#রোদোলা লেখাঃ #মাহাবুবা_মিতু পর্ব – ৫৬

0
701

#রোদোলা
লেখাঃ #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব – ৫৬

বাড়ি ফিরে শোভন সোজা চলে যায় গেস্ট রুমে। সেখানে গিয়ে দেখে সারার থাকা জিনিসপত্র কোথাও নেই, টেবিলে থাকা ল্যাপটপ, ওর জামাকাপড়, বইপত্র এমনকি লাগেজটাও… গত তিন তিনটা মাস এই রুমটাতে ব্যাচেলর সংসার পেতেছিলো মেয়েটা । আজ সব গুটিয়ে চলে গেছে।

বিছানায় বসে পরে শোভন, সেখানে হাত বুলিয়ে কিছু একটার অস্তিত্বকে খুঁজতে চেষ্টা করে। জানালর হালকা রঙের পর্দা উড়ছে এলোমেলো বাতাসে, ঝড় হবে কি…., এখন তো ঝড় হওয়ার কথা না, তাহলে…

বারান্দায় চোখ পরতেই লক্ষ করলো কাঠের চেয়ারের এক কোণে ওর একটা ওড়না উড়ছে,। গিয়ে সেটাকে হাতে নেয় শোভন, এত মিহি এই ওড়নাটা যে নিমেষেই পুরোটা হাতের মুঠোয় পুরে নিলো শোভন। এমন ভাবে করলো যেন সারাকেই মুঠোবন্দি করেছে সে। কিছুতেই যেতে দেবে না ও সারাকে। কিন্তু সারা যে চলে গেছে তা যেন ও জেনেও অজানা….

সেখানে দাঁড়িয়েই ঘরের কোণে ড্রেসিং টেবিলে চোখ পরে শোভনের, একটা হাত ঘড়ি পরে আছে, দ্রুত কাছে গিয়ে সেটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আয়নাতে চেয়ে
থাকে। ওড়না হাতে শোভন সারার চেহারাটা মনে করতে চেষ্টা করে। মনের ভিতরে অনেক খুঁজে একটা ছবি ফুটে উঠে শোভনের চোখে- চশমা পরা গোলগাল একটা হাসিখুশি মুখ। সারা বরাবর শান্ত স্বভাবের মেয়ে। একেবারে অন্তর্মুখী স্বভাবের। সে সবকিছু উপেক্ষা করে হঠাৎ এসেছিলো তার জীবণের অংশ হতে। তার এভাবে আসাটা অনেক সাহসিকতার পরিচয়। অনেক পূণ্য করলে জীবণে এমন ভালোবাসা মিলে। কিন্তু শোভন নিজের পিছুটানের জন্য তাকে গ্রহণ করতে পারে নি। ও হচ্ছে এক অভাগা….

বারবার মনে পরে গতরাতের সেই কথা গুলে। খুব রাগ লাগছিলো নিজের উপর। এমন অকৃতজ্ঞ সে…
আয়নায় প্রশ্ন করে নিজেকে নিজে….

সারার প্রতি কি তাহলে অন্যায় করলাম আমি….? মনের ভেতর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন উত্তর পায় না শোভন…

দ্রুত ঘড়িটাকে নিয়ে পকেটে পুরলো ও । তারপর তাকালো এদিক সেদিক… শোভনের এমন ভাব ও যেন খোঁজ করতে এসেছে সারা কি কি ফেলে গেছে ভুল করে…. গোটা মানুষটাই নেই, এসব খোঁজা যে অর্থহীন তা বুঝতে পারছে না ও।

ঘড়িটা পকেটে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে ও । ঘরে এসে ভাবে একবার যাবে কি না ওদের বাড়িতে….
আবার ভাবে না…
ওর বাবা-মা নিশ্চিত ওকে অপমান করে তাড়িয়ে দিবে। এভাবেই কাটে অনেকটা সময়।

এরপর কাপড় ছেড়ে বাথরুমে যায়, ফ্রেশ হয়ে এসে ট্রাউজারের পকেটে ঘড়িটা নিয়ে হাঁটতে বের হয় শোভন…..
বাড়িতে থাকলে মা কথা শুনাবেন।

রাস্তায় বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে ও। মনে তখন নানা দ্বন্দ্ব। সারার চলে যাওয়াটা কষ্ট দিচ্ছে শোভনকে। জীবণটাতে যেন একটা আশ্রয় ছিলো এতদিন। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। একই সাথে সারাকে স্বীকার করার ও উপায় নেই। মানুষ তো কোন ডিভাইস না, যে ফরম্যাট দিলাম সব শেষ হয়ে গেলো। মা গতরাতে বলছি- বাকীটা জীবণ কি একা থাকবি নাকি তুই…..? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নি শোভন, হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে প্রশ্নটা। বাকীটা জীবণ কি একা থাকবো আমি….!?

ঠিক এমন সময় রাস্তার ঠিক বিপরীত ফুটপাতে একটা পরিবার দেখে শোভন, একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে তার বাবার আঙুল ধরে হাঁটছে, হাঁটার মধ্যে কি একটা ভঙ্গি আছে বাচ্চাটার। মাশাল্লাহ…! ওর মা পেছন পেছন আসছে তাদের। নিঃসন্দেহে এটি পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যের একটি…..

হঠাৎ ভেতরটা হাহাকার করে উঠে, এমন একটা পরিবার কি ওর হতে পারতো না….
রোদেলা কেন চলে গেলো….
আমি যে কষ্ট পাচ্ছি তা কি ও দেখছে না…

ফুটপাতের ধরে এগুতেই হঠাৎ খেয়াল করে দেখলো ও যেখানে আছে সারাদের বাড়ি ঠিক তার বিপরীতে, অপলক তাকিয়ে থাকলো প্রাসাদসম দালান বাড়ির তিনতলার একটা ঘরের দিকে। সারার ঘরের আলো বন্ধ। ও কি তাহলে বাড়ি ফিরে নি….

একটা ফোন করে শোভন সারার ফোনে, অনেক চেষ্টা করেও কলটা ঢুকছে না। অন্য একটা সিম দিয়ে আবার চেষ্টা করে শোভন, প্রথম বারেই কল ঢুকে যায়, কিন্তু কেও ফোনটা রিসিভ করে না, আবার চেষ্টা করে শোভন, এবার কল রিসিভ করে সারা,
: হ্যালো….
: সারা, আমি…
তুই কি বাসায় ফিরেছিস….
: হ্যা, এই তো কিছুক্ষণ আগেই,
তার কথা বলায় কোন জড়তা ছিল না, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো কথাগুলো, যেন কিছুই হয় নি…
: আমি তোর বাসার সামনে, তোর বাসায় আসি…
একটু কথা ছিলো…
: না,
: না কেন… প্লিজ…
: শোন একটা হেল্প করবি…
: কি হেল্প বল…
: আমাকে কখনো কল করবি না,

শোভন চুপ হয়ে যায় সারার কথা শুনে…. একটু পর বলে-
: আমি সরি, কালকের ব্যাবহারের জন্য।
: তুই কোন ভুল করিস নি.. তাই সরি বলবার কোন দরকার নেই…
কথাটা বলেই কলটা কেটে দেয় সারা….

তারপর দুটো নম্বর দিয়ে অনেকবার চেষ্টা করেও কল ঢুকলো না ওর ফোনে। হঠাৎ ওর মনে পরে ব্লক লিস্ট নামে একটা অপশন রয়েছে সকল ফোনে। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে পকেটে ঠুকায় ও, একটা কষ্ট যেন পাক খায় ভিতরে।

অনেক রাতে ঘরে ফিরে শোভন, মার মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে, না খেয়েই শুয়ে পরে ঘরের বাতি নিভিয়ে। মাথায় বালিশ নিতেই কেমন অস্বস্তি হয় ওর। এই তো কিছুদিন আগেও সারা ঘুমানোর আগ পর্যন্ত গল্প করতো ওর সাথে।
মনে মনে বলে শোভন- সারা, মিস ইউ…..

ফোনটা সাইড টেবিলে রাখতেই একটা কিছু পরে গেলো মনে হয় ওর… সাইড টেবিলের বাতি জ্বেলে সেটার খোঁজ করতেই খাটের কিনারে একটা ভাঁজ করা কাগজ। সেটাকে তুলতেই হঠাৎ কেমন অস্থিরতা জেঁকে উঠে মনে। ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ে কিছুর জানান দিচ্ছে, না খুলে দেখা পর্যন্ত যেন অস্থিরতা কমবে না।

দ্রুত দাঁড়িয়ে ঘরের আলো জ্বালে ও, সুইচবোর্ডের কাছে দাঁড়িয়েই দেখে কি সেটা, ঝকঝকে হাতের লেখায় ভর্তি একটা সাদা পাতা।

—————–
শোভন,
আমার যাপিত জীবণের সময় বিন্যাস করলে তুই দেখবি ছোট্ট এ জীবণের বেশীরভাগ সময়ই কেটেছে দৌড়ের উপর থেকে। স্কুল, কোচিং, হোম টিউটর, গানের ক্লাস, ছবি আঁকার ক্লাস, কারাতে এসবের একটা চক্রে অনবরত ঘুরতে হয়েছে আমায়। কঠিন শৃঙ্খলে বেড়ে ওঠা আমি অনেক সকালে পড়তে বসার জন্য ঘুম থেকে উঠলেও কোনদিন সূর্য উঠা দেখি নি, অনেক রাত অব্দি পড়া তৈরী করতে গিয়ে কোনদিন খেয়াল হয় নি জোৎস্না রাত বলে অসম্ভব
কিছু একটা রয়েছে এই ছোট্ট পৃথিবীতে। শহরে বেড়ে উঠেছি বলে জানি না নদীর স্রোতে নৌকায় বসলে কেমন লাগে, কিংবা শীতের সকালে শিশির ভেজা ঘাসে খলি পায়ে হাঁটতে কেমন অনুভব হয়।

এই যে প্রকৃতির এত সব রূপ তা আমি জেনেছি শুধু বই পড়ে। এই বইই একমাত্র বিনোদন ছিলো আমার অনেক প্রাচুর্যময় জীবণে। বাবা মা তাদের জীবণে যা কিছু হতে চেয়েও হতে পারে নি অর্থ কিবা সুযোগের জন্য, একমাত্র মেয়ে হয়ে আমাকে তাদের সেই অপূর্ণতা পূরণ করতে হয়েছে মুখ বুজে। আমার বাবা চেয়েছিলেন ডাক্তার হতে, আর্থিক সংকুলান না থাকায় তা পারেন নি, আমার মায়ের নাচ শিখবার শখ ছিলো খুব, রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়ায় তার শখ তিনি পূরণ করতে পারেন নি। মোটের উপর বলতে গেলে আমি হচ্ছি আমার বাবা মায়ের অপূর্ণতা পূরণকারীর আপডেট ভার্সন।

সারাটা জীবন আমাকে সেই জামাটাই পরতে হয়েছে যা আমার মা আমাকে পছন্দ করে দিতেন। সবজায়গা যাওয়া বারন ছিলো কারন বাবা তা পছন্দ করতেন না। আমি স্কুলের প্রতিটি পিকনিকে টাকা জমা দিয়েও যেতে পারতাম না। কারন বাবা মা আমাকে একা ছাড়বে না।

আমি ঠিক আমি হয়ে বাঁচছিলাম না যেন। আমি কি পরবো, কি খাব কোথায় যাবো তার সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি নি কখনোই। তোরা এজন্য আমাকে রাগাতি কোন কিছুর ব্যাপারে মতামত নিতে হলে মজার ছলে বলতি- আরে ওকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই ওর মাকে জিজ্ঞেস কর, হা… হা… হা…

জানিস আমি কোনদিন ডাক্তার হতে চাই নি,
আমি চেয়েছি আট-দশটা ট্রিপিক্যাল মেয়ের মতো সংসারী হতে।

আমাকে সারাজীবন বোঝানো হয়েছে আমি অন্তর্মুখী একজন মানুষ, কিন্তু আমি তা নই….
আমি প্রথম আমাকে আবিষ্কার করি যেদিন প্রথম বার একা বের হয়েছিলাম, জরুরী দরকারে নীলক্ষেত গিয়েছিলাম তখন আমি লাস্ট সেমিস্টারে পড়ি। একদল ছেলে বাজে ভাবে আমার রিকশায় ধাক্কা দিয়েছিলো নীলক্ষেত প্রেট্রল পাম্পের সামনের জ্যামে। আমি রাগ হলেও চুপ ছিলাম। কিন্তু যখন অসভ্যের মতো আমাকে ইঙ্গিত করে বাইকের পিছনে থাকা ছেলেটার সাথে কথা বলছিলো, আমার রক্ত মাথায় উঠে গিয়েছিলো, আমি রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে থাপ্পড় দিয়েছিলাম বাইক চালানো ছেলেটাকে। ছেলেটা অবাক হয়েছিল আমার হঠাৎ এমন আচরণে। হতবাক আমিও কম হইনি, তারপর একটু একটু করে এক্সপ্লোর করি নিজকে। যদিও বাবা মা তখনো কিছু জানতো না।

নতুন করে কিছু জানাতে হয় নি আমাকে, ছোট কাকার বিয়ে খেয়ে ফিরবার সময় আমি যে গাড়িতে ফিরছিলাম সেখনে আমরা পাঁচজন ছিলাম। আমি আমার কাকাতো বোন, কাকাতো ভাই, মেঝো ফুফা আর ড্রাইভার। কুমিল্লায় হঠাৎ একটা ট্রাক মনে হলে আমাদের গাড়িটাকে উড়িয়ে দিয়ে গেলো, হঠাৎ প্রচন্ড আঘাতে আমি জ্ঞান হারালাম। এরপর আমার কিছুই মনে ছিলো না। সেবার আমি মারাত্মক ইনজুর হয়েছিলাম, আমার সাথে থাকা বাকী চারজনই স্পট ডেথ….. এরপর থেকেই বাবা মা আমাকে একটু স্পেস দিতে শুরু করলো। ফলে আমার যে নিজেকে এক্সপ্লোর করার একটা প্রক্রিয়া চলছিলো তা চলতেই থাকলো। বাবা মা ভাবলো মৃত্যুর এত কাছ থেকে ফিরে এসেছি, তাই আমার এমন পরিবর্তন। এরপর আমি আমার নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করা প্রক্রিয়া আরো বেগবান হল যেন। আমি জানতে পারলাম চ্যাঁপা শুঁটকির বাগার দেয়া ভর্তা আমার প্রিয়, যা আমাদের বাড়িতে একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিলো, লতি দিয়ে কুঁচো চিংড়ি আমার ভালো লাগে তাও জানলাম, বড় মাছ সহ আমার ভালো লাগে না আরো অনেক কিছুকে চিনলাম। আমি জানলাম লম্বা কুর্তির চেয়ে কামিজ পরতে আমার বেশী ভালো লাগে, এমন অনেক কিছু জানলাম, নতুন করে চিনলাম নিজেকে।

সেই আমি আমার সযত্ন লালিত চুলগুলো অনায়াসে কেটে ফেললাম রোদেলা হতে, লং শার্ট পরতে শুরু করলাম রোদেলার মতো। সু জুতা আমার দুই চোখের বিষ তাও পরতে শুরু করলাম।

এসব কিন্তু আমার এই প্রক্রিয়ার বিপরীতমুখী কাজকর্ম। তবুও আমি এসব কেন করেছি জানিস, তোর মনে একটু জায়গা পেতে। অনেক কষ্ট হতো তবুও এসব করতাম আর নিজেকে বোঝতাম তুই সুস্থ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

একটা সময় বুঝলাম আসলে আমি ঠিক কাজটি করছি না। নিজের সত্ত্বাকে বদলে ফেলা নিজের সাথে অন্যায় করা। আমার ভীষণ লজ্জা হতে লাগলো কারন- আমি ভুল এই কাজটা নির্ভুলে করে চলেছি দিনের পর দিন। তারপর আর একমুহূর্তের জন্য ও পারলাম না। এসব বাদ দিয়ে আমি সারা হয়ে সামনে আসতাম তোর। সারা….
ডা. মেহ্জাবিন নূর সারা।

তুই প্রচুর ঘুরতে পছন্দ করিস, আমি তোর সাথে দুনিয়া দেখতে চেয়েছিলাম, জোৎস্নারাতে একসাথে ঘাসের উপর শুয়ে থেকে চাঁদ দেখতে চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম তোর জীবণের একটা অংশ হতে। কিন্তু পারলাম না। তোর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র রাগ কিংবা ক্ষোভ নেই, এসব লিখলাম নিজেকে হালকা করতে।
অনেক হালকা লাগছে এখন….

তুই অনেক ভালো থাক শোভন,
রোদেলা সত্যি অনেক ভাগ্যবতী রে…..

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here