রোদেলা,পর্ব: ৫৫

0
844

#রোদেলা,পর্ব: ৫৫
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে শোভন। অফিসে যাচ্ছে নিয়মিত। গত সপ্তাহ থেকে জিম জয়েন করেছে। মনে একটা স্পিড আনতে। শোভনের বাবা বললো এবার সবাই মিলে দূরে কোথাও থেকে বেরিয়ে আসি চলো। শোভন এসবে পাত্তা দেয় নি। কারন ও জানে এসবে ওর জীবণ স্বাভাবিক হবে না, ও শুধু ব্যাস্ত রাখতে চাচ্ছে নিজেকে। ডুবে থাকতে চাচ্ছে কাজের মধ্যে। বেশ কিছু দিন ধরে রোদেলাকে নিয়ে করা পাগলামিটা বন্ধ হয়েছে ওর। বাস্তব মেনে নিয়েছে, যদিও কষ্ট হয়েছে অনেক। রোদেলা যে নেই, এবং ফিরে আসবে না তা স্পষ্ট এখন ওর কাছে। তাই ওর সামনে এ বিষয়ে কোন কথাই হয় না। যেন রোদেলা নামে কারো অস্তিত্বই ছিলো না কোনদিন।

বিকেলের রোদে গেস্ট রুমের বারান্দায় চুল শুকাতে শুকাতে অনেক কিছু ভাবছে সারা ওর জীবণ সম্পর্কে। এ বাড়িতে ও দুটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলো, এক শোভনকে সুস্থ করতে সাহায্য করা, দুই শোভনের জীবণে জায়গা করে নেয়া।

প্রথম কাজটা ও খুব সুন্দর ভাবেই করতে পেরেছে বলে সবাই মনে করে, আর দ্বিতীয় কাজটা….

অনেক চেষ্টা করেছে সারা শোভনের মনের বাড়িতে একটু জায়গা করে নিতে। জীবণের এ বয়সে এসে একটা মেয়ে এমন ক্রেজি হতে পারে না ভালোবাসার জন্য। এট লিস্ট আমাদের সমাজে এটা ততো টাও প্রচলিত না। কিন্তু সারা লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে সোজা ছেলের বাড়ি এসে উঠেছে। এখানেই শেষ না ওর পাগলামি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে ও নিজেকে বদলে ফেলতে চেয়েছে। নিজের ক্যারিয়ারের প্রতি উদাসীন হয়ে গিয়েছে এই শোভনের ই জন্য।

আর শোভন…..
ওর মা যখন গতরাতে ওকে বিয়ের ব্যাপারে বললো…, শোভন খুব বাজে রিয়্যাক্ট করলো… চিৎকার চেচামেচি শুরু করলো ওর মায়ের সাথে। হঠাৎ রুম থেকে বেরিয়ে গেস্ট রুমে আসে শোভন, ব্যাস্ত ভঙ্গিতে সারার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ওর মায়ের রুমে। ওর মায়ের চোখে তখন আতংক, তিনি তখন থরথর করে কাঁপছিলেন। তার ভয় ছিলো, শোভন না উল্টাপাল্টা কোন কথা বলে ফেলে এ মুহূর্তে। মেজাজ গরম হলে ওর মাথা ঠিক থাকে না।

এ মেয়েটা সব ছেড়ে এখানে এসেছে, ওর জীবণের চরম দুঃসময়ে ওর হাত শক্ত করে ধরেছে। সবটা মনে রাখবার মতো স্থিতি শোভনের তখন ছিলো না, কিন্তু বাড়ির প্রতিটি মানুষ দেখেছ কি করেছে ও শোভনের জন্য। এখন যদি উল্টোপাল্টা কিছু একটা বলে ফেলে।

তার নিচের ঠোঁট মৃদু কাঁপছে তা নজরে পরে সারার, ও বুঝতে পারছিলো না শোভন কেন ওর হাত ধরে টেনে এখানে আনলো, আর শোভনের মায়ের চোখেমুখে আতংক কেন..

শোভন দুম করে বললো-
সারা তুই অনেক করেছিস আমার জন্য, এ ঋণ শোধ করার মতো না। আমার জীবণের চরম দুঃসময়ে তুই আমার পাশে ছিলি, তার জন্য আমি সারা জীবন তোর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। তার জন্য কি তোকে আমার বিয়ে করতে হবে…?!

আমার যখন বাইক এক্সিডেন্টে হলো, আমাদের বুয়ার মেয়ে ঝুমা আমার অনেক সেবা করেছে। এখন কি আমার ওকে ও বিয়ে করা লাগবে….
হাউ লেইম পিপলস ইউ অল আর….

সারা শুধু চেয়ে ছিলো শোভনের দিকে,
কাজের মেয়ে ঝুমা আর সারাকে এক লাইনে দাঁড় করালো শোভন……! ঝুমা আর সারা কি এক হলো……

কিচ্ছু বলে নি ও, শুধু চেয়ে ছিলো শোভনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে। কথা শেষ করে শোভন রাগান্বিত ভঙ্গিতে বাইরে বের হয়ে যায়, সারা যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ওর পৃথিবীটা দুলছে…

এই ভয়টা ওকে প্রতিনিয়ত তাড়া করতো, তাই হলো অবশেষে। ওর মা এই কথাটাই বলছে গত তিনটা মাস ধরে। তিন তিনটা মাস ও কি না করেছে শোভনের জন্য। আর শোভন….. শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেই সব শেষ করে দিলো।

নিজেকে ঘেন্না হতে লাগলো সারার….
এত নীচ লাগছিলো, মনে হচ্ছিল পৃথিবীর বুক থেকে সারা নামের অধ্যায়টা যদি মুছে ফেলা যেতো। কতটা স্বার্থপর সে নিজে, যে বন্ধুর দুঃসময়ে পাশে থেকে তার প্রতিদান হিসেবে তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাচ্ছে…

চোখের কিনারায় একটু পানি জমলো সারার, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় পানি গুলে গড়িয়ে পরি পরি করে পরছে না। অবশেষে সেটা রূপ নিলো কান্নায়, মন খুলে কাঁদল সারা। এতদিন ও যে অনাধিকার চর্চা করেছে তা শোভন গতরাতে বুঝিয়ে দিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে। শোভনকে ও কোন দোষ দেয় না, দোষ ওর নিজের। ও যা করেছে তা ভুল, এর খেসারত শোভন কেন দিবে। তাছাড়া ও তো শোভনকে একটা রক্তমাংসের মানুষ হিসেবেই শুধু চায় নি, চেয়েছে আত্নীক ভাবেও। সেটা বোধহয় সম্ভব না। সম্ভব হলে এতগুলো দিন এত সময় একসাথে থেকেও কেন শোভনের মনের দড়জা ভেদ করতে পারলো না সারা….

———————-
গতরাতের ব্যাবহারটার জন্য অনুতাপে জ্বলছে ও। সারাটা দিন শোভন কোন কাজে মন দিতে পারছে না, দুপুরের পর একটা আউটডোর মিটিং ছিলো, নতুন একটা প্রোডাক্টের মার্কেট রেস্পন্স নিয়ে রিসার্চ টিমের একটা ফলোআপ। আজকের মিটিং এ সিদ্ধান্ত হতো প্রোডাক্টটা মার্কেট বড় আকারে লঞ্চ হবে কি না। খুবই গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিলো এটা। কল্লোল যাবার পর এসব কাজ ওকেই দেখতে হয়। বাবা কিংবা চাচা তারা এলেও শোভন মিটিং টা কেন্সেল করে। এমন মানসিক অবস্থায় এত বড় একটা সিদ্ধান্ত ও নিতে পারবে না তাই ও স্কিপ করে।

বাড়ির সবাই ভাবছে রোদেলাকে ভুলে গিয়েছে শোভন, তাই তড়িঘড়ি করে, কোনমতে বিয়েটা দিয়ে দিতে চাইছে। তারা হয়তো ভাবছে বিয়েটা হলে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আসলেই কি সবকিছু এত সহজ…

কাওকে বোঝাতে পারে না শোভন রোদেলা ঠিক কতটুকু জায়গা জুড়ে আছে এই মনের গহীনটাতে। রোদেলা নেই তাই বলে ভালোবাসা আর ওর জায়গাটা কি নাই হয়ে গেছে…

এত বড় একটা ধাক্কার পর ওকে একটু নিঃশ্বাস নিতে সুযোগ দিচ্ছে না কেও। বিয়ে করিয়ে দেয়া কেই একমাত্র সমাধান ভাবছে তারা। তারা একটা বার বুঝতে চাচ্ছে না ওর মনের অবস্থা।

আর সারা….
যাকে ও ভালো বন্ধু ছাড়া অন্য কিছুই ভাবে না,
সে……

আর নিতে পারে না শোভন, সারা নিঃসন্দেহে খুবই ভালো একটা মেয়ে, ভালো একজন বন্ধু, কিন্তু ওকে কখনো পার্টনার করা সম্ভব না শোভনের পক্ষে। ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হওয়া অব্দি কোন দিনও শোভনের মনে এমন কিছু আসে নি। এমনকি সারার চোখেও ওর প্রতি কোন দূর্বলতা ছিলো না কোন দিন। তাহলে হঠাৎ করে এসবের মানে কি….

শোভন কোন পুতুল নয়, ওরও একটা মন আছে….
তা সবাই কেন বুঝতে পারছে না। সবাই ওর ভালো চায়, কিন্তু ওর ভালো কিসে তা কেও জানতে চাচ্ছে না….

উঁচু দালানের অফিস ঘরেটার কাঁচের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে পেছনের দিনগুলোর কথা ভাবে শোভন,
রোদেলা – মৃ*ত্যু – সারা…..
নাহ….
এসব ভাবতে পারছে না ও….
দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর।

একটা সময় ফোন বেজে উঠে শোভনের। শোভনের মা কান্না জড়িত কন্ঠে বলছেন- সারাকে বাসায় কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি ও ফোনও রিসিভ করছে না…..
মাথায় আকাশ ভেঙে পরে শোভনের, এ আবার কোন নতুন মুসিবত এলো….

গত রাতের অপমানের কথা মনে পরে ওর, এতগুলো কথা না বললেও পারতো…. রাগের মাথায় একটু বেশীই করে ফেলেছিলো ও…..

কোথায় গেলো মেয়েটা….
অনবরত কল করে শোভন, কল হচ্ছে কেও ধরছে না, খুব সম্ভবত ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখা। লিফট ধরে দ্রুত নিচে নেমে গাড়িতে উঠেও কল করতে থাকে শোভন। ফোনটা কানে রেখেই ড্রাইভারকে বলে বাড়ির দিকে যেতে। কল কাটতেই একটা মেসেজ আসে ওর ফোনে-

“আমি আমাকে খুঁজে পেয়েছি শোভন, তাই গাড়িতে করে একটু ঘুরতে বেরিয়েছি অনেকদিন পর। সন্ধ্যে নামার আগেই ফিরবো আমার ঠিকানায়। ভয় পাস না, আজকের পর তুই আর আমাকে দেখবি না কোনদিন, ভালো থাকিস তুই…
আমি এটাই শুধু চাই….
আমার ভালো থাকা নিয়ে ভাবিস না, গত তিনটা মাস যথেষ্ট বাকী জীবণ ভালো থাকার জন্য।
– মেহজাবিন নূর সারা

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here