রোদেলা,পর্ব: ৫৩

0
641

#রোদেলা,পর্ব: ৫৩
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

গত কয়েকদিন ধরেই বৃষ্টি পরছে অবিরাম ভাবে। মনে হচ্ছে আকাশের গায়ে হয়তো ফুটো হয়ে গেছে, তাই এই বৃষ্টির থামাথামি নাই। ধুমধাম বৃষ্টি না টিপ-টিপ বৃষ্টি যাকে বলে ইলশে-গুঁড়ি। মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়াও বইছে, আবার শান্ত ভঙ্গিতে পরছে। ক্যালেন্ডারের হিসেবে এখন যদিও শরৎ কাল তবুও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ নাকি এই বৃষ্টির কারন। চলবে আরো কয়েকদিন । আবহাওয়া অফিস উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের আশংকা করছে। বর্ষাকলটা এবার কেটেছে কটকটে রোদের পাহারায়। বৃষ্টি তখন না বর্ষিত হয়ে বাকীর খাতায় যে হিসেব রেখেছিলো, তা শোধ দিতেই যেন এত তাড়াহুড়ো এই অসময়ে।

কৃষ্ণচূড়া বাড়িটার ঢালু ছাদ থেকে সব বৃষ্টির পানি পরছে বিশাল কাঁঠাল গাছটার গায়ে, টুপটাপ করে এক পাতা থেকে আরেক পাতায় পানি গড়িয়ে পরছে। যেন পাতাদের দলগত কাজ এটি, উপরের পানিকে অনেক যত্নে গড়িয়ে দিচ্ছে নিচ অবধি। খুবই সুন্দর দৃশ্য, দেখলেও চোখ যেন শান্তি পায়।

কিন্তু বড় মামী তার ঘরের লম্বা জানালার জং ধরা গ্রীল ধরে বাইরে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। খেয়াল করলে হয়তো তিনি দেখতেন সাদ রঙের শিউলি ফুল সবুজ ঘাসে পরে কি সুন্দর মিলেমিশে রয়েছে।
আর আজকের আকাশটা…..
কাঁঠাল গাছ থাকায় আকাশটা তিনি চাইলেও দেখতে পারবেন না। আজকের আকাশের এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে হলে যেতে হবে ছাদে। সেখানে গেলে দেখা যাবে কালো মেঘেরা কি সুন্দর ছুটাছুটি করছে পুরো আকাশময়…..
যেন তাদের কত তাড়া,
একটু ও ফুরসত নেই….

এত সুন্দর এই দৃশ্য দেখবার যেন কেও নেই…
ঠিক এই মুহূর্তে বাইরে বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাসের শব্দে মতোয়ারা তবুও এই কৃষ্ণচূড়া বাড়িটা যেন থুম ধরে আছে। যেন পৃথিবীর সাথে তার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।

বড় মামা গত কয়েকটা দিন যে কি অসহনীয় কষ্টের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন তা না দেখে বোঝা যাবে না। বড় মামা অসীম ধৈর্যের মানুষ। তার এই আসুখটার পুরো যাত্রায় তিনি একটা বারও কাওকে বলেন নি তার কষ্টের কথা, যন্ত্রনার কথা, কিন্তু শেষের কয়েকদিন ধরে তিনি যে এত কষ্ট পেতেন যে সবাইকে বলতেন- তোরা দোয়া কর আমার মৃ*ত্যু যেন দ্রুত হয়, এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না। য*ন্ত্র*ণা*য় কুঁকড়ে কেমন যেন সেন্সলেস হয়ে যেতেন। এমন কষ্ট যা চোখে দেখা যায় না। সত্যি সবাই নামাজে দোয়া করতো তার মৃ*ত্যু কামনা করে। তাতে যদি তার কষ্টটা কমে।

আজ সকালে….
ঘুম থেকে উঠে তিনি স্পষ্ট করে কথা বললেন মামীর সাথে, অনেক আবোলতাবোল বলে হঠাৎ তার রুগ্ন হাতটা বাড়িয়ে তার হাতের উপর রেখে ক্ষমা চাইলেন তার করা অন্যায়ের জন্য। মামী ব্যাস্ত ভঙ্গিতে প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছেন, আলতো হাতে হাতটাকে জড়িয়ে রেখেছেন পরম মমতায়।
বড় মামা হয়তো টের পেয়েছিলেন তার মৃ*ত্যু নিকটে, তাই হয়তো…..

এসব শুনে নাসিমা যখন এলো ভাইয়ের কাছে, ভাই তাকে দেখে হেসেছিলো, হাসলে মানুষকে সুন্দর দেখায়, অন্যের ভিতরে একটা অন্যরকম অনুভূতির আদানপ্রদান হয়।
অথচ তার হাসি নাসিমার মনে এক ভয়ের নির্মান করে। ইশারায় কাছে ডেকে বলে- বোনরে আমাকে ক্ষমা করে দিস, আমি ম*রে যাচ্ছি, তোকেও মে*রে যাচ্ছি। তুই পথে বসে যাবি, আমি যাবার পর হয়তো ছোট এ বাড়িটা দখল করে নিবে। আমার এমন কোন ইচ্ছে ছিলো না। তুই আমাকে ক্ষমা করিস বোন।

নাসিমা কিছুই বলে না মুখে, ভাইয়ের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়, তার ধারণা এতে হয়তো ভাইয়ের কিছুটা আরাম হবে। দুনিয়ার হিসাবে ওর এখন মন নেই, ও চেষ্টা করছে ভাইয়ের কষ্ট কমিয়ে দিতে। বার কয়েক আয়াতুল কুরসি পরে ফুঁ দিলো গায়ে, বললো ভাই চুপ করেন তো।

তিনি মলিন একটা হাসি দিলেন। বড় ভাই ছিলেন সুদর্শন, স্বাস্থবান পুরুষ। কিন্তু এখন তিনি এইটুকুন হয়ে গেছেন। শরীরের চামড়া যেন হাড়ের সাথে আটকে গেছে। এই রোগটা তার সুন্দর হাসিটাও কেঁড়ে নিয়েছে। আরো কত কি কেড়ে নিয়েছে এই পরিবারের তার হিসেব করতে কেটে যাবে অনেক সময়।

ঝড়ো বাতাস বাড়ার কারনে জানালার কপাট আটকাতে নেন বড় মামী, বৃষ্টির ছাঁটে জানালায় থাকা পাতলা আকাশী পর্দা ভিজে যাচ্ছে। বড়মামা নিষেধ করলেন তা আটকাতে।
মামী ফিরে এলেন সেটা খোলা রেখেই। পর্দাটা সরিয়ে দিলেন দুইপাশে। যেন বিছানায় শুয়েই আকাশ দেখতে পান। সাদা শ্বেত পাথরের মেঝেতে বৃষ্টির বিন্দু গুলো যেন আল্পনা তৈরী করছে। একটু পর বড় মামী গেলেন রান্নাঘরে, খিচুড়ি রান্না হবে আজ। এটা বৃষ্টি বিলাসের খিচুড়ি না। ঘরের বাজার ফুরিয়েছে ঘরে থাকা অবশিষ্ট ডাল, চাল, আর বাগানের কুমড়া দিয়ে খিচুড়ি রান্না হবে। সুফিয়ান হিসেব করে নিজ থেকেই বাজার পাঠিয়ে দেয়, গত কয়েকদিন বৃষ্টির কারনে হয়তো পাঠাতে ভুলে গেছে…..
যদিও বারবার বলেছেন কোন দরকার হলে যেন ওকে ফোন দেয়া হয়। কিন্তু নাসিমা কখনোই ওর কাছে সাহায্য চেয়ে ফোন দেয় না। না বলতেই যে সব বুঝে তাকে কি আর বলা যায়… প্রিসিলার আয় করা টাকাটা বাজারের জন্য খরচ করেন। নাতাশাও চাল, ডাল, শুকনো যা বাজার আছে তা করে দিয়ে যায় যখন আসে। নাতাশার উপর যতটা জোর আছে, ততটা তো আর সুফিয়ানের কাছে নেই। তবুও অনেক করছে ছেলেটা এ পরিবারের জন্য। বড় মামাকে হসপিটালে আনা নেয়া, কোথাও কোন দরকার হলে এসে পরে। টুকটাক কাজের জন্য একটা ছেলে ঠিক করে দিয়ে ছিলেন। তিনি সেই ছেলেটাকে বিদায় করে দিয়েছেন। সুফিয়ানের মতো ভরসা কাওকে হয় না তাই।

এই সুফিয়ান ছেলেটাকে ধরি বাজ ভাবতো নাসিমা।
সেই রাত…
ঐ যে নোভেলকে আটকে রাখার মিথ্যা ঘটনা সাজিয়েছিলো নোভেল নিজেই, সেই রাত …!?
তার পর থেকে সুফিয়ান যেন এদের একজন হতে সদা সচেষ্ট। যুবতী মেয়ে ঘরে থাকলে অনেক ছেলেরাই মেয়েদের মা এর সাথে আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করেন। সুফিয়ানের দৃষ্টিতে রোদেলার প্রতি কোন দূর্বলাতা না দেখলেও তিনি তা আন্দাজ করেছিলেন ঠিকই….

সুফিয়ান বুদ্ধিমান ছেলে। ও যাই করে কঠিন হিসেব করেই করে। নাসিমা তাই ভেবেছিলো। কিন্তু যাকে নিয়ে সুফিয়ানকে ধরি বাজ ভবতো নাসিমা সেই রোদেলাই নেই মাস ছয়েক হতে চললো, তবুও সুফিয়ান কিন্তু এখনো রয়েছে তাদের পাশে, ছায়ার মতো।

এই বাড়ি ছাড়বার সময় সব জিনিসপত্র ওর ছেলেপেলেরাই মহোৎসবে নিয়ে গেলো, বাড়ি খুঁজে দেয়া, মালপত্র পৌঁছে দেয়া, সব করে দিলো চোখের পলকেই। তারপর যা কিছু ঘটেছে তাদের জীবণে সেখানে সুফিয়ান নামটা কিভাবে কিভাবে যেন জুড়ে যাচ্ছিল। ছেলেটার এমন ভালোবাসায় নাসিমা সব হারিয়েও যেন কিছু পেলো। নাসিমা বর্তমানে এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যে ওর থেকে পাওয়া সাহায্য গ্রহণ করা ভুল না ঠিক তা ভাবার কোন অবকাশ তার নেই। মেয়েদের মাথার উপর একটা বটগাছ থাকতে হয়। হয় স্বামী, ভাই, কিংবা ছেলের….
সুফিয়ান যেন তাদের জনয় সেই বটগাছ….
নাসিমার এক ছেলে যেন ও ।

নিঃস্বার্থ এমন ভালোবাসা ঠিক ভুলের হিসেব করে হারাতে চান না নাসিমা, শুধু চান সুফিয়ান থাকুক মাথার উপর ছায়া হয়ে….

খিঁচুড়ি রান্না হয়েছে, খাওয়ার আয়োজন করতেই বড় মামী টেবিলের সামনে গেলেন। নাসিমা ভাইয়ের জন্য খিচুড়ি আনতে গেলেন। তিমি জানালেনএখন খাবেন না, একটু পরে খাবেন।

তারা টেবিলে বসে খাচ্ছে, খাওয়া শেষ করে নাসিমা ভাইয়ের মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। গতরাতে তার ঘুম হয় নি, ঝিমুনি আসছে তাই, তাকে ঝিমুতে দেখে বড় মামা বললেন রাতে তোর ঘুম হয় নি, যা ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে নে একটু। বড় মামী পাশে এসে বসায় তিনি উঠে নিজের ঘরে গেলেন। হাতে কোন কাজ নেই, খিচুড়ি যা রান্না হয়েছে রাত পর্যন্ত চলবে। তাই কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পরলেন তিনি।

বড় মামীও শুয়ে পরলেন তার স্বামীর পাশেই। একটু তন্দ্রাভাব ও হয়েছে তার। কখন যেন ঘুমিয়ে পরলেন তিনিও। বড় মামা অনেক কষ্টে পাশ ফিরলেন। তাকিয়েই রইলেন তার প্রিয়তমার মুখের দিকে। একটু যেন ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু পাছে ঘুম ভাঙে তাই মুচকি হেসে তাকিয়েই রইলেন।

এই মেয়েটা তার জীবণে এসেছিলো পুতুল খেলার বসয়ে। যদিও তাদের দুজনের বয়সের বিস্তর ফারাক ছিলো। তবুও ভালোবাসার যেন কমতি ছিলো না তাদের মধ্যে। কিন্তু পরিবারের মানুষ যেন তার এই বউ-প্রিতী টাকে ভালো চোখে দেখতেন না। পুরুষ মানুষের আবার এত মেয়ে ঘেঁষা স্বভাব হবে কেন। চাচী, ফুফুদের কথায়, কটাক্ষে এসব ইঙ্গিত পেয়ে তিনি তাদের চোখে ভালো থাকতে কেমন যেন দূরে সরে গেলেন তার স্ত্রীর থেকে। তারপর যেন প্রেমিক স্বামী থেকে পুরুষ হলেন তিনি। পরিবার আর সমাজের কাছে ভালো সাজার এই চেষ্টাটা একসময় তার স্বভাবে গেঁথে গেলো। তিনি হয়ে গেলেন আত্ন-আহংকারী স্বামী, যার পায়ের তলায় তার স্ত্রীর ঠাঁই। কথায় কথায় ধমক তার কোন মতামতকে গুরুত্ব না দেয়া, পরিবারে বোন কিংবা মা কারো সাথেই ঝগড়া কিংবা বিবাদ হলে দোষ যারই হোক ক্ষমা তাকেই চাইতে হবে এটাই যেন অলিখিত বিধান হয়ে যায়। এতদিনে যেন সবার মন জুড়ালো, চোখ জুড়ালো তাদের দুজনের এমন দূরত্বে, ছেলের পৌরুষে।

কিন্তু তিনি জানতেও পারলেন না সবাইকে খুশি করতে গিয়ে তিনি অদৃশ্য ইমারত তৈরী করে ফেললেন দুজনের মাঝখানে। স্ত্রী শুধু রাতেই প্রয়োজন, ছেলেমেয়ে জন্ম দেবার, আর সংসার সামলে রাখার এক মেশিন।

তার চোখের কোণে একবিন্দু পানি চলে আসলো। এ পানির উৎস্য তার অসুখ ঘটিত কোন যন্ত্রণা থেকে না, এর উৎস্য অতীতের করা অন্যায়ের অনুশোচনা বোধ থেকে।

বৃষ্টি এখনো পরছে অবিরত….
রাস্তা জনমানুষ শূন্য। এদিকটায় মানুষের যাতায়াত এমনিতেই কম। বৃষ্টির জন্য যেন তা দেখলেই মনে হবে জনমানবহীন কোন অনাবিষ্কৃত জায়গা এটি, যেখানটায় মানুষের আগমন এখনো ঘটেনি। খোঁজ পায় নি কেও এই সুন্দর ভূমিটার…..

প্রিসিলা সকাল থেকে ল্যাপটপে কাজ করছে, রোদেলার ফ্রিল্যান্সিং এর নোট আর ইউটিউব ঘেঁটে ঘেঁটে কিছু একটা শিখবার চেষ্টা করছে। ভেবেছে কোন একটা কোচিং এ ভর্তি হয়ে যাবে।

ঘড়িতে দুপুর গাড়িয়ে বিকেল হতে চললো, বৃষ্টি তখনো চলমান। বৃষ্টি ওর কাজে যেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কোমড় বেঁধে নামা যাকে বলে। রাস্তায় কিছুক্ষণ পরপর রিকশার টুংটাং শব্দ পৃথিবীর সাথে যেন যোগ ঘটাচ্ছে এ বাড়িটার।

এখন বিকাল সাড়ে তিনটা, কিন্তু বাইরে তাকালে মনে হবে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হবে একটু পরেই। তিনটা মাত্র মেয়ে মানুষ এই পুরো বাড়িটার মধ্যে, একটু আগেও তারা চারজন ছিলো…. কিন্তু বড় মামা একটু আগেই ই*হ*লো*ক ত্যাগ করেছেন বলে তারা চারজন থেকে তিনজন হয়ে গেছে। একেবারে নিভৃতে।

কারো চোখেমুখে কোন আর্তনাদে নেই, কান্না নেই, বড় মামা ম*রে যাওয়ায় যেন সবাই একটু খুশিই মনে মনে। কারন তিনি অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। সবাইকে খবর দেয়া হয়েছে। বৃষ্টি যেন বেড়ে গেলো এর পরপরই। নাতাশা এলো আধঘন্টার মধ্যে। ওর আসার পরই কান্নার রোল পরে গেলো সারা বাড়িটায়। যেন কান্নাট থেমে ছিলো এতক্ষণ ওর আসবারই অপেক্ষায়………..

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here