বিষ_করেছি_পান(১৪)

0
590

#বিষ_করেছি_পান(১৪)

(কপি করা নিষেধ)
ছুটি কিছুটা চমকে উঠে। বাঁধন ফোনটা সোফায় ছুড়ে প্যান্ট হাঁটুর ভাঁজে কিছুটা টেনে খাটের কোনায় বসে। সামনে উপস্থিত তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
— আমার বয়স হয়েছে। ত্রিশ পেরোলো বলে। আর চারপাচঁটা ছেলেমেয়ের মতো আমিযে প্রেম করিনি তা না। কলেজ লাইফে প্রেম হয়েছে দুই তিনেক। কিন্তু তারা কেউই আমার জন্য নয়। এ বয়সে এসে নতুন করে প্রেমে জড়ানোও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পরিবারের উপর ই ভরসা। সুমিকে মা পছন্দ করেছে। আমারো ভালো লেগেছে। সুন্দরী,মিস্টিভাষী, পড়াশোনা শেষ করেছে,ভালো ফেমেলী। আর তো কিছু চাওয়ার নেই। কথা বলছি ভালো লাগছে। বিয়ে হবে। একসময় ভালোবাসাটাও হয়ে যাবে। এরেঞ্জ ম্যারেজে ব্যপারটা এভাবেই আগায়। তোরা কি বলতে এসেছিস আমি বুঝতে পেরেছি। ছোট্ট মাথা চাপ নিসনা। বড় হ। সমাজের ভাব গতি আপনা আপনি বুঝে যাবি।
— আপনি রাজী?
— এখনো বলতে হবে বোকার হাড্ডি?
মলি আবদার করে বসে,
— ভাবীর সাথে কথা বলবো।
বাঁধন হো হো করে হেঁসে ফেলে। মনে হচ্ছে মলি কি দারুন হাসির একটা কথা বলেছে। ঝিমা ভ্রু কুচকায়। বাঁধনের হাসির মাঝেই ছুটি স্থান ত্যাগ করে। বাঁধন তা দেখে আরো হাসে। মলি ঝিমাকে কাছে টেনে একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলে,
— তোদের ভাবীর সাথে দেখা করিয়ে দিবো। ছুটিকে নিয়ে গিয়ে আইসক্রিম খেয়ে আয়।

বাঁধন তার কথা রাখে। একটা রেস্টুরেন্টে ছোটদের নিয়ে গিয়ে সুমির সাথৈ দেখা করায়। সুমিকে দেখে রতন বলে উঠে, — ভাবী আপনার কাজিন টাজিন কি নেই? সুমি হাসতে হাসতে আফসোস করে বলে,
— নাগো দেবর নেই।
রতন ব্যথা পেলো এমন ভান ধরে বুকে হাত রাখে।সবাই একযোগে হেসে উঠে। সুমি সবার সাথেই কথা বলে। সবার ই সুমিকে প্রচন্ড ভালো লাগে। সুমির চোখ পড়ে ছুটির উপর। ছুটিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
— এইযে দুষ্টুগার্ল। তুমি নাকি আমার নামে বিচার দিয়েছিলে বাঁধনের কাছে?
ছুটি মাথা নাড়ে। সুমি ছুটির মাথা নাড়ানো দেখে হাসে। আরেকটু জড়িয়ে ধরে বলে,
— সরি সরি সরিইইইই। জার্নিতে আমার মেজাজ একদমি ভালো থাকেনা। বাস ছাড়া উপায় ও নেই আপুর কাছে যাওয়ার। তুমি জানো না। তোমার মতো পুচকে মেয়ে গুলো বাসে বেশী ডিস্টার্ব করে জানালার পাশের সিট নিয়ে। আমি তো নিজেই জানালার পাশের সিট ছাড়া বসতে পারিনা। সেখানে সেক্রিফাইস কিভাবে করবো বলো?
— বুঝতে পেরেছি।
— গুড গার্ল। ইউ আর সো সুইট ইউ নো?
ছুটি মিস্টি হাসে। পুরো বিকেল মিলে একসাথে সবাই মজা করে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পার্কে যায় ঘুরতে। সুমির সাথে সবার ভাব হয়ে গেছে। ছুটির মনের মেঘ নিমেষেই দূর হয়ে যায়।সুমিকে তার বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে। বেশ মিস্টি লাগে সুমিকে। সুমি আইসক্রিম খায় না বলে সবার আগে ছুটি সুমির আইসক্রিম নিয়ে দৌড় দেয়। সবাই দৌড়ায় ছুটির পেছনে। এতো হৈ হুল্লোড়ের মাঝে বাঁধন সুমির হাতটা ঠিকই ধরে রাখে। নতুন একটা অনুভুতির সাগরে দুজনেই ভেসে চলে। যার যে স্তর! সেই স্তরেই রয়েছে।

ধীরে ধীরে বিয়ের দিন এগোতে থাকে। বউয়ের শপিং সব আলাদা করেই হয়। মহিলারা এক হয়ে নতুন বউয়ের জন্য একটু একটু করে শপিং করে আনছে। তাদের একটু মানে ছেলেমেয়েদের চোখে পাহাড় সম। এতো এতো শপিং দেখে ঝিমা তো আফসোস করেই বসলো — ইসসস.. আমার যে কবে বিয়েটা হবে!
মলি এই নিয়ে তাকে পচাতে লাগলো।রিতীর টেস্ট পরিক্ষা। সে সারাদিন টেবিলে বসে থাকে আর বাইরে আওয়াজ শুনতে পেলেই জানলা দিয়ে উঁকি দেয়। ছুটির তো দেখাই পাওয়া যায়না। সে আছে নানান রঙে। রুম্পা এতো ব্যস্ততায় সময় করে রিতীকে তিনবেলা খাইয়ে দিয়ে যায়। রিতীর তিনবেলা খাওয়া পড়া আর একটু একটু উঁকি দেওয়াতেই জীবন চলছে। এর ই মাঝে একটা উটকো নিয়মবিরোধী কাজ ও রয়েছে। সোহাগের ফোন রিসিভ করা। রিতী কল কাটে না। রিসিভ করে রেখে দেয়। টাকা বেশী হলে মানুষ কে ভীমরতি তে ধরে। রিতীর মতে সোহাগের ভীমরতিতে ধরেছে। তার কত টাকা আর কত ডিস্টার্ব করতে পারে রিতীও দেখে ছাড়বে। একটু পর পর বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে আর দেখে কল কাটলো কিনা। কল কাটলে আবার কল দিলে আবার রিসিভ করে আবার বালিশের নিচে রাখে।

এরি মধ্যে একগাদা অর্কিড হাতে ছুটি রিতীর রুমে আসে। রিতীর সামনে রেখে বলে,
— আপু নিচে যাও। এক্ষুনি যাবে। এই মুহূর্তে।
— কেনো রে? কি হয়েছে? এমন করছিস কেনো?
— নিচে তোমার পেয়ারের প্রেম এসেছে।
— থাপ্পড় খাবি একটা। আবোল তাবোল বলিস কেনো?
— তুমি নাকি সোহাগ ভাইকে বলেছো এখানে আসতে? তোমার জন্য অর্কিড ও এনেছে। আপু! তুমি নাকি ডেইলি কথা বলো ঐ বখাটে টার সাথে।এতো দূর!
— একদম বাজে কথা বলবিনা। মার কানে গেলে কি হবে ভেবে দেখেছিস? আমি মোটেও তাকে ডাকিনি।সে কল দেয় কিন্তু আমি একটাও কথা বলিনা।
— তাড়াতাড়ি বিদায় করো। গলিতে বিয়ে উপলক্ষে মানুষের যাতায়াত বেশি। দেখে ফেললে সর্বনাশ।
রিতী ধপ করে বসে পড়ে। এখন কি হবে? সে মোটেও নিচে যাবেনা। কিছুদিন থেকে কলেজ যাচ্ছেনা তাই চোখের সামনে ও পড়ছেনা। কতটুকু শান্তি পাচ্ছে তা শুধু রিতীই জানে। আবার দেখা দিয়ে এই শান্তির মাকে গলা টিপে হত্যা করার কোন ইচ্ছেই নেই। রিতী অর্কিড গুলো ছুটির হাতে তুলে দেয়। কাঁধে ধরে দরজায় ধাক্কিয়ে বলে,
— যা বোন যা। তুই গিয়ে বিদায় করে আয়। আমি কিছুতেই নিচে যাবোনা।
— সোহাগ ভাই বলেছে মানবেনা।
— কোন ব্যপার না। আমি ফোনে কথা বলছি তাও তুই যা।

ছুটি গিয়ে সোহাগ কে বলে,
— ফোন কানে নিন আপু কথা বলবে।
— ফোন কানেই আছে। তোমার আপু কথা বলছেনা।
— আপনি মজা নিচ্ছেন ভালো কথা।বাড়িতে আসলেন ভালো কথা। আমার আপু দেখা করবেনা সেটাও ভালো কথা। এবার আপনি চলে যাবেন সেটাও ভালো দেখায়।
— তো আমার লাভ?
— আপুকে দেখে কি লাভ?
— এনার্জি পাই। এক্সটা। সে তুমি বুঝবেনা।
— ফুলগুলো দোকানে দিয়ে দিবেন। দামী ফুল। অনেক টাকা। পচেই যাবে। শুধু শুধু টাকা খরচ করে লাভ নেই।এই টাকায় কয়েকটা আইসক্রিম খাওয়া যেতো। আইসক্রিম খেয়ে লাভ আছে । এনার্জি আসে। এক্সটা।
— তোমার আপুতো কথা বলছেনা।
রিতী কথা বললো। অনুনয় করে বললো,
— আপনি চলে যান প্লিজ। আমার বাড়ির কাছে আসবেন না।
— দেখা করতে বলেছিলাম। দেখাতো করলেনা।
— সামনে পরিক্ষা। প্রথম পরিক্ষা দিয়ে আমি দেখা করবো।
— পাক্কা?
— পাক্কা। এবার যান।
— আচ্ছা।
সোহাগ চলে গেলো। যাবার সময় বাঁধনের মুখোমুখি হলো। বাঁধন একবার সোহাগকে দেখে ছুটিকে পেছনে দেখতে পেলো। ছুটির হাতে অর্কিড ফুল। বাঁধন আড়চোখে দেখতে দেখতেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

বাঁধনের হলুদের দিন রিতীর প্রথম পরিক্ষা। রিতী পড়ছে কম উশখুশ করছে বেশী। পড়া থেকে মন আগেই চলে গেছে। লাউড মিউজিকে বক্সে গান বাজছে। রিতীর প্রিয় গান। গায়ে হলুদ, পায়ে আলতা,হাতে মেহেদি…. । ক্লাস টুতে ফাইভের বিদায় অনুষ্ঠানে এইগানের নেচেছিলো রিতী আজো মনে আছে। রিতী উদাস হয়ে আছে। একবার ইচ্ছে করছে ঐ বাড়িতে কি হচ্ছে দেখে আসতে। আরেকবার ইচ্ছে করছে না গেলে পড়া যা পড়েছে সব গুলিয়ে ফেলবে। এতো উতলা সময়ের মাঝে সোহাগ ও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তার সাথে দেখা করতে হবে। হলুদের গানের সাথে রিতীর মনে মেলোডি গান বাজছে। সোহাগ মানেই রিতীর কাছে এক আতঙ্ক। ছেলেটা বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া এক অকর্মা। দামী দামী ড্রেসাপে গেটাপে বুঝার উপায় নেই। ভাব খানা এমন যে একজন হিরো। চেহারা খানাও মাশাআল্লাহ।যে কোন মেয়ে একবার তাকালে আরেকবার তাকাতেই চাইবে। কিন্তু তার ভেতরটা যে এমন তা কে জানবে? রিতীর জীবনটা কাপড়ের মতো কেচে যাচ্ছে। কম আঘাত সহ্য করছে না এর জন্য। রিতী ঠিক করে সোহাগের সাথে এবার ফাইনাল কথা বলবে। এভাবে বিরক্ত হবার জন্য রিতী জম্মেনি। রিতী সোহাগকে শর্ত দেয় রিতী যদি অক্ষত থাকে তবেই রিতী সোহাগের সাথে দেখা করবে। শর্তের কোন ফিডব্যাক আসেনা। বরং আসে গা জ্বালানো হাসি।

গায়ে হলুদ দিনে না হবে সন্ধ্যায়। বাঁধনের বন্ধুবান্ধব আসবে। সে কারনেই সময়টা পিছিয়ে দিয়েছে। খবরটা শোনা মাত্রই ছুটি রিতীর কাছে দৌড়ে এসেছে। রিতী কলেজের জন্য রেড়ী হয়ে গেছে। রুম্পা রান্নাঘর থেকে চেঁচাচ্ছে।
— স্কেল,পেন, এডমিট ভালো করে দেখে নিয়েছিস?
— হ্যা মা। নিয়েছি।
— টেবিলে বস। আয়। খায়িয়ে দিচ্ছি।
রিতী গিয়ে টেবিলে বসে। রুম্পা ভাজা মাছের বড় বড় কাটা বেছে বড় বড় লোকমা করে রিতীকে খাইয়ে দিচ্ছে। ছুটি এসে রুম্পার পাশে বসে।
— আপু তুমি হলুদে নিশ্চয় থাকতে পারবে। হলুদ সন্ধ্যায় হবে। আমরা সবাই হলুদ শাড়ি পরবো। তাই না মা?
— এতো লাফাস না। ঢ্যাং ঢ্যাং করে করে যে তিন চারদিন থেকে লাফাচ্ছিস খাওয়া নেই ঘুম নেই খালি বক্সের তালে নাচা। চুপ করে বসতো। আপুর সাথে খা। হা কর।
ছুটি হা করে। দুই মেয়েকে একসাথে খাওয়াতে থাকে। রিতী মুখে কাঠিন্য বজায় রেখে বলে,
— কয়দিন থেকে স্কুলে যাসনা?
— পরের সপ্তাহেই যাবো।
— কিহ? এতো দিন? মেহের স্যার ফোন দিয়েছিলো। তোর নামে বিচার দিয়েছে।
— এসব মেহের টেহের সোহাগ মোহাগ তোমাকেই যে কেনো ফোন দিতে যায় আমি বুঝিনা বাপু।
রিতী ঠোটে আঙুল চেপে চুপ করতে বলে। চোখ রাঙিয়ে রুম্পাকে দেখিয়ে দেয়। ছুটি মুখে টেডি স্মাইল ঝুলিয়ে রেখে এক ঢুক পানি খেয়েই দৌড় লাগায়।

পরিক্ষা শেষে উদাস হয়ে হল থেকে রিতী বের হয়। পরিক্ষা তার ভালো হয়নি। ভালো হবারো কথা নয়। পড়তেই তো পারেনি। গোল্ডেন আর তার এবারে থাকলোনা। স্যারদের সামনে মুখ দেখাবে কি করে? কি যে হচ্ছে তার সাথে! হাটতে হাঁটতেই উস্টা খায়। পরতে নিলেই নিজেকে ব্যালেন্স করে নেয়। পাশের একটা মেয়ে বলে,– আর ইউ ওকে?
রিতী চকিতে ফিরে মাথা নাড়ায়। সে ঠিক আছে। কানে গলা ফাটানো হাসির আওয়াজ পায়। একদম হো হো করে হাসি।কোথা থেকে আসছে? আশে পাশে চোখ বুলাতেই সামনে রাস্তায় বাইকের উপর বসা সোহাগকে দেখতে পায়। পাগলের মতো হাসছে ছেলেটা। মনে হচ্ছে কোন সারকাস দেখেছে। সারকাস দেখে মজা পেয়েছে। রিতী সারকাস! রাগে দুঃখে রিতীর কান্না চলে আসে। সোহাগ হাত দিয়ে রিতীকে কাছে ডাকে। রিতী মুখ ফুলিয়ে ধপ ধপ পা ফেলে সোহাগের সামনে দাঁড়ায়। সোহাগ এখনো হেসে চলেছে। রিতী নাট সিঁটকায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
— পৃথিবীর জঘন্য হাসি।
সোহাগের হাসি থেমে যায়। রিতীর দিকে হেলে বলে,
— কি পিরিতী? পেলে তো ব্যথা? আমার সাথে না তোমার ব্যথার একটা কানেকশন আছে। যখন তখন আমার সামনে ব্যথা পাবে। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে। আমি দিলেও পাবে।না দিলেও পাবে।এইযে শর্ত দিয়েছিলে… আমি ভাই মেনে নিলাম। তুমি তো এমনিতেই…. হা হা হা।
সোহাগ আবার হাসতে লাগলো। সোহাগের হাসিতে রিতীর গা জ্বলে যাচ্ছে। একেতো রিতীর কষ্টে হাসছে তারউপর ভয়ঙ্কর সুন্দর ছেলেটার হাসি। রিতী আচমকা একটা কাজ করে বসে। একহাতে সোহাগের মাথা আরেকহাতে থুতনি ধরে একসাথে লাগিয়ে দেয়। ঘটনায় সোহাগ টাস্কি খেয়ে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে।

চলবে,
লাবিবা_তানহা_এলিজা~

ছবিয়াল: তরু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here