে হবে। নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারে। কেউ যদি যেচে এসে তার ক্ষতি করে তাহলে সে কি করবে?
সন্ধ্যা বেলা রিতীর ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। রিতী আননোন নাম্বার দেখলে নিজে কখনোই ধরে না। হয় তমালকে দিয়ে ধরায় নয়তো মাকে দিয়ে। রিতী মাকে কয়েকবার ডাকে।সাড়া পায়না। তমালকে ডেকেও পায়না। গেলো কই সব? ছুটি তো এসময় ঘরে থাকার মেয়েই নয়। তিনবারের রিং হবার সময় রিতী বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করে। কানে ধরে হ্যালো বলে। ওপাশ থেকে কোন শব্দ কথা আসেনা। আরো তিনবার হ্যালো বলে রিতী ফোন কেটে দেয়। হয় নেটওয়ার্ক সমস্যা নয়তো কলদাতার সমস্যা।আরো দু বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এবার শন শন বিচ্ছিরি একটা আওয়াজ পাওয়া যায়। শব্দটা এরকম যে কোন ধান ভাঙানোর মিল থেকে আসছে। এরকম অনেক লোক আছে যারা বানিয়ে বানিয়ে একটা নাম্বারে কল দেয় কিন্তু কথা বলেনা। এটা তাদের একটা ফ্যান্টিসি। কিছু কিছু খারাপ লোক তো মেয়েদের ভয়েজ শোনার জন্য ও ফোন দেয়। রিতী সুন্দর ভাবে নাম্বার টা ব্ল্যাকলিস্ট এ রেখে দেয়। মিনিট পাঁচেক ও লেট হয়নি আবার আরেক নাম্বার থেকে ফোন আসে। এবার রিতী চটে যায়। একটা নাম্বার ব্লকলিস্ট এ রাখা হয়েছে জন্য আরেকটা নাম্বার থেকে কল দিয়েছে।এভাবেতো দেখা যাবে কল দিতেই থাকবে।এবার মুখ না খুললেই নয় । রিসিভ করেই রিতী ধমকে উঠে।
— এই কে আপনি? পেয়েছেন টা কি? ফোন দিয়ে কথা বলেন না আবার বার বার ফোন দেন।আগের নাম্বারটা ব্লকলিস্টে রেখেছি দেখে অন্য নাম্বার থেকে কল দিয়েছেন। খবরদার আর ফোন দিবেন না।
— ব্লক টা ছাড়াও।
— কে?
— আমি।
রিতী থমকে যায়। সোহাগ! সোহাগের গলা। এই বদমাইশ টা নাম্বার কোথা থেকে পেলো?
— কি হলো? তোমার জন্যে কি আমি বারবার সিম কিনে টাকা নষ্ট করবো? ছাড়াও বলছি।
রিতী টুপ করে ফোনটা সুইচস্টপ করে দেয়।বালিশের নিচে ঢুকিয়ে নিজেই বালিশের উপর উঠে বসে। খারাপ লাগছে শরীরটা। ভীষণ খারাপ লাগছে। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে।কপালে ঘাম হচ্ছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম।
ছানোয়ার হোসেন স্কুলে এসেছেন। এসে দেখেন হেডস্যার যে ফাইলটা উনাকে দিয়েছিলেন সেটা নিয়ে আসেননি। অথচ স্যার উনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। নিশ্চয় এই ফাইলের জন্যে। এখন উনার পর পর তিনটি ক্লাস আছে। এখন বাড়ি ফেরা সম্ভব না। তাই তিনি রিতীকে কল দিলেন। রিতী যেনো তাকে ফাইলটা পৌঁছে দেন। রিতীর ফোন বারবার সুইচ স্টপ বলছে। এই মেয়ে বাড়িতে থেকে কেনো সুইচ স্টপ রাখবে? মেজাজ খারাপ হলো ছানোয়ারের। বাড়ির নম্বরে কল দিলেন। রিতীর কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন তিনি জানেন না। দরজা বন্ধ করে রিতী ঘুমিয়ে আছে। রুম্পা রতনকে দিয়ে ফাইলটা পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।
বাসায় এসে ফোন বন্ধ করে রাখার জন্য ছানোয়ার একগাদা উপদেশ কম বকা টাই বেশী দিলো। রাগে দুঃখে রিতী তৎক্ষনাৎ ফোন ওপেন করলো।শুধু করেই থেমে থাকলোনা।ছুটির হাতে দিয়ে দিলো। ছুটি তো পেয়ে মহা খুশি। আজ আর তার পড়াশোনা হবেনা। টেম্পল রানে বারোলাখের বেশী পয়েন্ট তুলেই ছাড়বে। সেই বারো লাখ কেনো? ছয়লাখেও রিতী পৌঁছতে পারছেনা। যখনি রাতে পড়া রেখে খেলতে বসলো তখনি কল আসা শুরু হলো। সেই নিশ্চুপ কল। ছুটি দেখলো এই নাম্বারে এটাই প্রথম কল। ছুটির মজা লাগলো। আবার বিরক্ত ও হলো। পঞ্চম বারে কলদাতা মুখ খুললো।
— কে ছুটি?
— আপনি কে?
— সোহাগ।তোমার আপুকে ফোন দাও।
— দিবোনা। ওওও বুঝতে পেরেছি এর জন্য আপু ফোন বন্ধ রেখেছে। আপনি জানেন আপনার জন্য আজকে আপু কতগুলা বকা খেয়েছে?
— নেক্সট বকাটা আমি দিবো। ফোন দাও আমার পিরিতীকে।
— দিলে কি হবে?
— আদর হবে। আমার পিরিতীকে আদর করবো ।
— ফোনে আদর করা যায়?
— আমিতো সামনা সামনিই আদর করতে চাই। দেয়না তো।
— সোহাগ ভাই আপনি কি আমার আপুকে ভালোবাসেন?
— না।
— ভালো না বাসলে আদর কেনো করবেন?
— ইচ্ছে ।
— সোহাগ ভাই আপনি কি আসলেই এতো খারাপ?
— হ।
— আপনি খারাপ না সোহাগ ভাই। আপনি ভালো। খারাপ মানুষ রা সত্য কথা বলেনা। আর আপনি মিথ্যা বলেন না। নিন আপুর সাথে কথা বলেন।
রিতী সেখানেই ছিলো। লাউড স্পিকারে সোহাগের কথা শুনে রিতীমতো ফুসছিলো। ছুটির কথায় দাত কড়মড় করে তাকায়। মনে হয় এক্ষুনি খেয়ে ফেলবে। রিতী কথা বলেনা। কলটা কেটে যায়। ছুটি বলে,
— কথা বলে দেখোনা কি বলে?
— কি বলবে? ঐসব নোংরা কথা? আমি আর নিতে পারছিনা এই লোকটাকে। কবে আমার পিছু ছাড়বে?
— যেদিন তার ইচ্ছা ফুরিয়ে যাবে।
রিতী বাধ্য হয়ে সোহাগের সাথে কথা বলে। সোহাগ রিতীকে পেয়েই জিজ্ঞেস করে,
— পিরিতী। কেমন আছো?
কি শান্ত! কত ই না অদ্ভুত। অদ্ভুত ই বটে! এমন প্রশ্নে কাট কাট উত্তর দেওয়া যায়না। রিতী চাইলেও দিতে পারেনা। নরমাল ভাবে বলে,
— ভালো।কেনো ফোন দিয়েছেন?
— অনেক দিন দেখিনা তোমায়। দেখা করো।
— আপনার সাথে আমি কেনো দেখা করবো?
— এনার্জি লোডের জন্য। তুমারে দেখলে আমার শরীরে একটা এক্সটা এনার্জি লোড হয়ে যায়।শরীরটা চাঙা ফুরফুরা হয়ে যায়। এইযে কতদিন তোমারে দেখিনা.. মনে হয়তাছে জীবনটা পানসে খাইয়া যাইতাছে।
— ফালতু কথা বলবেন না। ফোন রাখেন।
— আরে আরে খাড়াওনা। কোমড়ে বেশী ব্যথা পাইছিলা?
— তো কি সুখ পাওয়ার জন্য ফেলে দিয়েছিলেন?
— আমি তো দিতেই চাই।নেওনা তো।
— আর একটা বাজে কথা বলবেন না। এই আপনি নাম্বার কোই পাইছেন আমার?
— শালাবাবুর থেকে।
— কার থেকে?
— রতইন্না শালার থেকে। হাতে একটা বড় নোট গুঁজে দিলাম। আর টুপ করে তোমার নাম্বারটা মুখ থেকে বের করে নিলাম। দারুন না?
— রতনের বাচ্চা ………….
প্রত্যেকটা দলে একটা করে বিপরীত ধর্মী মানুষ থাকে। যাকে একটু তেল দিয়ে ঘষা মাজা করলেই ইশারায় নাচানাচি করে। এদের দলে রতন হলো সেই বিপরীত ধর্মী মানুষ। আজ তার ই ক্লাস নিচ্ছে রিতী। শিপ্রু মলির মাথায় হাত। পাঁচশ টাকার বিনিময়ে দল পাল্টে ফেললো? তাও আবার তাদের ভাগটা না দিয়েই। কান ধরে উঠবস করা শেষ হোক। তারপর হবে তাদের অপারেশন। এই পাঁচশ টাকায় যদি ভাগ না পায় তাহলে আজকে রতনের একদিন কি তাদের যতদিন।
সন্ধ্যা বেলায় হাসি হাসি মুখ নিয়ে পিঠার বাটি হাতে বীনা ছুটিদের বাড়িতে আসে। রুম্পাকে এক মিনিট জড়িয়ে ধরে। মুখ থেকে যেনো হাসি কোন ভাবেই সরছেনা। রুম্পাকেও অনেক উত্তেজিত দেখাচ্ছে। দুই বান্ধবীতে পিঠা মুখে পুরছে আর গল্প করছে। মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হেসেও উঠছে। ছুটির একদমি পড়াতে মন বসছে না। মা চাচী কি গল্প করে তাই শোনার জন্য কান আঁকুপাঁকু করছে। পানির খাওয়ার বাহানায় ছুটি উঠে যায়। হটপটে পুলিপিঠা দেখে চিৎকার করে উঠে,
— ওয়াও…পুলি পিঠা।
— নে নে তোর জন্য ই বানিয়ে নিয়ে এলাম।
বীনা হটপট টা এগিয়ে দেয়। ছুটি হাঁটু মুড়ে বসে পুলি মুখে দেয়। খেতে খেতেই জিজ্ঞাসা করে,
— তোমরা এতো কি নিয়ে হাসা হাসি করছিলে?
রুম্পা হাসিমুখেই বলে,
— খুশির খবর। তোর বাঁধন ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হলো বলে। বাসে যে সুন্দর করে মেয়েটা দেখেছিলি তাকেই তোর চাচী পছন্দ করেছে।মেয়ের বাড়িরা আমাদের ছেলেকে পছন্দ করেছে জানিয়েছে। এবার ওদের বাড়ি দেখতে গিয়ে একেবারে পাকা কথাই বলে আসবে।
চলবে,
লাবিবা_তানহা_এলিজা~
ছবিয়াল: তরু