একটুখানি_সুখ স্পেশাল পর্ব

0
840

#একটুখানি_সুখ
স্পেশাল পর্ব

ভোরের এক চিলতে রোদ মোহের চোখজোড়াতে পড়তেই চোখ মেলে তাকায় মোহ। তার পাশেই স্বচ্ছের শার্ট ফেলে রাখা। সেখান থেকে আসছে এক তীব্রতর ঘ্রাণ। স্বচ্ছ যেই পারফিউম ইউজ করে সেটা আর ঘামের সংমিশ্রণে অদ্ভুত ঘ্রাণের সৃষ্টি হয়েছে। ঘ্রাণ তীব্র হতেই মোহের মনে পড়ল তার গায়ে স্বচ্ছের কোট। নিজের দিকে তাকালো মোহ। তার চোখেমুখে বিষণ্ণ ভাবটা এখনো কাটেনি। অশ্রু শুঁকিয়ে গিয়েছে। গতকাল সন্ধ্যের পরের ঘটনা মনে হতেই আবারও মোহের চোখের কোণে ভেসে উঠল রাজ্যের অশ্রু। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“এক্সিডেন্ট তো শুধু বাহানা ছিল। মা-বাবা অবশেষে সৌমিত্র ভাইয়ের ক্রোধের স্বীকার হয়েই গেল। কোথাও গিয়ে এখন মনে হচ্ছে আমি একমাত্র আমিই দায়ি এসব কিছুর জন্য। না আমি থাকতাম না এতো নির্মম কিছু ঘটতো।”

এদিক ওদিক তাকালো মোহ। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে পেলো না। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ব্ল্যাঙ্কেট থেকে বেরিয়ে পা নিচে রাখল সে।
“স্বচ্ছ? এই লোকটা আবার কোথায় গেলেন? আমার একা লাগছে জেনেও কোথায় গেলেন?”

বলেই থামল মোহ। তার অস্থির লাগছে। আকুলতার সঙ্গে বলল,
“কাল থেকে উনারও কি হয়েছে জানি না। কারণে অকারণে ব্যাস একটাই কথা বলে যাচ্ছেন যে, উনি পরিচয়হীন বলে উনাকে ছেড়ে দেব না তো? এতোদিনে উনি আমাকে এই চিনলেন?”

উঠে দাঁড়ালো মোহ। স্বচ্ছের কোটটা নামাতেই কিছুটা ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সে। তার জামার হাতার কয়েকটা জায়গা ছিঁড়ে গেছে। গতকালের কথা স্মরণে আসে তার।
“আই উইশ সৌমিত্র ভাই ঠিক হয়ে যাক। কিন্তু সুস্থ হলেও আমি উনাকে ক্ষমা করতে পারব না। আমার জীবনের সবথেকে দামি মানুষ কেঁড়ে নেওয়ার অপরাধ করছেন উনি। উনার প্রতি আমার ক্ষোভটা সারাজীবন থাকবে।”

সৌমিত্রের চিকিৎসা চলছে পুরোদমে। রয়েছে পুলিশের অধীনে। পুলিশ ওকে অবশেষে ধরেছে স্বচ্ছের মাধ্যমেই। গতকাল সব ধোঁয়াশা দূর হয়েছে। গতকাল স্বচ্ছ ও মোহ বান্দরবান ফিরেছিল। মিসেস. রেবা ও নেহাল সাহেব ছুটে এসেছিলেন ছেলের জন্য। মিসেস. রেবা বারবার করে অনুরোধ করছিলেন সৌমিত্রকে ছাড়িয়ে নিতে। কিন্তু স্বচ্ছ তাতে আর সায় দেয়নি। নিজেকে নিজ জায়গায় স্থির রেখে সে আর সাথ দেয়নি তার মায়ের। কাল সৌমিত্র মোহকে দেখেই রাগে গজগজ করে সবকিছু স্বীকারও করে ফেলেছে। এমনকি মোহের মা-বাবার মৃত্যুর পেছনে ওর হাত রয়েছে সেটাও সে জানিয়েছে। তখনই বাকহারা হয়েছিল মোহ। সেইসঙ্গে সকলেই হতবাক হয়েছিল। কারণ কেউই এই সম্পর্কে অবগত নয়। সৌমিত্র জানায়, মোহের মা-বাবা বেঁচে থাকলে মোহের বিয়ে কিছুতেই ওই বাড়িতে দিতো না। সেকারণেই সে ট্রাক ভাড়া করে নিজে ড্রাইভিং করে দেখেশুনে ফাঁকা রাস্তায় মোহের মা-বাবার গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছিলো। গাছের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার পর সৌমিত্র নিজেই ওদের গাড়িসহ ট্রাকেও আগুন লাগিয়ে পালিয়ে আসে। সবটা শুনে স্তব্ধ হয় সকলেই। বিশেষ করে মোহ। সৌমিত্রের গালে কষিয়ে দুটো চড় মেরেছিল সে। ফলস্বরূপ সৌমিত্রও ধস্তাধস্তি করে মোহকে আক্রমণ করে বসে সকলের সামনেই। স্বচ্ছ আর বাকি পুলিশ কোনোমতে ছাড়িয়ে নিয়েছিল মোহকে। তবে জামার হাতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তারপর স্বচ্ছ নিজের কোট মোহের গায়ে জড়িয়ে দেয়। স্বচ্ছ ক্রুদ্ধ হয় সৌমিত্রের প্রতি। ইচ্ছে হয়েছিল তাকে আঘাত করার কিন্তু পুলিশ তাকে আঁটকায়। কয়েকদিন পর তার কেস কোর্টে তোলা হবে। হয়ত বিচার হিসেবে যাবতজীবন জেল হলেও মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় চিকিৎসা চলবে দীর্ঘদিন। কিন্তু সৌমিত্রের সুস্থ হবার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ও সম্পূর্ণভাবে অসুস্থ!

আশেপাশে তাকিয়ে স্বচ্ছকে না দেখতে পেয়ে বড় শ্বাস নিয়ে বলে,
“কি জানি সকাল সকাল কোথায় বেড়িয়ে গেলেন!”

ডান দিকে এগিয়ে গিয়ে সোফার কাছে থাকাত লাগেজটা খুলে ফেলে মোহ। খুলে উপরের অংশটা মেলে ধরতেই আশ্চর্যজনকভাবে একটা নীল রঙের চিরকুট ভেসে উঠল তার চক্ষুদ্বয়ের সামনে। কৌতুহলবশে দ্রুত সেটা খপ করে ধরে নিজহাতে তুলে নিল। সেই চেনা হাতের লিখা! যা মোহের মনের খুব কাছের! স্বচ্ছের ছোট ছোট করে লিখা কথাগুলো মোহের মনের মাঝে বিশাল আকারের প্রেমের ঢেউ সৃষ্টি করে সেটা যদি স্বচ্ছ নামক ব্যক্তিটি জানতো! মোহ নিজের অপরূপ চোখজোড়া লিখাগুলোতে স্থির করে।
“এইযে অপরূপা নারী! আমার আবদার মানার সময় কি হবে আপনার? সারারাত কান্নাকাটি নামক বিরক্তিকর জিনিসটাকে সময় দিয়ে গেলেন। এবার বরটার দিকে একটু তাকান। চটপট করে লাগেজের সবার ওপরে থাকা শাড়িটা পড়ে চলে আসুন বাহিরে ঝটপট।”

মোহের বিষণ্ণতায় শুঁকনো হয়ে যাওয়া চোখেমুখে হাসির ঝলকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর নজর রাখলো লাগেজের ওপরের শাড়িতে। হালকা গোলাপি সাধারণ পাতলা শাড়ি। মোহের ভ্রুযুগল কুঁচকে যায়। হাতে নেয় শাড়িটা। এটা তো সে আগের বছর নবীন বরন অনুষ্ঠান উপলক্ষে পড়েছিল। আর তার যতদূর মনে পড়ছে এই শাড়ি সে নিয়ে আসেনি। কোথা থেকে এলো এটা? স্বচ্ছ নিয়ে এসেছে? আর সব ছেড়ে এটাই কেন?

আগপাছ ভাবতে ভাবতে ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পড়েই নিল মোহ। বরাবরই মোহ ভারি কাজ করা শাড়ি পছন্দ করে না। সবসময় সাদামাটা হিসেবে থাকতেই ভালোবাসে। তাই শাড়িটাও তার বেশ পছন্দ। অতঃপর গিয়ে বসল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। হাতে বড় চিরুনীটা নিতেই আয়নায় লাগানো আরেকটি চিরকুট দেখতে পেলো মোহ। না চাইতেও হেঁসে দিল সে। মনে মনে ভাবল, লোকটা কি শুরু করেছে?
“মোহময়ী নারী! মুখে কোনো কৃত্রিম প্রসাধনী নয়। আজ শুধু তোমার মোহের দর্শন পেতে চাই। যেখানে কোনো কৃত্রিমতার ছোঁয়া থাকবে না।”

মোহের হাসি গাঢ় হলো। চুল খোলা রেখে উঠে দাঁড়াল সে। সে মুখে কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করেনি। কিন্তু স্বচ্ছের কর্মকান্ড বোঝার ক্ষমতা নেই তার। রুম থেকে বের হতেই মোহের মনে পড়ল সে যাবে কোথায়? স্বচ্ছ কোথায়? সামনে হেঁটে এগোতেই রিসেপশন। সেখানটা পেরিয়ে যেতেই রিসেপশনিস্ট বলে উঠলেন,
“ম্যাম, স্যার আপনার জন্য নীলগিরি পাহারের মেইন স্পটে অপেক্ষা করছেন।”

“থ্যাংক ইউ।”
মুচকি হেঁসে রিসেপশনিস্টের উত্তর দিয়ে হাঁটা দিল মোহ। মেইন পয়েন্ট খুব একটা দূরে নয়। পাঁচ মিনিটের পথ। পাহাড়ি সরু রাস্তা হাঁটছে মোহ। একপাশে খাদ। নিচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে অজস্র সৌন্দর্য পরিপূর্ণ প্রাকৃতিক দৃশ্য। হালকা শিরশিরে বাতাসে মৃদু কাঁপছে মোহ। মাথার খোলা হালকা কোঁকড়ানো চুল দুলছে তার সঙ্গে। আচমকা আকস্মিক কন্ঠস্বরে হকচকিয়ে উঠল মোহ। আশেপাশে তাকালো ধড়ফড়িয়ে।
“এইযে হরিণী চোখের অধিকারিণী! কি খুঁজছ আশেপাশে? আমাকে? হয়ত ভাবছো কি পাগলামি শুরু করেছে এই লোক! পাগলামির কারণটা তো তুমিই। তাই আমাকে পাগল করার দোষটাও তোমার।”

মোহ চোখ বড় বড় করে রয়েছে। তার বিস্ময় কাটানো যাচ্ছে না। আসলেই কি শুরু করেছে স্বচ্ছ? আশেপাশের সবাই তার দিকে ভূতের মতো চেয়ে আছে। মোহ আন্দাজ করতে পেরেছে স্বচ্ছ এখানে নেই। মেইন পয়েন্টেই আছে। সে অন্য কোনোভাবে এখানে কথাগুলো পৌঁছাচ্ছে। কোনোরকমে চাহনিগুলো হজম করে সে দ্রুত হাঁটা লাগালো মেইন পয়েন্টের দিকে। তবুও কথাগুলো কানে আসছে।
“লুকিয়ে ভালোবাসার একটা আলাদা সুবিধা আছে। তোমার মি. চোর এতোদিন তোমাকে লুকিয়ে ভালোবেসে কি সুবিধা পেয়েছে জানো? তোমার চোখে অদ্ভুত অনুভূতির দর্শন পেয়েছে। কখনো রাগ, কখনো বিস্ময়, কখনো বড্ড বিচলিত হওয়া তোমাকে দেখতে পেয়েছে। তুমি আমাকে ধরার জন্য যা যা করেছো সেসব ইনজয় করেছি আমি। শেষমেশ কিনা আমাকে ধরিয়ে দিতে আমাকে সাথ করে নিয়েই পুলিশে রিপোর্ট লিখাতে যাচ্ছিলে। সেদিন আমাকে চমকে দিয়েছিলে তুমি।”

মোহ মাথানিচু করে হাঁটছে। লজ্জায় ইতিমধ্যে তার গালের দুপাশে শাড়ির রঙই ফুটে উঠেছে। এখানে যদি মাটি ফাঁক হয়ে যেত! আবার ইচ্ছে করছে লজ্জায় পাহাড় থেকে ঝাপ দিতে। এতো লজ্জা কেন?

“তোমার কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনো দেওয়া বাকি মোহময়ী! আজকের দিনটা আমার কাছে খুবই স্পেশাল। কেন সেটা জানতে পারবে। কাম ফাস্ট!”
স্বচ্ছের আরো কিছু কথা কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাতেই মোহ খেয়াল করে সে মেইন পয়েন্টে পৌঁছেছে। আশেপাশে বেশ ভীড়। ভোরের দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন এখানে অনেক ভীড়ই হয়। কিন্তু শেষ প্রান্তে কেন যেন জটলা পাকিয়ে ভীড়! মোহ সেদিকেই এগিয়ে গেল। আবারও কানে এলো স্বচ্ছের কন্ঠ। যা বাজছে জোরে জোরে।
“হোয়ার আর ইউ?”

মোহ এগিয়ে গেল। স্বচ্ছের গলার আওয়াজ সেখান থেকেই আসছে। মোহ ভীড় পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই চোখজোড়া ছানাবড়া হলো তার। স্বচ্ছের হাতে মাইক্রোফোন। যেটা দিয়ে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে সে আর সকলে হা হয়ে সেটা শুনছে। তার কি লাজ লজ্জা কিছুই নেই? একটু তো থাকা উচিত! সবার সামনে এসব কথা বলছে কি করে?

পিছু ফিরে তাকায় স্বচ্ছ। মোহের স্নিগ্ধ চেহারাতে চোখ আঁটকায় তার। ঘোলাটে চোখে যেন নেশা ধরে যাচ্ছে। সে মাইক হাতে নিয়েই বলে,
“মাই কুইন, কাম হেয়ার!”

মোহ কি করবে ভেবে না পেয়ে একপা দুইপা করে এগিয়ে যায় স্বচ্ছের দিকে। ঝট করে মোহের হাতটা ধরে সকলের সামনে আচানক মোহের হাতের পিঠে নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ লাগিয়ে ফেলে। সকলে স্তব্ধ! কেউ কেউ মুচকি হেঁসে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মোহ ইতস্ততবোধ করে আশেপাশে তাকিয়ে স্বচ্ছের দিকে একবার চোখ গরম করে তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়। ধীর গলায় বলে,
“এসব কি করছেন আপনি?”

“যা করার তাই।”
স্বচ্ছের নির্লিপ্ত কন্ঠ শুনে মিইয়ে যা মোহ। মিনমিন করে বলে,
“সবাই দেখছে।”

স্বচ্ছ তার উত্তর না দিয়ে বলল,
“ক্লোজ ইউর আইস।”

“বাট…”
মোহের কোনোপ্রকার কথা না শুনে মোহের চোখের ওপর হাত রাখে স্বচ্ছ। আর কিছুটা শীতল কন্ঠে বলে,
“যা বলছি তাই করো। আমি যে কতটা নির্লজ্জ ব্যক্তি সেটা নিশ্চয় বলে দিতে হবেনা?”

মোহ চুপ হয়ে যায়। স্বচ্ছ হাত সরায় তার চোখের ওপর থেকে। মোহ চোখ বন্ধ করে নিজের শাড়ি দুহাতে খামচে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। না জানি কি করতে চলেছে স্বচ্ছ সবার সম্মুখে! ঠকঠক করে কাঁপছে সে। আর আশেপাশের সকলে বিমোহিত হয়ে দৃশ্য দেখাতে ব্যস্ত। এমন দৃশ্য খুব কম দেখা মিলে যে নিজের ভালোবাসা, নিজের মনের গহীনে থাকা অনুভূতি প্রকাশ করে সবার সামনে। স্বচ্ছ পরিষ্কার কন্ঠে নিলে,
“ওপেন ইউর আইস মাই কুইন!”

মোহ চোখজোড়া ধীরে খোলার সাথে সাথে স্বচ্ছের অন্যহাতে আবিষ্কার করে একটা লাল টকটকে গোলাপ। আরেকটা হাত পেছনে রাখা। আকাশ সমান বিস্ময় নিয়ে স্বচ্ছের চোখের দিকে তাকায় মোহ। তার ঘোলাটে চোখে রাজ্যের অনুভূতি জড়ো হয়ে আছে। মুখে মৃদু হাসি চমৎকার লাগছে! মোহ এই সুদর্শন পুরুষকে দেখে যেন নতুন করে প্রেমে পড়ে গেল। লাল গোলাপটা মোহের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে স্বচ্ছ বলল,
“প্রথমেই এই গোলাপের মাধ্যমে তোমাকে থ্যাংকস জানাই আমার জীবনে আসার জন্য।”

মোহ কাঁপা কাঁপা হাতে হেঁসে গোলাপ চেপে ধরে। তার কন্ঠস্বর কাঁপছে। সবাই দেখছে। লজ্জা, সুখ সব মিলিয়ে সে ঠকঠক করে কাঁপছে। কিছু বলতেই পারছে না। হাতের পেছন থেকে আরেকটা গোলাপ বের করে স্বচ্ছ। সেটাও মোহের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এই গোলাপটা তোমাকে দিলাম কারণ আমার এই দিনটাকে সুন্দর বানিয়েছো তুমি। তোমার কাছে আজকের এই দিনটা সাধারণ মনে হতে পারে কিন্তু আজকেট এই দিনটাতে তুমি দেখা দিয়েছিলে আমার জীবনে ভালোবাসার রং মাখিয়েছিলে। আমার রং বিহীন এক বিষাদময় জীবনের গল্পে তোমার আগমনে আমার জীবনের গল্প তার রং ফিরে পেয়েছিল।”

মোহ এবার হতবাক হয়। কিছু বুঝতে পারে না। স্বচ্ছের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে মাত্র ২-৩ মাসের মতো। কিন্তু স্বচ্ছের কথা তো অন্য বলছে। তবুও স্বচ্ছ মোহের হাতে গোলাপ ধরিয়ে আরেকটা গোলাপ বের করল পেছন থেকে।
“মনে পড়ে সেই দিন? যেদিন তুমি ঠিক এই শাড়িটাই পড়ে বিনা সাজে তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পার হচ্ছিলে? হয়ত কোথাও যাওয়ার তাড়াহুড়ো ছিল আমার। আমি রূঢ় মেজাজে গাড়িতে বসে ছিলাম। ট্র্যাফিকে ভর্তি রাস্তায় আসার অভ্যেস ছিল না আমার। ফলে রাগ হয়েছিল প্রচুর। একটা এম্বুল্যান্স ছিল। যেই গাড়ি আমার পেছন ছিল। ট্র্যাফিক জ্যাম সবে একটু একটু ছাড়ছে। আমি আবার হৃদয়হীন ব্যক্তির মতো নিজের গাড়ি আগে নিয়ে গেলাম। তোমার কন্ঠ শুনতে পেয়েছিলাম আমি। তুমি বলেছিলে এম্বুল্যান্সে অসুস্থ মানুষ আছে যাতে তাকে আগে যেতে দেওয়া হয়। সেটা শুনে রাগে গজগজ করে আমি আগে গাড়ি চালিয়ে দিই। কারণ আমারও গন্তব্য স্থানে যাওয়াটা খুবই জরুরি ছিল। তারপরেই কি যে হলো আবার ট্র্যাফিকে পড়লাম। সেই সুযোগে আড়াল থেকে আমার গাড়ির গ্লাসে রাগের চোটে ঢিল ছুঁড়ে মারলে তুমি। গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। তখনও আমি তোমার মুখ দেখিনি। রেগেমেগে বেরিয়ে আসতে চাইলাম গাড়ি থেকে। নেমেও পড়লাম। আশেপাশে তাকালাম কাজটা কার জানতে! তুমি ছুটে পালিয়ে গেলে। সেটা আমার চোখে ধরা পড়ল। তুমি তো পালিয়ে গিয়েছিলে কিন্তু আমার মন নিয়েই পালিয়েছিলে। তুমি শুধু গাড়ির গ্লাস ভেঙে চুরমার করো নি। সঙ্গে চুরমার করেছো আমার কঠিন মনকে। আর কঠিন মনটাকে ভেঙে দেওয়ার জন্য এই গোলাপ তোমার জন্য।”

মোহ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে স্বচ্ছের দিকে। মস্তিষ্কে আলতো চাপ দিতেই মনে পড়ে সেই দিন গুলো। তখন মোহের মাঝে একটু বেশিই চাঞ্চল্যের ভাব ছিল। নবীন বরণ অনুষ্ঠানে যাবেনা বলে বাড়িতে শুয়ে ছিল। কিন্তু বন্ধুমহল নামক জিনিসটার সেটা হজম হয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে গোমড়ামুখে বেরিয়েছিল শুধু একটা শাড়ি পড়ে কোনোরকম সাজগোছ ছাড়াই। সেটা সেদিনেরই ঘটনা। ঘটনাগুলো এতো সুন্দর কাকতালীয় ভাবে মিলতে পারে ভাবতে পারেনি মোহ। হৃৎপিণ্ডে যেন ঢোল বাজানো শুরু হয়েছে। চারিদিকে শুধু অনুভূতির জোয়ার। স্বচ্ছ মোহের হাতে আরেকটা গে্ালাপ গুঁজে দিয়ে আরেকটা গোলাপ বের করে। মুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে বলে,

“এই গোলাপটা আমাকে আরেকবার দেখা দেওয়ার জন্য। বাড়িতে যখন বেশ আগ্রহ নিয়ে ছবির এলবাম দেখছিলাম তখন নজরে আসে তোমার হাসিমাখা ছবি। আমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে তোমার ফ্যামিলির সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না। তবুও একটা ছবিতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তোমাকে দেখা যাচ্ছিল। দুই গালে হলুদ মেখে দাঁড়িয়ে ছিলে ছবিতে। ছবিটা তোমার সেই হাসিতে যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। তড়িঘড়ি করে মাকে জিজ্ঞেস করি তুমি আসলে কে? তোমার পরিচয় কি? যখন তোমার পরিচয় জানতে পারি প্রচন্ড অবাক হই। এমন মেয়েকে পছন্দ হলো কি করে আমার? যার ফ্যামিলির সঙ্গে আমার ফ্যামিলির সম্পর্ক ভালো না। অনুভূতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। দেশ থেকে আবার চলে যাওয়ার আগে ঠিক করে যাই এরপর যখন দেশে আসব অবশ্যই তোমাকে পাওয়ার উদ্দেশ্যে আসব!”

“আ…আপনি আপনি তাহলে…”
বলতে বলতে থেমে গেল মোহের কথা। সে বলতে পারছে না। প্রচন্ডরকম অবাক হয়েছে সে। সেই সঙ্গে লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়েছে। চোখের পাতা নড়তেও ব্যর্থ! ঢক গিলে নিল শুঁকনো। স্বচ্ছ এগিয়ে এসে আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল,
“আমি… আমি কি?”

“আপনি আমার সব অভ্যেসের কথা জানলেন কিভাবে?”

“উমম…কথায় বলে ঘর শত্রু বিভীষণ। তোমার ঘরেও একটা শত্রু আছে। যে তোমার কথা, তোমার অভ্যেস, তোমার আচরণ, তোমার রাগ, তোমার পছন্দ-অপছন্দ সব কথা আমাকে বলতো।”

মোহের ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল এবার। কৌতুহল তড়তড় করে বেড়ে গেল। তড়িঘড়ি করে বলল,
“ক…কে কে সে?”

“কলি। ইয়েস কলি। তোমার সব কথা আমাকে জানিয়েছে। ওর মাধ্যমেই সবসময় তোমার খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি।”

মুখটা হা হয়ে গেল মোহের। কলির ওপর রাগ হলো ভীষণ! রাগে গজগজ করে বলল,
“আমার পেছন এতো কিছু করল আমি জানলামও না? বাড়িতে যাই শুধু! তারপর ওকে বোঝাবো।”

স্বচ্ছ শব্দ করে হাসে। এরপর একের পর এক গোলাপ এনে মোহরে সামনে হাজির করে একটা শব্দ রিপিট করতে থাকে।
“ভালোবাসি।”

মোহ ফুল নেয়। আবারও আরেকটা ফুল এনে হাজির করে। আবারও স্বচ্ছ বলে,
“ভালোবাসি।”

এমনটা কয়েকবার করার পর মোহের হাতে জায়গা থাকে না ফুল নেওয়ার। এরপর স্বচ্ছ এক হাঁটু গেঁড়ে বসে গোলাপ ফুলের মস্ত বড় গুচ্ছ নিয়ে সকলের সম্মুখে চিৎকার করে বলে,
“ভালোবাসবে এই পরিচয়হীন ছেলেকে? জায়গা হবে তোমার মনের কুঠুরিতে? তোমার হাসির কারণ হতে দেবে আমায়? তোমার সুখ রাজ্যের রাজা বানাবে আমায়?”

লজ্জা, সংকোচবোধ ত্যাগ হয়ে মূহুর্তেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে মোহ। ঠোঁটে ফুটে ওঠে সুন্দরতম হাসি এবং চোখে চিকচিক করে পানি। এতো ভালোবাসা যেন সে আশাই করেনি। হ্যাঁ বলতে চায় সে। কিন্তু সব কথা যেন গলাতেই দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আশপাশ থেকে সবাই বলে ওঠে,
“ছে ইয়েস!”

বড় বড় দুটো শ্বাস নিয়ে মোহ ফট করে বলে দেয়,
“ভালোবাসবে নয়। ভালোবাসি আপনাকে। শুনতে পেয়েছেন? শুধু আপনি নয়। আমিও ভালোবাসি আপনাকে। মনের সমস্ত জায়গা জুড়ে শুধু আপনার নাম! ভালোবাসি আপনাকে।”

স্বচ্ছের হাতে থাকা গোলাপের গুচ্ছ ধরল মোহ। স্বচ্ছ উঠে দাঁড়ালো। আচমকা সকলে মুগ্ধ হয়ে হাত তালি দিল। এতো সুন্দরভাবে ভালোবাসা প্রকাশ খুব কম করা যায়। অনেক কম দেখা যায়। স্বচ্ছ মোহের দিকে তাকালো। মোহ স্বচ্ছের দিকে। দুজনের চোখে দুজনকে পাওয়ার বিচলতা!

সময়টা রাত! ঝিঁঝিপোকার আওয়াজ তা জানান দিয়েছে। জোনাকিগুলো পরিবেশটাকে আরো স্নিগ্ধ করে তুলেছে। পাহাড়ের গা দিয়ে ভেসে থাকা একটি রিসোর্ট! সেখানকার এক রুমের বেলকনিতে জোনাকিগুলি যেন মুখরিত হয়ে বেশিই উড়াউড়ি করছে। বেলকনিতে লাগানো ফেইরি লাইটের টিমটিমে আলোতে এক পুরুষ ও এক নারীকে দুজন দুজনের চোখে মত্ত হতে দেখা যাচ্ছে। মোহ স্বচ্ছের বুকের কাছে নেতিয়ে নিজের থুঁতনি ঠেকিয়ে নিষ্পলক চোখে তার সুদর্শন পুরুষকে দেখে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হিম করা বাতাসে কেঁপে উঠছে দুজন। নিরবতা ভেঙে স্বচ্ছ বলে উঠল,
“কি দেখছো এতো?”

“আপনাকে! দেখছি আর ভাবছি চোরও এতো সুন্দর হয়?”

স্বচ্ছ চট করে মোহের গালে চাপড় দিয়ে বলল,
“আমি চোর?”

“মহা চোর! শুধু চোর না! কত চোরামি করেছেন জানেন?”

স্বচ্ছ আসে আর বলে,
“তোমার রিয়েকশনগুলো কিন্তু দারুণ ছিল।”

“ঘুমাবেন না?”

“আজ ঘুম উড়িয়ে দিয়েছি। আমার সামনে এতো বড় চাঁদ ধরা দিয়েছে। তাকে দেখতে হবেনা?”

মোহ লজ্জামিশ্রিত হাসি দেয়। আর চাপা সুরে বলে,
“যা তা বলেন!”

“স্ট্রবেরি হয়ে যাচ্ছো দেখছি। খেয়ে নেব?”

মোহ স্বচ্ছের বুকে কিল মেরে বলল,
“অসভ্য!”

স্বচ্ছ মোহকে নিজের সঙ্গে শক্ত করে জাপ্টে ধরে বলে,
“এই রাত তোমার আমার!”

মোহ হাসে। স্বচ্ছ ডুবে যায় মোহতে। মোহ ডুবে যায় স্বচ্ছতে। এই রাত সত্যিই যেন তাদের!

সমাপ্ত

[বি.দ্র. অবশেষে দিয়ে দিলাম। লিখালিখির এমন এক পর্যায়ে চলে এসেছিলাম যে না পারছিলাম লিখালিখি ছাড়তে আর না পারছিলাম নিয়মিত হতে। সব মিলিয়ে অনেক চেষ্টার পরে এটা লিখতে পেরেছি। এটাও লিখতাম না। কিছু জিনিস ক্লিয়ার করার বাকি ছিল যা এক্সামের কারণে করতে পারিনি দ্রুত গল্প শেষ করেছিলাম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here