স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা পর্ব-২৬

0
297

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

পর্ব-২৬

‘ লায়লা আপা ফোন দিয়েছেন। ‘
রান্নাঘরে মামীর কাজে সাহায্য করছিল মুশরাফা, তখনই ফরিদা কথাটা বললেন। মুশরাফা থামকে গেল। তড়িৎ ঘাড় বাকিয়ে তাকাল মামীর দিকে। অস্ফুটস্বরে বলল,
‘মা!’
‘হ্যাঁ। সকালে কল দিল।’
মুশরাফা কাঁপা গলায় বলল, ‘কেমন আছে মা?’

‘ভালো।’

এই মানুষটার কথা কত মনে পড়ে ওর! মন পুড়ে। দেখতে ইচ্ছে করে, কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে সাধ্য কি আর আছে ওর? বিয়ের পর একটা কল দিয়েও খোঁজ নেননি। মুশরাফার হঠাৎ অদম্য আগ্রহ জাগল,
‘ আমাকে একটু দাও, আমি মায়ের সাথে কথা বলব।’

ফরিদা ও কাজ থামিয়ে দিলেন। থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি বলতে পারলেন না, তোর মা একটাবার ও তোর সাথে কথা বলতে চায়নি। তোর মা শুধু সমাজ রক্ষার্থে তোকে একবার ও বাড়ি যেতে বলেছেন। তিনি কথাটা বলতে না পেরে প্রসঙ্গ ঘুরালেন,
‘আপা তোকে বাসায় যেতে বলেছেন।’

কথাটা শুনে মুশরাফা সে কী খুশি হলো। মুখে বিস্ময়ের সাথে খুশিরা তাল মিলাল,
‘সত্যিই! কতদিন মাকে দেখিনা!’

ওর খুশিটা ফরিদার ভালো লাগল না। তিনি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালেন। যে মা ওকে দিনের পর দিনে নির্যাতন করে হাসপাতালমুখী করেছে, সেই মায়ের সাথে দেখা হবে বলে এত খুশি? তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,
‘এতকিছুর পরও তুই ওই মহিলার সামনে যাবি?’

মুশরাফা হাসল। একটা মানুষ যতই ব্যক্তিত্ববান হোক, তার যতই আত্মসম্মানবোধ থাকুক না কেন। একটা মানুষের কাছে এলে তার ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মান কাজ করেনা। সে হলো মা। মায়ের সাথে কখনো সৌজন্যতাবোধ আসেনা। আত্মসম্মান, ব্যক্তিত্ব, সবকিছুর উর্ধ্বে হলো ‘ মা’। মায়ের প্রতি ভালোবাসা সব কিছু ছাড়িয়ে তার কাছে যেতে বাধ্য করে। এই যে মুশরাফার জীবনের বড়ো একটা খারাপ অংশ ওর মা। কত মেরেছে, কত কথা শুনিয়েছে। প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধ মুশরাফার।
ওকে অপছন্দ করা ব্যক্তিদের থেকে দূরেই থাকে সে। কিন্তু এই মানুষটার থেকে চেয়ে ও দূরে থাকতে পারেনি। এখন যখন তাকে দেখার সুযোগ হলো, তখন ওর লোভ হলো। মায়ের আদরের লোভ। ছুটে যেতে ইচ্ছে হলো। মাকে ভীষণ ভালোবাসে। মুশরাফা মৃদুহেসে বলল,

‘যত যাইহোক। উনি আমার মা। আমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, পৃথিবীতে এনেছেন। কত ঋণ। সব ভুলে যেতে পারি না কি! ইসলাম ‘মা’ কে সম্মান করতে বলেছেন। মা যদি অমুসলিম হয়, তবু ও তাকে সম্মান করতে হবে। তিনি যদি ইসলামের বিরুদ্ধচারণ করেন, তবে সম্মানের সাথে তাকে বুঝাতে বলা হয়েছে, বিধানের উপর অবিচল থাকতে বলেছেন। কিন্তু কোনভাবে উনার সাথে বেয়াদবি করতে বলে নি। মা হিসেবে আমি উনাকে সম্মান করি, ভালোবাসি। এই ভালোবাসার টানেই যাব। একজন সন্তান হিসেবে আমার দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে। ‘

থামল মুশরাফা। তারপর ধীর আনন্দের সাথে বলল,

‘আমি উনার সাথে কথা বলে দেখি। উনি বললে যাব ইন শা আল্লাহ।’

ফরিদা রেগে তাকালেন ওর দিকে। বললেন,
‘ যা, এক্ষুনি যা। আমার সাথে কথা বলবিনা। আমার বাসায় আর পা রাখবিনা। ওই বাসাতেই গিয়ে থাক। জামাইকে ও নিয়ে যা। ভাইয়ের হাতে মার খাইয়ে আন। ওর তো শ্বশুরবাড়ির আপ্যায়ন হয়নি। ‘

মুশরাফা হাসল। এই মহিলাটা অকারণেই ওকে ভালোবাসেন। সবার থেকে বেশি ভালোবাসেন ইনিই। নিজের মেয়েদের জন্য ও এত চিন্তা করেন না যতটা মুশরাফার জন্য চিন্তা করেন। মামীর ভালোবাসা মুগ্ধ করে যায় মুশরাফাকে। ও কাজ থামিয়ে মামীর দিকে এগুলো। মামীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ এমন কিছু হবে না। আল্লাহ আছেন না! আমার আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।’

ফরিদা মুশরাফার উপর রেগে থাকতে পারেন না। এবার ও পারলেন না। ওর মিষ্টি কথায় গলে গেলেন। তবুও গম্ভীরতার ভান করে কড়া স্বরে বললেন,
‘এবার যদি তোর গায়ে একটা আঁচ পড়ে আমি তোর মায়ের বিরুদ্ধে কেস করব।’

‘কিছু হবে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।’
মুশরাফা অভয় দিল। ফরিদা আর কিছু বললেন না।

মুশরাফা রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিল। সময় দেখল। বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে। জাওয়াদের এখন অফিসে থাকার কথা। আজ এ বাসায় আসবেন না, আসলে রাতেই কথা বলতো। মুশরাফার তর সইছে না, জাওয়াদ অনুমতি দিলে এখনি চলে যাবে। মুশরাফা কল করল। আজ প্রথমবারেই রিসিভ হলো। মুশরাফা সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম!’

‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কিছু বলবে? ‘

‘মা ফোন দিয়েছিল। ‘
ভণিতা না করে বলে দিল মুশরাফা।

জাওয়াদ অবাক হলো। ও ‘মা’ বলতে মায়মুনাকেই বুঝেছে। মা ওকে চরম অপছন্দ করেন, কল দেয়ার কথা না। কেন কল দিয়েছেন? কৌতুহলী মন প্রশ্ন করল,
‘ কী বললেন ?’

‘বাসায় যেতে বলেছেন।’

‘সকালে তো মায়ের সাথে আমার কথা হলো। তখনো তো মা আমায় কিছু বলল না। হঠাৎ কী হলো?’
জাওয়াদকে চিন্তিত দেখাল। মুশরাফা ওর ভুলটা ধরতে পারল। শোধরাবার চেষ্টা করে বলল,

‘আমি শ্বাশুড়ি মা নয়, আমার মায়ের কথা বলছি।’

‘কার মা!’
জাওয়াদের স্বরে বিস্ময়। মুশরাফা উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘আমার মা। মা আমায় বাসায় যেতে বলছেন। ‘

ওপাশটা নিরবতার চাদরে ঢাকল। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাসের শব্দ এলো কেবল। আর কোন উত্তর এলো না। মুশরাফা আবদারের সুরে বলল,
‘আমি যাই?’

অপাশে তখনো নিরবতা ছেয়ে আছে। এ যাবত শান্ত থাকা স্বরটা হঠাৎ রাগত হয়ে উঠল,
‘যা ইচ্ছে করো। আমাকে বলছো কেন?’

খট করে ফোন কেটে দিল। মুশরাফা ভ্রু কুঁচকাল। হলোটা কী উনার! সে আবার ম্যাসেজ দিল,
‘আমি কি যাব?’

উত্তর এলো না। হয়তো কাজে আটকে গেছেন। ফ্রি হয়ে উত্তর দিবেন। এই আশায় অপেক্ষায় রইল মুশরাফা। মিনিট বিশেক পরেও যখন কোন কল বা ম্যাসেজ এলো না তখন নিজেই কল করল। সাথে সাথেই অপাশ থেকে কেটে দেয়া হলো। মুশরাফা ম্যাসেজ করল,
‘ হ্যাঁ, না একটা তো বলুন।’

খানিক বাদে ম্যাসেজ এলো, ‘ রওনক ভাই বিয়ের উপহার হিসেবে হানিমুন প্যাকেজ দিয়েছেন। হোটেল বুক করে ফেলেছেন। আজ রাতের বাস। আমি যাচ্ছি। আপনার যাওয়ার ইচ্ছে হলে জানাবেন। না হলে আপনার টিকেট ক্যান্সেল করতে হবে।’
রওনক জেরিনের স্বামী।

ম্যাসেজ পড়ে মুশরাফা হতাশ হলো। মা নিজ থেকে ওকে যেতে বলেছে, কোথায় ভেবেছে যাবে, সেই সময়ই দুলাভাইকে টিকেট বুক করতে হলো! আর কটাদিন পরে করলে কী হতো! আর উনি বা রাজি হলেন কিভাবে? অন্যসময় তো ওর সাথে বেরুতেই সমস্যা, ওর বোরকা দেখলে নাক ছিটকান। হঠাৎ কী হলো, ওকে নিয়ে হানিমুনে যাবার জন্য প্রস্তুত। অন্যসময় হলে জাওয়াদের সিদ্ধান্তে খুশি হতো, কিন্তু আজ কেন যেন খুশি হতে পারল না। নিরাশ হয়ে বসে রইল।

রান্না শেষ করে ফরিদা হাসি হাসিমুখে মুশরাফার কাছে এলেন। বললেন,
‘জাওয়াদের সাথে কথা বলেছিস? কী বলল ও?’

মুশরাফা মলিন মুখে ঘুরতে যাবার কথা বলল। ফরিদা চওড়া হাসলেন। তাকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে। তিনি হাসি থামিয়ে মুশরাফার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘মন খারাপ করিস না। আল্লাহ যা করেন বান্দার ভালোর জন্যই করেন। তোদের বাসায় না যাওয়ার মাঝেই বোধহয় তোর মঙ্গল নিহিত আছে। তুই তো সহজে হতাশ হোস না। আজ এই সামান্য ব্যাপারে হতাশ হয়ে গেলি?’

মামীর কথায় হঠাৎ খারাপ লাগা কাজ করল মুশরাফার। ও কেন আল্লাহর সিদ্ধান্তে খুশি থাকছে না। নিরাশ হচ্ছে, আল্লাহ তো বলেছেন, তার রহমত থেকে নিরাশ না হতে। যা হয় সব ভালোর জন্যই হয়। নিশ্চয়ই এতে ও তার জন্য মঙ্গল নিহিত আছে। অপরাধবোধ কাজ করল ওর মাঝে। হতাশা বিলীন হলো ওর চোখ থেকে, বিষন্নতা সরে গেল। ও শান্ত স্বরে বলল,
‘ আমি আল্লাহর উপর ভরসা করি। তিনি ভালো কিছুই করবেন।’

ফরিদা হাসলেন এবার। হেসে বললেন,
‘ বিয়ের পর তো তেমন কিছু কিনলি না। ঘুরতে যাবি নতুন নতুন জামা পরবি। চল শপিংয়ে যাব।’

মুশরাফা বলল, ‘যেগুলো আছে ওগুলো দিয়ে হয়ে যাবে।’

ফরিদা কড়া স্বরে বললেন, ‘ দুপুরের পর বেরুবো আমরা। তোর কোন কথা শুনছিনা।’

শুনলেন ও না। বিকেলে ওকে নিয়ে গেলে শপিংয়ে।
বিয়ের আগে মামী প্রায়ই ওকে এটা ওটা কিনে দিতেন। তখন এতটা অস্বস্তি লাগতো না ওর। এখন যতটা লাগছে। বোধহয় বিয়ের পর বাবার পক্ষ থেকে আগের মতো আর কিছু নেয়া যায় না বলেই। মুশরাফা আজ চুপচাপ রইল। মামী যা কেনার নিজের পছন্দ মতো কিনে দিক।
ফরিদা নিজের পছন্দ মাফিক কুর্তি নিলেন কয়েকটা। কী ভেবে যেন শাড়ি ও নিলেন। তিনি আজ কথায় কথায় হাসছেন। মুশরাফা এই খুশির কারণ জানে না।

শপিং শেষে ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়াল। সারাদিনে জাওয়াদের কোন খবর নেই। মুশরাফা ম্যাসেজ করল,
‘ কয়টায় বেরুবো? আপনি আসবেন আমাকে নিতে? না কি আমি মামার সাথে কাউন্টারে যাব?’

কোন উত্তর এলো না এবার ও। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ নিজে এসে হাজির হলো জাওয়াদ। এসে বসার ঘরে বসল,নাজমুল সাহেবের সাথে গল্প করছে। মুশরাফা নাস্তা নিয়ে গেল। মামার হাতে চায়ের কাপ তুলে দেয়ার পর যখন জাওয়াদের কাপ হাতে নিয়ে ওর সামনে গেল, তখন জাওয়াদ এমনভাবে তাকাল, পারলে চোখ দিয়ে বাষ্প করে দেয়। মুশরাফা অবাক হলো। চা দিয়ে তড়িঘড়ি করে রুমে চলে এলো। জাওয়াদের চোখে নিজের জন্য রাগ দেখেছে ও, লোকটা রেগে আছে কেন? কী করেছে ও? কারণ পর্যবেক্ষণ করতে বসল মুশরাফা। এক পর্যায়ে মাথায় এলো, জাওয়াদ ওর সাথে কোথাও যেতে ইচ্ছুক নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে হানিমুনে যেতে হচ্ছে বলেই হয়তো রেগে আছেন। আর রাগটা ঝাড়ছেন মুশরাফার উপর। তার সন্দেহ শক্তপোক্ত হলো জাওয়াদ রুমে আসার পর।

মুশরাফা ওকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, ‘ কয়টায় বেরুবো আমরা?’
জাওয়াদের হাতে ওর কাপড়ের ব্যাগ ছিল। সেটা শব্দ করে মুশরাফা সামনে মেঝেতে ফেলল। তারপর হনহন করে ওয়াশরুমে চলে গেল। উত্তর দিল না।

মুশরাফার নিজের সন্দেহের উপর অটল রইল। ব্যাগ নামিয়ে কাপড় গুছাতে লাগল।
জাওয়াদ ওয়াশরুম থেকে বের হলে ধীর স্বরে বলল,
‘ আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন? দেখুন, আমি কিন্তু বলিনি হানিমুনে যাবার কথা। আপনিই বলেছেন। আমার সাথে যাবার ইচ্ছে না হলে আপনি ক্যান্সেল করে দিন। আমার জন্য ভালোই হবে। আমি কাল আমার বাসায় যে….

জাওয়াদ তেড়ে এলো ওর দিকে। আক্রোশে ফেটে পড়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আর একটা ও কথা বলবে না তুমি। আধঘন্টা সময় দিলাম, চুপচাপ রেড়ি হয়ে আসো। আমার সাথে কথা বলার ট্রাই করবেনা। এই মুহুর্তে তোমার কথা শুনলেই আমার রাগ হচ্ছে। বেয়াদব মেয়ে!’

জাওয়াদের ধমকে কেঁপে উঠল মুশরাফা। ওর ঠিক অপরাধটা কোথায় সেটাই বুঝতে পারছে না ও। এত অনিচ্ছা হলে একাই যাক, ওকে নিচ্ছে কেন?

জাওয়াদ আবার বসার ঘরে চলে গেছে। মুশরাফা ব্যাগ গুছিয়ে, তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরুলো। ওর চোখ মুখ থমথমে। ওকে দেখে এগিয়ে এলেন ফরিদা। হেসে বলল,
‘সাবধানে থাকিস।’

মুশরাফা মলিন স্বরে বলল, ‘ফি আমানিল্লাহ।’
ওর মুখভঙ্গি দেখে ফরিদা আবার হাসছেন। বিদায় বেলা নাজমুল সাহেব বললেন,
‘ আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো।’
জাওয়াদ কৃত্রিম হাসি দিল, ‘ আচ্ছা।’
ফরিদা হেসে বললেন, ‘সাবধানে থেকো। পৌঁছে ফোন দিও।’

আবার কবে না কবে দেখা হবে এই ভেবে নাজমুল সাহেবের খারাপ লাগছে। কিন্তু ফরিদার লাগছে না। কিন্তু শুধু হাসছেন। দুপুরের পর আসা কল থেকেই তার হাসির উৎপত্তি। তিনি হেসেই চলেছেন।

সিড়ি দিয়ে নিচে নামছে মুশরাফা। ব্যাগটা এমনিতেই ভারি। আজকের করা শপিংয়ের সব কাপড় আরও ভারি করেছে। জিলবাব, ব্যাগ একসাথে সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। জাওয়াদ থমথমে চেহারায় আগে আগে নেমে যাচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে, একটাবার ও পিছু তাকাচ্ছেনা। রাগে ফোঁসফোঁস করছে কেবল। চারতলা থেকে তিনতলা অবধি এসে হাফিয়ে গেল মুশরাফা। আর পারা যাচ্ছেনা। কোমরে হাত দিয়ে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছে। জাওয়াদ নিচে নেমে গেছে। ওকে দেখা যাচ্ছে না। আজ যা রেগে আছে, ওকে সাহায্য করবে বলে ও মনে হয়না। মুশরাফা খানিক জিরিয়ে আবার নামতে ধরল। দুটো সিড়ি বেয়ে নামতেই জাওয়াদ এসে হাজির হলো। ওর দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে ট্রলির হাতলটা ছো মেরে নিয়ে নিল। তারপর নামতে শুরু করল। যেন কেউ ওকে বাধ্য করেছে ব্যাগটা নিতে। কয়েক কদম এগিয়ে বলল,

‘ ব্যাগে মঙ্গল গ্রহ ঢুকিয়ে নিলেও বোধহয় এত ভারি হতো না। নিয়েছে টা কী এখানে আল্লাহ জানে। ‘

জাওয়াদ থেমে থেমে নামল। নিচে নেমে সিএনজি নিল। মুশরাফাও ততক্ষণে নেমে এসেছে। জাওয়াদ চুপচাপ সিএনজিতে বসল। ওকে উঠতে বলল না। মুশরাফা নিজেই উঠল। সারাপথ জাওয়াদ থমকে বসে রইল। কিছু বলল না। মুশরাফাও কিছু বলার সাহস পেল না।

কাউন্টারে বাস দাঁড়ানো ছিল। টিকেট কাটানো থাকায় ওরা গিয়েই উঠে গেল। মুশরাফা চুপচাপ জানালার পাশে গিয়ে বসল। জাওয়াদ বসল না। কোথায় যেন চলে গেল। মিনিট দশেক পরে ফিরে এলো। হাতে একটা কালো পলিথিন। পলিথিন এনে মুশরাফার সামনে সিট পকেটে রাখল, তারপর ধপ করে বসে রইল। মুশরাফা পলিথিনের দিকে চোখ পড়তেই ও অবাক হয়ে তাকাল। জাওয়াদ সিটে হেলান দিয়ে ফোনে কথা বলছে। চোখ বন্ধ ওর। একবারে ধীর স্বরে কথা বলছে। শুনা যাচ্ছে না। অনেকটা ফিসফিস করে,
‘কাজ হয়েছে?’
‘কোনটা? নাম বল?
‘ একাউন্ট চেক কর। আমি পে করেছি। ম্যানেজারকে গাড়ি পাঠাতে বলবি।’
‘ থ্যাংকস ইয়ার। বাঁচালি। প্যারায় পড়ছিলাম।’

মুশরাফা সেদিকে কান পাতল না। কৌতূহল নিয়ে পলিথিন খুলে দেখল। আইসক্রিম, কেক, চিপস, চকলেট সব আরও অনেক রকমের স্ন্যাকস আইটেম। বাসে উঠলে চিপস খাওয়ার অভ্যাস মুশরাফার। নিশ্চয়ই মামা বলেছেন! লোকটা রাগের মাঝেও সব খেয়াল রেখেছে। রাগে কথা বলছে না, তাকাচ্ছে না অথচ খেয়াল রাখতে ও ভুলছে না। মুশরাফা আনমনেই হাসল।

বাস চলতে শুরু করল। মুশরাফা বাহনে চড়ার দোয়া পড়ল,
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। সুবহানাল্লাজি সাখখারালানা হা-যা ওয়া-মা-কুন্না লাহু মুকরিনিন, ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুন কালিবুন।’

অর্থ : আল্লাহর নামে শুরু করছি, যিনি অত্যন্ত দয়ালু ও অশেষ করুণাময়। তিনি পূতপবিত্র ওই সত্তা যিনি বাহনকে আমার অধীন করে দিয়েছেন। আমাদের কাছে তাকে আয়ত্তে আনার ক্ষমতা ছিল না। অবশ্যই আমরা আমাদের প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।

এসি বাস। জানালা বন্ধ। মুশরাফা বন্ধ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। চাঁদনী রাত। রূপালী আলোয় সবুজ শ্যামল গাছগুলো কালচে লাগছে। গাছপালা, খাল বিল, পুকুর দীঘি সব পাশ কাটিয়ে বাস চলছে শাঁ শাঁ করে। কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে পাশ ফিরল। জাওয়াদ তখনো চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কানে ইয়ারফোন, গান শুনছে বোধহয়। মুশরাফা ভ্রু কুঁচকাল। কথা বলার বাহানা খুঁজল, পেয়ে ও গেল।

শাহাদাত আঙুল দিয়ে জাওয়াদের বাহুতে টোকা দিল। জাওয়াদ চোখে মেলে তাকাল। গম্ভীর চোখেই তাকাল ওর দিকে। মুশরাফা ওর কান থেকে একটা ইয়ারফোন খুলে ফিসফিস করে বলল,
‘ লাইটটা অফ করতে বলুন। আমি খাবার খাবো।’

জাওয়াদ সুপারভাইজারকে ডেকে লাইট অফ করে দিতে বলল। আবার কানে ইয়ারফোন গুজে দিল। মুশরাফা মুখ থেকে নিকাব সরাল। আইসক্রিম প্রায় গলে গেছে। একটা আইসক্রিম নিল ও। আইসক্রিমের কামড় বসিয়ে বলল,

‘ আমার সাথে কথা বলছেন না কেন? কী করেছি আমি।’

জাওয়াদ সে কথা শুনল কি না কে জানে? তবে এর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রাগে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। উত্তর দিতে পারল না। উত্তর না পেয়ে মুশরাফা বলল,
‘আচ্ছা, সে নাই বা বললেন। একটু কিছু মুখে নিন। রাতে তো খাওয়া হয়নি।’

জাওয়াদ ভাবভঙ্গিমার পরিবর্তন হলোনা। মুশরাফা একা একাই খাওয়া শেষ করল। ব্যাগ থেকে ফোন আর ইয়ারফোন বের করল। ইয়ারফোন কানেক্ট করে কুরআন তেলাওয়াত চালিয়ে একটা নিজের কানে গুজল। জাওয়াদের কান থেকে একটা ইয়ারফোন খুলে নিজের একটা ইয়ারফোন গুজে দিল। ধীর স্বরে বলল,
‘গান আপনার রাগ বাড়াবে, গুনাহ বাড়াবে। কুরআন তেলাওয়াত আপনার রাগ কমাবে, সাওয়াব বাড়াবে। রেগে চোখ রাঙিয়ে, কথা না বলে রাগ ঝাড়লে সমস্যার সমাধান হবে? হবে না। তারচেয়ে বরং ঠান্ডা মাথায় আমাকে আমার অপরাধটা বলুন। আমি শুধরে নিব। ‘

ইয়ারফোনে কুরআন তেলাওয়াত বেজে উঠল। সুরা ইয়া-সীন তেলাওয়াত হচ্ছে। আল্লাহ সম্পর্কিত ব্যাপার স্যাপার ছেড়ে দেয়া যায় না। জাওয়াদ ইচ্ছাসত্ত্বেও ইয়ারফোনটা খুলে রাখতে পারল না। কুরআন ওকে বশ করে ফেলল। মুশরাফা জাওয়াদের কাধে মাথা রেখে বলল,
‘ একটু স্বাভাবিক হোন। কথা বলুন আমার সাথে। আমি আপনার কথাকে মিস করছি। ‘

জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল, ‘আমার তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বিরক্ত করোনা। সরো।’

‘সরবো, তেলাওয়াতটা শেষ হোক।’ মুশরাফা ঠেসে রইল। সুরা ইয়া-সীন তেলাওয়াত শেষ হলো। তেলাওয়াতের মাঝেই মুশরাফা ঘুমিয়ে গেল। জাওয়াদের রাগ নিয়ন্ত্রণে এলো। তবে মুখে চাপা গম্ভীরতা রয়ে গেল। পুরোপথ কিছু খেল ও না, ঘুমাল ও না। কত কী ছক আঁকল।

পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর হলো। হোটেল বুক থাকায় ঝামেলা হলো না। চাবি নিয়ে রুমে গেল। তখন ফজরের ওয়াক্ত প্রায় শেষের দিকে। মুশরাফা গিয়ে বাইরের কাপড় ছেড়ে অযু করে নামাজে দাঁড়াল। দু’রাকাত পড়ে সালাম ফেরানোর পর দেখল, জায়নামাজ মেলে তার সামনে নামাজে দাঁড়িয়েছে জাওয়াদ। লোকটা পাকাপোক্ত নামাজী হয়ে গেছে, ভেবেই আনন্দ হলো মুশরাফার।

নামাজ পড়ে দুজনেই ঘুমাল ঘন্টা চারেক। উঠার পরেই ঘটল আরেক বিপত্তি। লায়লা আঞ্জুমানের কল এলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here