বিষ_করেছি_পান(৪৭)

0
577

#বিষ_করেছি_পান(৪৭)

(কপি করা নিষেধ)
বাঁধনের চোখ দুটো জ্বলছে। মরিচের ছোঁয়া লাগেনি। আগুনের আঁচ ও লাগেনি। সচ্ছ চোখ জোড়া একফোঁটাও জল ফেলেনি। তবুও কেনো যে জ্বলছে… কারণ থাকলেও জ্বলার কারণ নেই। তবুও জ্বলছে। বাঁধনের একপাশে বসে আছে তার মা আরেকপাশে বসে তার বাবা। ঠিক ছোট্ট বেলা যেমন বসত। জজের কথায় চোখ তুলে বাঁধন। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দৃশ্যমান হয় সুমির মুখটা। হুইলচেয়ার বসে আছে শূণ্য দৃষ্টিতে। কোন মায়ামনীই এখন এই মেয়েটাকে দেখলে চোখের জল ছেড়ে দিবে। ইমোশন আটকে রাখতে পারবেনা। আলতো হাতে বাঁধনের মুখটা ঘুরিয়ে সামনে করে দেয়। এই হাতের মালিক ঝিমা। তার ছোট্ট বোন। বাঁধনের আজ নিজেকে বড্ড অমানবিক মনে হচ্ছে।একটা মেয়েকে বিয়ে করলো। তার দায়িত্ব নিলো। যেই মেয়েটা পা হাড়ালো সেই ছুড়ে ফেলে দিলো! বাঁধনের যদি একই অবস্থা হতো তাহলে কি সুমির মতোই তাকে ছুড়ে ফেলা হতো? কাবিনের টাকা উসুল করে যত ই দেক,এটা কি ছুড়ে ফেলা নয়? বাঁধনের ধৈর্য্য ক্ষমতা কমে আসছে। বার বার মনে হচ্ছে সে কোন অপরাধ করছে। এতো লোকের ভিড়ে দম হারিয়ে ফেলছে। একটু ফাঁকে হুইল চেয়ারে বসা মেয়েটা তাকে নিচু মানুষ হিসেবে প্রমাণ করেছে। বাঁধন উঠতে গিয়েও উঠতে পারছেনা। ছটফট করে যাচ্ছে। হটাৎ ঘাড়ে ঠান্ডা ছোঁয়ায় শান্ত হয়ে বসে। হাতটা শার্টের কলার গড়িয়ে ভেতরে কাঁধ ছুইয়েছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে গলার নরম জায়গাটার উপর এসে থেমেছে। কানে ফিসফিস শুনতে পায়,
— নিয়তি আগে থেকেই লিখে রাখা হয়েছে। এতে তোমার কোন হাত নেই বাঁধন ভাই। যা হচ্ছে তাই হবে। মনকে শান্ত করো। আমি আছি তোমার পাশে।
হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলে বাঁধন সরাতে দেয়না। নিজ গলায় চেপে রাখে যতক্ষন না সাইনের জন্য পেপারস এগিয়ে দেওয়া হয়। বাঁধন একবারো সুমির দিকে তাকায় না। সেই শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেই আর সইটা করার ক্ষমতা পাবেনা। ঝটপট সইটা করে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে। ফের চেপে ধরে ছুটির হাত। বাকিটা সময় ওভাবেই বসে থাকে। মেশিনে টাকা গুণা হচ্ছে। গুনে গুনে দশলাখ টাকা বীণার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই দশলাখ টাকা কম পরিশ্রমে ঘরে আসেনি। ফাও ফাও একটা মেয়েকে দিতে হচ্ছে বলে বীনার বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে । তাড়াতাড়ি এখান থেকে যেতে হবে। ফর্মালিটিজ ফুলফিল করে বাঁধনকে নিয়ে উঠে পড়ে। কোর্ট থেকে বাইরে এসে মুখোমুখি হয় সুমির পরিবারের। সুমির মা এগিয়ে এসে বলে,
— মাফ করে দিবেন আপা। বিয়েটা নিয়ে অনেক সমস্যার মুখে আমাদের প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে হয়েছে ।
বীণা জোর পূর্বক হেসে বলে,
— এতো টাকা ডাললাম তবুও তো আপনার অবাধ্য মেয়ের পা দুটো ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। আমার কপালটাই খারাপ আপা। তা না হলে স্বামী সন্তানের রক্ত পানি করা টাকা গুলো এভাবে হাইজ্যাকার নিয়ে যায়?
সুমি জোর গলায় বলে,
— মা উনাদের টাকা গুলো ফিরিয়ে দাও। আমার কোন টাকা চায়না।
বীণা সুমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
— রাগ করোনা মা। তোমাকে তো আমিই পছন্দ করে বউমা করেছিলাম! ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। মধ্যবিত্ত মানুষ আমরা তাই বলে তোমার হক তো মেরে খাবো না।
বীণা চলে যায়। সুমির চোখ গড়িয়ে জল পড়ে। ছুটি সুমির চোখ মুছে দিয়ে বলে,
— নিবে না কেনো আপু? তোমার যা প্রাপ্য তা এক কড়িও ছাড়বেনা। যতদিন তোমার হাতে টাকা গুলো থাকবে ততোদিন দেখবে তোমার প্রয়োজনীয় সব তুমি পাচ্ছ। ভালোভাবে বেঁচে আছো। ভুলেও টাকাগুলো হাতছাড়া করবে না।

সুমি মুচকি হাসে বাঁধনের দিকে তাকিয়ে। বাঁধন নিশ্চুপ,নিরুত্তাপ।
— দোষী তুমি নও বাঁধন। শান্ত হও। আমার জন্য চিন্তা করোনা। আমি ভালো থাকবো। দোয়া করি তুমিও ভালো থাকো। আমার খুব ভালো লাগছে এটা দেখে যে তুমি তোমার ভরসার হাত পেয়ে গেছো। এই হাত কখনোই ছেড়োনা।
বাঁধনের হাতের মুঠোয় ছুটির হাত এখনো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। সেদিকেই নজর সুমির। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই সাপোর্ট টুকু বাঁধন কে কতোটা স্বস্তি দিয়েছে সুমি খুব ভালোভাবেই দেখেছে। বাঁধন ছুটির দিকে একবার দেখলো। আরেকবার দুটো হাতে মিলিত স্থানে নজর বুলালো। ছুটির দৃষ্টিও সেদিকে। বাঁধন হাত ছাড়লোনা। সুমিকে কিছু বললোও না। উপর নিচ মাথা ঝুমিয়ে ছুটিকে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে প্রস্থান করলো।

বাঁধনের বাড়িতে সুনশান নিরবতা পালন হচ্ছে। এই নিরবতা একদিনো টিকলো না। হটাৎ ই আমেজে পূর্ণ হলো। ঝিমা বললো বাড়িতে নাকি মেহমান আসবে। শুক্রবারের দিন মেহমান আসতেই পারে ভেবে বাঁধন মাথা ঘামালো না। নিচতলা থেকে পোলাও এর দারুন স্মেল আসছে। কিছুক্ষণ পর রোস্টের স্মেলটাও মিশেল পাওয়া যায়। ক্ষীরের স্মেলটা নাকে লাগতেই বাঁধন জোরে শ্বাস টানে। মন মেজাজ কোনোটাই ভালো না। কে আসবে বাঁধন জানেনা। উঠেও দেখার চেষ্টা করলোনা।ওভাবেই মরার মতো পড়ে রইলো।

আধঘন্টা পরে বীনা এসে বাঁধনের কাঁধ ঝাকাচ্ছে।
— এই বাঁধন! উঠ বাবা। উঠ। মেহমান এসেছে তোর সাথে দেখা করতে চাইছে। উঠ বাবা।
— কে এসেছে মা?
— তোর বাবার একটা বন্ধু আছেনা? ঐযে ছাদে মাল ছাড়া। চুল নেই আর। ওর শালীর পরিবার।উঠ বাবা। তাড়াতাড়ি আয়।
— উনারা কেনো এসেছেন?
প্রশ্নটা করে বাঁধন আর উত্তর পেলো না। তার আগেই বীনা রুম থেকে প্রস্থান করেছেন।

ড্রয়িংরুমে এলাহি কান্ড। ছয়জন এসেছেন। বাঁধন গিয়ে পাশে দাড়াতেই বীনা বলে — আমার ছেলে বাঁধন।
বাঁধনকে মহিলা পুরুষ সবাই মিলে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে। ভাবগতিতে বাঁধন যা বোঝার বুঝে নেয়। বাকিটাও পরিষ্কার হয় যখন সর্বো বয়স্ক একজন বলে,
— ছেলে মেয়ে দুজনকেই মানাবে। লেনদেনের বিষয়টা তবে ক্লিয়ার করে নেই কি বলুন বেয়াই সাহেব?
বাঁধন তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞাস করে,– এসব কি বাবা?
বীণা ইশারা দিয়ে বলে,– চুপ।ঘরে যাও।
— মা?
— তোমার সাথে পরে কথা বলছি। লোকজনের সামনে মাথা হেড করোনা আমাদের।
দশভরি গহনা নগদ বিশলক্ষ টাকা। এতোটাকা কেনো যৌতুক দিতে চাইছেন উনারা? মেয়ে নাকি বোঝা দূর করতে চাইছেন? আর মা বাবা যৌতুক নিচ্ছেন? এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে কিসের? ভদ্রলোকদের সামনে কিছু বলতেও পারছেনা। রাগে ফুস ফুস করছে। হন হন করে কিছু না বলেই প্রস্থান করে। সিঁড়িতে ছুটির সাথে ক্রস হয়। হাতে খালি জগ নিয়ে পানি নিতে এসেছে। আগামীকাল একটা পরিক্ষা আছে। বেচারা পড়তে পড়তে কোমড় লেগে গেছে। একহাতে কোমড় চেপে ধরেই সিড়ি বেয়ে নামছে। সারাবছর না পড়লে যা হয় আরকি। ভেবেই বাঁধন আবার উপরে উঠতে থাকে। দু পা এগিয়ে আবার তাঁকে থামতে হয় ভদ্রমহিলার কথাতে। ছুটিকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— আপা আপনার মেয়ে? মাশাআল্লাহ পুতুলের মতো সুন্দর। এতো সুন্দর মেয়ে আত্ত্বীয়ের মাঝেই থাকতে আমারা কিনা এদিক ওদিক খুঁজে মরছি?
বীণা হেসে বলে,
— আমার মেয়ে না আপা। তবে আমার মেয়ের থেকে কম না। আমার বান্ধুবী রুম্পার মেয়ে। ঝিমার সাথেই পড়ে। এখানে থেকেই পরিক্ষা দিচ্ছে।
— নাম কি তোমার মা?
— ছুটি।
— ভালো নাম কি?
— বলবোনা।
ছুটির ত্যাড়া উত্তর। বীণা চোখ মুখ দেখেই বুঝে গেছে ছুটির রাগ।এই মেয়ে ‘ ক’ বলতেই ‘ কলা একটি মিষ্টি ফল’ পুরোটাই বুঝে যায়। খুবই চালাক! ছুটিকে বলে,
— যাও পানি নিয়ে যাও। বই রিভাইস শেষ?
ছুটি মাথা নাড়ায়। না শেষ হয়নি। মহিলা বলে,
— আরে পড়বে ক্ষন। একটু দাঁড়াক না। এই ছবি তুলে নাও তো একটা। তোমার ছেলেকে দেখাবো। বিয়ের জন্য যদি এবার না বলে আমার নাম পাল্টে রেখো।

বাঁধনের এবার আর সহ্য হয়না। ধুপ ধাপ করে নিচে নেমে আসে। ছুটিকে ধমকে বলে,
— পড়া নেই? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিস এখানে? যা এখান থেকে।
ছুটি সাথে সাথে দৌড় দেয়। বাঁধনের বিনয়ের সাথে বলে,
— বেয়াদবি নিবেন না আন্টি। ছুটি এখনো ছোট। মাত্র এস এস সি দিচ্ছে। ওর বিয়ে হতে হতে আরো ছয় সাত বছর পর। গার্ডিয়ান ছাড়া ছবি নেওয়া আমার মনে হয়না ঠিক হবে।
— কি বলো বাবা! ছোট! আজকালকার মেয়েরা বারো তেরোতেই বাইরে নজর চলে যায়। প্রেম ভালোবাসা করে ঘর ছাড়ে। বাবা মা ছাড়ে। এতো বড় মেয়ে কিভাবে ছোট হয়?
— আপনার মেয়েও সেরকম কিছু করেছিলো বুঝি? সেজন্য ই এতো যৌতুক!
মহিলার মুখটা থমথমে হয়ে যায়। বাঁধন ফিচেল হাসে।
— গায়ে গতরে বড় হলেই হয়না আন্টি। পরিপূর্ণ বয়সটাও হতে হয়। বিয়ে সংসার বোঝার মতো মানসিকতা ও থাকতে হয়। দেশে আইন টাইন ও কিছু আছে ভুলে যাবেন না।
বলেই বাঁধন বেড়িয়ে যায়।

সন্ধ্যায় বীণা বাঁধনকে বলতে এলে এলে বাঁধন প্রচুর রিয়েক্ট করে বসে।
— পেয়েছোটাকি? একবার এভাবে ধুপ দাপ বিয়ে করিয়ে তোমার শখ মেটেনি? ডিভোর্স হতে না হতেই আবার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছো? তাও আবার একটা ক্যারেক্টারলেস মেয়ের সাথে। সেই মেয়েটাও বোধ হয় বয়স হয়নি। কেনো করছো এসব যৌতুকের লোভে?
— কিসের যৌতুক?মেয়ে বিয়ে দিবে কিছু পাঠাবেনা সাথে?এমনিতেই শুধু শুধু দশলাখ টাকা খুইয়ে গেছে আমার সেদিকে তোমার হুস আছে? ডিভোর্স হয়ে গেছে ঝামেলা শেষ এবার তাড়াতাড়ি বিয়ে করো। নাতির মুখ দেখাও আমাকে।ছোট সময় ওসব ভুল একটু আধটু হয়েই থাকে। আর এই মেয়ের এখন উনিশ বছর কোন সমস্যা হবে বলে আমার মনে হয়না।
— মা তুমি আর কথাই বলোনা। ছুটিটা কেও ছাড়লেনা। তুমি কি ছুটির গার্ডিয়ান? ওর বিয়ের কথা তুমি কিভাবে আলাপ করতে পারো?
— আমার কথা রুম্পা কোনদিন ফেলবেনা।
— পরের মেয়ের চিন্তা না করে নিজের মেয়ের চিন্তা করো। পারলে তোমার মেয়ের বিয়ে দাও। ছুটির থেকে বয়সেও বড়,বোঝদার ও বেশী।
ঝিমা বলে,
— আমাকে নিয়ে কেনো পড়লে তুমি ভাইয়া?
— মার পাগলামো তে সায় দিচ্ছিস কেনো?
— আমি কি বলবো? তোমার এতো লাগছে কেনো ভাইয়া? আজ হোক কাল হোক বিয়েতো তোমার হবেই। ফুল পাত্রী পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। এতো রিয়েক্ট করছো কেনো? নাকি ছুটিকে নিয়ে মায়ের ব্যাপারটা সহ্য করতে পারছোনা?
আসল জায়গায় হাত দিয়ে দিয়েছে ঝিমা। বাঁধন কিছু না বলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ফোন আর ওয়ালেট নিয়ে বাড়ি ছাড়ে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here