ডাইনি – ৪

0
633

ডাইনি – ৪

শেষপর্ব

ভাওয়াল রাজবাড়ির সামনে বিশাল পদ্মপুকুর। পদ্ম ফুঁটে আছে। বর্ষার পানি পেয়ে সবার সব পাঁপড়ি খুলে গেছে। প্রতিভার ইচ্ছে করছে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরে ওই পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে।

সমীর আর স্বর্ণ মহাবিরক্ত। রিতাও। কেমন বেড়াতে আসা এটা? এই বৃষ্টি হচ্ছে সারাদিন তো বৃষ্টি কেটে তীব্র গরম। কটেজেই দিন কাটছে, রাত নামছে।

সুন্দর ছিমছাম দোতলা রিসোর্ট। বড়ো বড়ো দরজা আর জানালাগুলো সব স্বচ্ছ কাচের। উপর থেকেই পদ্মপুকুরটা স্পষ্ট দেখা যায়, আর কী যে আনন্দ হয় প্রতিভার!

রিসোর্টের কাছেই একটা প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ, একেবারে দীঘির উল্টোদিকটাতে। মন্দিরের সিঁড়িটা নেমে এসেছে একেবারে দীঘির জলের ভেতর। মন্দিরটা প্রাচ্যের ঢঙে বানানো না, অনেকটা প্রাচীন গ্রীসের ঢঙে। বড়ো বড়ো আর অনেক উঁচু উঁচু থাম, যার উপরের দিকটা তুলনামূলক চওড়া। আর সাদা রঙের চুনপাথরের কাজ পুরো স্থাপনাজুড়ে। দূর থেকে শ্বেতকায় মনে হয়, এই জরাজীর্ণ ভগ্নদশাতেও। গ্রীকরা মন্দির বলে না, ওদের কাছে এই মন্দিরগুলো দেবতাদের ডোয়েলিং। ওরা বিশ্বাস করে দেবতারা বাস করে ওখানে। নিশ্চয়ই কখনো ভিনদেশি কেউ এসেছিল এই ভাওয়াল রাজবাড়িতে আর তার আরাধ্য কোনো দেবতা অথবা দেবীর পূজা করত ওখানে। মন্দিরটা দেখে বারবার মিলার কথা মনে পড়ে যায় প্রতিভার। ডাইনি মেডিয়াও তখন উঁকি দিয়ে যায় কল্পনায়।

মন্দিরটার স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে পানিতে পদ্মপাতার ফাঁক দিয়ে।

পুকুরে টপটপ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। কেঁপে উঠছে পানির উপরটা। প্রতিভা সেদিকে তাকিয়ে উচাটন হলেন। লাগেজ খুলে শাড়ি পরলেন বড়ো যত্ন করে। কপালে টিপ আঁকলেন, সিঁদুর ছোঁয়ালেন সমীরের নামের, চুলের খোঁপা খুলে দিলেন। সমীর বিরক্ত হলেন প্রতিভাকে এই সাজে দেখে,

—- তুমি বুঝি এখন জলকেলি করতে বেরুলে? তোমার ছেলে সামলাবে কে? রিতাকে কি মেইড পেয়েছ? সংসার কী করো কিছু? বাচ্চাকাচ্চা পর্যন্ত আরেকজন পালছে!

প্রতিভার চোখে জল এলো। একবার সমীর তাকাতে পারত গভীর চোখ চেয়ে। বলতে তো পারত,

—- পপি, সেই আগের মতো দেখাচ্ছে তোমায়!

আদর করে সমীর পপি ডাকে না, কতদিন!

অভিমান ভুলে নিজেই সমীরকে জড়িয়ে ধরলেন প্রতিভা। কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে মলিন হওয়া সম্পর্কে আদরের পরশ বোলাতে। কিন্তু সমীর একেবারে ছিটকে গেলেন। ভয় পেলেন যেন, কেউ দেখে ফেললেই বিপদ! বিশ্রী করে বললেন,

—- আহ, কী করছ। বাচ্চাকাচ্চা আছে। রিতা আছে। কাজের লোকে ঘরভর্তি।

প্রতিভা খুব লজ্জিত হলেন। আস্তে করে বললেন,

—- দেখলে কী? আমরা স্বামী-স্ত্রী সমীর। আর নতুন বর-বউও না।

— আহ। স্বামী-স্ত্রী বলেই কি দিনেদুপুরে বেহায়াপনা করতে হবে নাকি? রাখঢাকও তো চাই। কেউ দেখে ফেললে কী ভাবত!

অত্যন্ত ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিভার চোখে জল এলো, গলা বুজে আসতে থাকল। চোখ ছাপিয়ে পড়তে যাওয়া জলটুকু লুকিয়ে নিলেন প্রতিভা সাথে সাথেই। সমীরের কথা পাত্তা দিলেন না। আজ নিজের মনের ডাক শুনতে ইচ্ছে করছে। টুপটুপটুপ জলের ডাক!

দীঘির পানিতে পা দিতেই শরীর শিরশিরিয়ে উঠল প্রতিভার। কী ঠান্ডা পানি! পা দোলাতে থাকলেন। একটা ধাঁধাঁর জবাব মিলে গেল ওর। সেদিনের পর থেকে মিলার ব্যাপারটা অনেক ভেবেছেন তিনি। যুক্তিবাদি মানুষ হয়ে চট করে মেডিয়া, মিলার রথে করে হারিয়ে যাওয়াটা বিশ্বাস করাটা হাস্যকর মনে হয় তার কাছে। তারপর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন নিজে নিজেই।

একজন কেমিস্ট হিসেবে যেকোনো দুষ্প্রাপ্য বা নিষিদ্ধ ড্রাগস জোগাড় করা, সেগুলো ব্যবহার করে কোনো মারাত্মক ওষুধ তৈরি করাও মিলার জন্য খুব সহজ ছিল। সেই ড্রাগই মিলা হয়তো আমীরের উপর প্রয়োগ করেছে আর আমীরের কাছ থেকেই ছড়িয়েছে নাদিয়া নামক মেয়েটির শরীরে। বিভ্রম তৈরি হয়েছে তাদের মস্তিষ্কে আর একজন আরেকজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। স্বামীর পরকিয়ার বিচার সে নিজেই করেছে, দুজন ব্যাভিচারিকেই দিয়েছে কঠিনতম শাস্তি, পুরো করেছে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা। হয়তো মেডিয়ার মিথটা কিছুটা প্রভাবিত করেছে মিলাকে। সে নিজেই হয়ে উঠেছে মেডিয়া। ডুয়েল পারসোনালিটি ক্যারি করে গেছে। কখনো সে মায়াবতী মিলা, কখনো রক্তপিপাসু মায়াবিনী মেডিয়া! সেই ড্রাগের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়তো মিলার মাঝেও বিকৃতি ঘটিয়েছে। তাই নিজেই কামড়ে জখম করেছে নিজের সন্তান আয়শাকে!

তারপর থাকল প্রতিভার নিজের ব্যাপার। প্রতিভার উপরেও হয়তো কোনো মাদকের ব্যবহার করে গেছে মিলা। সেই যে বেলী ফুলের ঘ্রাণ! সেই ঘ্রাণেই কি মিশেছিল কিছু, যা সাইকিয়াট্রিস্ট প্রতিভা সান্যালের মস্তিষ্ক উত্তেজিত করে তুলেছিল আর কল্পনা করিয়ে নিয়েছিল মিথলজিক্যাল মেডিয়ার গল্প!

রতনের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে কোনো একসময় তার গাড়িতে আয়েশাকে রেখে যাওয়া আর ড্রাগসের প্রভাব মিলেমিশে তৈরি হয়েছিল এক সিনেমাটিক হ্যালুসিনেশন! মিলার খোঁজ নিতে হবে, ঢাকায় ফিরেই, মনে মনেই ভেবে রেখেছেন প্রতিভা।

তাহলে কেন এসেছিল মিলা ওর কাছে?

আয়েশাকে নিরাপদে মিলার বাবার বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে দিতে? শুধুমাত্র এই ছিল কারণ! সে তো অন্য কোনোভাবেও করাতে পারত এই কাজটা, অন্য অনেকের মাধ্যমে। মায়াবী ডাইনি মেডিয়া চরিত্রকে যে ত্রানকর্ত্রী বানিয়েছে তার জন্য তো অসম্ভব হতো না কিছুই! মানসিক রোগের সুস্থতাও তো মিলার চাহিদা ছিল না। তবে প্রতিভাকে কেন বেছে নিয়েছিল সে!

কেন এসেছিল মিলা প্রতিভার কাছে, আজ সেই উত্তরটা পেয়ে গেলেন প্রতিভা।

দীঘির জলের দিকে তাকিয়েও পেছনটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তিনি। একেবারে স্পষ্ট। কটেজের স্বচ্ছ জানালার কাচ ভেদ করে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছেন দৃশ্যটা। শাড়ি পরেছে আজ রিতাও। ওর ফর্সা, মেদহীন, চকচকে, অনাবৃত কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনেছে সমীর। প্রতিভার সমীর! রিতার অভিমানী গাল চুম্বনে লাল করে দিয়ে বলছে,

—- আর কটাদিন সহ্য করো প্লিজ। ফ্ল্যাটের ইন্সটলমেন্টটা শেষ হয়ে গেলেই আমি প্রতিভার সাথে সব শেষ করে দেবো!

প্রতিভার পেছনে এই ঘটনা প্রায়ই ঘটে। প্রায়ই বিকেলে বাড়ি আসে সমীর আর রিতাকে নিয়ে দরজা দেয় ঘরের। স্বর্ণ বলেছে অনেকবার প্রতিভাকে। ছোটোমানুষ, ঠিকঠাক বলতে, বোঝাতে পারেনি। অথবা বুঝতে চাননি প্রতিভা। আজ সব যেন বুঝে গেলেন তিনি। একেবারে ফকফকা!

ইশ, বৃষ্টির ছাঁটে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে প্রতিভার! ঈষদুষ্ণ পানীয়র পেয়ালা হাতে। তবে চা বা কফি নয়, অন্য কোনো তরলের তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হলো ওর! ঘন, টকটকে, টাটকা, লাল তরল! মানুষের ধমনী কেটে প্রবাহিত হওয়া তীব্র স্রোতের রক্ত হলে মন্দ হতো না!

হাসি পেলো প্রতিভার। ঠোঁটজুড়ে প্রাচিন মায়াকলা জানা ডাইনির লিপ্সা!

আর মাথার ভেতর বৃষ্টির টাপুরটুপুর কোরাস করে চলেছে ‘ চয়েস ইজ ইয়োরস, চয়েস ইজ ইয়োরস, চয়েস ইজ….’

সমাপ্ত

আফসানা আশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here