#বিষ_করেছি_পান(১৫)
(কপি করা নিষেধ)
সোহাগের হাতের মুঠোয় রিতীর হাত। রিতীর মুখের উপর সোহাগের দৃষ্টি। রিতীর চোখ দুটো ঘাসের দিক নিবদ্ধ। ধৈর্য শক্তি বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। সোহাগ একটু পর পর মুখ দিয়ে বাজে সাউন্ড করছে। রিতীর বিরক্ত লাগছে। ফস করে সোহাগের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়। সোহাগের মুখের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
— সোহাগ ভাই আপনার কি মা বোন নাই?
— মা আছে বোন নাই। আমার রাজ্যে আমিই রাজা।
— আপনি যে শুধু শুধু আমার পিছু লেগেছেন। বিরক্ত করছেন।ঠিক একি কাজ যদি আপনার মায়ের সাথে করা হতো তখন কেমন লাগতো আপনার মার?
— আম্মার ভালোই লাগতো। না হলে কি আর আমার আব্বার সাথে সংসার করতো?
— ওহ! আপনার আব্বাও! তাইতো বলি ডেলিভারি কোই থেকে আসে? সোহাগ ভাই আপনার আম্মার ভালো লাগলেও আমার ভালো লাগেনা। আমি জীবনেও আপনার সাথে সংসার করবো না।
— ঠেকা লাগছে? তোমার সাথে সংসার করার তো আমার ঠেকা লাগছে? বড়লোক বাপের পোলা দেইখা পইটা গেলা? হায়রে মেয়ে মানুষ! সবগুলা শালা এক বিছনের চারা।
রিতীর মুখটা অপমানে লাল হয়ে আসে। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। তেজের সাথে বলে,
— আমি জীবনেও আপনার মুখ দেখতে চাইনা। তার আগে যেনো আল্লাহ আমার চোখ দুটা নিয়ে নেয়। ব্যাগটা তুলে রাস্তার দিকে হাটা দেয়। কি মনে করে দাঁড়িয়ে পরে। আবার ফিরে এসে ঠিক সোহাগের মুখের সামনে মুখ নিয়ে আসে। চোখে চোখ রেখে বলে,
— আপনি অত্যন্ত নোংরা প্রকৃতির একটা মানুষ। লালসা থাকলে লালসা মেটানোর মেয়েও আছে। তাদের কাছে যান। আমার মতো ভালো মেয়েদের উত্ত্যক্ত করবেন না। আমার আপনার এবং আপনার বাবার সম্পত্তির প্রতি ইন্টারেস্টেড নেই। চুপ করে আছি বলে ভাববেন না সবসময় চুপ করেই থাকবো। আপনার রাত দিনের সিডিউল খুব ভালো করেই জানা আছে আমার।
— বাহ খোঁজ খবর ও রাখা হয় বুঝি?
— খোঁজ খবর রাখতে হয়না। পতিতা পল্লীর সামনের রাস্তায় পা পড়লেই দেখা যায় কে ঢুকলো আর কে বেরোলো।
— পিরিতী? তোমার ভয় লাগেনা?
— নাহ।
সোহাগ ফিচলে হাসে। রিতী তৎক্ষনাৎ প্রস্থান করে।
ছাদের সব গাছ এক জায়গায় করা হয়েছে। বড় করে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। হলুদের আয়োজন করা হচ্ছে। মাগবিরের পর পরই ভিডিওগ্ৰাফি শুরু হবে। মেয়েরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌড়াচ্ছে। এ বাড়ি কাজল দিচ্ছে তো ও বাড়ি লিপিস্টিক দিচ্ছে। ছেলেরা লাইটিং এর জন্য ক্যাবল ঠিক করায় লেগে পরেছে। রুম্পা রিতীকে দুইঘন্টার জন্য ছেড়ে দিয়েছে। খাটের উপর শাড়ি ব্লাউজ রাখা আছে। রিতীর কোন হেলদোল নেই। সমস্ত মনখারাপিরা আজ তার মনে আচর কেটেছে। রুম্পা এসে একবার তাড়া দিয়ে গেছে। রিতীর ভালো লাগছে না। কাল শুক্রবার তারপরদিন আবার পরিক্ষা। রিতী জানালা ছেড়ে দাড়ায়। একটা বই নিয়ে খাটে এসে শুয়ে পড়ে। মুখের সামনে বই ধরে পড়ার চেষ্টা করে। পড়তে পারেনা। চোখ বন্ধ করে থাকে। ছুটির ডাকে চোখ মেলে। ছুটি শাড়ি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। রিতীকে বলে
— আপু পড়িয়ে দাও।
রিতী উঠে বসে। শাড়িটা হাতে নেয়। হলুদ জমিনের গোলাপী পাড়ের জামদানি শাড়ি। খুব সুন্দর। রিতী ছুটিকে ইশারা করে বলে,
— তুই আর ঝিমা এই শাড়ি নিয়েছিস বুঝি?
— না। শুধু আমি নিয়েছি। ঝিমা অন্য শাড়ী।
— বাব্বাহ! আলাদা কেনো?
— কারণ আজ ঝিমা আলাদা সাজবে আর আমি আলাদা সাজবো। দুজনের লুক হবে আলাদা আলাদা।
–ওহ। আয় এদিকে আয়।
রিতী ছুটিকে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেয়। ছুটি মেকাপ বক্স এনে ইচ্ছেমতো গালগুলো হালকা পিংকিশ করে নেয়। ঠোটে লাগায় কড়া গোলাপী লিপস্টিক। চুলগুলো ফুলো বেনী করে বাধে। শাড়ি ধরেই এক দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে ফুলের ডালা নিয়ে আসে। গাদা ফুলগুলো রিতীর হাতে ধরিয়ে দেয়।
— বেনীর ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দাও।
লম্বা বেনীটার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ গাঁদা গুঁজে দেয়। গাদার মালা হাতে গলায় এমনভাবে পড়ে যেনো আজ তারই গায়ে হলুদ। রিতী হা করে ছুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথায় হাতে দিয়ে বলে,
— আরেব্বাস!ছুটি? আজ বাঁধন ভাইয়ের গায়ে হলুদ নাকি তোর?
ছুটি মাথা থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
— আমার হতে যাবে কেনো? বাঁধন ভাইয়ের হলুদ। আমি তো হলুদে যাবো জন্য সাজলাম মাত্র!
— এত্তো! এই সত্যি করে বলতো কাকে পাগল করতে যাচ্ছিস?
— আমি এখনো ছোট আপু। আমার এসব কথা শুনতে নাই।
ডালাটা হাতে নিয়ে কোমড় বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে হেঁটে ছুটি চলে যায়। রিতীর মাথা খুলতেই একলাফে শাড়িটা হাতে নিয়ে নেয়। মাথায় একটা কথাই চলছে। ছুটির সাথে থাকতে হবে। মেয়েটাকে আজ তার থেকেও বড় লাগছে।
বাঁধন হলুদ পাঞ্জাবী পড়েছে। তাকে ঘিরে তার বন্ধুরা রয়েছে। একেকজন একেকটা কথা বলছে আর পুরো বন্ধু মহল হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাঁধন সুবোধ বালকের মতো বসে আছে। একটু পর পর মুচকি মুচকি হাসছে। কি সুন্দর লাগছে! ছুটির চোখ যেনো সরেই না। চোখ দুটো নিজের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ দেখা যেনো শেষ দেখা। এরপর আর কোনদিন চোখ মেলে দেখা হবেনা। বন্ধুমহল সরে যেতেই বোনদের দল ঘীরে ধরে বাঁধন কে। ফটোগ্ৰাফি চলছে। বাঁধনের পাশে ঝিমা বসে। ছুটি তারপরেই। দু তিনটা ছবি তোলার পর ই ছুটি ঝিমাকে টেনে তুলে ঝিমার জায়গায় গিয়ে বসে। বাঁধন আর ছুটি পাশাপাশি। হলুদে হলুদ মিলন। ছুটি হাসি হাসি মুখে এপাশ ওপাশ ফিরে সুন্দর সুন্দর পোজ দেয়।এরপর আসে ভাইদের দল। লেবুমামা এসে ঝিমা ছুটি বলে ডাক ছাড়ে। মেয়েদের দল দৌড়ে যায়। নিচ থেকে হলুদ বাটার ট্রে সাথে করে নিয়ে আসে। ভিডিওগ্ৰাফি চালু হয়েছে। এক এক করে সব মেয়েরা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। সুন্দর করে সিনেমাটিক পোজে বাঁধনের পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রথমে মুরুব্বিরা বাঁধনকে হলুদ মাখিয়ে দেয়। তারপর ছেলেমেয়েরা যে যেভাবে পারে এসে বাঁধনকে হলুদ মাখিয়ে দেয়। ছুটি ঝিমা তালে আছে। তারা একসাথে হলুদ মাখাবে। দুজনে চোখে চোখে কথাও বলছে। যেই না দুজনে একসাথে গিয়ে বাঁধনের দুই পাশে বসেছে তখনি ছেলেরা হৈ হৈ করে উঠে। রিতী বলে,
— আরে কি করছিস? একে একে যা।
বাঁধন হাত তুলে রিতীকে থামিয়ে দেয়।
এ ফাঁকে ছুটি ঝিমা দুজনেই হাত ভরে হলুদ মাখিয়ে নেয়। রিতীকে ভেংচি দিয়ে দুজনেই বাঁধনের কানের কাছে মুখ নেয়। কি যেনো কানকথা বলবে এমন ভাব। বাঁধন ও আগ্ৰহী হয়ে আছে। দুজনেই ঠোঁট টিপে একসাথে বলে,
— ভাইয়া অনেক ভালোবাসি।
— আমিও তোদের অনেক ভালোবাসি।
— তাহলে ভালোবাসা নাও।
ঝিমা হলুদ মাখা হাত বাঁধনের সারা মুখে লাগিয়ে দেয় আর ছুটি সরাসরি বাঁধনের বুকে ঢুকিয়ে দেয়। ঠিক যে জায়গায় হার্ট থাকে সে জায়গায় সম্পুর্ন হলুদ মাখিয়ে ঘাড় গলা এক করে দেয় । দুজনের দুষ্টুমিতে হৈ হৈ রব পড়ে। হাসতে হাসতে বড়রা একেকার হয়ে যায়।বন্ধুরা গিয়ে বাঁধনের পাঞ্চাবী খুলে সারা গায়ে হলুদে ভুত বানিয়ে দেয়।
— দোস্ত আজকে তোমাকে পেয়েছি।কোন ছাড়াছাড়ি নেই। হলুদে চুবাবো। আমাদেরই সময়।
বাঁধনের নাজেহাল অবস্থা। চোখে নাকে হলুদ লেগে গেছে। তাতে কারো খেয়াল নেই। একেবারে হলুদে ঢুবিয়েই তাকে গোসল দেওয়ানো হয়।
হলুদ মাখানোতে বাঁধনের স্কিন চকচক করছে। কাচা হলদে রেশ টেনেছে। তাকে কোন রাজ্যের রাজপুত্র লাগছে। ছুটি বাঁধনের ঘরের সামনে দিয়ে ছুটাছুটি করছে। শাড়ি পরেই তাকে এই চেয়ার,মোড়া টানাটানির কাজে নেমে পড়ছে। ঘরের ভেতর থেকে বাঁধনের ডাক পড়ে। ছুটিকে জিজ্ঞেস করে,
— আমার ফোন কোথায় রেখেছে জানিস? পাচ্ছিনাতো।
— কাকীমনির কাছে। আলমারিতে তুলে একেবারে চাবী মেরেছে। নয়তো এতো মানুষ।চুরি হয়ে যাবে।
— ওহ। আচ্ছা। যা।
ছুটি চলে যেতে নেয়। বাঁধন আবার ডাক দেয়।
— শোন। আচ্ছা তোর ফোন হবে?
— আমার যদি ফোন রাখার বয়স হতো তাহলে কি আমি এখানে থাকতাম?
— কোথায় থাকতি?
— থাকতাম কোথাও তবে এখানে থাকতামনা। এভাবে জ্বলতাম ও না।
বাঁধন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পুরোপুরি সন্দেহের দৃষ্টি। আজকাল ছুটি কি করে কোথায় যায় কার সাথে মিশে কার সাথে কথা বলে তা নিয়ে বাঁধন ঘোলাটে অবস্থায় আছে। ঠিক নেই। কিচ্ছু ঠিক নেই। সাতপাঁচ চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বলে,
— আচ্ছা লাগবেনা। ছুটি শোন।তোকে আজ বড় বড় লাগছে। এদিক সেদিক কোথায় যাবিনা। বাড়িতে অনেক ছেলেপুলে আছে। বড় কারো সাথে সাথে থাকবি। ছাদে যাবি আমার চোখের সামনে থাকবি। ঝিমা কোথায়? ঝিমার হাত ছাড়বিনা।
ছাদে একপাশে নাচের জন্য জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে।উচ্চস্বরে গান চলছে। সাজন সাজন গান। ছুটির পছন্দের। সব পছন্দের গান গুলোই ছুটি ঝিমা বক্সে বাজাবে বলে মেমোরীতে লোড করে এনেছে। একে একে সবাই চলে এলে নাচের আসর শুরু হয়। বাঁধনের মামাতো বোনরা অনেক ভালো নাচাতে পারে। তারাই আসর মাতিয়ে তুলছে। কিছুক্ষন পর পর শীষ বেজে উঠছে। গান শেষ হতেই একজোড়ে হাতের তালি দিচ্ছে। ঝিমা ছুটি মলি মিলে দলীয় নৃত্য দিবে। তারা একসাথে উঠে গিয়ে দিললাগাদিয়া গানে নাচতে থাকে। দীর্ঘ চারদিন রিয়ার্সেল করে আজ তাদের পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে। এতো সুন্দর পারফরমেন্স শেষে আবার হাততালি পড়ে। সবটাই ভিডিও করা হয়েছে। বাঁধনের এক বন্ধু খুশি হয়ে তিনজনকে ডাকে। কাছে যেতেই তিনজনের হাতে তিনশ টাকা ধরিয়ে দেয়। ছুটির খুব আফসোস হচ্ছে। সে এতো সুন্দর পারফর্ম করলো অথচ রিতী দেখতে পেলোনা। হলুদ পর্ব শেষে সে বসেছে পড়ার টেবিলে। পরের পরীক্ষার পড়া পড়তে।
ছুটি অনেক ক্ষন থেকে খেয়াল করছে একটা কিউট মিউট ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আছে তো আছেই তার পিছু পিছুও যাচ্ছে।ছুটি মনে মনে প্রমোদ গুনে। ঝিমাকে বলতেই ঝিমা বাঁধনের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে ছেলে মেয়েরা আস্তে আস্তে ফ্লোরে এক হচ্ছে। লাস্ট ফিনিশিং টা একহয়ে পাগলা নাচ নেচেই শেষ হবে। ঝিমার শরীরে ফাল উঠেছে। সে ছুটিকে টানছে। ছুটি নড়ছেনা। ছেলেটা ধীরে ধীরে ছুটির কাছেই আসছে। ছুটি আড়চোখে দেখছে। যেই ছেলেটা ছুটির পাশে এসে দাঁড়াবে সেই ছুটি ছেলেমেয়েদের ভিতরে ঝিমাকে নিয়ে ঢুকে পড়ে। ঝিমা ছুটির হাত ধরে ইচ্ছা মতো গানের তালে লাফাচ্ছে। ছুটিও লাফাচ্ছে। দুজনে ডুয়েট নাচছে। তালে তালে পা নাড়াচ্ছে। ঝিমার শাড়ি প্রায় খুলে গেছে। একটানে শাড়ি ফেলে নিচের স্কাট পড়েই নাচা শুরু করেছে। ছুটিও শাড়ী কোমড়ে গুঁজে ডিজে গানের পাগলা নাচ নাচছে। গাদা ফুলের মালা ফ্লোরে পড়ে পায়ে পায়ে পিষ্টন হচ্ছে। হটাৎ ছুটির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথা শোনে।
— এইযে আপু? শুনছেন? নামটা কি বলা যাবে?
পেছন ঘুরতেই ছেলেটার খোমাটা সামনে পড়তেই ছুটি চিৎকার করে উঠে,
— বাঁধন ভাই……….এই ছেলেটা ফোন নাম্বার চাইছে।
ঘটনা আকষ্মিকে সবাই হতভম্ব। বক্সে গান একটা মাত্র ই শেষ হয়েছে। সেইসুবাদে ত্রিশ সেকেন্ড আওয়াজ বিহীন রয়েছে। তৎক্ষনাৎ ছুটির চিৎকারে বাঁধন দৌড়ে এসেছে। ছেলেটা বাঁধনের বন্ধুর ছোট ভাই লাগে। ছেলেটা ভীষন লজ্জায় পড়ে মুখ ঢেকে ছাদ থেকে দৌড় দিয়েছে।
চলবে,
লাবিবা_তানহা_এলিজা~
ছবিয়াল: তরু