(ব্রুটাল কন্টেন্ট। সেনসিটিভ মনের পাঠক গল্পটা এড়িয়ে যাবেন, প্লিজ!)
খাসীর মাংসে অদ্ভুত একটা গন্ধ আসে। তীব্র। ভালো লাগে না। আর পরিস্কার করতে হয় অনেক খুঁটে খুঁটে। চর্বির সাথে পশম লেগে থাকে অনেক। হাজার ধুলেও যায় না। একটা একটা করে বেছে বেছে ধুয়ে নিতে হয়। সময় লাগে প্রচুর। প্রচুর মনোযোগ দিতে হয়, চোখও হতে হয় চিলের মতো। খাসীর মাংস ধুয়ে পরিষ্কার করতে করতে একা একাই বকে ও,
—- কোথায় একটু রোমান্স করবে এমন ঝরঝরঝর মুখরো বাদর দিনে, তা না, খাসীর মাংস আর খিচুড়ি করো! হুহ!
ও বিরক্ত হয়। সংসারের উপর থেকে মন উঠে যাচ্ছে ওর। সবকিছু ছেড়েছুড়ে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে বারান্দায় বসে পায়ের পাতাটা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে। উড়ে আসা বৃষ্টির পানির ছাঁটে মুখ ডুবিয়ে চোখ বুজে থাকার আরাম নিতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছেমতো গালাগাল করতে করতে কনুই দিয়ে কিচেন সিংকে ভর দিয়ে কাজ করতে থাকল ও।
—- খাওয়া, খাওয়া আর খাওয়া। খাওয়া ছাড়া কি মানুষের আর কোনো কাজ থাকতে নেই? সারাদিন কি খাওয়ার চিন্তাই মাথায় ঘুরতে হবে? সারাদিন কী খাওয়া হবে, কী রান্না হবে এই ভাবনা আর তারপরে রান্নাঘরে মুখ গুঁজে কাটাবাছা করে তিন চার ঘন্টা লাগিয়ে রান্না করা আর খেতে মাত্র দশ থেকে পনেরো মিনিট। তাও হাতে সেই স্মার্টফোন গুঁজে! দুটো মানুষ মাত্র অথচ কোনো কথা নেই তাদের। কী হয় একবেলা না খেলে? একদিন দোকানের পাউরুটি আর কলা,জ্যাম খেয়ে থাকলে?
মেজাজ খারাপ হয় ওর।
বিরক্ত মনে হঠাৎ খেয়াল করল, মনের অজান্তে এক টুকরো কাঁচা মাংস ও নিজের মুখে পুরে দিয়েছে। ইয়াক করে মুখ থেকে ফেলে দিতে চাইল কিন্তু আরও বেশি বিস্মিত হয়ে আবিস্কার করল কাচা গোশের স্বাদ খারাপ লাগছে না ওর। বরং একটু রাবারি টেক্সচার, একটু নোনতা নোনতা, অন্যরকম স্বাদ কিন্তু বেশ ভালো! দাঁতগুলোও সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে, চিবুতে আরাম লাগছে। ঘ্রাণটাও মাতাল মাতাল লাগছে। দারচিনি, এলাচ, গোটা জিরে, সর্ষের তেলে কষিয়ে তেল উঠে আসা মাংসের চাইতে এই স্বাদ কোনো অংশেই কম না, বলা যায় আরও আরও অনেক বেশি সুস্বাদু লাগল ওর জিভের তলায়। আরামে ওর জিভ অসাড় হয়ে যেতে চাইল…
*****
সারারাত ঝমঝম করে বৃষ্টি হয়েছে। সকালেও থামাথামি নেই কোনো। ঝমঝমিয়ে পড়েই যাচ্ছে। দরজা-জানালা আটকে দিলে ঘরে বৃষ্টির শব্দ আসে না, কেমন একটা গমগমে ভাব চারিদিকে আর একটা আদুরে অনুভূতি। পাতলা কাঁথাটাতে নাক ডুবিয়ে আরও কিছুক্ষণ অলসতা করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখন এইটুকু অলসতা মিলার কাছে বিলাসিতা। কোটি টাকার বিলাসিতা। সেই কতদিন আগে অনেক বেলা করে বিছানায় গড়িয়েছে মনে করতে পারে না ও। অথচ একদিন একটু আগে ঘুম থেকে উঠলেই বাবা বলত,
—- ওরে আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছে? আমার প্রিন্সেস তো সকালের সূর্যটা দেখে ফেলল!
—- বাবা?
বলে অনুযোগের সুরে বাবার বুকে মুখ লুকোতো মিলা। কতদিন বাবাকে দেখে না!
আমিরকে বিয়ে করাটা বাবার অমতে হওয়ায়, আর কোনোদিন মিলার মুখদর্শন করেনি ওর বাবা। নিজের বাবা হলে কি এমন করতে পারত? একটু রাগ করে থাকত, কিন্তু নিজের প্রিন্সেসকে ছেড়ে থাকতেই পারত না। পালক মেয়ে বলেই পেরেছে, পারছে। প্রথম প্রথম খুব কান্না পেতো, আজকাল আর ওর চোখে জলও আসে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ও ডানকাত হয়ে শুলো। কী সুন্দর হা করে ঘুমাচ্ছে আয়শা! ওর মেয়ে। তেরো মাস বয়স। এই তেরো মাসে যেন তেরো বছরের ব্যস্ততা মিলার। একটা সেকেন্ড ফুরসত পায় না। দিনের শুরু কোথায় হয় আর কোনদিক দিয়ে টুপ করে দিন গলে শেষ হয় কে জানে! বাচ্চাকাচ্চা এমন হ্যাপা জানলে ও কখনোই মা হতে চাইত না। আয়শাকে সুন্দর মুখটা দেখে ওর কেমন বিতৃষ্ণা পায় সেই কথাটা ও কাউকে বলতেও পারে না। আয়শার জন্য আমিরও কতটা দূরে চলে গেছে। সবচেয়ে রোমান্টিক কাপল হিসেবে চিনত ভার্সিটিতে সবাই ওদের – কতদিন গাঢ় চুমুতে ঠোঁট দলে দেয়নি, নিবিড় আলিঙ্গনে নেয়নি ওকে আমির, হিসেবও করা যায় না আজ আর।
পাশ বদল করে আমিরের দিকে তাকালো মিলা। ইশ গালের খোঁচাখোঁচা দাঁড়িতে কেমন ম্যানলি লাগছে ওকে। মিলার শরীরের কোষে কোষে কাঁপন উঠল। আরেকটু কাছে সরে এসে আমিরের গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। চুমুতে চুমুতে অস্থির করে দিতে দিতে নিজেও অশান্ত হয়ে উঠল। আমির ঘুমকাতুরে গলায় বিরক্তি ঝাড়ল,
–আহ, মিলা? অফিস যেতে হবে। এইসময় পাঁচ মিনিটের ঘুমও অনেক দরকার আমার।
— আর আমার দরকার?
ছিটকে এলো আমিরের কাছ থেকে মিলা। ফুঁসতে থাকল।
— আহ ঘুমাও তো! তোমার এইটাই বেশি দরকার এখন।
— আমার দরকার বোঝো তুমি?
হিসহিসিয়ে উঠল মিলা, প্রত্যাখানের ঘেন্নায়৷
—- আহ, মিলা কী শুরু করলে? ঘুম পুরো না হলে আমার মাথা ঝিমঝিম করে। অফিসে বসে ঘুম পায়। ঢুলতে থাকি। সবাই হাসাহাসি করে।
আমির আসল কথাটা বলল না। যেসব রাতে মিলার সাথে ওর তীব্র ভালোবাসার ব্যাপারটা ঘটে, কেমন যেন ক্লান্ত মনে হয় খুব। মনে হয়, সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। নিজেকে অসমর্থ পুরুষ মনে হতে থাকে। তাই অপরাধবোধে মিলার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আগে মিলাও এত বেশি আগ্রহী ছিলো না এই ব্যাপারগুলোতে, ইদানিং যেন আমিরই ওর সাথে পেরে ওঠে না!
মিলা তখনও ফুঁসছে। দাঁতে দাঁত কেটে বলল,
— আসল কথা বলো, আমার মোহ কেটে গেছে এখন। ওই নাদিয়ার সাথে শুয়ে এসে আর আমাকে ছুঁয়ে দেখার এনার্জি থাকে না!
কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। আয়েশা হওয়ার আগে মিলার প্রতি ভালোবাসা তীব্র হয়েছিল আমিরের। পিতৃত্ব টগবগ করে ফুটছিল। মিলার প্রতিটা খুঁটিনাটি যত্ন করেছে খুব মমতায়। আয়েশার জন্মের পরেও কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছে, রাত জেগেছে, মিলাকে ঘুমাতে দিয়ে। কিন্তু মা হওয়ার পরে আয়েশার যত্ন নিতে গিয়ে মিলা যেন ক্রমশ দূরে সরে গিয়েছে। কিছুটা মিলার ব্যস্ততায়, কিছুটা আমিরের অনিচ্ছায় – দুজনের দাম্পত্যের মাঝে যে খালি জায়গাটা তৈরি হয়েছে, সেটাতে নাদিয়া নামটা ঢুকে পড়েছে। নাদিয়া, আমিরের সাবঅর্ডিনেন্ট কলিগ। নতুন রিক্রুইটমেন্ট। কিছু না বুঝলেই দৌঁড়ে আসে, আহ্লাদি গলায় টেনে টেনে বলে,
—- আমিইইইর ভাই, প্লিজ এই কোটেশনটা একটু বুঝিয়ে দেন তো?
কিংবা
—- আমিইইইর ভাই, গাড্ডায় আছি, মার্জিনটা বলবেন?
— ও আমিইইইর ভাই, ব্রেক ইভেন পয়েন্টটা কি ধরতে পেরেছি?
এমনভাবে আমিইইইর ভাই বলে ডাকে মেয়েটা, অনেকক্ষন নাদিয়ার গলার আওয়াজ না শুনলে আমিরের ভালো লাগে না, কাজ করতে পারে না শান্তিতে। আর বারবার মনে হতে থাকে, কখন নাদিয়া ডাকবে!
আমির চমকে উঠল মিলার কথায়। নিজের মনের কথাটা তো ও নিজেকেই বলে না, খুব সাবধানতা অবলম্বন করে যেন ওর চোখেও মিলা কিছু দেখতে না পায়, তবে মিলা কীভাবে জানল?
এমন কিছু তো হয়নি নাদিয়া আর ওর মাঝে? না এতকিছু হয়নি, যা হয়েছিল, খুবই সামান্য। মাসখানেক আগে, আয়েশা আর মিলাকে নিয়ে ভাওয়াল ঘুরতে গিয়েছিল, তিনদিনের ট্যুরে। চার দিনের অদেখায় হয়তো সেদিন বেশ আবেগি হয়ে পড়েছিল। আর নাদিয়া খুব সুন্দর করে শাড়ি পরেছিল, কপালে শিশির বিন্দুর মতো টিপ, আর হাত ভরা রিনিকঝিনিক চুড়ি। আমিরের প্রাইভেট কেবিনে ফাইলটা দেখাতে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে এসেছিল নাদিয়া আর ওর খোলা চুলগুলো আমিরকে এলোমেলো করে দিলো। কী শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধোয় মেয়েটা? আমির উঠে দাঁড়িয়ে, সন্তর্পনে চুলগুলো গুঁজে দিয়েছিল নাদিয়ার কানের পাশে। নাদিয়া একটু বিব্রত হয়ে লাজুক তাকিয়েছিল। সেই চোখে যেন ভাওয়াল রাজবাড়ির পদ্মদীঘিটা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল আমির আর ওতে ডুব দেওয়ার তীব্র আকর্ষণে নাদিয়ার হালকা গোলাপরঙা ঠোঁট দুটোতে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়েছিল। মুহূর্ত কয়েক, আমির জানে না, আজও ভাবলে রোমাঞ্চিত হয় শরীরের প্রতিটি রোমকূপ। নাদিয়াও সেই রোমাঞ্চে সাড়া দিয়েছিল। সমানতালে চুম্বনে ভরিয়ে দিয়েছিল আমিরকেও। ওইটুকুই তো শুধু। তারপরে আর এমন কিছু হয়নি।
এখন চোখে চোখ পড়লে নাদিয়া হেসে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমির হয়তো একটা টেক্সট দেয়। বৃষ্টিতে জুটি বেঁধে অল্পবয়সী ছোকরাছুকরির মতো রিকশায় করে ভিজেছিল একদিন আর প্রতিদিন উবারে নাদিয়াকে লিফট দেয় আমির। উবার ড্রাইভারের চোখ বাঁচিয়ে একটু হাতের উপর হাত রাখা নইলে হাতটা গালে ছুঁইয়ে দেয়া, খুব আলতো শরীরে ছোঁয়া বা হালকা চুমু। ব্যস এইটুকুই তো! বাস ছেড়ে উবারে একটু বেশি টাকা খরচ হয়, তাছাড়া আর তো কিছু না। মিলা কীভাবে জানল? মিলাকে কে বলল? সেদিন রেস্টুরেন্টে কেউ কি দেখেছিল? বা যেদিন যমুনা ফিউচার পার্কে শপিংয়ে গেল? নাদিয়া একটা হিরের আংটি পছন্দ করেছিল, একটু দামি আমিরের পকেটের তুলনায়, তবুও আমির ক্রেডিট কার্ডে কিনে দিয়েছিল ওকে তেষট্টি হাজার টাকা দিয়ে। মিলা কি কোনোভাবে জেনে গেছে? নাহ। মিলা তো আমিরের টাকাপয়সার কোনো খোঁজই কোনোকালে রাখেনি।
তবে কি নাদিয়াই বলে দিলো ওকে? কেন কিছু বলবে নাদিয়া? ও তো সব জেনেই আমিরের সাথে জড়িয়েছে। সেদিন ওর জন্য যে এক রুমের ফ্ল্যাটটা দেখতে গিয়েছিল, কেয়ারটেকার ফ্ল্যাটটা দেখিয়ে বের হতে হতে সেকেন্ড দশেক সময়ে ও হুট করে আমিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিল
—- সবটুকু সময় মিলা আপার, আমাকে শুধু প্রতিদিন অফিসফেরত দুটো ঘন্টা দিও?
আরেকটা সংসারের খরচ সামলানো একটু কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে এই কথাটা ঠিক, কিন্তু আমিরের বেতনও তো বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, সেই খবর তো মিলা জানে না। তবে নাদিয়ার কথা হুট করে কীভাবে বলল? এত সতর্ক থাকে আমির! ফোন করাও বারণ নাদিয়ার। আর নাদিয়া তো খুবই বাধ্য, আমিরের। আমিরের পছন্দ, অপছন্দ সবকিছুতেই কত গুরুত্ব দেয়। মাঝে মাঝে আমিরের মনে হয় ওই জীবনটা একবার বেঁচে দেখতে নিজের মতো করে, সমাজের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে। মিলাকে যেমন বিতৃষ্ণা লাগে তেমনি আকর্ষণ করে নাদিয়ার ছোপানো দীঘল চুলের রাশি, পেলব ঠোঁট আর কোমল শরীর। তবুও আমির সাহস করে ওঠে না, শারীরিক সম্পর্কে বড্ড ক্লান্তি আসে। নিজের পৌরুষত্বের দুর্বলতা নাদিয়াকে জানতে দিতে ইচ্ছে করে না। অনেক চেষ্টায় নাদিয়ার শরীরের আকর্ষণ ও মনের ভেতর কবর দিয়ে রাখে।
আয়েশা ঘুমের ঘোরে কেঁদে উঠল। মিলা ওকে কোলে টেনে নিলো। আমিরের ঘুম উড়ে গেছে। ও চোখ বুজে পড়ে আছে। ভাবতে চেষ্টা করছে কখন, কীভাবে মিলা জেনেছে? কতটুকু জেনেছে? অনিচ্ছাকৃত সঙ্গমে মিলার আলিঙ্গনে ও নাদিয়াকে ভেবে সুখ পায়, তখন কি কখনো নাদিয়ার নাম ধরে ডেকেছে? ভয়ংকর ভাবনা। আমিরের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়!
আয়েশা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। ঠান্ডা আবহাওয়াতে মেয়েটা অনেকক্ষণ ঘুমায়। মিলা এসে আমিরের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো,
—- এই অফিস যাবে না? ওঠো!
একটু আগের আলোচনার কোনো প্রভাবই নেই ওর ভেতর। আমির চিন্তিত হলো, এই একটু আগে ওসব কথা কি মিলা সত্যিই বলেছে নাকি সবটাই আমিরের আধো ঘুমে দেখা স্বপ্ন? আশ্চর্য, স্বপ্ন কখনো এতটা বাস্তব হয়? এমনকি মিলার স্পর্শও এখনো গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে মনে হচ্ছে, গলার কাছটায় বিষাক্ত কিছু দংশন করে গেছে এমন লাগছে।
মিলা ধাক্কা দিলো আবার।
—- কী? অফিস যাবে না?
—- হ্যাঁ।
— আজ তাড়াতাড়ি ফিরো তো?
— কেন?
— এমনি।
— আচ্ছা, লাঞ্চ করব একসাথে।
—- সত্যি? আমি কিন্তু এমনিতেই বলেছিলাম?
— না সত্যি।
আমির নিজেই জানে না, কেন এমন বলল ও। অফিস থেকে আগে আসার কোনো কারণ নেই ওর। কাজের চাপও এখন বেশি আর ছুটির পরে নাদিয়ার সাথে সময় কাটাতে সারাদিন উন্মুখ হয়ে থাকে। লাঞ্চে চলে আসলে সেসব কিছুও হবে না!
—- তাহলে কী খেতে চাও লাঞ্চে?
মিলারও আগ্রহ নেই অতটা। এই বৃষ্টির দিনে স্পেশাল কোনো আয়োজনের ইচ্ছেই করছে না। আমির না থাকলে ও লাঞ্চে একটা ডিম ভেজে বা ভাতগুলো তেল-পিঁয়াজ দিয়ে ভেজে চালিয়ে দেয়। কোনো কোনোদিন আগের রাতের লেফটওভার দিয়েই দিন পার করে। রাতে আমির খুব বেশি কিছু খায় না। দুটো-একটা পদ রান্না করে। তাই ঝঞ্জাট নেই। এখন দুপুরের খাবার রান্না করতে গেলে আয়েশাকে নিয়ে ওর একশো একটা ঝক্কি। মেয়েটা হয়েছেও তেমন – একটু রেস্ট দেয় না। এক মিনিট রেখে কোথাও যাওয়া যায় না। প্যা প্যা করতেই থাকে। ওয়াশরুমে গেলেও কাঁদবে। এমনকি ঘুমালেও মিলার একটা হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমাতে হবে। মাথাটা সরিয়ে বালিশে দিলেই দুনিয়া মাথায় নিয়ে কাঁদবে। খাওয়াতে গেলেও এই মেয়ে দুনিয়ার জ্বালাতন করে। একঘন্টা বসে থেকে যা গেলাবে তা একবারে বমি করে সবটা উঠিয়ে দেবে! নিজের আঙুল নিজেই গলায় ঢুকিয়ে দিয়ে বমি করবে। সেসব পরিস্কার করতেও মিলার আরেকদিন যায়। ছুটা বুয়া আসে, দিনে একবার – সে ও সপ্তাহে দুইদিন কোনো খবর না দিয়েই উধাও হয়ে থাকে। রান্না করতে হবে এই চিন্তায় ও মেজাজ হারাতে শুরু করে।
*****
দুপুরের রান্না শেষ করে গোসল সেরে বের হতে হতে মিলার চারটে বেজে যায়। বুয়ার কাছে আয়েশাকে রেখে গোসলে ঢুকেছিল। পাঁচ মিনিটে গোসল সেরে আসে সাধারণত, আজ হয়তো একটু বেশি সময় লেগে গেছে। কত আর বেশি, হয়তো মিনিট পনেরো। মাথায় শ্যাম্পু করল আর শরীরটা একটু রগড়ে নিলো। আয়নায় নিজেকে দেখতে নিজেরই খারাপ লাগে এখন। বেঢপ মোটা, মুখে মাংস লেগেছে, স্বল্প ঘুমে চোখের নিচটা ফোলা, চুল আঁচড়াতে মনে থাকে না, লোশন টোশন ক্রিম ডলার সময় নেই – ইচ্ছেও নেই। আয়শাকে ব্রেস্টফিডিং করানোতে শরীরে আঁশটে গন্ধ লেগে থাকে। সেই কতদিন আগের মিলাকে কল্পনা করে স্বপ্ন মনে হয় আজকের আয়েশার মা মিলার। ফেসিয়াল আর ফেসপ্যাকের দরুণ ধাঁধা লেগে যাওয়া সুন্দর মুখ, হেয়ারপ্যাকে উজ্জ্বল চুল, পেডিকিওর, মেনিকিওর করা চকচকে হাত, পা। নাইট ক্রিম, ডে ক্রিম, সানক্রিম, হ্যান্ডক্রিম, ফুট ক্রিম – কত কী! এখন আয়েশার বডি লোশনের বোতলটা থেকে দুফোঁটা গায়ে ডলে সেই হাতটাই মুখে ডলে নেয়। আয়েশার জন্মের আগের সেই দুরন্ত, চৌকস, মেধাবী, দারুণ পরিশ্রম করা এক্টিভ চাকুরে মিলাকে খুব মিস করতে থাকে ও। অসহায় লাগে ওর। অসহ্য মনে হয় চারিপাশটা!
*****
— মা হইলে খাওন কী আর ঘুমান কী? মা হইলো জননী। এত্তটাইম গুসলে থাকলে বাচ্চার ঠান্ডা লাগি যাইব।
বের হতে হতে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল বুয়া।
আমির আসেনি লাঞ্চে। সময় পায়নি। মিলা ক্ষেপে গেছে। খাসীর মাংস আর খিচুড়ি করেছে, ইলিশ মাছ ভেজেছে, ধনেপাতার চাটনি, সরিষা ভর্তা আর আচার। – আমিরের চাহিদামতো। এখন একা একা খেতে বসে ওর রুচি চলে গেল। কয়েকটাদিন কী যেন হয়েছে। খাবারে একেবারেই রুচি নেই। আয়েশার দুধের কষ্ট হবে বলে খুব অরুচি নিয়েই খাবারে পেটটা ভরায় ও। আমির বলে দিয়েছে, দুই বছর বুকের দুধ দিতেই হবে। তড়িঘড়ি করে কোনোরকমে গিলে নিয়ে খাবার খেতে চেষ্টা করছিল, আয়েশার কান্না শুনে খাবার বিনে ফেলে, প্লেট গুছিয়ে সিংকে ঢেলে, হাত ধুয়ে নিলো ও। আজ আর খাবেই না।
মিলা ঢুকতেই আয়েশা তাকালো। কান্না থেমে গেলো। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। ঢুলুঢুলু কান্নাভেজা চোখে ও মিলার দিকে তাকিয়ে চারদাঁত মেলে মিষ্টি হাসল। বৃষ্টি শেষে রোদ ওঠায়, গরম পড়েছে বলে শুধু ডায়াপার পরিয়েই ওকে শুইয়ে দিয়েছিল মিলা। আয়েশার উদোম গায়ের দিকে তাকিয়ে মিলার সারা শরীর ঝাড়া দিয়ে অন্যরকম অনুভূতি হলো। আয়েশা নয়, ও যেন বিছানায় একটা সাতকেজি ওজনের নধর, গোলগাল, পাকা রুইমাছ দেখতে পাচ্ছে। জ্যান্ত মাছটা। লেজে বাড়ি দিয়ে পেটে হাঁটছে। সেদিকে তাকিয়ে লোভে মিলার লোল পড়তে থাকল। সমস্ত রুচি আর প্রচন্ড খিধে একসাথে ফিরে এসেছে যেন। কচি হাড়ে কামড় দেওয়ার মতো উত্তেজনায় দাঁত কিটকিট করছে ওর – নিজেকে বাধা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকল মিলা কিন্তু অন্য কোনো এক মিলা দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকল আয়েশার দিকে আর আয়েশাও দুহাত বাড়িয়ে উঠে বসেছে….
চলবে…
ডাইনি – ১ (রিপোস্ট)
আফসানা আশা